ডাক, তার ও টেলিফোন এবং তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী এখনো কি মন্ত্রী আছেন? ১০ অক্টোবর শুক্রবার এই লেখাটি লিখছি। তখনও কি তিনি মন্ত্রী আছেন? কেউ কেউ বলবেন, না, তিনি মন্ত্রী নেই। কেউ কেউ বলবেন, এখনো অর্থাৎ ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী আছেন। আজ ১২ অক্টোবর রোববার আওয়ামী লীগের কার্য নির্বাহী পরিষদের বৈঠক হচ্ছে। একটি মহলের মতে, এই বৈঠকেই নির্ধারিত হবে লতিফ সিদ্দিকীর ভাগ্য। ধারণা করা হচ্ছে যে, এই বৈঠকে লতিফ সিদ্দিকীকে মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগ থেকে বাদ দেয়ার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এই সিদ্ধান্ত লতিফ সিদ্দিকীকে জানানো হলে তিনি পদত্যাগ করবেন এবং তিনি মন্ত্রিসভা এবং আওয়ামী লীগ থেকে খারিজ হয়ে যাবেন। তাহলে ধরে নেয়া যায়, লতিফ সিদ্দিকী ১২ তারিখ পর্যন্ত মন্ত্রী থাকলেন।
এই মন্ত্রীকে সরানো হবে, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও সিদ্ধান্তটি এতদিন ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? মন্ত্রীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তিনি এই ১০-১২ দিন ভোগ করলেন কেন? আসলে তাকে ভোগ করতে দেয়া হলো কেন?
নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী যে আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন করেন সেখানে তিনি বুঝালেন যে, কোনো একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে গেলেই সংবিধান মোতাবেক কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হজ্বে গিয়েছেন। তিনি হজ্ব থেকে না ফিরলে লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। অন্যরা বলেন যে, লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ নিয়ে অযথা সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আজ ১২ দিনের বেশি হয়ে গেল, কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। অথচ এত লম্বা সময় তো লাগার কথা নয়। সেজন্যই বিরোধী দলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ধূম্রজাল সৃষ্টি করছেন। ব্যাপারটির একটি সহজ-সরল সমাধান ছিল। সেটি হতে পারতো নিম্নরূপ :
যেদিন লতিফ সিদ্দিকীর ধর্মদ্রোহী বা ব্লাসফেমাস বক্তব্য ছাপা হলো সেদিনই প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিতে পারতেন। তখন প্রধানমন্ত্রী এবং লতিফ সিদ্দিকী দু’জনই নিউইয়র্কে ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকী কিন্তু বিবিসিকে বলেছেন যে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাকে যে নির্দেশ দিবেন সেই নির্দেশই তিনি পালন করবেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন তাহলে তিনি সেটিও করবেন, অর্থাৎ তিনি বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। আর যদি পদত্যাগের নির্দেশ দেন তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এটি ছিল সবচেয়ে সহজ সমাধান। সংবিধানে বলা হয়েছে যে, যে মুহূর্তে কোনো একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করবেন সেই মুহূর্ত থেকে তার পদত্যাগ কার্যকর হবে। সেখানে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সেই পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তবে যদি ঐ মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাকে বরখাস্ত বা অপসারণ করবেন এবং সেই অপসারণ বা বরখাস্ত যেদিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক গৃহীত হবে সেদিন থেকে তিনি আর মন্ত্রী থাকবেন না।
আলোচ্য ক্ষেত্রে এরকম কোনো কথা শোনা যায়নি যে লতিফ সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর কথার অবাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগ না করলে তো তাকে দেশে ফিরে আসতে হবে এবং দেশে ফিরে এসে মন্ত্রিত্ব চালাতে হবে। এক্ষেত্রে তো সেই প্রশ্নই আসে না। লতিফ সিদ্দিকী তো আর দেশে ফিরে আসছেন না। তিনি ইতোমধ্যেই কানাডা চলে গেছেন। সেখানে তার বড় মেয়ে বা এই ধরনের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় থাকেন। তিনি নাকি ইতোমধ্যেই কানাডা গিয়েছেন এবং কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে কানাডা সরকারের নিকট তিনি যে দরখাস্ত পেশ করেছেন সেটি নাকি শুনানির জন্য গৃহীত হয়েছে। এমন একটি ক্ষেত্রে তার নিকট থেকে পদত্যাগপত্র চাইলে তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি দিয়ে দিতেন এবং সেই মুহূর্ত থেকেই সেটি কার্যকর হতো। অর্থাৎ সেদিন থেকেই তিনি আর মন্ত্রী থাকতেন না।
কিন্তু এগুলো কিছুই না করে একটি লম্বা প্রক্রিয়া ফলো করা হয়। এভাবে ২ সপ্তাহ অযথা সময় ক্ষেপণ করা হলো। অথচ সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
৫৮। (১) প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি-
(ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন;
(গ) এই অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি অনুরূপ নির্দেশ দান করেন; অথবা
(ঘ) এই অনুচ্ছেদের (৪) দফায় যেরূপ বিধান করা হইয়াছে তাহা কার্যকর হয়।
(২) প্রধানমন্ত্রী যে কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।
দুই
যাই হোক, ধরে নেয়া হচ্ছে যে, দেরিতে হলেও লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হলো এবং তিনি আর মন্ত্রী থাকলেন না। আরো সিদ্ধান্ত হলো যে, তিনি আর আওয়ামী লীগের সদস্য থাকছেন না। কিন্তু এতটুকুতেই কি জনগণ সন্তুষ্ট হবেন? মন্ত্রিত্ব নেই বা আওয়ামী লীগে নেই, এটা কি কোনো শাস্তি হলো? জনগণ অবশ্যই এতটুকুতে সন্তুষ্ট এবং ক্ষান্ত হবেন না।
লতিফ সিদ্দিকীর অকল্পনীয় ইসলামবিরোধী কথাবার্তা বিশেষ করে পবিত্র হজ্ববিরোধী বক্তব্য এবং মহানবীকে অপমান করে প্রদত্ত বক্তব্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী যত বড় অপরাধ করেছেন তত বড় অপরাধ সাম্প্রতিক অতীতে আর কেউই করার দুঃসাহস দেখায়নি। অতীতে কবি দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নাসরিন ইসলামবিরোধী কবিতা ও রচনা লিখেছে। কিন্তু সেটা তারা করেছে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। তারপর তাদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দাউদ হায়দারকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই দাউদ হায়দার আজো বাংলাদেশে ফিরতে পারেনি। আজও সে জার্মানীতে বসবাস করছে।
তসলিমা নাসরিনকেও জনতার রুদ্র রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর ২০ বছর পার হয়ে গেছে। বহু ঘাটের পানি খেয়েছে তসলিমা নাসরিন। কিন্তু আজও সে দেশে ফিরতে পারেনি।
কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আওয়ামী লীগের মতো দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি দলের একটির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। তাই বিগত ৫ বছর তিনি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ছিলেন। এবারও তাকে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী বানানো হয়েছে। দেয়া হয়েছে ডাক, তার ও তথ্য প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। তিনি ক্যাবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার বলেই তাকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন উচ্চ ক্ষমতার আসনে বসে পবিত্র হজ্ব এবং মহানবী সম্পর্কে এমন জঘন্য মন্তব্য করার অধিকার তার নেই। যদি তার ইসলামবিরোধী, রাসূল (সা.) বিরোধী এবং হজ্ববিরোধী কথাবার্তা বলার এতই খায়েশ হয় তাহলে তিনি মন্ত্রিত্বের পদ, সংসদ সদস্যের পদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্য পদ ছেড়ে দিয়ে ময়দানে নামতে পারেন এবং ময়দানে এসব বক্তব্য দিতে পারেন। তখন দেখা যাবে কত ধানে কত চাল। কিন্তু সরকারি অর্থে আমেরিকা পর্যন্ত ভ্রমণ করে নিউইয়র্কে বসে মন্ত্রী হিসেবে এসব বক্তব্য মন্ত্রিসভার কেউ দিতে পারেন না।
এইতো কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করার দায়ে একজনকে জেল খাটতে হচ্ছে। সেখানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসিত বক্তব্য দেয়ার জন্য সংসদ সদস্যের পদ এবং মন্ত্রিত্বের পদ থেকেই অপসারণই কি যথেষ্ঠ? জনগণ বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর তাই দাবি, লতিফ সিদ্দিকীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক এবং আইন মোতাবেক তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক।
এতবড় গর্হিত কাজ করার পরেও লতিফ সিদ্দিকী অনুতপ্ত নন এবং বিবেকের দংশনে তিনি দংশিত নন। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি যা বলেছি সেইসব মন্তব্যে আমি অনড়।’ এসব বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনুতাপ করার কিছুই নেই। কারণ তিনি কি বলেছেন সেটি তিনি জানেন এবং যা তিনি বলেছেন সেটি দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন।’
বিবিসিকে দেয়া এই বক্তব্যের পর লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি নমনীয় হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। এই ধরনের বক্তব্য যারাই শুনেছেন তারা প্রথমে হতভম্ব হয়েছেন । তারপর তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য ২০ দলের তরুণ নেতা ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছেন যে, হজ্বের সময় বড় ও ছোট জামারায় অর্থাৎ শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারলে অনেক সওয়াব হয়। লতিফ সিদ্দিকীকে যদি জুতা মারা যায় তাহলে অতো সওয়াব হয়ত হবে না, কিন্তু কিছু সওয়াব তো হাসিল করা যাবে। হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা সফি বলেছেন যে, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ইসলাম থেকে ইতোমধ্যে খারিজ হয়ে গেছেন।
পবিত্র হজ্ব ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাবলীগ জামাত সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অন্যায়, অসংযত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জন্য তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১ অক্টোবর সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান গত মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছেন।
মানুষ তাকিয়ে আছে, প্রধানমন্ত্রী ফিরে এসে কি ব্যবস্থা নেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে কোনো অসম্মানজনক কথা লেখা হলে লেখককে গ্রেফতার করা এবং সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তি দেয়ার একাধিক নজির রয়েছে। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই জঘন্য অপমানের পর শেখ হাসিনার সরকার লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে কারাদন্ড দেয় কিনা সেটি দেখার জন্য বাংলাদেশের মুসলমানরা ব্যাকুল আগ্রহে প্রহর গুনছে।
এই মন্ত্রীকে সরানো হবে, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরেও সিদ্ধান্তটি এতদিন ঝুলিয়ে রাখা হলো কেন? মন্ত্রীর যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা তিনি এই ১০-১২ দিন ভোগ করলেন কেন? আসলে তাকে ভোগ করতে দেয়া হলো কেন?
নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী যে আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন করেন সেখানে তিনি বুঝালেন যে, কোনো একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে গেলেই সংবিধান মোতাবেক কতগুলো আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। তিনি বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হজ্বে গিয়েছেন। তিনি হজ্ব থেকে না ফিরলে লতিফ সিদ্দিকীকে অপসারণ করা যাবে না।
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। অন্যরা বলেন যে, লতিফ সিদ্দিকীর অপসারণ নিয়ে অযথা সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। আজ ১২ দিনের বেশি হয়ে গেল, কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী সম্পর্কে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। অথচ এত লম্বা সময় তো লাগার কথা নয়। সেজন্যই বিরোধী দলের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যে, লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ধূম্রজাল সৃষ্টি করছেন। ব্যাপারটির একটি সহজ-সরল সমাধান ছিল। সেটি হতে পারতো নিম্নরূপ :
যেদিন লতিফ সিদ্দিকীর ধর্মদ্রোহী বা ব্লাসফেমাস বক্তব্য ছাপা হলো সেদিনই প্রধানমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিতে পারতেন। তখন প্রধানমন্ত্রী এবং লতিফ সিদ্দিকী দু’জনই নিউইয়র্কে ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকী কিন্তু বিবিসিকে বলেছেন যে, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাকে যে নির্দেশ দিবেন সেই নির্দেশই তিনি পালন করবেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলেন তাহলে তিনি সেটিও করবেন, অর্থাৎ তিনি বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন। আর যদি পদত্যাগের নির্দেশ দেন তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এটি ছিল সবচেয়ে সহজ সমাধান। সংবিধানে বলা হয়েছে যে, যে মুহূর্তে কোনো একজন মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করবেন সেই মুহূর্ত থেকে তার পদত্যাগ কার্যকর হবে। সেখানে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সেই পদত্যাগপত্র গৃহীত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। তবে যদি ঐ মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাকে বরখাস্ত বা অপসারণ করবেন এবং সেই অপসারণ বা বরখাস্ত যেদিন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক গৃহীত হবে সেদিন থেকে তিনি আর মন্ত্রী থাকবেন না।
আলোচ্য ক্ষেত্রে এরকম কোনো কথা শোনা যায়নি যে লতিফ সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রীর কথার অবাধ্য হয়েছেন। পদত্যাগ না করলে তো তাকে দেশে ফিরে আসতে হবে এবং দেশে ফিরে এসে মন্ত্রিত্ব চালাতে হবে। এক্ষেত্রে তো সেই প্রশ্নই আসে না। লতিফ সিদ্দিকী তো আর দেশে ফিরে আসছেন না। তিনি ইতোমধ্যেই কানাডা চলে গেছেন। সেখানে তার বড় মেয়ে বা এই ধরনের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয় থাকেন। তিনি নাকি ইতোমধ্যেই কানাডা গিয়েছেন এবং কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এমন কথা শোনা যাচ্ছে যে, রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে কানাডা সরকারের নিকট তিনি যে দরখাস্ত পেশ করেছেন সেটি নাকি শুনানির জন্য গৃহীত হয়েছে। এমন একটি ক্ষেত্রে তার নিকট থেকে পদত্যাগপত্র চাইলে তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি দিয়ে দিতেন এবং সেই মুহূর্ত থেকেই সেটি কার্যকর হতো। অর্থাৎ সেদিন থেকেই তিনি আর মন্ত্রী থাকতেন না।
কিন্তু এগুলো কিছুই না করে একটি লম্বা প্রক্রিয়া ফলো করা হয়। এভাবে ২ সপ্তাহ অযথা সময় ক্ষেপণ করা হলো। অথচ সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে,
৫৮। (১) প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি-
(ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন;
(গ) এই অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুসারে রাষ্ট্রপতি অনুরূপ নির্দেশ দান করেন; অথবা
(ঘ) এই অনুচ্ছেদের (৪) দফায় যেরূপ বিধান করা হইয়াছে তাহা কার্যকর হয়।
(২) প্রধানমন্ত্রী যে কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।
দুই
যাই হোক, ধরে নেয়া হচ্ছে যে, দেরিতে হলেও লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগপত্র গৃহীত হলো এবং তিনি আর মন্ত্রী থাকলেন না। আরো সিদ্ধান্ত হলো যে, তিনি আর আওয়ামী লীগের সদস্য থাকছেন না। কিন্তু এতটুকুতেই কি জনগণ সন্তুষ্ট হবেন? মন্ত্রিত্ব নেই বা আওয়ামী লীগে নেই, এটা কি কোনো শাস্তি হলো? জনগণ অবশ্যই এতটুকুতে সন্তুষ্ট এবং ক্ষান্ত হবেন না।
লতিফ সিদ্দিকীর অকল্পনীয় ইসলামবিরোধী কথাবার্তা বিশেষ করে পবিত্র হজ্ববিরোধী বক্তব্য এবং মহানবীকে অপমান করে প্রদত্ত বক্তব্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে ক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। লতিফ সিদ্দিকী যত বড় অপরাধ করেছেন তত বড় অপরাধ সাম্প্রতিক অতীতে আর কেউই করার দুঃসাহস দেখায়নি। অতীতে কবি দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নাসরিন ইসলামবিরোধী কবিতা ও রচনা লিখেছে। কিন্তু সেটা তারা করেছে দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে। তারপর তাদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দাউদ হায়দারকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দিয়েছেন। সেই দাউদ হায়দার আজো বাংলাদেশে ফিরতে পারেনি। আজও সে জার্মানীতে বসবাস করছে।
তসলিমা নাসরিনকেও জনতার রুদ্র রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর ২০ বছর পার হয়ে গেছে। বহু ঘাটের পানি খেয়েছে তসলিমা নাসরিন। কিন্তু আজও সে দেশে ফিরতে পারেনি।
কিন্তু লতিফ সিদ্দিকীর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি আওয়ামী লীগের মতো দেশের সবচেয়ে বড় দু’টি দলের একটির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন। তাই বিগত ৫ বছর তিনি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী ছিলেন। এবারও তাকে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী বানানো হয়েছে। দেয়া হয়েছে ডাক, তার ও তথ্য প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। তিনি ক্যাবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার বলেই তাকে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এমন উচ্চ ক্ষমতার আসনে বসে পবিত্র হজ্ব এবং মহানবী সম্পর্কে এমন জঘন্য মন্তব্য করার অধিকার তার নেই। যদি তার ইসলামবিরোধী, রাসূল (সা.) বিরোধী এবং হজ্ববিরোধী কথাবার্তা বলার এতই খায়েশ হয় তাহলে তিনি মন্ত্রিত্বের পদ, সংসদ সদস্যের পদ এবং আওয়ামী লীগের সদস্য পদ ছেড়ে দিয়ে ময়দানে নামতে পারেন এবং ময়দানে এসব বক্তব্য দিতে পারেন। তখন দেখা যাবে কত ধানে কত চাল। কিন্তু সরকারি অর্থে আমেরিকা পর্যন্ত ভ্রমণ করে নিউইয়র্কে বসে মন্ত্রী হিসেবে এসব বক্তব্য মন্ত্রিসভার কেউ দিতে পারেন না।
এইতো কিছুদিন আগেও বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কটূক্তি করার দায়ে একজনকে জেল খাটতে হচ্ছে। সেখানে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসিত বক্তব্য দেয়ার জন্য সংসদ সদস্যের পদ এবং মন্ত্রিত্বের পদ থেকেই অপসারণই কি যথেষ্ঠ? জনগণ বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর তাই দাবি, লতিফ সিদ্দিকীকে অবিলম্বে গ্রেফতার করা হোক এবং আইন মোতাবেক তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হোক।
এতবড় গর্হিত কাজ করার পরেও লতিফ সিদ্দিকী অনুতপ্ত নন এবং বিবেকের দংশনে তিনি দংশিত নন। বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি যা বলেছি সেইসব মন্তব্যে আমি অনড়।’ এসব বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনুতাপ করার কিছুই নেই। কারণ তিনি কি বলেছেন সেটি তিনি জানেন এবং যা তিনি বলেছেন সেটি দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন।’
বিবিসিকে দেয়া এই বক্তব্যের পর লতিফ সিদ্দিকীর প্রতি নমনীয় হওয়ার কোনোই সুযোগ নেই। এই ধরনের বক্তব্য যারাই শুনেছেন তারা প্রথমে হতভম্ব হয়েছেন । তারপর তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাবেক সংসদ সদস্য ২০ দলের তরুণ নেতা ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেছেন যে, হজ্বের সময় বড় ও ছোট জামারায় অর্থাৎ শয়তানকে পাথর ছুড়ে মারলে অনেক সওয়াব হয়। লতিফ সিদ্দিকীকে যদি জুতা মারা যায় তাহলে অতো সওয়াব হয়ত হবে না, কিন্তু কিছু সওয়াব তো হাসিল করা যাবে। হেফাজতে ইসলামের প্রধান আল্লামা সফি বলেছেন যে, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী ইসলাম থেকে ইতোমধ্যে খারিজ হয়ে গেছেন।
পবিত্র হজ্ব ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তাবলীগ জামাত সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর অন্যায়, অসংযত ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের জন্য তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১ অক্টোবর সারা দেশে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান গত মঙ্গলবার বিবৃতি দিয়েছেন।
মানুষ তাকিয়ে আছে, প্রধানমন্ত্রী ফিরে এসে কি ব্যবস্থা নেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে কোনো অসম্মানজনক কথা লেখা হলে লেখককে গ্রেফতার করা এবং সংশ্লিষ্ট আইনে শাস্তি দেয়ার একাধিক নজির রয়েছে। পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর এই জঘন্য অপমানের পর শেখ হাসিনার সরকার লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে কারাদন্ড দেয় কিনা সেটি দেখার জন্য বাংলাদেশের মুসলমানরা ব্যাকুল আগ্রহে প্রহর গুনছে।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন