বিএনপি প্রধান এবং ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ দেশের মানুষের সংখ্যা ১৬ কোটি। যখন তখন যে সে ব্যক্তি যার তার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই মামলা করতে পারেন। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি সম্পূর্ণ আলাদা। এটি করতে গেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা সরকারের অনুমতি নিতে হয়। সরকার অনুমোদন না দিলে সেই মামলা আদালত আমলে নেয় না। একটি মামলা আমলে নিতে গেলে প্রাথমিকভাবে তার কিছু মেরিট থাকা দরকার। বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের যে মামলা করা হয়েছে তার কি কোনো মেরিট আছে? এ কথা ঠিক যে, মেরিট আছে কি না আছে সেটি চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবে আদালত। যে কোন শিক্ষিত মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের আইনী এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সংজ্ঞা জানেন। সেই সব সংজ্ঞার আওতায় বেগম জিয়ার মামলা পড়ে না। তিনি বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। এই কথাটিই কি রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ হয়ে গেল? শহীদের সংখ্যা নিয়ে আমরা এই নিবন্ধে কোনো আলোচনায় প্রবৃত্ত হবো না। বেগম জিয়া বলেছেন যে, সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। সরকারের অফিসিয়াল স্ট্যান্ড হলো এই সংখ্যা ৩০ লাখ। বেগম জিয়া কি বলেছেন যে, ঐ সংখ্যা ৩০ লাখের কম? নাকি তিনি বলেছেন যে, ঐ সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি? এই মামলা যদি অগ্রসর হয় তাহলে সেখানে তার আইনজীবীরা অবশ্যই বেগম জিয়ার পক্ষে বক্তব্য দেবেন। কেন এই সংখ্যা বিতর্কিত সেটিও তারা বলবেন।
বাংলাদেশের বিগত ৪৪ বছরের পত্রপত্রিকা এবং নেতা নেত্রীর বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা এবং বিবৃতি পাঠ করলে অথবা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে মুক্তিযুুদ্ধে শহীদের পরিসংখ্যান নিয়ে নানান রকম তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি আমাদের আজকের বিষয় নয়। এগুলো বেগম জিয়ার আইনজীবীদের কাজ। এগুলো বেগম জিয়ার তথ্য শাখা বা গবেষণা শাখার কাজ। তারা তাকে তথ্য উপাত্ত বা পরিসংখ্যান দেবেন। আমাদের বক্তব্য হলো, শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে যদি কোনো অপরাধ হয়েই থাকে, তাহলে সেটি আর যাই হোক না কেন, সেটি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অপরাধ নয়। সকলেই জানেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে কি কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসি হতে পারে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা যেন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একুশে টেলিভিশনের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। কিভাবে হয়েছে সেটি একটি ভিন্ন বিষয়। ঐ টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করতেন এক ভদ্র লোক। নাম ড. কনক সরোয়ার। অফিসে তার কি কাজ ছিল সেটি আমরা জানি না। তবে তিনি ‘জনতার চোখ’ অথবা ‘একুশের চোখ’ এই রকম একটি নামে ঐ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেন। দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন সেসব কথা ঐ অনুষ্ঠানে প্রচার করা হতো। জনাব কনক সারোয়ার আর কি করতেন সেগুলো আমরা জানি না। কিন্তু একদিন দেখা গেল, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলখানায় পাঠানো হয়েছে। আরো জানা গেল যে, তাকে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কাজ করেছেন সেটি অবশ্য পত্র পত্রিকায় আসেনি। তাই আমরা সেটি জানিও না। তবে কয়েকদিন আগে শুনলাম যে, তিনি নাকি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার মুক্তিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে আদতেই কি কোনো চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে? করা হয়ে থাকলে তিনি কি অপরাধ করেছেন? করা হয়ে না থাকলে তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অপরাধের অভিযোগ কেন আনা হলো?
॥দুই॥
এসব কথা বলতে হলো বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ শুনে। জনগণ আশা করেন যে, সরকার মামলাটি ঝুলিয়ে রাখবেন না। বেগম জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কি অপরাধ করেছেন সেগুলোর একটি তালিকা জনগণ জানতে চায়। সেই মামলা হবে প্রকাশ্যে। কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল নয়। সরকার যা বলবেন সেগুলোর খুটিনাটি আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। তেমনি বেগম জিয়ার তরফ থেকে যা বলা হবে সেগুলোও বিস্তারিত আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। এই প্রসঙ্গে যারা প্রবীণ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্র মামলার কথা। যখন মামলা শুরু হয় তখন সেটি হয় প্রকাশ্যে। সরকার পক্ষ অভিযোগের সপক্ষে যতকথা বলেন তার প্রতিটি কথা যেমন দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় তেমনি আসামী পক্ষে অর্থাৎ শেখ মুজিবের পক্ষের আইনজীবীরা যত কথা বলেন তার প্রতিটি কথা তেমনি দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, শেখ মুজিবের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছিল বৃটিশ এমপি এবং ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে। তবে শেষ মুহূর্তে শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান আইনজীবী হিসাবে মামলা পরিচালনা করেন সেই সময়কার বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান। ঐ মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী যেমন বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে এসেছে তেমনি বেগম জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে আসতে হবে। কারণ পাকিস্তান আমলসহ এদেশে রাজনীতির অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে যারা খুটিনাটি জানেন তারা বুঝতে পারছেন যে বেগম জিয়ার এই মামলা যদি এগিয়ে যায় তাহলে এটি হবে একটি ঐতিহাসিক মামলা। এই মামলা হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতির অনেক কিছুই পাল্টে দেবে।
জনগণ ইতোমধ্যেই ধারণা করতে শুরু করেছেন যে এটি কোনো রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়নি, এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। কেন এই কথা বললাম সেটি অনুধাবন করতে হলে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা এবং আনুষঙ্গিক বিষয় জানতে হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Treason. কোনো কোনো অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে Sedition. মূলত বাংলায় রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা, বিরুদ্ধাচরণ অর্থাৎ যে ব্যাপকতা এবং সার্বিক বিরোধিতা প্রকাশ পায় ইংরেজি শব্দগুলো দিয়ে তা সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না। আমরা রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহকে যেভাবে দেখি, পাশ্চাত্যে সে রূপ নয়। রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে। ব্রিটিশরা আমাদের শিখিয়েছে তাদের সৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলা কওয়া অন্যায়। অপর দিকে, পশ্চিমা লক্ষ্য রাষ্ট্র নয়, শাসক। সুতরাং অক্সফোর্ড অভিধানে Treason অর্থ, The crime of betraying one’s country, especially by attempting to kill or overthrow the sovereign or government. বিশ্বকোষ এবং সমর্থক শব্দকোষ থেকে প্রাপ্ত আরো দুটো সংজ্ঞা এরকম : A revolt or an incitement to revolt against established authority, usually in the form of Treason or Defamation against government. আরেকটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Incitement of resistance to or insurrection against lawful authority.
॥ তিন ॥
এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ইউরোপ-আমেরিকায় দেশ জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত আইন শৃঙ্খলা, বৈধ কর্তৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাষ্ট্রদ্রোহকে সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সাথে এক করে দেখা হয়েছে। যেমন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ। কলকাতার অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের প্রতি কি আনুগত্যের অভাব দেখিয়েছেন? নাকি ঐ উক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন? বাংলাদেশের অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো কাজ করেছেন? করে থাকলে উদাহরণসহ জনগণের কাছে তা পেশ করার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গতকাল ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে বলেছেন, ‘‘কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, ক্ষমতাসীনগোষ্ঠী তাদের প্রতিপক্ষের সব কর্মকাণ্ডকে ঢালাওভাবে দেশদ্রোহ আখ্যায় আখ্যায়িত করে শ্বেতসন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে অবদমিত করার প্রয়াস পায়।’ পাশ্চাত্য এবং আমাদের দেশজ সংজ্ঞাগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, আমরা রাষ্ট্র ও সরকারকে গুলিয়ে ফেলেছি। রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। অপর দিকে, সরকার হচ্ছে একটি বাস্তব সংগঠন। রাষ্ট্র সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে অবস্থিত সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ও রাজনীতি এক জিনিস নয়। রাষ্ট্রের সাথে মত ভিন্নতা থাকতে পারে না। অপর দিকে রাজনীতি মানেই হচ্ছে ভিন্ন মত-ভিন্ন পথ।’’
রাষ্ট্রদ্রোহিতা একটি গুরু গম্ভীর বিষয়। যেখানে সেখানে এটির অপব্যবহার করে বিষয়টির গাম্ভীর্যকে হাল্কা করে ফেলা উচিত নয়। আজ আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করলেই হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। অথচ কোনো মানুষ বিশ্বাস করছে না যে, তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারেন। রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাইলে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনই তো ক্ষতি করতে পারতেন। অথচ তখন তার সমস্ত কাজই ছিল দেশপ্রেমিকতায় উজ্জীবিত। আজ যখন তিনি ক্ষমতাহীন, যখন সরকারের রাজদ- তার মাথার ওপর ডেমোক্লিসের তলোয়ারের মতো ঝুলন্ত এবং দোদুল্যমান, যখন তিনি দন্তনখরবিহীন ব্যাঘ্র তখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব দেখে শুনে বিএনপির একজন নেতা সেদিন বলেছেন, ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।’
বাংলাদেশের বিগত ৪৪ বছরের পত্রপত্রিকা এবং নেতা নেত্রীর বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা এবং বিবৃতি পাঠ করলে অথবা এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করলে মুক্তিযুুদ্ধে শহীদের পরিসংখ্যান নিয়ে নানান রকম তথ্য পাওয়া যায়। এগুলি আমাদের আজকের বিষয় নয়। এগুলো বেগম জিয়ার আইনজীবীদের কাজ। এগুলো বেগম জিয়ার তথ্য শাখা বা গবেষণা শাখার কাজ। তারা তাকে তথ্য উপাত্ত বা পরিসংখ্যান দেবেন। আমাদের বক্তব্য হলো, শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে যদি কোনো অপরাধ হয়েই থাকে, তাহলে সেটি আর যাই হোক না কেন, সেটি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অপরাধ নয়। সকলেই জানেন যে, রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। শহীদের সংখ্যা বিতর্কিত, এই কথা বললে কি কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসি হতে পারে?
দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এই সরকারের আমলে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে মামলা যেন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একুশে টেলিভিশনের মালিকানার হাত বদল হয়েছে। কিভাবে হয়েছে সেটি একটি ভিন্ন বিষয়। ঐ টেলিভিশন চ্যানেলে চাকরি করতেন এক ভদ্র লোক। নাম ড. কনক সরোয়ার। অফিসে তার কি কাজ ছিল সেটি আমরা জানি না। তবে তিনি ‘জনতার চোখ’ অথবা ‘একুশের চোখ’ এই রকম একটি নামে ঐ চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতেন। দেশের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কি ভাবছেন সেসব কথা ঐ অনুষ্ঠানে প্রচার করা হতো। জনাব কনক সারোয়ার আর কি করতেন সেগুলো আমরা জানি না। কিন্তু একদিন দেখা গেল, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং জেলখানায় পাঠানো হয়েছে। আরো জানা গেল যে, তাকে নাকি রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কাজ করেছেন সেটি অবশ্য পত্র পত্রিকায় আসেনি। তাই আমরা সেটি জানিও না। তবে কয়েকদিন আগে শুনলাম যে, তিনি নাকি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তার মুক্তিকে আমরা অভিনন্দন জানাই। তবে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের বা দেশদ্রোহের অভিযোগে আদতেই কি কোনো চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে? করা হয়ে থাকলে তিনি কি অপরাধ করেছেন? করা হয়ে না থাকলে তার বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অপরাধের অভিযোগ কেন আনা হলো?
॥দুই॥
এসব কথা বলতে হলো বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ শুনে। জনগণ আশা করেন যে, সরকার মামলাটি ঝুলিয়ে রাখবেন না। বেগম জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কি কি অপরাধ করেছেন সেগুলোর একটি তালিকা জনগণ জানতে চায়। সেই মামলা হবে প্রকাশ্যে। কোনো ক্যামেরা ট্রায়াল নয়। সরকার যা বলবেন সেগুলোর খুটিনাটি আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। তেমনি বেগম জিয়ার তরফ থেকে যা বলা হবে সেগুলোও বিস্তারিত আসতে হবে পত্র পত্রিকায়। এই প্রসঙ্গে যারা প্রবীণ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, শেখ মুজিবের ষড়যন্ত্র মামলার কথা। যখন মামলা শুরু হয় তখন সেটি হয় প্রকাশ্যে। সরকার পক্ষ অভিযোগের সপক্ষে যতকথা বলেন তার প্রতিটি কথা যেমন দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয় তেমনি আসামী পক্ষে অর্থাৎ শেখ মুজিবের পক্ষের আইনজীবীরা যত কথা বলেন তার প্রতিটি কথা তেমনি দাঁড়ি, কমা ও সেমিকোলনসহ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, শেখ মুজিবের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছিল বৃটিশ এমপি এবং ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামকে। তবে শেষ মুহূর্তে শেখ মুজিবের পক্ষে প্রধান আইনজীবী হিসাবে মামলা পরিচালনা করেন সেই সময়কার বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম খান। ঐ মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী যেমন বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে এসেছে তেমনি বেগম জিয়ার রাষ্ট্রদ্রোহের মামলার প্রতিদিনের কার্য বিবরণী বিস্তারিতভাবে প্রতিদিন খবরের কাগজে আসতে হবে। কারণ পাকিস্তান আমলসহ এদেশে রাজনীতির অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে যারা খুটিনাটি জানেন তারা বুঝতে পারছেন যে বেগম জিয়ার এই মামলা যদি এগিয়ে যায় তাহলে এটি হবে একটি ঐতিহাসিক মামলা। এই মামলা হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং রাজনীতির অনেক কিছুই পাল্টে দেবে।
জনগণ ইতোমধ্যেই ধারণা করতে শুরু করেছেন যে এটি কোনো রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়নি, এটি একটি রাজনৈতিক মামলা। কেন এই কথা বললাম সেটি অনুধাবন করতে হলে রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা এবং আনুষঙ্গিক বিষয় জানতে হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Treason. কোনো কোনো অভিধানে শব্দটির অর্থ করা হয়েছে Sedition. মূলত বাংলায় রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটির মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা, বিরুদ্ধাচরণ অর্থাৎ যে ব্যাপকতা এবং সার্বিক বিরোধিতা প্রকাশ পায় ইংরেজি শব্দগুলো দিয়ে তা সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না। আমরা রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহকে যেভাবে দেখি, পাশ্চাত্যে সে রূপ নয়। রাষ্ট্রদ্রোহ বা দেশদ্রোহ শব্দটি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করে। ব্রিটিশরা আমাদের শিখিয়েছে তাদের সৃষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলা কওয়া অন্যায়। অপর দিকে, পশ্চিমা লক্ষ্য রাষ্ট্র নয়, শাসক। সুতরাং অক্সফোর্ড অভিধানে Treason অর্থ, The crime of betraying one’s country, especially by attempting to kill or overthrow the sovereign or government. বিশ্বকোষ এবং সমর্থক শব্দকোষ থেকে প্রাপ্ত আরো দুটো সংজ্ঞা এরকম : A revolt or an incitement to revolt against established authority, usually in the form of Treason or Defamation against government. আরেকটি সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, Incitement of resistance to or insurrection against lawful authority.
॥ তিন ॥
এসব সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, ইউরোপ-আমেরিকায় দেশ জাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত আইন শৃঙ্খলা, বৈধ কর্তৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাষ্ট্রদ্রোহকে সরকারের পরিবর্তে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সাথে এক করে দেখা হয়েছে। যেমন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘রাজনীতির অভিধান’-এ রাষ্ট্রোদ্রোহ বলতে বোঝানো হয়েছে, ‘দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্যের অভাব বা বিরুদ্ধাচরণ।’ আর আমাদের এখানের ‘রাজনীতি কোষ’-এ প্রায়োগিক সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, ‘রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কাজকেই বলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহ। কলকাতার অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি আলোচ্য উক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্বের প্রতি কি আনুগত্যের অভাব দেখিয়েছেন? নাকি ঐ উক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন? বাংলাদেশের অভিধান মোতাবেক বেগম জিয়া বা তার দল বিএনপি কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর কোনো কাজ করেছেন? করে থাকলে উদাহরণসহ জনগণের কাছে তা পেশ করার জন্য আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।
জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গতকাল ২৯ জানুয়ারি শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নিবন্ধে বলেছেন, ‘‘কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, ক্ষমতাসীনগোষ্ঠী তাদের প্রতিপক্ষের সব কর্মকাণ্ডকে ঢালাওভাবে দেশদ্রোহ আখ্যায় আখ্যায়িত করে শ্বেতসন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে অবদমিত করার প্রয়াস পায়।’ পাশ্চাত্য এবং আমাদের দেশজ সংজ্ঞাগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, আমরা রাষ্ট্র ও সরকারকে গুলিয়ে ফেলেছি। রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্তা। অপর দিকে, সরকার হচ্ছে একটি বাস্তব সংগঠন। রাষ্ট্র সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে অবস্থিত সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র ও রাজনীতি এক জিনিস নয়। রাষ্ট্রের সাথে মত ভিন্নতা থাকতে পারে না। অপর দিকে রাজনীতি মানেই হচ্ছে ভিন্ন মত-ভিন্ন পথ।’’
রাষ্ট্রদ্রোহিতা একটি গুরু গম্ভীর বিষয়। যেখানে সেখানে এটির অপব্যবহার করে বিষয়টির গাম্ভীর্যকে হাল্কা করে ফেলা উচিত নয়। আজ আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করলেই হয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। অথচ কোনো মানুষ বিশ্বাস করছে না যে, তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারেন। রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে চাইলে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখনই তো ক্ষতি করতে পারতেন। অথচ তখন তার সমস্ত কাজই ছিল দেশপ্রেমিকতায় উজ্জীবিত। আজ যখন তিনি ক্ষমতাহীন, যখন সরকারের রাজদ- তার মাথার ওপর ডেমোক্লিসের তলোয়ারের মতো ঝুলন্ত এবং দোদুল্যমান, যখন তিনি দন্তনখরবিহীন ব্যাঘ্র তখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। এসব দেখে শুনে বিএনপির একজন নেতা সেদিন বলেছেন, ‘এই দিন দিন নয় আরো দিন আছে।’
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন