গত তিন দিন থেকে সারা ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশে একই আলোচনা সর্বত্র শোনা যাচ্ছে। একে অপরকে জিজ্ঞাসা করছেন, এ কেমন ইলেকশন হলো? যারা কিছুটা শিক্ষিত এবং বোদ্ধা তারা নিজেরা আলোচনার সময় বলছেন, এ ধরনের পৌর নির্বাচন করে সরকারের কি লাভ হলো? সকলেই বলছেন, এ ধরনের নির্বাচন না করলে সরকারের কি ক্ষতি হতো? রাজনৈতিক মহল বলছেন যে আওয়ামী সরকার তো অলরেডি প্রশাসন এবং ক্ষমতার ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। বিগত সাধারণ নির্বাচনে সব দল অংশ গ্রহণ না করলেও ব্যুরোক্র্যাসির ওপর সরকারের রয়েছে ফার্ম কন্ট্রোল। আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী অর্থাৎ পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি সরকারের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য প্রশ্নাতীত। অন্যদিকে বিরোধী দল এখন মাঠে নাই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই সরকারের ক্ষমতার মসনদের প্রতি কোন দিক থেকেই কোন রকম হুমকি নাই। এমন একটি পটভূমিতে সরকার যদি এই পৌর নির্বাচন নাও করতো তাহলেও সরকারের ক্ষমতার গদিতে বিন্দু মাত্র কম্পন সৃষ্টি হতো না। কিন্তু তারপরেও সরকার এমন প্রহসনমূলক সাজানো নাটকের মতো একটি নির্বাচন করে খামাখা অনেক বদনাম কুড়ালো। অথচ এই বদনাম কুড়ানোর কোন প্রয়োজনই সরকারের ছিল না।
গত ৩১ তারিখে কিছু বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন মিলে আমরা আড্ডায় বসেছিলাম। সংখ্যায় অন্তত ২৫ জন। তাদের মধ্যে অন্তত ২৩ জনই এই ইলেকশনের সমালোচনায় মুখর। আলোচনায় দেখা গেল যে, সকলেই ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বরের খবরের কাগজ পড়েছে এবং টেলিভিশন দেখেছে। এদের প্রায় সকলেই ছিল অরাজনৈতিক ব্যক্তি। যেসব পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের মানুষ বেশি পড়েন সেই সব পত্র-পত্রিকার প্রায় সব ক’টিতেই ভোট ডাকাতি, জাল ভোট এবং কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার খবর এবং ফটো ছাপা হয়েছে।
একটি ইংরেজী দৈনিক খবর দিচ্ছে, অন্তত ৩০টি কেন্দ্রের ভোট শুরু হওয়ার সময় থেকেই আগে থেকে সিল মারা ব্যালট পেপার ঢোকানো শুরু হয় এবং ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত সেটি চলে। ইংরেজী ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক, সকাল ৮টার আগেই আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা অনেকগুলো কেন্দ্র দখল করে নেয় এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়। বের করে দিয়ে তারা ব্যালট বাক্সে সিল মারতে থাকে এবং সেগুলো ব্যালট বাক্সে ভরতে থাকে। নির্বাচনী কেন্দ্রসমূহে তাদের যাতায়াত ছিল অবাধ ও বাধাহীন। ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, ভোটের এই কারচুপিতে পুলিশ আওয়ামী কর্মীদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে। এসব অনিয়ম চেপে রাখার জন্য নির্বাচনী অফিসার, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা গণ মাধ্যমের কর্মীদের অধিকাংশ কেন্দ্রেই প্রবেশ করতে বাধা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে গণ মাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতেই পুলিশের সহযোগিতায় ব্যালট পেপারে সিল মারা শুরু হয়।
ডেইলি স্টার এর বিশাল রিপোর্টে অনেক কেন্দ্রের ভোট ডাকাতির খুটিনাটি বিবরণ দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের একাধিক মেয়র প্রার্থী কিভাবে বিরোধী দলকে হটিয়ে নিজেরাই ব্যালট বাক্সে জাল ভোট ঢুকিয়েছে সেসব কাহিনীও সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।
ডেইলি স্টারের অপর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই অনিয়ম এবং নির্বাচনে পুকুর চুরির প্রতিবাদে অন্তত ৪৯ জন মেয়র প্রার্থী ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। রিপোর্টে এই ৪৯ জন মেয়র প্রার্থীর অনেকের নাম-ধাম দেয়া হয়েছে।
গত ১লা জানুয়ারির দৈনিক ‘মানবজমিনে’ দেখানো হয়েছে যে, কি অস্বাভাবিক পরিমাণে ভোট পড়েছে এই নির্বাচনে। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক দেখা যায় যে, ২০৭টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ হারে। ৫টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায়। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের এ হার অস্বাভাবিক। স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের স্বাভাবিক হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মধ্যেই থাকার কথা।
॥দুই॥
নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে রাজশাহীর মোহনপুরে ৯২ দশমিক ১৭ শতাংশ। ৫টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। জয়পুরহাটের কালাইয়ে ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ, রাজশাহীর মোহনপুরে ৯২ দশমিক ১৭ শতাংশ, কুষ্টিয়ার মিরপুরে ৯০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, বরিশালের উজিরপুরে ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ ও নাটোরের নলডাঙায় ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ইলেকশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ইটিআই) মাগুরা-১ উপনির্বাচন উপলক্ষে ভোটের হার নির্ধারণে একটি পরীক্ষা চালায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সুষ্ঠুভাবে ভোট হলে একটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে শুধু একটি মাত্র ব্যালট ব্যবহার হয়। পৌর নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের জন্য পৃথক ৩টি ব্যালট ব্যবহার করা হয়। পৌর নির্বাচনে ভোটের হার জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম হওয়ার কথা। এছাড়া পৌর নির্বাচনে এত পরিমাণ ভোট পড়ার নজির নেই। ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনেও এত পরিমাণ ভোট পড়েনি। ভোট প্রদানের হারের বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, ৭০ ভাগের বেশি ভোট কাস্ট হওয়া সন্দেহজনক। এছাড়া বেশি ব্যালট হলে সময়ের হিসেবেও ভোট কাস্ট হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। অথচ ধামরাই আইডিয়াল স্কুলের ওই কেন্দ্রে ভোট দেখানো হয়েছে ৯৫ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মেয়র পদে গড়ে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে এই পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায়। আর ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে গত বছরের মে মাসে তিন ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬২ থেকে ৬৪ শতাংশ। তার আগে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ভোটের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। ‘প্রথম আলোর’ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব পৌরসভায় অনিয়ম ও কারচুপি বেশি হয়েছে এবং যেখানে বিএনপির প্রার্থী দুর্বল বা এজেন্ট ছিল না, সেখানেই ভোট পড়ার হার অন্য এলাকার চেয়ে বেশি ছিল।
॥তিন॥
নির্বাচনের নামে ২৩৪ টি পৌরসভায় যে প্রহসনমূলক নাটক মঞ্চস্থ হলো সেটি গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার পরিবর্তে সমগ্র জাতির জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা ও কলঙ্কের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। একই সাথে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা অবনমিত হলো। গত বুধবার ২৩৪ টি পৌরসভাতে যত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, কারচুপি এবং সহিংসতা ঘটেছে সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে নির্বাচনের নামে যে তা-ব ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। আমরা এখানে তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি অপকর্মের কথা তুলে ধরছি। ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারের’ মতে, ২৩৪ টি পৌরসভার মধ্যে অন্তত ৮০ টিতে অনিয়ম এবং কারচুপি ঘটেছে। ১৮ টি পৌরসভার ৩৮ টি নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। নরসিংদীর মাধবদীর পৌর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ৩৯ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন এবং নতুন নির্বাচনের দাবি করেছেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় এক ব্যক্তি (দৈনিক ‘প্রথম আলো’র মতে দুই ব্যক্তি) নিহত হয়েছেন। সারা দেশে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত এক শত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। গতকাল ‘দৈনিক ইনকিলাবে’র খবর মোতাবেক ধামরাইয়ের খোলা মাঠে ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে। নোয়াখালীতে ভোট কেন্দ্র দখল নিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলী বিনিময় ঘটেছে। এই গুলী বিনিময়ে ৫ ব্যক্তি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। টাঙ্গাইলে ব্যালট নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান পলায়ন করেছেন। সৈয়দপুরে অর্থ বিতরণকালে ৪ ব্যক্তি আটক হয়েছে। স্বরূপকাঠির অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল ভোটার শূন্য। সোনারগাঁয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। ওসিসহ ১২ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তারাবোতে মেয়র প্রার্থীর সামনেই জাল ভোট প্রদান করা হয়েছে। লাকসামে অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগের ৮ নেতাকে আটক করা হয়েছে। শরীয়তপুর সদরে সব কেন্দ্র দখল করা হয়েছে। এরশাদ পন্থী জাতীয় পার্টির অভিযোগ, ২৫ টি পৌরসভার ১৭৪ টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবের খবর মোতাবেক, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌরসভার বাইমহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আনাগোনা ছিল খুব কম। নির্বাচনী কর্মকর্তা ও এজেন্টরা পার করেছেন অলস সময়। তারপরেও দুপুরের মধ্যেই ৬১ শতাংশ ভোট প্রদত্ত হয়েছে।
দৈনিক প্রথম আলো নওয়াপাড়া পৌরসভার গাজীপুর রওফিয়া কামিল মাদরাসা কেন্দ্র প্রাঙ্গণে ভোট প্রদানের খবর দিচ্ছে এভাবে, “ভোট কক্ষের ভেতর তাকিয়ে দেখা গেল, ব্যালট বক্সের সামনে একজন দাঁড়ানো। ভোটাররা মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের তিনটি ব্যালট পেপার নিয়ে মেয়র প্রার্থীদের ব্যালটে সবার সামনে দাঁড়িয়েই নৌকা প্রতীকে ভোট দিচ্ছেন। বাকি দুই ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন পর্দার আড়ালে গিয়ে। এখানে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সুশান্ত কুমার রায়। একজন ভোটার নৌকায় ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানালে পাশ থেকে একজন বলেন, ‘‘না দিলে খবর আছে। তাড়াতাড়ি ভোট দিয়ে ভাগ।’’ গত শুক্রবার ইংরেজি ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদে বলা হয়েছে, দেশের অন্তত ৮০ টি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা চরম অনিয়ম এবং ভোট জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন স্থানীয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগের লোকেরা ইচ্ছেমত ব্যালট পেপারে সিল মারে এবং সেই সব ব্যালট পেপার ব্যালট বক্সে ঢুকিয়ে দেয়। পত্রিকাটির সাংবাদিকদের চোখের সামনেই বিএনপির নির্বাচনী এজেন্টদের আওয়ামী লীগের লোকেরা বের করে দেয়। অনেক নির্বাচনী কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।
এই ছিল বুধবারের প্রহসনমূলক নির্বাচনের সাধারণ চালচিত্র। প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের ছত্রে ছত্রে এসব কেলেঙ্কারি কাহিনী বিধৃত রয়েছে। পৌর নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় যারা এসব কাণ্ড ঘটালো তারা এসব করে নতুন প্রজন্মকে, বিশেষ করে যারা এবারই নতুন ভোটার হয়েছে, তাদের কি দেখালো এবং কি শেখালো? এইসব তরুণ, যারা ভবিষ্যতে এই জাতির হাল ধরবে, তাদের মনে নির্বাচন সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো না। বরং যেটি করা হলো সেটি সম্পূর্ণ নেতিবাচক। তরুণ প্রজন্ম এসব দেখে এবং শুনে একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে তেমনি হতাশ। গত ৩০ ডিসেম্বর বুধবার পৌর নির্বাচনের নামে বাংলাদেশের মতো একটি সংগ্রামী জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আরেকটি কালো অধ্যায় রচিত হলো।
গত ৩১ তারিখে কিছু বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন মিলে আমরা আড্ডায় বসেছিলাম। সংখ্যায় অন্তত ২৫ জন। তাদের মধ্যে অন্তত ২৩ জনই এই ইলেকশনের সমালোচনায় মুখর। আলোচনায় দেখা গেল যে, সকলেই ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বরের খবরের কাগজ পড়েছে এবং টেলিভিশন দেখেছে। এদের প্রায় সকলেই ছিল অরাজনৈতিক ব্যক্তি। যেসব পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের মানুষ বেশি পড়েন সেই সব পত্র-পত্রিকার প্রায় সব ক’টিতেই ভোট ডাকাতি, জাল ভোট এবং কেন্দ্র থেকে বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়ার খবর এবং ফটো ছাপা হয়েছে।
একটি ইংরেজী দৈনিক খবর দিচ্ছে, অন্তত ৩০টি কেন্দ্রের ভোট শুরু হওয়ার সময় থেকেই আগে থেকে সিল মারা ব্যালট পেপার ঢোকানো শুরু হয় এবং ভোট শেষ হওয়া পর্যন্ত সেটি চলে। ইংরেজী ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক, সকাল ৮টার আগেই আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা অনেকগুলো কেন্দ্র দখল করে নেয় এবং বিরোধী দলের নেতাকর্মী এবং পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়। বের করে দিয়ে তারা ব্যালট বাক্সে সিল মারতে থাকে এবং সেগুলো ব্যালট বাক্সে ভরতে থাকে। নির্বাচনী কেন্দ্রসমূহে তাদের যাতায়াত ছিল অবাধ ও বাধাহীন। ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয় যে, ভোটের এই কারচুপিতে পুলিশ আওয়ামী কর্মীদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে। এসব অনিয়ম চেপে রাখার জন্য নির্বাচনী অফিসার, পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা গণ মাধ্যমের কর্মীদের অধিকাংশ কেন্দ্রেই প্রবেশ করতে বাধা দেয়। কোন কোন ক্ষেত্রে গণ মাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতেই পুলিশের সহযোগিতায় ব্যালট পেপারে সিল মারা শুরু হয়।
ডেইলি স্টার এর বিশাল রিপোর্টে অনেক কেন্দ্রের ভোট ডাকাতির খুটিনাটি বিবরণ দিয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগের একাধিক মেয়র প্রার্থী কিভাবে বিরোধী দলকে হটিয়ে নিজেরাই ব্যালট বাক্সে জাল ভোট ঢুকিয়েছে সেসব কাহিনীও সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।
ডেইলি স্টারের অপর একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, এই অনিয়ম এবং নির্বাচনে পুকুর চুরির প্রতিবাদে অন্তত ৪৯ জন মেয়র প্রার্থী ভোট শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এবং পুনরায় নির্বাচন দাবি করেছেন। রিপোর্টে এই ৪৯ জন মেয়র প্রার্থীর অনেকের নাম-ধাম দেয়া হয়েছে।
গত ১লা জানুয়ারির দৈনিক ‘মানবজমিনে’ দেখানো হয়েছে যে, কি অস্বাভাবিক পরিমাণে ভোট পড়েছে এই নির্বাচনে। ঐ রিপোর্ট মোতাবেক দেখা যায় যে, ২০৭টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ হারে। ৫টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায়। নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের এ হার অস্বাভাবিক। স্থানীয় নির্বাচনে ভোটের স্বাভাবিক হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মধ্যেই থাকার কথা।
॥দুই॥
নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ভোট পড়েছে রাজশাহীর মোহনপুরে ৯২ দশমিক ১৭ শতাংশ। ৫টি পৌরসভায় ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। জয়পুরহাটের কালাইয়ে ৯২ দশমিক ৪২ শতাংশ, রাজশাহীর মোহনপুরে ৯২ দশমিক ১৭ শতাংশ, কুষ্টিয়ার মিরপুরে ৯০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, বরিশালের উজিরপুরে ৯১ দশমিক ১২ শতাংশ ও নাটোরের নলডাঙায় ৯০ দশমিক ৭৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্প্রতি ইলেকশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ইটিআই) মাগুরা-১ উপনির্বাচন উপলক্ষে ভোটের হার নির্ধারণে একটি পরীক্ষা চালায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, সুষ্ঠুভাবে ভোট হলে একটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হার সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে শুধু একটি মাত্র ব্যালট ব্যবহার হয়। পৌর নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরের জন্য পৃথক ৩টি ব্যালট ব্যবহার করা হয়। পৌর নির্বাচনে ভোটের হার জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে কম হওয়ার কথা। এছাড়া পৌর নির্বাচনে এত পরিমাণ ভোট পড়ার নজির নেই। ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনেও এত পরিমাণ ভোট পড়েনি। ভোট প্রদানের হারের বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন জানিয়েছেন, ৭০ ভাগের বেশি ভোট কাস্ট হওয়া সন্দেহজনক। এছাড়া বেশি ব্যালট হলে সময়ের হিসেবেও ভোট কাস্ট হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। অথচ ধামরাই আইডিয়াল স্কুলের ওই কেন্দ্রে ভোট দেখানো হয়েছে ৯৫ শতাংশ।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মেয়র পদে গড়ে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে এই পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে ৭৪টি পৌরসভায়। আর ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬৩টি পৌরসভায়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে গত বছরের মে মাসে তিন ধাপে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬২ থেকে ৬৪ শতাংশ। তার আগে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ভোটের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। ‘প্রথম আলোর’ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব পৌরসভায় অনিয়ম ও কারচুপি বেশি হয়েছে এবং যেখানে বিএনপির প্রার্থী দুর্বল বা এজেন্ট ছিল না, সেখানেই ভোট পড়ার হার অন্য এলাকার চেয়ে বেশি ছিল।
॥তিন॥
নির্বাচনের নামে ২৩৪ টি পৌরসভায় যে প্রহসনমূলক নাটক মঞ্চস্থ হলো সেটি গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার পরিবর্তে সমগ্র জাতির জন্য সবচেয়ে বড় লজ্জা ও কলঙ্কের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল। একই সাথে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা অবনমিত হলো। গত বুধবার ২৩৪ টি পৌরসভাতে যত অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, কারচুপি এবং সহিংসতা ঘটেছে সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে নির্বাচনের নামে যে তা-ব ঘটেছে তার বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। আমরা এখানে তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো কয়েকটি অপকর্মের কথা তুলে ধরছি। ইংরেজি ‘ডেইলি স্টারের’ মতে, ২৩৪ টি পৌরসভার মধ্যে অন্তত ৮০ টিতে অনিয়ম এবং কারচুপি ঘটেছে। ১৮ টি পৌরসভার ৩৮ টি নির্বাচনী কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। নরসিংদীর মাধবদীর পৌর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। ৩৯ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন এবং নতুন নির্বাচনের দাবি করেছেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় নির্বাচনী সহিংসতায় এক ব্যক্তি (দৈনিক ‘প্রথম আলো’র মতে দুই ব্যক্তি) নিহত হয়েছেন। সারা দেশে নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত এক শত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। গতকাল ‘দৈনিক ইনকিলাবে’র খবর মোতাবেক ধামরাইয়ের খোলা মাঠে ব্যালট পেপার পাওয়া গেছে। নোয়াখালীতে ভোট কেন্দ্র দখল নিয়ে শাসক দল আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলী বিনিময় ঘটেছে। এই গুলী বিনিময়ে ৫ ব্যক্তি গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। টাঙ্গাইলে ব্যালট নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান পলায়ন করেছেন। সৈয়দপুরে অর্থ বিতরণকালে ৪ ব্যক্তি আটক হয়েছে। স্বরূপকাঠির অধিকাংশ ভোট কেন্দ্র ছিল ভোটার শূন্য। সোনারগাঁয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। ওসিসহ ১২ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তারাবোতে মেয়র প্রার্থীর সামনেই জাল ভোট প্রদান করা হয়েছে। লাকসামে অস্ত্রসহ আওয়ামী লীগের ৮ নেতাকে আটক করা হয়েছে। শরীয়তপুর সদরে সব কেন্দ্র দখল করা হয়েছে। এরশাদ পন্থী জাতীয় পার্টির অভিযোগ, ২৫ টি পৌরসভার ১৭৪ টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। দৈনিক ইনকিলাবের খবর মোতাবেক, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর পৌরসভার বাইমহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের আনাগোনা ছিল খুব কম। নির্বাচনী কর্মকর্তা ও এজেন্টরা পার করেছেন অলস সময়। তারপরেও দুপুরের মধ্যেই ৬১ শতাংশ ভোট প্রদত্ত হয়েছে।
দৈনিক প্রথম আলো নওয়াপাড়া পৌরসভার গাজীপুর রওফিয়া কামিল মাদরাসা কেন্দ্র প্রাঙ্গণে ভোট প্রদানের খবর দিচ্ছে এভাবে, “ভোট কক্ষের ভেতর তাকিয়ে দেখা গেল, ব্যালট বক্সের সামনে একজন দাঁড়ানো। ভোটাররা মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের তিনটি ব্যালট পেপার নিয়ে মেয়র প্রার্থীদের ব্যালটে সবার সামনে দাঁড়িয়েই নৌকা প্রতীকে ভোট দিচ্ছেন। বাকি দুই ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন পর্দার আড়ালে গিয়ে। এখানে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সুশান্ত কুমার রায়। একজন ভোটার নৌকায় ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানালে পাশ থেকে একজন বলেন, ‘‘না দিলে খবর আছে। তাড়াতাড়ি ভোট দিয়ে ভাগ।’’ গত শুক্রবার ইংরেজি ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত প্রধান সংবাদে বলা হয়েছে, দেশের অন্তত ৮০ টি পৌরসভায় ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা চরম অনিয়ম এবং ভোট জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে। তখন স্থানীয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগের লোকেরা ইচ্ছেমত ব্যালট পেপারে সিল মারে এবং সেই সব ব্যালট পেপার ব্যালট বক্সে ঢুকিয়ে দেয়। পত্রিকাটির সাংবাদিকদের চোখের সামনেই বিএনপির নির্বাচনী এজেন্টদের আওয়ামী লীগের লোকেরা বের করে দেয়। অনেক নির্বাচনী কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের যুব ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ভোট প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।
এই ছিল বুধবারের প্রহসনমূলক নির্বাচনের সাধারণ চালচিত্র। প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকের ছত্রে ছত্রে এসব কেলেঙ্কারি কাহিনী বিধৃত রয়েছে। পৌর নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় যারা এসব কাণ্ড ঘটালো তারা এসব করে নতুন প্রজন্মকে, বিশেষ করে যারা এবারই নতুন ভোটার হয়েছে, তাদের কি দেখালো এবং কি শেখালো? এইসব তরুণ, যারা ভবিষ্যতে এই জাতির হাল ধরবে, তাদের মনে নির্বাচন সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হলো না। বরং যেটি করা হলো সেটি সম্পূর্ণ নেতিবাচক। তরুণ প্রজন্ম এসব দেখে এবং শুনে একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ, অন্যদিকে তেমনি হতাশ। গত ৩০ ডিসেম্বর বুধবার পৌর নির্বাচনের নামে বাংলাদেশের মতো একটি সংগ্রামী জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আরেকটি কালো অধ্যায় রচিত হলো।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন