ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা চলছে বলে ইদানীং জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের ভেতরে শুধু নয়, আলোচনা চলছে বিদেশেও। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্টে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্রমেই ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে ভিন্নমত প্রকাশের বিষয়টি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বলা বাহুল্য, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোতে থাকা সরকার সাধারণত ‘কর্তৃত্বপরায়ণ’ হয়ে ওঠে। এর প্রমাণ একবার পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭৪-৭৫ সময়কালে, যখন জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন চাপানো হয়েছিল। সে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোরই নাকি চেষ্টা শুরু হয়েছে! প্রসঙ্গক্রমে জানুয়ারি মাস সম্পর্কেও বলা দরকার। কারণ, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে বাকশালী শাসন শুরু হয়েছিল।
সে আলোচনায় যাওয়ার আগে জানুয়ারি মাসেরই অন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি- যাকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৭ সালের এই দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের আড়াল নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সামনে রেখেছিলেন মাঝারি মানের ব্যাংকার ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে। এ দুই উদ্দিনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে জড়িত অন্যজনরা সংবিধান নির্দেশিত সময়ে ও পন্থায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে ক্ষমতা তো দখল করেছিলেনই, তারা বেশি বলেছিলেন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমন ছিল যেন রাজনীতিকরা দেশের শুধু ক্ষতিই করেছেন, ভালো কিছু দেননি। শুনে মনে হয়েছিল যেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা ভালো কাজের বন্যা বইয়ে দেবেন, রাজনীতির ‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে’ও লাইনের ওপর দাঁড় করিয়ে দেবেন!
অন্যদিকে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের সরকার জাতীয় জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটানোর বাইরে কিছুই করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অযৌক্তিক হুকুম চাপানোর মাধ্যমে অনেক ওলট-পালট করার চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। ‘সংস্কার’ ও ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ এবং ‘জাগো বাংলাদেশ’ ধরনের আহামরি অনেক স্লোগান শুনিয়েছেন। ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ‘জাতীয় সনদের’ মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এবং তাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানকে যুক্ত করে দেয়ার মতো সাংবিধানিক কিছু ব্যবস্থার কথাও বলেছিলেন তারা। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই তারা ‘জেলের ভাত’ খাইয়ে গেছেন। ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান দুদককে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের অসম্মানিত করেছেন তারা যথেচ্ছভাবে। ‘উদ্দিন’ সাহেবদের দু’ বছরের মধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। কোনো জিনিসের দামই মানুষের নাগালের কাছাকাছি অসেনি। ওদিকে আয় বাড়া দূরে থাকুক, বহু মানুষকে চাকরি হারাতে হয়েছিল। অসংখ্যজনের ব্যবসা-বাণিজ্য ‘লাটে’ উঠিয়েছিলেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। এর ফলে অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী। ‘উদ্দিন’ সাহেবরা এমন অনেক মৌলিক ও নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ও সেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছিলেনÑ যেগুলো কেয়াটেকার সরকারের এখতিয়ারে পড়ে না। তাদের আমলে ছয় থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত দেশ থেকেছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। এ সময় আইনশৃংখলা পরিস্থিতিতেও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু ‘উদ্দিন’ সাহেবরা কোনো প্রতিকারই করতে পারেননি। তারা পেরেছিলেন শুধু মানুষের বাড়ি ও ভবন ভেঙে ফেলতে এবং হকার উচ্ছেদের নামে মানুষের পেটে লাথি মারতে!
এসব কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে সুকৌশলে ‘উদ্দিন’দের রেহাই দেয়া হয়েছে। এমনকি পাল্টা প্রশ্নের পাশাপাশি ‘স্বাধীন’ আদালতে মামলা করার পরামর্শও দিয়েছিলেন এমন একজন, যার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য নেই ক্ষমতাসীনদের কারো।। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতাসীনদেরই কেউ কেউ এমনকি সাফাই পর্যন্ত গেয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই সাংবাদিকদের কাছে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১/১১-এর জন্য রাজনীতিকরাই দায়ী। আমরা, রাজনীতিকরাই খাল কেটে ‘কুমির’ এনেছিলাম। দেশকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়ে গেলেও ‘কুমির’ নামের ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রতি উদারতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। বলেছিলেন, ‘কুমির’ কী করলো তা নাকি দেখার বিষয় নয়! এখানেই রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের মনের কথাটুকু। কারণ, এ কথা ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রাথমিক দিনগুলোতেই জানাজানি হয়েছিল যে, নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় জোটের সামনে আওয়ামী শিবির দাঁড়াতে পারতো না বলেই লগি-বৈঠার তান্ডব শুরু করা হয়েছিল। এর পর ছিল ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের পালা। অন্য অনেকের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফ নিজেও সে প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সুদূর লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কথাটা বলে গেছেন নওগাঁর আবদুল জলিল- সৈয়দ আশরাফ যাকে ঠ্যালা-ধাক্কা মেরে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর প্রচারণা রয়েছে। ওদিকে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় পার্টনার জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বেশ কিছু উপলক্ষেই জানান দিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে মইন উ ‘সহযোগিতা’ না করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। একই কারণে ক্ষমতা পাওয়ার পর ‘ঋণ’ পরিশোধ করার প্রশ্ন এসেছে। ক্ষমতাসীনরাও সে কারণে ‘কুমির’ নামধারীদের সকল কর্ম-অপকর্মের দায়দায়িত্ব বহন করার ‘সদিচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে একথা বলতেই শুধু বাকি রাখা হয়েছে যে, ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচার তারা করবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারি। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।
বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে অনেক যুক্তিই দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাকশাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল। কারণ, বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি! অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র দুই দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির শোচনীয় পরিণতির উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দু’টি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দু’টিকে নিয়ে শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাকশালের ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বের অবস্থান পাননি এমনকি কমরেড মনি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও। এই দু’জনকেসহ দু’দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে ১৯৭৪ সালের জুন থেকে সন্তোষে গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘সাময়িককালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন।
একথা অবশ্য ঠিক যে, চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্যÑ যেমনটি পরবর্তীকালে করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করেছিল সরকার। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে কফিনে ঢোকানো এবং তার পরিবর্তে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরো একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছিলেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্লাস স্বাভাবিক হলেও মরহুম শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিববিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এমপিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা মরহুম নেতার কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!
এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাকশাল এবং সমাজতন্ত্রের মতো মৌলিক বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে পরিত্যক্ত হয়েছে। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারিকে নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্য করেননি। দিনটিকে সুকৌশলে পার করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বরং একথারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের পদক্ষেপ ছিল গণতন্ত্র বিরোধী এবং চরম ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক। এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তোফায়েল আহমদের মতো নেতা ও এমপিরা- যারা বাকশাল গঠন করার সময় যেমন, তেমনি দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার সময়ও জাতীয় সংসদে উপস্থিত থেকেছেন এবং প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মরহুম নেতার সম্মান বাঁচানোর জন্য এখন তারা অনেক কথাই বলতে চাইতে পারেন, কিন্তু একথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না যে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদের মতো ১৯৭৩-৭৫ সালের প্রথম সংসদে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠতে পারেননি। পারেননি অন্যজনদের জড়িয়ে ধরে নৃত্য করতেও। কারণ, পরিবেশ তখন এত খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্য ব্যয়ে শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারো কোনো উপায় ছিল না।
বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। এবারও নীরবই থেকেছেন তিনি। মাঝে-মধ্যে দু’চারজন নেতাকে অবশ্য খুবই দুর্বল কণ্ঠে বাকশালের পক্ষে কৈফিয়ৎ দিতে বা ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার কসরত করতে দেখা গেছে। কিন্তু কারো পক্ষেই শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়।
এত কিছুর পরও কথা থাকার একটি কারণ হলো, অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। সুতরাং ইতিহাস স্মরণে রাখলে এবং নতুন পর্যায়ে একই ধরনের ভুল পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা না করলে আওয়ামী লীগই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এককালের জনপ্রিয় ও প্রচন্ড ক্ষমতাদর্পী নেতাকে আবারও জনগণের মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসতে কতটা বছর লেগেছে ও লাগছে- সে হিসাবও মাথায় রাখা দরকার।
সে আলোচনায় যাওয়ার আগে জানুয়ারি মাসেরই অন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণ করা যাক। দিনটি ছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি- যাকে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ নামকরণ করা হয়েছে। ২০০৭ সালের এই দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের আড়াল নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) মইন উ আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সামনে রেখেছিলেন মাঝারি মানের ব্যাংকার ড. ফখরুদ্দিন আহমদকে। এ দুই উদ্দিনের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে জড়িত অন্যজনরা সংবিধান নির্দেশিত সময়ে ও পন্থায় অনুষ্ঠেয় নির্বাচন বানচাল করে ক্ষমতা তো দখল করেছিলেনই, তারা বেশি বলেছিলেন রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। ভাবখানা এমন ছিল যেন রাজনীতিকরা দেশের শুধু ক্ষতিই করেছেন, ভালো কিছু দেননি। শুনে মনে হয়েছিল যেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা ভালো কাজের বন্যা বইয়ে দেবেন, রাজনীতির ‘লাইনচ্যুত ট্রেনকে’ও লাইনের ওপর দাঁড় করিয়ে দেবেন!
অন্যদিকে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের সরকার জাতীয় জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সর্বনাশ ঘটানোর বাইরে কিছুই করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অযৌক্তিক হুকুম চাপানোর মাধ্যমে অনেক ওলট-পালট করার চেষ্টা চালিয়েছেন তারা। ‘সংস্কার’ ও ‘নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র’ এবং ‘জাগো বাংলাদেশ’ ধরনের আহামরি অনেক স্লোগান শুনিয়েছেন। ‘জাতীয় ঐকমত্য’ ও ‘জাতীয় সনদের’ মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির এবং তাদের সঙ্গে সেনাপ্রধানকে যুক্ত করে দেয়ার মতো সাংবিধানিক কিছু ব্যবস্থার কথাও বলেছিলেন তারা। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাসহ প্রধান নেতা-নেত্রীদের অনেককেই তারা ‘জেলের ভাত’ খাইয়ে গেছেন। ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান দুদককে দিয়ে মামলার পর মামলা চাপিয়ে নেতা-নেত্রীদের অসম্মানিত করেছেন তারা যথেচ্ছভাবে। ‘উদ্দিন’ সাহেবদের দু’ বছরের মধ্যে ছয় মাসের বেশি সময় দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল। কোনো জিনিসের দামই মানুষের নাগালের কাছাকাছি অসেনি। ওদিকে আয় বাড়া দূরে থাকুক, বহু মানুষকে চাকরি হারাতে হয়েছিল। অসংখ্যজনের ব্যবসা-বাণিজ্য ‘লাটে’ উঠিয়েছিলেন ‘উদ্দিন’ সাহেবরা। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ধারে-কাছে যাওয়ার পরিবর্তে বিনিয়োগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা সৃষ্টির ব্যাপারেই তারা বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। এর ফলে অর্থনীতির সকল সূচক হয়েছিল নিম্নমুখী। ‘উদ্দিন’ সাহেবরা এমন অনেক মৌলিক ও নীতিগত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ও সেসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছিলেনÑ যেগুলো কেয়াটেকার সরকারের এখতিয়ারে পড়ে না। তাদের আমলে ছয় থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত দেশ থেকেছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। এ সময় আইনশৃংখলা পরিস্থিতিতেও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল। কিন্তু ‘উদ্দিন’ সাহেবরা কোনো প্রতিকারই করতে পারেননি। তারা পেরেছিলেন শুধু মানুষের বাড়ি ও ভবন ভেঙে ফেলতে এবং হকার উচ্ছেদের নামে মানুষের পেটে লাথি মারতে!
এসব কারণেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচারের সম্মুখীন করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু প্রতিবারই সরকারের পক্ষ থেকে সুকৌশলে ‘উদ্দিন’দের রেহাই দেয়া হয়েছে। এমনকি পাল্টা প্রশ্নের পাশাপাশি ‘স্বাধীন’ আদালতে মামলা করার পরামর্শও দিয়েছিলেন এমন একজন, যার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য নেই ক্ষমতাসীনদের কারো।। শুধু তা-ই নয়, ক্ষমতাসীনদেরই কেউ কেউ এমনকি সাফাই পর্যন্ত গেয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই সাংবাদিকদের কাছে সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, ১/১১-এর জন্য রাজনীতিকরাই দায়ী। আমরা, রাজনীতিকরাই খাল কেটে ‘কুমির’ এনেছিলাম। দেশকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দিয়ে গেলেও ‘কুমির’ নামের ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রতি উদারতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। বলেছিলেন, ‘কুমির’ কী করলো তা নাকি দেখার বিষয় নয়! এখানেই রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের মনের কথাটুকু। কারণ, এ কথা ‘উদ্দিন’ সাহেবদের প্রাথমিক দিনগুলোতেই জানাজানি হয়েছিল যে, নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বে গঠিত চার দলীয় জোটের সামনে আওয়ামী শিবির দাঁড়াতে পারতো না বলেই লগি-বৈঠার তান্ডব শুরু করা হয়েছিল। এর পর ছিল ‘রোডম্যাপ’ বাস্তবায়নের পালা। অন্য অনেকের সঙ্গে সৈয়দ আশরাফ নিজেও সে প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে সুদূর লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন। কথাটা বলে গেছেন নওগাঁর আবদুল জলিল- সৈয়দ আশরাফ যাকে ঠ্যালা-ধাক্কা মেরে দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর প্রচারণা রয়েছে। ওদিকে আওয়ামী মহাজোটের দ্বিতীয় পার্টনার জেনারেল (অব.) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো বেশ কিছু উপলক্ষেই জানান দিয়েছেন, সেনাবাহিনীকে সামনে রেখে মইন উ ‘সহযোগিতা’ না করলে আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘জীবনেও’ ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। একই কারণে ক্ষমতা পাওয়ার পর ‘ঋণ’ পরিশোধ করার প্রশ্ন এসেছে। ক্ষমতাসীনরাও সে কারণে ‘কুমির’ নামধারীদের সকল কর্ম-অপকর্মের দায়দায়িত্ব বহন করার ‘সদিচ্ছা’ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় সংসদে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে একথা বলতেই শুধু বাকি রাখা হয়েছে যে, ‘উদ্দিন’ সাহেবদের বিচার তারা করবেন না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য একটি ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারি। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনীর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে ছিল এক বিচিত্র অবস্থা। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি একমাত্র দল বাকশাল গঠন করেন। তার নির্দেশে তাকেই চেয়ারম্যান করে বাকশালের ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয় ৬ জুন। সরকার নিয়ন্ত্রিত চারটি দৈনিক ছাড়া দেশের সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ হয়ে যায় ১৬ জুন।
বাকশাল গঠনের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে অনেক যুক্তিই দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শেখ মুজিব নাকি ‘মহৎ উদ্দেশ্য’ নিয়ে ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বাকশাল গঠন করেছিলেন! এ কথাও বলা হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল জাতীয় সংসদে। অন্যদিকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস কিন্তু এসব যুক্তিকে সমর্থন করে না। যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’র যুক্তি দেখানো হয় তার জন্য দায়ী ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বব্যাপী দুর্নীতি, কালোবাজারি ও চোরাচালানসহ প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা, সরকারের রাজনৈতিক নির্যাতন ও হত্যাকান্ড এবং সবশেষে ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। বাকশাল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণেও এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দরকার যখন ছিল ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নতুন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান কিংবা জরুরি ভিত্তিতে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করা, ক্ষমতাদর্পী শেখ মুজিব তখন উল্টো রাজনৈতিক আন্দোলন ও সরকার বিরোধিতার পথ বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে এগিয়েছিলেন বাকশালের একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পথে।
সমগ্র এই প্রক্রিয়া ও কর্মকান্ডের একমাত্র উদ্যোক্তা, নির্দেশদাতা, নিয়ন্ত্রক ও লাভবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ মুজিব। সর্বময় ক্ষমতাও তার হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ বলা হলেও বাকশাল বাস্তবে আওয়ামী লীগেরই নামান্তর মাত্র ছিল। কারণ, বাকশাল বলতে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বোঝানো হয়েছিল, ‘আওয়ামী লীগ’ নামটিকে বাদ দেয়া হয়নি! অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে যদি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র দুই দল ন্যাপ (মোজাফফর) এবং সিপিবির শোচনীয় পরিণতির উল্লেখ করা হয়। স্বাধীনতার পর প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই দল দু’টি সরকারের লেজুড়বৃত্তি করে এসেছে, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে দল দু’টিকে নিয়ে শেখ মুজিব ‘ত্রিদলীয় ঐক্যজোট’ও গঠন করেছিলেন। কিন্তু বাকশালের ১১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেতৃত্বের অবস্থান পাননি এমনকি কমরেড মনি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মতো দলীয় প্রধানরাও। এই দু’জনকেসহ দু’দলের মাত্র ছয়জনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে নেয়া হয়েছিল। তাদের ক্রমিক সংখ্যা ছিল ৭০-এর ঘরে। ওদিকে স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে ১৯৭৪ সালের জুন থেকে সন্তোষে গৃহবন্দী রাখা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ বিরোধী অন্য নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশেও চলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ গঠনের যুক্তিকে রাজনৈতিক অসততা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
‘সাময়িককালের’ জন্য গঠন করা হয়েছিল ধরনের যুক্তিকেও গ্রহণ করা যায় না। কারণ, সে ধরনের কোনো বিধান চতুর্থ সংশোধনীর কোথাও কিংবা বাকশালের গঠনতন্ত্রে ছিল না। গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা-উপধারা বরং প্রমাণ করেছে, রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই বাকশাল গঠন করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন এবং সংসদ সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া থেকে বাকশাল, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতা ছিল শুধু রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের। তিনি এমন একজন চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি ছিলেন, যাকে নির্বাচিত করার কোনো পন্থা বা বিধানেরই উল্লেখ ছিল না বাকশালের গঠনতন্ত্রে। ছিল না সংবিধানেও। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে একথাই ঘোষণা করা হয়েছিল যে, শেখ মুজিব আজীবন রাষ্ট্রপতি এবং বাকশালের চেয়ারম্যান থাকবেন।
একথা অবশ্য ঠিক যে, চতুর্থ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস করা হয়েছিল। কিন্তু অনস্বীকার্য সত্য হলো, ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদের পক্ষ থেকে একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় জনগণকে জানানো হয়নি যে, ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ এত মৌলিক ধরনের ব্যাপক কোনো পরিবর্তন ঘটাবে। সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্যÑ যেমনটি পরবর্তীকালে করেছিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকার। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে শেখ মুজিব প্রবর্তিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি বাতিল করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমে পাস করা সত্ত্বেও এ প্রশ্নে গণভোট আয়োজন করেছিল সরকার। কিন্তু বাকশাল গঠন এবং চতুর্থ সংশোধনী পাস করার সময় শেখ মুজিব এ ধরনের গণতন্ত্রসম্মত চিন্তাই করেননি।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে পঞ্চম সংসদের সেই অধিবেশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যে অধিবেশনে শেখ মুজিবের চতুর্থ সংশোধনীকে কফিনে ঢোকানো এবং তার পরিবর্তে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। দ্বাদশ সংশোধনীর অর্থ প্রকৃতপক্ষে ছিল শেখ মুজিবের আরো একটি মৃত্যু। কিন্তু তারপরও সংসদে উপস্থিত আওয়ামী লীগের এমপিরা আনন্দে উল্লসিত হয়েছিলেন, একজন অন্যজনকে জড়িয়ে ধরে নৃত্য করেছিলেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে এই আনন্দ-উল্লাস স্বাভাবিক হলেও মরহুম শেখ মুজিবের মনোভাব ও চিন্তাধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কিন্তু মানতেই হবে যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো মুজিববিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলিতভাবে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার জন্য আওয়ামী লীগের অন্তত এত বেশি উল্লসিত হওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। কেননা, দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবে শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’কেই প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করা হয়েছিল। অন্যদিকে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ এমপিদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল যেন তারা মরহুম নেতার কোনো চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন!
এটা তাদের পরাজয় বরণ করে নেয়ার গণতন্ত্রসম্মত কৌশল হতে পারে। কিন্তু এভাবেই তারা একের পর এক মরহুম নেতার ‘কীর্তি’ ও চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান ও বাতিল করে এসেছেন। এই প্রক্রিয়ায় বাকশাল এবং সমাজতন্ত্রের মতো মৌলিক বিষয়গুলো পর্যায়ক্রমে পরিত্যক্ত হয়েছে। শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু বাকশাল প্রতিষ্ঠার ‘ঐতিহাসিক’ দিন ২৫ জানুয়ারিকে নিয়ে সামান্য উচ্চবাচ্য করেননি। দিনটিকে সুকৌশলে পার করে দেয়ার মধ্য দিয়ে বরং একথারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে, বাকশাল গঠনের পদক্ষেপ ছিল গণতন্ত্র বিরোধী এবং চরম ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক। এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন সাজেদা চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও তোফায়েল আহমদের মতো নেতা ও এমপিরা- যারা বাকশাল গঠন করার সময় যেমন, তেমনি দ্বাদশ সংশোধনী পাস করার সময়ও জাতীয় সংসদে উপস্থিত থেকেছেন এবং প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মরহুম নেতার সম্মান বাঁচানোর জন্য এখন তারা অনেক কথাই বলতে চাইতে পারেন, কিন্তু একথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবেন না যে, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদের মতো ১৯৭৩-৭৫ সালের প্রথম সংসদে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠতে পারেননি। পারেননি অন্যজনদের জড়িয়ে ধরে নৃত্য করতেও। কারণ, পরিবেশ তখন এত খোলামেলা ছিল না। পরিস্থিতি বরং ছিল বিশেষ রকমের এবং বদ্ধ ওই সংসদে বিনা বাক্য ব্যয়ে শেখ মুজিবের হুকুম পালন করা ছাড়া কারো কোনো উপায় ছিল না।
বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত ভুল ও অন্যায় ছিল বলেই মুজিব-উত্তর কোনো বছর ২৫ জানুয়ারির মতো ‘ঐতিহাসিক’ একটি দিবসকে আওয়ামী লীগ কখনো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও সম্মানের সঙ্গে পালন বা উদযাপন করেনি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলো দিনটিকে ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দিনটিকে পার করেছে নীরবে। দিনটির স্মরণে দলটি প্রকাশ্যে কখনো কোনো অনুষ্ঠান করেনি, এমনকি শেখ হাসিনার মতো নেত্রী কোনো বছর একটি বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। এবারও নীরবই থেকেছেন তিনি। মাঝে-মধ্যে দু’চারজন নেতাকে অবশ্য খুবই দুর্বল কণ্ঠে বাকশালের পক্ষে কৈফিয়ৎ দিতে বা ‘জাতীয় প্ল্যাটফর্ম’ ধরনের যুক্তি তুলে ধরার কসরত করতে দেখা গেছে। কিন্তু কারো পক্ষেই শেখ মুজিবের সর্বশেষ ‘কীর্তি’ বাকশালকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা সম্ভব হয়নি। এটা আসলে হওয়ারও কথা নয়।
এত কিছুর পরও কথা থাকার একটি কারণ হলো, অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৩ সালে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই তিনি সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। ওই সংসদেই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো হয়েছিল। সেটা টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। এখনো সে টানাটানির শেষ হয়নি। সুতরাং ইতিহাস স্মরণে রাখলে এবং নতুন পর্যায়ে একই ধরনের ভুল পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা না করলে আওয়ামী লীগই কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো এককালের জনপ্রিয় ও প্রচন্ড ক্ষমতাদর্পী নেতাকে আবারও জনগণের মোটামুটি কাছাকাছি নিয়ে আসতে কতটা বছর লেগেছে ও লাগছে- সে হিসাবও মাথায় রাখা দরকার।
আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন