বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

ব্রিটেনের উদ্বেগ ও পরামর্শ


পুলিশ তথা আইন-শৃংখলা বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লংঘনের অব্যাহত ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ঢাকায় নবনিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেক। গত বুধবার নিজের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ব্রিটিশ হাইকমিশনার বিশেষ করে সরকারের প্রতি সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি তারা অব্যাহতভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং করতে থাকবেন। সতর্ক করতে গিয়ে এলিসন ব্লেক আরো বলেছেন, তার দেশ কোনো দেশের এমন কোনো সংস্থা বা বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করে না, যারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। সংবাদ সম্মেলনে দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচন প্রসঙ্গেও স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। বলেছেন, ব্রিটেন সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চায়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক অতীতে নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে ব্রিটেনের যে উদ্বেগ ছিল সেটা গোপন করার কিছু নেই। কারণ, এসব নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটার জনগণ ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্রে সব দল ও সব ভোটারের অংশগ্রহণ থাকা উচিত। কেন না, এটাই একটি দেশের জন্য সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আনে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সব পর্যায়ের সব নির্বাচনে সব পক্ষের অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে ব্রিটেনের সহায়তা থাকবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন দেশটির হাইকমিশনার। 
আমরা ব্রিটিশ হাইকমিশনার এলিসন ব্লেকের প্রতিটি বক্তব্যকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। পুলিশ এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টিকে সামনে আনা হলে স্মরণ করতেই হবে যে, শুধু ব্রিটেন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডাসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পুলিশের বাড়াবাড়ির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা হত্যাকাণ্ড ও দমন-নির্যাতন বন্ধ করার এবং পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে। মূলত সে কারণেই ব্রিটিশ হাইকমিশনারের এ সংক্রান্ত বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্য দিয়ে পুলিশের বাড়াবাড়ি সম্পর্কে শুধু নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতি-মনোভাব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়ার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে। পরিষ্কার হয়েছে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি পুলিশ রাষ্ট্র হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের জন্য অসম্মানজনক হলেও ব্রিটিশ হাইকমিশনার বা অন্য কারো সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সে সুযোগ সরকারই রাখেনি। কারণ, বর্তমান সরকারের প্রাথমিক দিনগুলো থেকেই পুলিশকে দিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর প্রচণ্ড দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে। ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দুই দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ প্রকৃত বিরোধী কোনো দলকেই সামান্য ছাড় দিচ্ছে না সরকার। এ সংক্রান্ত উদাহরণের সংখ্যাও এত বেশি যে, সেগুলো সম্পর্কে পৃথকভাবে উল্লেখের দরকার পড়ে না। সরকারের প্রশ্রয়ে থাকায় এবং কোনো অপরাধের বিচার না হওয়ায় পুলিশ শুধু বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি, অনেক ব্যক্তির ওপরও হামলা ও নির্যাতন চালাতে শুরু করেছে। 
নবাগত ব্রিটিশ হাইকমিশনার আসলে সেসব ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছেন, তার দেশ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে এবং পর্যবেক্ষণ করতে থাকবে। এ প্রসঙ্গে তার হুশিয়ারিও লক্ষ্য করা দরকার। কারণ, তিনি বলেছেন, তার দেশ কোনো দেশের এমন কোনো সংস্থা বা বাহিনীকে সাহায্য-সহযোগিতা করে না, যারা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। উল্লেখ্য, পুলিশ ও র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর জন্য ব্রিটেন অর্থনৈতিক এবং প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসহ নানা ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে। এই সাহায্যের পরিমাণ ইতিমধ্যেই অনেক কমে এসেছে। পুলিশের লাগাম না টেনে ধরা হলে ভবিষ্যতে হয়তো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। সে কথাটাই জানিয়ে কিছুটা ঘুরিয়ে দিয়েছেন হাইকমিশনার এলিসন ব্লেক। 
দেশের রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচন প্রসঙ্গেও তার বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন এবং একথা সত্যও যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনকে ব্রিটেন আদৌ ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন সম্পর্কেও একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তিনি। এই প্রতিক্রিয়াকে দেশটি যে গোপন রাখেনি বা রাখছে না সে কথাটাও জানিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ হাইকমিশনার। তিনি সেই সাথে সব দল ও পক্ষের অংশগ্রহণে এমন নির্বাচন অনুষ্ঠান করার তাগিদ ও পরামর্শ দিয়েছেন, যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত। এ লক্ষ্যে সরকার এবং সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, যাতে নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হয় এবং সব দল যাতে সে নির্বাচনে বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এলিসন ব্লেকের বক্তব্যের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা নেই। তার দেশ চায়, বাংলাদেশে অচিরেই সকলের অংশগ্রহণমূলক নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। 
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত অবিলম্বে অবস্থানে পরিবর্তন ঘটানো এবং বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপ শুরু করা। বেগম খালেদা জিয়া অনেক আগেই একাধিক উপলক্ষে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে সমাধান দিয়ে রাখায় সংলাপের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এখন দরকার আসলে ক্ষমতাসীনদের সদিচ্ছার। আমরা আশা করতে চাই, ব্রিটিশ হাইকমিশনারের মূল কথাগুলো অনুধাবনে ক্ষমতাসীনরা কোনো ভুল করবেন না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads