সোমবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৬

বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ও আহমদিয়াদের বিভ্রান্তি


স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদের সংখ্যাকে বিতর্কিত বলে অভিহিত করায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে বলে জানা গেছে। বলা বাহুল্য, একজন আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত বৃহস্পতিবার এ মামলা করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দিন আহমদ বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অনুমোদন চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪৫ বছর পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ও দুইবারের বিরোধীদলীয় নেতা এবং স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক এবং সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের এ মামলাকে অনেকেই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন। এই মামলার মেরিট থাকুক বা না থাকুক বেশিরভাগ বিশ্লেষকের মতে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে পেশীশক্তি ও কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় এসে দেশে গণতন্ত্র হত্যা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ব্যভিচার ও নৈরাজ্যের যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারবিরোধী জনরোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে তা প্রতিহত করার জন্য বিরোধী দলসমূহকে নেতৃত্বহীন ও নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যেই সরকারের ইঙ্গিতে এই মামলা করা হয়েছে।
একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অগণিত শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা কখনো নিরূপণ করা হয়নি এবং স্বয়ং সরকারের হাতেও এর নিশ্চিত কোনো পরিসংখ্যান নেই। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পাকিস্তানী কারাগার থেকে ফিরে আসার পথে লন্ডনে সাংবাদিকদের এই যুদ্ধে নিহত লোকের সংখ্যা তিন মিলিয়ন বলেছিলেন। দেশে ফেরার সময় তার অন্যতম সাথী ছিলেন বিবিসির খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং বাংলাদেশেরই নাগরিক সিরাজুর রহমান। সিরাজুর রহমান তার এক লেখায় এই মর্মে এক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব প্রকৃতপক্ষে তিন লাখই বলতে চেয়েছিলেন এবং ইংরেজিতে তিন লাখকে তিন মিলিয়ন বলে ফেলায় এই পরিসংখ্যান বিভ্রাট ঘটেছে। আসলে এই উপমহাদেশের দেশগুলো মিয়ানমার, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান ছাড়া দুনিয়ার আর কোনো দেশে ‘লাখ’ শব্দের ব্যবহার নেই। তারা ‘মিলিয়ন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আমাদের  হিসেবে এক মিলিয়ন সমান দশ লাখ। এ প্রেক্ষিতে তার তিন মিলিয়ন নিহত হবার পরিসংখ্যান ত্রিশ লাখে পরিণত হয়েছে বলে ঐ সময় এবং এর পরেও পত্র-পত্রিকায় আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। এ ব্যাপারে তৎকালীন আওয়ামী লীগের এম.এল.এ ও পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক আবদুল মোহাইমেন তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছিলেন এবং আব্দুল মুবিন চৌধুরী ত্রিশ লাখ শহীদের পরিসংখ্যানের সত্যতার ওপর প্রশ্ন তুলে একটি বিশ্লেষণধর্মী পুস্তক রচনা করেছিলেন। যশোর নিবাসী মাওলানা আবুল খায়েরের একটি বিশ্লেষণধর্মী তথ্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক সালাহউদ্দিন জহুরীর ‘ত্রিশ লাখের তেলেসমাতি’ শীর্ষক একটি বই এখনো বাজারে পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে কোনো সমীক্ষা বা শুমারি পরিচালনায় তৎকালীন সরকার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে দশ জানুয়ারি দেশে ফেরার পথে অথবা পাকিস্তান অবস্থানকালে কে বা কারা এই তথ্য দিয়েছিলেন তা জানা যায়নি। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য ও জনশ্রুতি তথ্য-পরিসংখ্যান এক নয় এবং এই জাতের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতাও ভিন্ন। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে প্রতিটি থানায় সার্কেল অফিসারদের আহ্বায়ক করে সারা দেশে এই সংখ্যা নিরূপণের জন্য ঋধপঃ ঋরহফরহম কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বিস্তারিত জরিপ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার রিপোর্টও জমা দিয়েছিলেন। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। বিভিন্ন থানা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানসমূহ একত্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিসংখ্যানও এই মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু প্রাপ্ত তথ্য এক লাখেরও কম ছিল বিধায় তা আর জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি বলে পত্র-পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়।
বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ ও তাদের পরিবারবর্গকে ভাতা দিয়ে থাকেন। সমাজকল্যাণ বিভাগের তরফ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০১০ সালে এর সংখ্যা ছিল এক লাখের নিচে। ২০১৫ সালের নবেম্বরে এসে এই সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার এ বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যে অনেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা নিবন্ধনের ন্যায় কিছু কারসাজি আছে বলে মনে করেন। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ লোকের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ ও তা প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। তারা আমাদের ইতিহাসের অংশ এবং তাদের রক্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাদের সংখ্যা নিয়ে কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তি থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। দেশবাসী আশা করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলায় সরকারের তরফ থেকে ত্রিশ লাখ শহীদের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা প্রভৃতি আদালতে দাখিল করে সরকার প্রমাণ করবেন যে, এই পরিসংখ্যান সত্য এবং সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সাথে সাথে শহীদদের পরিবারসমূহের জন্য অন্যান্যদের ন্যায় ভাতার ব্যবস্থা করে ইনসাফের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। এতে বেগম জিয়ার মতো দেশের কোটি কোটি মানুষ সন্দেহমুক্ত হবেন।
॥ দুই॥
গত রোববার ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ দেখে পাঠক-পাঠিকাদের অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সংবাদটি হচ্ছে আহমদিয়া মুসলিম জামাত কর্তৃক আয়োজিত একটি শান্তি সম্মেলন সংক্রান্ত। ঢাকায় আহূত এ সম্মেলনে সকল ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের সন্ত্রাস প্রতিরোধের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ আহ্বানটি যৌক্তিক, মানবাধিকার এবং ইনসাফবান্ধব। ধর্ম কখনো মানুষকে সন্ত্রাসী হতে উৎসাহিত করে না বরং শান্তি প্রতিষ্ঠাতেই উজ্জীবিত করে। এ প্রেক্ষিতে  আলোচনার বিষয়বস্তুকে আমি সঠিক এবং সময়োপযোগী বলে মনে করি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়। সারা দুনিয়ার আলেম সমাজ আহমদিয়া সম্প্রদায়কে মুসলমান মনে করেন না। ওআইসির ফিকাহ একাডেমি আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি মুসলিম দেশ ইতোমধ্যে আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য করছে। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে আহমদিয়া সম্প্রদায় খতমে নবুওয়্যাতে বিশ্বাস করেন না এবং মির্জা গোলাম মোহাম্মদ কাদিয়ানীকে নবী হিসেবে মানেন। যে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে এবং বিশ্বাস করে মুসলমান হতে হয় তারা তাতে বিশ্বাস করেন না। আগেই বলেছি তাদের মুসলমান না হওয়া সম্পর্কে বিশ্বের সকল খ্যাতনামা আলেম একমত। আমাদের দেশেও তাদের একই অবস্থা। কিন্তু গত রোববার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে তারা বাংলাদেশ আহমদিয়া মুসলিম জামাতের নামে যে সিম্পোজিয়ামটির আয়োজন করেছেন তাতে মুসলিম শব্দটির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তারা তো মুসলিম নন, মুসলমান হবার প্রাথমিক শর্ত পালন করে না, তাদের আকীদা বিশ্বাসও মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাসের পরিপন্থী। আবার এতে দেখা যায় যে, ড. কামাল হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। ঘাদানিক সভাপতি শাহরিয়ার কবীর, বাড্ডার বৌদ্ধ মন্দিরের ভেন শুনানন্দপ্রিয় ভিক্ষু, ফাদার তপন ডি রোজারিও এবং সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক এতে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আব্দুর রশীদও এতে বক্তব্য রেখেছেন। কে প্রধান অতিথি ছিলেন, কে বিশেষ অতিথি অথবা কারা কারা বক্তব্য রেখেছেন এটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে কাদিয়ানীদের মুসলিম শব্দ ব্যবহার নিয়ে। আগেই বলেছি তারা মুসলিম নন। তারা নিজেদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে এ দেশের মুসলমান এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন বলে মনে হয়। এ বিভ্রান্তি পরিকল্পিত এবং সরকারি অনুগ্রহপ্রাপ্ত। ইসলাম সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, খুন, রাহাজানি, হত্যায় বিশ্বাস করে না। এর বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য আয়াত রয়েছে এবং রাসূল (সা.)-এর অসংখ্য হাদীসও রয়েছে। আমার জানা মতে অনেকগুলো ইসলামী দল সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ও আলোচনা অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের কাছে অনুমতি চেয়েও তা পায়নি। এই অবস্থায় কাদিয়ানীদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে অনুষ্ঠান করার পেছনে ইসলামবিরোধী তৎপরতা এবং ষড়যন্ত্র নেই এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন। কাদিয়ানীরা কাদিয়ানী হিসেবেই থাকুক, তাদের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি সংযোজন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি কেউ না করুক এটাই আমাদের কাম্য।
ড. মোঃ নূরুল আমিন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads