রিপাবলিক অর্থে প্রজাতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আছে। রাজতন্ত্র শেষ, এখন প্রজার বা নাগরিকের তন্ত্র চলবে, এটাই প্রজাতন্ত্রের মর্মকথা। আধুনিক কালের স্বাধীন দেশের এ ঘোষণা মূল্য অপরিসীম। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি দেশই প্রজা অর্থে নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইনের দ্বারা, নৈতিক বিবেচনায় এবং প্রকাশ্য উচ্চারণে নাগরিকগণের জয় ঘোষণা করাই গণতান্ত্রিক, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। নাগরিক অধিকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দেয়াই বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
কিন্তু সকল দেশে নাগরিক অধিকার সমান নয়। সকল দেশ নাগরিকদের সকল ধরনের সুবিধা দিতে পারে নি। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিক অধিকার যতটুকু সমুন্নত রয়েছে, অনুন্নত দেশে ততটুকু নয়। কোথাও নাগরিক নিগ্রহের চিত্র ভয়াবহ। উদাহরণ বাড়ানোর দরকার হয় না। সকলের সামনে নানারূপ আতঙ্কের চিত্র বিদ্যমান। নাগরিক অর্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উপযুক্ত সেবা, নিরাপত্তা ও সম্মানজনক অধিকার পাওয়া এখনো বিভিন্নভাবে দুরূহ। বরং নাগরিক অধিকারের নানা রকম পদদলনের চিত্রই দেখা যায়। সাম্প্রতিক পত্র-পত্রিকায় বিষয়গুলো উপস্থাপিতও হচ্ছে। এতে সামগ্রিক মানবাধিকারে ধস নামার আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে আইনের ন্যায্য প্রয়োগের ক্ষেত্রটিও সঙ্কুচিত হয়ে আসার ভয় থাকছে। এই পরিস্থিতি তাত্ত্বিকভাবে হলেও, বহুদলীয় ব্যবস্থা, নিয়মিত নির্বাচন, বিবিধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, বিশেষত বহুস্বর সংবাদমাধ্যমের মুক্ত পরিসরে আঘাত হানবে। গণতন্ত্রের সৌধ, প্রজাতন্ত্রের গৌরব, শাসনের সুকৃতিকেও ম্লান করবে। অতএব, প্রজা বা নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বসময়েই চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের ভাবিত করেছে; নাগরিক অর্থে জনগণকে ভরসায় ও নিরাপত্তায় রাখার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বও পেয়েছে এ কারণেই।
তাত্ত্বিক ক্ষেত্র থেকে বাস্তবে চোখ রাখলে, কিংবা নেতৃবর্গকে দেখলে বা তাদের আচরণ পর্যবেক্ষণ করলে নাগরিক অধিকারের বিষয়ে সংশয় গভীর হওয়ার কারণ ঘটে। ভাবার দরকার হয় যে, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নেতৃবর্গ কি সত্যই মনে করেন যে, নাগরিকরাই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী? আর তাঁরা জনপ্রতিনিধি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরূপে সেই ক্ষমতার অছি বা প্রতিনিধি মাত্র? সেই বোধ সংশ্লিষ্টদের কথায়, কাজে, বিশ্বাসে, আচরণে, অন্তরে থাকলে প্রতি মুহূর্তে নাগরিকদের উপর দাপট দেখানোর এতো উদাহরণ সৃষ্টি হতে পারতো না। দাপট যখন সাধারণ মানুষের উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপদ্রব ও অত্যাচারের শামিল হয়, তখন তা নিয়ে কথা হয়, মিডিয়া ও নানা আলোচনায় কিছু সমালোচনাও হয়, ক্ষমতাবানরা অন্তর হতে না হউক, লোকলজ্জায় দুঃখ প্রকাশ করেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনরায় ভোট-প্রাপ্তির ভয় না থাকলে মৌখিক ক্ষমা চাওয়ারও প্রয়োজন হয় না। উল্টা নাগরিক নিপীড়নকেই নানা বাহানায় জায়েজ করা হয়। এতে প্রজাতান্ত্রিকতার বদলে রাজতান্ত্রিকতারই যে উৎকট প্রকাশ ঘটে, সে খেয়ালও রাখার তোয়াক্কা করা হয় না। গণতন্ত্রের সঙ্গে, প্রজাতান্ত্রিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈসাদৃশ্যপূর্ণ আচরণ হর-হামেশাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতি উগ্রতার লক্ষণবাহী এবং নাগরিক বা প্রজা পালনের প্রতিষ্ঠিত শিষ্টতার সঙ্গে বেমানান এবং সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এ কারণেই শাসনের মর্মসত্য ও প্রকৃত তাৎপর্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়; শাসনের রূপ-চরিত্র উপলব্ধির জন্যও অপেক্ষার দরকার হয়। সেই অপেক্ষা যদি ভয়াবহতায় হাবুডুবু খেতে থাকে, তাহলে নাগরিক সংস্কৃতিতে বেদনার কালো ছায়াপাত অবশ্যম্ভাবী। তখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সত্য এবং ন্যায়ের অবস্থান কোথায়? শুধু বিচারালয়ের রায়ে? নেতার বক্তৃতায়? সুবচনে? আশ্বাসে? হুমকিতে? ধমকিতে? না। তা মোটেও নয়। বস্তুত আইন এবং বিচার এবং প্রশাসন যেখানে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে, সেখানে অনাচারের আশঙ্কা কম। ক্ষমতার বৃত্ত যখন আইন, বিচার ও শাসন ইত্যাদি নানা শাখায় সুসামঞ্জস্য ও ভারসাম্যপূর্ণ থাকে, তখনই নাগরিকগণ গণতন্ত্রের স্বাদ লাভ করেন; নিজেদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রটিকে চাক্ষুষ দেখতে পান। কিন্তু যখন সকল ক্ষমতা এক হাতে বা এক স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়, তখনই আসে গলদ। এককেন্দ্রীক ক্ষমতার প্রবাহ বহুমাত্রিক সুশাসনের সামনে কালাপাহাড়ের বিঘœ ছাড়া আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের দ্বারা শিষ্টের উদ্দেশে দুষ্টের হুমকি প্রবৃত্তিগত ভাবে স্বাভাবিক হতে পারে, তাকে দমিয়ে রাখার কাজ বর্তায় কিন্তু ক্ষমতার বলয়ে অধিষ্ঠিত সকলের উপরই। এখানে ফাঁক তৈরি হলে দুষ্টরাই শিষ্টের বারোটা বাজাতে পারে। নাগরিকদের নানাভাবে হেনস্তা করতে পারে। পারে নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করতে।
অতএব, রাষ্ট্র এবং নাগরিকের অলিখিত সম্পর্ক হলো, নাগরিক সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে রাষ্ট্রের প্রতি। বিনিময়ে রাষ্ট্র নাগরিককে দেবে সার্বিক স্বাভাবিক নিরাপত্তার বলয়। নানা প্রজাতির দুষ্ট যদি আকাশে আতঙ্ক এবং সংশয়ের মেঘকে ঘনিয়ে তুলতে সক্ষম হয়, তখন সেটাকে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, দমনের দায়িত্ব নিতে হয়। এই জরুরি দায়িত্বে শৈথিল্য দেখা গেলেই দুষ্টতন্ত্র বহাল হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে দুষ্টামী, উৎপীড়ন, অত্যাচার ইত্যাদি কুকর্মকেই নিয়মে পরিণত করে। যদিও এরূপ পরিস্থিতি কাম্য নয়, তথাপি গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে বা প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেও আগাছার মতো এই দুষ্টচক্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। সেই আগাছাই এক সময় গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের বারোটা বাজায়। অতএব, কর্তাব্যক্তিবর্গ যদি অনিয়ম ও আগাছা সম্পর্কে সতর্ক না হোন তাহলে বিপদ। আর কখনো যদি বিশেষ কোনো কারণে উচ্চতর স্তর হতে সুযোগ ও পক্ষপাত এইসব কুপক্ষকে দেখানো হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠতে বাধ্য; নাগরিকগণ এদের পীড়নে অতিষ্ঠ হবেই।
প্রায়োগিক অর্থে, শিল্পবাণিজ্যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক পরিসরে, সমাজে, রাজনীতিতে, তথা সর্বত্র শাসনের দীর্ঘ বাহু নানা ব্যক্তি ও প্রশাসনের দ্বারা প্রসারিত। বাধ্য করার নামে বা অধীনস্থ করার কুপরিকল্পনায় বজ্রমুষ্টিতে নিয়ন্ত্রণের রশি ধরে রাখার অপতৎপরতায় যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অগ্রণী হয়, তারা সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাগামছাড়া হয়ে যায় এবং সেই ঝাপ্টা সাধারণের ওপর ঝড়ের বেগে প্রবাহিত হয় এবং নাগরিক অধিকারকে ন্যূব্জ করে। মূলত মুষ্টি যখন অতিপ্রবল হয়, তখন দাপটের অতি ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে। এমন উদাহরণ দুর্লভ্য নয় মোটেই। কখনো এইসব বাড়াবাড়ির বিপক্ষে শোরগোল ওঠে, নিন্দা-সমালোচনার ঝড় ওঠে বটে। কিন্তু শীর্ষ যখন অকারণ-অপ্রয়োজনীয়-অনৈতিক হস্তক্ষেপের যে নীতি এবং রীতি তাকে নিজস্ব শক্তির উৎস রূপে ‘স্বাভাবিক’ বলে গণ্য করে বা স্বীকৃতি দেয়, তখন সেটার অবসান না হলে ব্যাধি সারবে না; প্রজাতন্ত্র সঠিক অর্থে নাগরিকতন্ত্র হয়ে উঠবে না। বিশ্বব্যাপী ভঙ্গুর, অ-অংশগ্রহণমূলক, অ-স্বীকৃত গণতন্ত্রের অধীনে নাগরিকতন্ত্র ও মানবাধিকারের যে শনির দশা চলছে, সেটা অতিক্রম করতে না পারলে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র-এর পক্ষে যথাযথ অর্থে বিকশিত বা কার্যকর হওয়া দুঃসাধ্য। উন্নয়নের দামামা বাজিয়েও এসব অসম্পূর্ণতাকে চাপা দেয়া অসম্ভব। কারণ, সব কিছুর আগে মানুষের অধিকার, স্বার্থ, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নটি এসে যাবেই। তাত্ত্বিক অসঙ্গতিতে আক্রান্ত কাজ-কর্মের দ্বারা প্রায়োগিক সফলতা আসতে পারে না, এ কথাটিও বুঝতে হবে। বিশ্ববিশ্রুত বিদগ্ধ পণ্ডিতদেরও একই অভিমত।
তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো এদেশেও যে মানুষ ভাবছে না, তা নয়। সঙ্কটের উদাহরণ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকেই দেয়া সম্ভব। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলেই নানা নিরাপত্তার ঘাটতিজনিত চিত্র দেখা যায়; ভয়াবহ খবর পাওয়া যায়। কে কারে মেরেছে, কে কাকে ধরে নিয়েছে, কে কাকে শাসাচ্ছে, ইত্যাদির সঙ্গে রয়েছে রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার বিচিত্র কাহিনী। তাই, গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, নাগরিকতন্ত্র সম্পর্কে তত্ত্ব আর বাস্তবের আলোকে বার বার ভাবনা-চিন্তা করতে হয়। কি হওয়ার কথা আর কি হচ্ছে, এই সমীকরণ যত তাড়াতাড়ি মেলানো যাবে, তত তাড়াতাড়িই সঙ্কট মুছে যাবে। নাগরিক স্বার্থ ও নিরাপত্তার কথা বলবো কিন্তু নাগরিক দায়িত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হবো না কিংবা অধিকার প্রয়োগ করবো না; তাহলে তো সমস্যা সুরাহা হবে না! সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সেটা সবাইকে মিলে-মিশেই করতে হবে।