শুক্রবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১৬

জুমার খুতবায় রাজনৈতিক বক্তব্যে নিষেধাজ্ঞা হিতে বিপরীত হতে পারে


ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, জুমার খুতবায় রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অবশ্য রাজনৈতিক বক্তব্যের সংজ্ঞা তারা নির্ধারণ করে দেননি। রাজনৈতিক বক্তব্য কাকে বলা হয় তা নির্ধারণ না করে শুধু রাজনৈতিক বক্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিলে বিরাট একটি সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। কারণ নিষেধাজ্ঞা যারা জারি করছেন এবং যাদের উপর জারি করছেন তারা সবাই খুব ভালভাবেই জানেন যে এখানে ইসলামী রাজনীতির কথাই বুঝানো হচ্ছে। ইসলামী রাজনীতির কথা ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কেউ কখনো মসজিদে রাজনীতির কথা বলেননি এবং তা মসজিদে বলার অনুমতিও ইসলাম দেয় না। এবং ইসলামী রাজনীতির কথা মসজিদে বলা হয় এবং সেটা বলার অনুমতিও ইসলামে আছে। আর সেটাই বন্ধ করার জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি চালু আছে, যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইসলামী রাজনীতি। অন্য কথায় বলতে গেলে, কেউ তাদের জীবনে আব্রাহাম লিঙ্কন এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে, আর কেউ লেনিন, মাওসেতুং এর আদর্শ বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে, আবার কেউ রাসূল সঃ এর দর্শন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক বক্তব্য বলতে যদি লেনিন, মাওসেতুং বা আব্রাহাম লিঙ্কন এর রাজনীতি বুঝানো হয়, তাহলে এই রাজনৈতিক বক্তব্য মসজিদে দেয়া যাবে না। এতে কোনো মুসলমানের দ্বিমত নাই, থাকতে পারে না। আর যদি রাজনৈতিক বক্তব্য বলতে ইসলামী রাজনীতি বুঝানো হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়াবে রাসূল সঃ এর আদর্শ নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করার কথা মসজিদে বলা যাবে না। এখানে মুসলমানদের ঘোর আপত্তি আছে এবং থাকবে। কারণ মসজিদ মুসলমানদের জন্য আল্লাহর ইবাদাত করার স্থান। আর রাসূল সঃ এর আদর্শ মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার নামই হচ্ছে ইসলাম। এবং রাসূল সঃ যেমন নামাজ রোজা করেছেন ও এর নিয়ম কানুন আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি বিচার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনাও তিনি করেছেন এবং এর সমস্ত নিয়ম-কানুনও তিনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। আর রাসূল সঃ এর আদর্শ সমস্ত মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার আদেশ আল্লাহ্ কুরআন মজিদে দিয়েছেন। হুজুর সঃ এর জীবনের সিংহভাগই রাজনীতি। হুজুর সঃ এর আদর্শ মুসলমানদের জীবনে বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেয়াকে রাজনীতি বলা হোক বা ওয়াজ নসিহত বলা হোক, এটাকে নিষেধ করা যেতে পারে না। এটাকে নিষেধ করার অর্থ হলো পুরো ইসলাম ধর্মকেই নিষিদ্ধ করে দেয়া। এটা কোনো মুসলমান মানতে পারে না। আর ইসলামী রাজনীতির কথা মসজিদে বলা যাবে না বলে যারা ঘোষণা দেবে এবং বিশ্বাস করবে যে ইসলামের মধ্যে রাজনীতি নাই বা ইসলামী রাজনীতি অস্বীকার করবে, তারা পক্ষান্তরে পুরো কুরআনকেই অস্বীকার করল। কারণ কুরআনে যেমন নামায রোজার কথা বলা হয়েছে, তেমন বিচার ব্যবস্থা ও দেশ পরিচালনার কথাও বলা হয়েছে। ইসলাম শুধুমাত্র নামায রোজার মতো কিছু নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম নয়। ইসলাম ধর্ম হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো মানবজাতির জন্য জীবনবিধান। আর ইসলামে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদাত পালন করে বাকি অংশকে অস্বীকার করার সুযোগ নাই। তবে ইসলামের সমস্ত বিধানকে স্বীকার করে তার সবটুকু পালন করতে না পারলেও আল্লাহর কাছে তওবা করার একটা সুযোগ থাকে। কিন্তু ইসলামের কিছু অংশকে অস্বীকার করলে সে আর মুসলমানই থাকে না। যেমন কেউ যদি বলে যে, ইসলাম ধর্ম আমি পালন করব, তবে কুরআনের যে সমস্ত আয়াতে রাজনীতির কথা বলা হয়েছে তা আমি মানব না বা স্বীকার করব না, এমনকি সেইসব বিধান যারা পালন করবে তাদেরকে আমি বাধা দেব- তাহলে সবাই জানে যে সে মুসলমান হতে পারবে না। অর্থাৎ তার ঈমান থাকবে না। আবার কেউ যদি বলে যে, ইসলামে নামায রোজা যেমন আছে সেরকম রাজনীতিও আছে। তবে আমি নামায রোজাতে অবহেলা করলে যেমন আল্লাহর কাছে লজ্জিত হই, সে রকম ইসলামী রাজনীতি করতে না পারার কারণেও আমি আল্লাহর কাছে লজ্জিত। তাহলে সে গোনাহগার হলেও মুসলমান। তার ঈমান নষ্ট হবে না।
একইভাবে আবার নামায রোজাতে বাধা দিলে যেমন ঈমান নষ্ট হয়ে যায়, সেরকম ইসলামী রাজনীতিতে বাধা দিলেও ঈমান নষ্ট হয়ে যায়। কারণ ইসলামে নামায রোজা যেমন ইবাদত, তেমনি ইসলামে ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী বিধিবিধান বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করাও ইবাদত। এখানে একটা পালন করার অনুমতি দিয়ে অন্যটাকে বাধা দেয়া মানেই ইসলামকে অস্বীকার করা। কেউ ইসলামকে অস্বীকার করলে সে আর মুসলমান থাকে না। আল্লাহ্ বলেন- অর্থাৎ, “তবে কি তোমরা (আল্লাহর প্রেরিত) গ্রন্থটির কিয়দংশ বিশ্বাস কর এবং কিয়দংশ অবিশ্বাস কর? যারা এরূপ করে পার্থিব জীবনে দুর্গতি ছাড়া তাদের আর কোনই পথ নেই। কিয়ামতের দিন তাদের কঠোরতম শাস্তির দিকে পৌঁছে দেয়া হবে। আল্লাহ তোমাদের কাজ-কর্ম সম্পর্কে বেখবর নন।” (সূরা বাকারা, ৮৫)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- অর্থাৎ, “হে ইমানদারগণ তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর না। নিশ্চিতরূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” (সূরা বাকারা, ২০৮)।
কুরআনের আয়াত থেকে বুঝা যায়, কিছু বিষয়ে ইসলাম পালন করা আর কিছু বিষয়ে পালন না করার অনুমতি আল্লাহ তায়ালা মানুষকে দেননি। ইসলামী রাজনীতি করা যাবে না শুধু নামায রোজা করা যাবে- এরকম বলার অর্থ দাঁড়ায় ইসলাম পরিপূর্ণভাবে মানা যাবে না। তবে খণ্ডিতভাবে মানা যাবে। আর আল্লাহ্ বলছেন ইসলাম পরিপূর্ণভাবেই মানতে হবে। তাহলে যারা বলছেন মসজিদে ইসলামী রাজনীতি করা যাবে না, তারা তো বলতে গেলে এক প্রকার আল্লাহর সাথে যুদ্ধই ঘোষণা করে ফেলেন।
কেউ হয়ত বলতে পারেন যে, মসজিদে রাজনৈতিক কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে, ইসলামী রাজনীতি বলে কথা নাই, সব ধরনের রাজনীতির কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি যে, সব ধরনের রাজনীতি বন্ধ করলে ইসলামী রাজনীতিও বন্ধ হয়ে যায়। তা ছাড়া মসজিদে কেউ লেনিনবাদ আর সমাজতন্ত্রের কথা বলে না। বলে শুধু ইসলামী রাজনীতির কথা। সেটাই বন্ধ করার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইসলামী রাজনীতি শুধু মসজিদে নয়, সভা-সেমিনারেও বন্ধ করার জন্য নজরদারির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, ইসলামী রাজনীতি বন্ধ করার জন্যই এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যে ইসলামে রাজনীতি নাই সেরকম ইসলাম পালন করতে পারবেন আর যে ইসলামে রাজনীতি আছে সেরকম ইসলাম পালন করা যাবে না- এটাই তারা বলতে চাচ্ছেন। তো আল্লাহ্ যে ইসলাম আমাদের জন্য দিয়েছেন সেটাতে তো রাজনীতি আর ইসলাম একটার সাথে একটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা রাজনীতিমুক্ত ইসলাম পাব কোথায়?
কয়েক বছর আগে আদালত থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ। এ রায় শুনে  সারা দেশের মুসলমানগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সারা দেশ উত্তাল হয়ে পড়েছিল এই রায়ের বিরুদ্ধে। বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে তারা, কিন্তু আন্দোলন থেকে সরে আসেনি। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়েছিল এই কথা বলতে যে ফতোয়া বৈধ।
আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
খন্দকার মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads