বুধবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৬

গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার দাবি


বিএনপি চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া জনগণ জেগে ওঠার আগেই নতুন একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা দিবসের সমাবেশে তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে গুম-খুন এবং মামলা ও গ্রেফতারের পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর অনেক অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাছাড়া একদলীয় ও ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী এই সরকারের কোনো বৈধতা নেই। সে কারণে ক্ষমতাসীনদের ভুল স্বীকার করতে হবে। না হলে জনগণ কখন জেগে উঠবে তা তারা টেরও পাবেন না। আর জনগণ একবার জেগে উঠলে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। বেগম খালেদা জিয়া আরো বলেছেন, সরকারের যদি শুভ বুদ্ধির উদয় না হয় তাহলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জালিমদের বিদায় করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার পথ দেখাতে গিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সরকারকে সব দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে।
আমরা বেগম খালেদা জিয়ার দাবি, আহ্বান এবং হুশিয়ারিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময় মনে করি। তার বক্তব্য সকল মহলে ব্যাপকভাবে সমর্থিতও হয়েছে। এটাই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি তিনি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে এসেছেন। এই দাবিতে আন্দোলনও করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, খালেদা জিয়া শুধু দাবি উত্থাপন করেই থেমে যাননি, তিনি একইসঙ্গে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখাও পেশ করেছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর উপস্থাপিত এই রূপরেখায় সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য সম্মানিত একজন নাগরিককে নির্দলীয় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। উপদেষ্টাদের ব্যাপারে বলেছিলেন, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমান সংখ্যক উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করা হবে। খালেদা জিয়ার এই রূপরেখা দেশের সকল মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। এখনো, এতদিন পরও মনে করা হয়, ক্ষমতাসীনরা যদি ওই রূপরেখাসহ তার প্রস্তাব মেনে নিতেন তাহলে রাজনৈতিক সংকট এত মারাত্মক হয়ে উঠতো না। উল্লেখ্য, সরকারের প্রতি দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সে সময়ও খালেদা জিয়া বলেছিলেন, হিংসা ও শত্রুতা ভুলে সবার আগে দরকার জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া। এজন্য প্রথমে দরকার নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
কিন্তু সংকট কাটিয়ে ওঠার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার এগিয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক নীতির ভিত্তিতে, ফ্যাসিবাদী পন্থায়। ক্ষমতাসীনরা তখন সেই সংবিধানের দোহাই দিয়েছিলেন যে সংবিধানকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী এমনভাবে সংশোধন করেছেন যাতে তারাই আবারও ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। বেগম খালেদা জিয়াকে অঘোষিতভাবে গৃহবন্দী করে এবং তার বাসভবনের সামনে আবর্জনাভরা ট্রাক রেখে দশম সংসদ নির্বাচনের নামে সরকার লজ্জাকর এক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে নির্বাচনে ১৫৪ জন সদস্যই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছিলেন। নির্বাচনের ঘোষিত তারিখ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিও জনগণ ভোট কেন্দ্রের আশেপাশে যায়নি। তা সত্ত্বেও ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে হিসাব দেখিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। অর্থাৎ বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমঝোতামুখী ও গণতন্ত্রসম্মত অবস্থান নেয়া হলেও ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশ্য ছিল অন্য রকম, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে পরবর্তী দিন ও মাসগুলোতে। এ সময়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কোনো একটি দলকেই বাধাহীনভাবে তৎপরতা চালাতে দেয়া হয়নি। সরকার সেইসাথে তথাকথিত জঙ্গিবাদের ধোয়া তুলে নেতাকর্মীদের সর্বক্ষণ ধাওয়ার মুখে রেখেছে। মিথ্যা মামলায় তো পড়েছেনই, অনেকে গুম ও গুপ্তহত্যারও শিকার হয়েছেন। সে অবস্থা এখনো চলছে বলে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে বিরোধী দলের পক্ষে কার্যকরভাবে অংশ নেয়াই সম্ভব হয়নি।
আমরা মনে করি, সমগ্র এ প্রেক্ষাপটেই বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ আহ্বান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরকার যে নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে এবং যে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এভাবে রাজনৈতিক সংকটই শুধু আরো ঘনীভুত হবে না, সারা দেশে সহিংসতাও ছড়িয়ে পড়তে থাকবে যে ধরনের পরিস্থিতি অবশ্যই আশংকাজনক এবং জনগণের আকাক্সক্ষার পরিপন্থী। এ জন্যই সরকারের উচিত রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়া। সরকারকে বিরোধী দলের ওপর হামলা ও নির্যাতন এবং গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, খালেদা জিয়ার আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার প্রস্তাব অনুযায়ী সব দলের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সংবিধানে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান যুক্ত করতে হবে। বলা দরকার, সময় যেহেতু দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে সেহেতু উদ্যোগ নিতে হবে স্বল্পকালের মধ্যে, জনগণ জেগে ওঠার আগেই। সবশেষে বেগম খালেদা জিয়ার হুশিয়ারিটুকু স্মরণ করা দরকার- যেখানে তিনি বলে রেখেছেন, জনগণ একবার জেগে উঠলে তাদের ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads