মঙ্গলবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক প্রসঙ্গে

১৯৭১ সালে কত লোক গণহত্যার শিকার হয়েছেন, অন্য কথায় কতজন মানুষ শহীদ হয়েছেন তা নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই নতুন বিতর্কের সৃষ্টি। বেগম জিয়া মুুক্তিযুদ্ধের সময়কার শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে বলে মন্তব্য করায় আওয়ামী লীগ, আওয়ামী জোটভুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা তার ওপর ভীষণভাবে ক্ষেপে গেছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ লোক নিহত হয়েছেনÑ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। ওই প্রতিষ্ঠিত সত্যকে কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ লাখ লোক নিহত হয়েছেন এই তথ্যটি প্রথম উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এবং সেই থেকেই বলা হচ্ছে যে, মুক্তিযুদ্ধে শাহাদতবরণকারী মানুষের সংখ্যা হচ্ছে ৩০ লাখ।
এখন দেখা যাক, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে বঙ্গবন্ধু সেদিন কী বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন : You Know What has happened in Bengal? I will tell you. Three million People have been killed, including children, woman, intellectuals, peasants, workers, students. At least 25 percent to 30 percent of houses are burned and looted in Bangladesh. All food go downs have been destroyed. 
Frost : And how do you know that the number as high as three million?
Sheikh Mujib : Before my coming, my people had started collecting information. I have messages coming from allover where I have a base. We have not finally concluded, it might be more, but definitely it will not be less than three million (সূত্র : www.thedailystar.net)
এর বাংলা অনুবাদ নিচে দেয়া হলো :
শেখ মুজিব : আপনি কি জানেন বাংলায় কী ঘটেছে? আমি আপনাকে বলছি, শিশু, নারী, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রসহ ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুট করা হয়েছে। সব খাদ্যগুদাম ধ্বংস করা হয়েছে।
ফ্রস্ট : আপনি কিভাবে জানেন যে, ৩০ লাখের মতো এত বিপুল লোককে হত্যা করা হয়েছে?
শেখ মুজিব : আমি আসার আগেই আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। যেখানে যেখানে আমার লোকজন রয়েছে সব জায়গা থেকেই আমি তথ্য পাচ্ছি। আমরা এখনো হিসাব চূড়ান্ত করিনি। এটা বেশিও হতে পারে। তবে নিশ্চিতভাবেই ৩০ লাখের কম নয়।
এখানে লক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে : এক, বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে ফেরত আসার আগেই তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। দুই, সব জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের লোকেরাই তথ্য সংগ্রহ করছিল। তিন, সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে কত লোক নিহত হয়েছে সে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়নি। নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখের বেশিও হতে পারে, তবে কম নয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাতে নিহত, আহত ও নির্যাতিতদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করে। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালনকারী জনাব এইচ টি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ বইয়ে জানিয়েছেন, গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি গণহত্যা সেল গঠন করা হয়েছিল। সেলের কাজ ছিল, গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং গণহত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রস্তুত করা।
তিনি লিখেছেন, ‘গণহত্যা সেল গঠন ছিল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। বাংলাদেশ হাইকমিশনে এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে ছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে রাষ্ট্রদূত ফাতেহ সাহেব ও মোমেন সাহেব দায়িত্ব নেন। প্রতিটি অঞ্চলের (তড়হব-এর) কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যেন তথ্য সংগ্রহ করেন, সাক্ষী-সাবুদ প্রস্তুত রাখেন পরবর্তীকালে আদালতে ব্যবহারের জন্য। দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে প্রচুর তথ্য, সাক্ষী সংগ্রহ করা হয়।’ (পৃষ্ঠা-৭৩) ওই বইয়েরই আরেকটি স্থানে তিনি লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রথম দিকেই আমরা আরেকটি কাজ শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তখন নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সঙ্গীরা। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর ধ্বংস, জ্বালানো, লুটতরাজ চালাচ্ছিল সর্বত্র। যেখানে ওরা যাচ্ছে সেখানেই তারা এই কাজ করছিল। এইসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং শহীদ, আহত এবং নির্যাতিতদের তালিকা তাদেরই দেয়া বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরের অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে।’ (পৃষ্ঠা-২৬৯)
এইচ টি ইমামের লেখা থেকে আরো জানা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নির্যাতিত মহিলাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহের জন্য মুজিবনগর সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘নভেম্বর মাসের শেষ দিকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। প্রথমটি সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা ও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ। দ্বিতীয়টি নির্যাতিত মহিলাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য। পরিকল্পনা বোর্ডকে এই দায়িত্ব দেয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করা হয়।’ (পৃষ্ঠা-৩২১)
তাহলে দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহত, আহত ও নির্যাতিতদের তালিকার কাজ মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকেই শুরু হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পরও অব্যাহত ছিল। এখন প্রশ্ন হলো, এত কষ্ট করে, এত সময় ধরে, এত মানুষকে দিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও তালিকা করার পরও তা চূড়ান্ত করা হলো না কেন? এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে, তালিকাটি চূড়ান্ত করা হয়নি বলেই তা প্রকাশ করা হয়নি, আর যদি তা চূড়ান্ত করা হয়েই থাকে তাহলে সেটা প্রকাশ করা হলো না কেন? আওয়ামী লীগ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিধায় তালিকা প্রকাশ করার জন্য তাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল বলেই অনেকে মনে করেন।
বর্তমান সরকার যদি মুক্তিযুদ্ধে নিহত, আহত ও নির্যাতিতদের তালিকাটি প্রকাশ করে তাহলে বিতর্কের অবসান ঘটতে পারে, তা না হলে বিতর্কের সুষ্ঠু কোনো সমাধান হবে না। কারণ, বিতর্ক সৃষ্টি করার মতো অনেক উপাদান হাতের কাছেই রয়ে গেছে। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘ঠিক এই সময়ে উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কী উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন, এমন কী নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লাখ বাঙালিকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা জানাননি।’ (বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, পৃষ্ঠা-৯২)
এখানে লক্ষণীয় যে, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে এসে ১০ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার কথা বলেছেন। অন্য দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধশেষে ৩১ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে ১০ লাখ মানুষ নিহত হওয়ার কথাই বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ ও ইন্দিরা গান্ধী কী ভূমিকা পালন করেছিলেন তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
ওয়ালিউল হক

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads