শুক্রবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৪

জাতিসংঘ থেকে খালি হাতে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী


সরকারের সুচিন্তিত কৌশলের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে টাঙ্গাইলের ছেলে ও বাদ পড়া (?) ‘বিশিষ্ট’ মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নিন্দনীয় বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যাচ্ছে সত্য, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিউইয়র্ক সফরের নানাদিক নিয়ে এখনো জোর আলোচনা চলছে। চুলচেরা বিশ্লেষণও করছেন তথ্যাভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা। এই সফরকে প্রধানমন্ত্রীর ‘জাতিসংঘ গমন’ এবং লতিফ সিদ্দিকীর বক্তব্যকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহকে ‘নিউইয়র্ক ড্রামা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন তারা। কারণ, লতিফ সিদ্দিকী হঠাৎ ঝামেলা না বাঁধালে ব্যর্থতা এবং নিন্দনীয় বিভিন্ন বক্তব্য ও কর্মকান্ডের কারণে ফেঁসে যেতে হতো প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি যে শূণ্যের বেশি কিছুই অর্জন করতে পারেননি এবং তাকে যে মহাসচিব বান কি মুন থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদী পর্যন্ত অনেকের কাছেই প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে এবং তিনি যে বিশেষ করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তার মাধ্যমে গঠিত তার বর্তমান সরকারের জন্য কোনো রাষ্ট্র ও সরকারেরই বৈধতা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেননি- সে কথাগুলোও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রতি বছরই জাতিসংঘে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্বটুকু পালন করে এসেছেন। একজন সরকার প্রধানের জন্য এটাই অবশ্য স্বাভাবিক হলেও কথা উঠেছে অন্য কারণে। এবার রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যঙ্গাত্মকভাবে বেশি আলোচিত হয়েছেন তার সফরসঙ্গীরা। কারণ, প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রতিনিধি ও সফরসঙ্গী নামের বিরাট এক বহরকে। ‘মাত্তরই’ ১৮০ জন- কারো কারো হিসাবে ২০০ জনের বেশি ছিল তার সফরসঙ্গীদের সংখ্যা। প্রত্যেকের নামের আগে ‘বিশিষ্ট’ বিশেষণ যোগ করে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের নেতা ও এমপি এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা থেকে ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক পর্যন্ত এমন জনেরাই ওই বহরে ছিলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যাদের কোনো ভূমিকাই থাকার কথা নয়। তেমন সুযোগ এবার রাখাও হয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী যখন সাধারণ পরিষদে ভাষণ দিয়েছেন তখন বাংলাদেশের ১০ জনের বেশি প্রতিনিধি অধিবেশন কক্ষে থাকতে পারেননি। এরপর ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক। দু’জনের সঙ্গেই বৈঠক হয়েছে মাত্র ২০ মিনিটের। সেখানেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ জনা পাঁচেক সফরসঙ্গীর বাইরে কেউ থাকতে পারেননি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে যেখানে মাত্র ১৫ জন অংশ নিতে বা উপস্থিত থাকতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী সেখানে প্রায় ২০০ জনকে নিয়ে গেছেন। এজন্যই বলা হচ্ছে, জাতিসংঘে যাওয়ার নামে প্রধানমন্ত্রী আসলে ভ্রমণেরই আয়োজন করেছিলেন।
উল্লেখ্য, ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবছরই প্রধানমন্ত্রী এমন ব্যক্তিদের সফরসঙ্গী করেছেন, মার্কেটে গিয়ে কেনাকাটা করা এবং ঘুরে বেড়ানো ছাড়া জাতিসংঘে অন্তত যাদের কোনো কাজ নেই। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি, কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে এবার রেকর্ড করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কারণ, ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোনো বছরই তার সফরসঙ্গীদের সংখ্যা ৮১ থেকে ১৪০ জনের বেশি ছিল না। কিন্তু এবার তিনি প্রায় ২০০ জনকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যারা গিয়েছিলেন তাদের কারো কারো পরিচিতি নিয়েও রসাত্মক আলোচনা কম হচ্ছে না। যেমন মুক্তিযোদ্ধার সাটিফিকেট নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে মাত্র ক’দিন আগে ধাওয়া খেয়েছেন এমন এক সচিব নিজেই শুধু যাননি, গেছেনও আবার তার সহধর্মিনীকে নিয়ে। তা সত্ত্বেও হয়তো কথা উঠতো না, প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশিষ্ট’ এই সফরসঙ্গীদের জন্য রাষ্ট্রকে যদি কোটির অংকে অর্থ ব্যয় না করতে হতো। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে ‘খাজনার চাইতে বাজনা বেশি’ প্রবাদ বাক্যটিকেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের একই অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গেছেন ২৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গিয়েছিলেন আরো কম সংখ্যক- মাত্র ১৫ জন।
জাতিসংঘে গিয়ে আরো অনেকভাবেই জাতিকে ডুবিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। উদাহরণ দেয়ার জন্য সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের উল্লেখ করা যায়। শেখ হাসিনা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও সচেতন মহলগুলোর অনেকের আশা ছিল, জাতিসংঘে তিনি অন্তত আওয়ামী লীগের জনসভার মতো ভাষণ দেবেন না। আন্তর্জাতিক রীতিনীতির ব্যাপারেও সতর্কতা অবলম্বন করবেন তিনি। কিন্তু ‘যাহা বাহাহ্ন তাহা তেপ্পান্ন’ প্রবাদের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে পাওয়া মিনিট কয়েকের পুরো সময়টুকুই তিনি তার সরকারের গুণকীর্তন করে পার করেছেন। যথারীতি টেনে এনেছেন নিজের পিতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানকে। পিতার হত্যাকা- থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ইতিহাস শুনিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সরকারের বইয়ে দেয়া উন্নয়নের জোয়ারের গালগল্প তো শুনিয়েছেনই। প্রধানমন্ত্রী একই নিঃশ্বাসে দেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সমালোচনাও করেছেন যথেচ্ছভাবে। বলেছেন, ওই সরকারের আমলেই বাংলাদেশ নাকি জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের রাজ্যে পরিণত হয়েছিল এবং আওয়ামী লীগ  ক্ষমতায় আসার পরই নাকি সব জঙ্গি গোষ্ঠীকে দমন ও উৎখাত করা হয়েছে! প্রধানমন্ত্রী জানাননি, জেএমবি নেতা শায়খ আবদুর রহমান কোন দলের কোন নেতার আপন দুলাভাই ছিলেন এবং বাংলা ভাই ও শায়খ রহমানসহ জেএমবি নেতাদের গ্রেফতার ও বিচারের ব্যবস্থা আসলে চারদলীয় জোট সরকারই করেছিল। ভাষণে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও চেয়ে বসেছেন তিনি। কিন্তু বলেননি, কোন পন্থায় ও আন্তর্জাতিক ঠিক কোন আইনের অধীনে বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়ে তাকে সমর্থন দেবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ভাষণ অন্য দেশগুলোর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে আদৌ ইতিবাচক কোনো প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে কি না সে সম্পর্কে অবশ্য জানা যায়নি। কারণ, শেখ হাসিনা যখন নিজেদের গুণকীর্তনের পাশাপাশি দেশের প্রকৃত বিরোধী দলগুলোকে এক হাত নিচ্ছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সমর্থন চেয়ে বিদেশীদের স্তম্ভিত করছিলেন তখন অধিবেশনে সব মিলিয়ে শ’ দেড়েকের বেশি মানুষকে উপস্থিত দেখা যায়নি। তাদের মধ্যে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সংখ্যা জনা বিশেকের বেশি ছিল না। অন্যদিকে দর্শক গ্যালারিতে ছিল ‘উপচে পড়া ভিড়’! কারণ, প্রধানমন্ত্রীর প্রায় ২০০ জন সফরসঙ্গী এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সাংবাদিকরা শুধু নন, প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও পুত্রবধূ ছাড়াও তার মেয়ে ও বোন রেহানাসহ আরো অনেকেই গিয়ে হাজির হয়েছিলেন গ্যালারিতে। প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে, প্রায় ফাঁকা অধিবেশন কক্ষের দর্শক গ্যলারিতে এত বেশি মানুষের ভিড় দেখে জাতিসংঘের কর্মকর্তা এবং বিদেশীদের মধ্যে কৌতুকপূর্ণ হাসি ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণও তার সম্মান বাড়াতে পারেনি। কারণ, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ কিংবা পল্টনের মতো কোনো ময়দান নয়। জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশন আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনও ছিল না। একই কারণে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেয়ার গালগল্প করাটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য শোভনীয় হয়নি। বিএনপি-জামায়াতসহ ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত ও প্রকৃত বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও প্রধানমন্ত্রীর নীতি বিশ্বাস সম্পর্কে তার ‘জ্ঞানের বহর’ সম্পর্কেই জানান দিয়েছে- যা দেশের ভাবমর্যাদার জন্য ইতিবাচক হয়নি। কারণ, জাতিসংঘের যে কোনো অধিবেশনে সাধারণত এমন সব বিষয়েই বলতে হয় যেগুলোর সঙ্গে নিজ দেশের এবং বিশ্বশান্তির কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা থাকে। যেমন পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ও নরেন্দ্রনাথ মোদী কাশ্মীর সমস্যাসহ দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়ে বলেছেন। তারা সেই সঙ্গে যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজেদের পরিকল্পনা ও অঙ্গিকারের ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যরা বলেছেন পারমাণবিক অস্ত্র সম্পর্কে। তারাও বিশ্বকে শান্তির প্রতিশ্রুতি শুনিয়েছেন।
অন্যদিকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতকেই শুধু তুলোধুনো করেননি, কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টিকেও এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন এর সঙ্গে বিশ্বশান্তির বিরাট কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে! লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বিএসএফ-এর হত্যা, অপদখলীয় ভূমিসহ সীমান্ত সমস্যা, বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি, চোরাচালান এবং তিস্তা চুক্তি না করা ও ভারতের পানি আগ্রাসনের মতো কোনো একটি বিষয় সম্পর্কেই বিশ্ববাসীকে জানতে দেননি। তার এই পাশ কাটানোর কৌশল থেকে মনে হতে পারে যেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সমস্যাই নেই! ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রী ঠোঁটে আঙুল চেপে রেখেছেন। অথচ এই সংকট কাটিয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য গত বছর, ২০১৩ সালে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন। একই আহবান জানাতে একাধিকবার ঢাকায় এসেছিলেন বান কি মুনের বিশেষ প্রতিনিধি তারানকোও। সে কারণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই অন্য দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। তারা শেখ হাসিনার মুখে এ সম্পর্কে শুনবেন বলেও আশা করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এত বড় একটি বিষয়কেও দিব্যি পাশ কাটিয়ে গেছেন। অর্থাৎ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ কোনো সুফলই অর্জন করতে পারেনি। সব মিলিয়ে জনগণকে তো নিরাশ করেছেনই, জাতিসংঘে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকেও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে এসেছেন তিনি।
প্রাসঙ্গিক দ্বিতীয় উদাহরণ দেয়ার জন্য নিউইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের উল্লেখ করা দরকার। ২৮ সেপ্টেম্বরের এই সংবাদ সম্মেলনে দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থে ‘যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত’ বলে ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি শেখ হাসিনা উল্টো প্রশ্ন করেছেন, কিসের মধ্যবর্তী নির্বাচন? তার মতে নির্বাচন তো ৫ জানুয়ারি হয়েই গেছে- যে নির্বাচনে ৪০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে! সারা বিশ্ব যেখানে পাঁচ শতাংশের কথা বলছে প্রধানমন্ত্রী সেখানে ৪০ শতাংশের হিসাব কোথায়, কিভাবে পেলেন সে সম্পর্কে কিন্তু কোনো জবাব দেননি তিনি। সংবাদ সম্মেলনে দেশের সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজকেও ধোলাই করেছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, নিজেরা মন্ত্রী হওয়ার আশা নিয়ে এই ‘সুশীল বাবুরাই’ অতীতেও সব সংকটের সৃষ্টি করেছেন, এখনো করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। দেশে কোনো রাজনৈতিক সংকট নেই বলে ঘোষণা দিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনেও শেখ হাসিনা যথারীতি বেগম খালেদা জিয়ার এবং তার সন্তানদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন, পুনরাবৃত্তি করে বহুবার বলা দুর্নীতি ও টাকা পাচারের কথাও শুনিয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, শেখ হাসিনা কিন্তু জানাননি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র নাথ মোদী এবং জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ‘একান্ত বৈঠকে’ ঠিক কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে বান কি মুন তাকে নতুন কিছু বলেছেন কি না কিংবা গত বছর তার সমঝোতার আহবানে সাড়া না দেয়ার কারণে অসন্তোষের প্রকাশ ঘটিয়েছেন কি নাÑ এসব বিষয়ের ধারেকাছেও যাননি শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, এই সফরে যাওয়ার মাত্র মাসখানেক আগে বিএনপি ও জামায়াতসহ দেশের প্রকৃত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তাগিদ দিয়ে ইউএনডিপি প্রধানের মাধ্যমে মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে চিঠিটিকে তিনি ১৬ দিন পর্যন্ত গায়েব করে রেখেছেন। এ বিষয়ে সবকিছু ফাঁস হয়েছে প্রধানমন্ত্রী রওনা দেয়ার ঠিক প্রাক্কালে।
ওদিকে নিউইয়র্কের সংবাদ সম্মেলনে নতুন একটি কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে নাকি ‘কখনোই’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। ৫ জানুয়ারি সেটাই করে তিনি নাকি ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছেন! বলা দরকার, এবার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা এত বেশি ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছেন যে, তার বর্ণিত নির্বাচনকেন্দ্রিক নতুন ‘দৃষ্টান্ত’ সম্পর্কে’ জানার ব্যাপারে বিশ্ববাসীর মধ্যে আগ্রহ অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘কখনোই’ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি কথাটার মধ্যদিয়ে অজান্তে হলেও প্রধানমন্ত্রী কিন্তু নিজের মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সে নির্বাচন এতটাই ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ হয়েছিল যে, তিনশ আসনের মধ্যে বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মাত্র সাতজন জিততে পেরেছিলেন। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ এবং ‘ওরে আসতে দিস না’ ধরনের হুকুমের কারণে ভোটের পরদিন সকাল পর্যন্ত গণনায় অনেক এগিয়ে থাকা অনেকেও সেবার কুপোকোত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত লক্ষ্যই করেননি যে, ‘কখনোই’ কথাটার মধ্য দিয়ে তিনি তার নিজের পিতার শরীরেও ধূলা মাখিয়েছেন, তাকেও চরমভাবে অসম্মানিত করেছেন। সেটা তিনি করতেই পারেন, কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করার বিষয় নিয়ে কেননা, জনগণ কি চায় সে কথাটা নিইউইয়র্কে গিয়েও প্রধানমন্ত্রীকে টের পেতে হয়েছে। জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে ম্যারিয়টস হোটেলের সামনে পর্যন্ত প্রতিটি স্থানেই বাংলাদেশীরা তাকে চমৎকার ‘সংবর্ধনা’ দিয়েছেন। তাকে এমনকি জাতিসংঘে ঢুকতে হয়েছে অনির্ধারিত একটি দরোজা দিয়ে। আলোচ্য সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিক ও ‘সুশীল বাবুদের’ খোঁচা মারতে গিয়ে তাকে কম বিব্রত হতে হয়নি।  এজন্যই সব কথাকে পাশ কাটিয়ে যথারীতি তিনি নিজেদেরই ইচ্ছামতো সংশোধিত সংবিধানকে জাপটে ধরেছেন এবং ওই সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন একটি ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের ঘোষণা শুনিয়েছেন।
ক্ষমতায় আছেন, সুতরাং যা কিছু তিনি বলতে ও করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু তার একার চাওয়াটাই সব নয়। কারণ, প্রধান জাতীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটই তাকে শুধু ব্যতিব্যস্ত রাখেনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সামান্য সমর্থন আদায় করতে পারেননি শেখ হাসিনা। এমনকি একমাত্র রাষ্ট্র হিসেবে যে ভারত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তার সরকার ও সংসদকে  বৈধতা দিয়েছে, সে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র  নাথ মোদীও একটি শব্দ বলেননি শেখ হাসিনার সমর্থনে। জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশের কথা বলেছেন। দেশগুলোর নাম বলতে গিয়ে নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান থেকে শুরু করে চিরশত্রু পাকিস্তানের কথা পর্যন্ত বলেছেন। কিন্তু তার সে নামের তালিকায় স্থান পায়নি শেখা হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ। যার অর্থ হলো, ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীও মনে করেন না যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র রয়েছে! কথাটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তত অনুধাবন করা উচিত। একই কারণে নতুন পর্যায়ে নাটকীয়তা করার কষ্ট না করে প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিএনপি ও জামায়াতসহ প্রকৃত জনসমর্থিত দলগুলোর দাবি মেনে নেয়া এবং দ্রুত পদত্যাগ করে ও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া। সব সংকট যেহেতু তিনি একাই তৈরি করেছেন সেহেতু নির্বাচনের লক্ষ্যে সব পদক্ষেপও তাকেই নিতে হবে। বলা দরকার, শেয়ার বাজারের মহালুণ্ঠন এবং পদ্মাসেতুকেন্দ্রিক দুর্নীতি ও ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন থেকে সবশেষে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর প্রশ্নসাপেক্ষ ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য পর্যন্ত অনেক ‘দৃষ্টান্ত’ই জনগণকে দেখতে হয়েছে। জনগণ তাই নতুন আর কোনো ‘দৃষ্টান্ত’ দেখতে চায় না। তারা চায়, প্রধানমন্ত্রী জনগণের তথা ২০ দলীয় জোটের কথার পাশাপাশি জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের পরামর্শ শুনুন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে দেশকে সংকট ও সংঘাতের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করুন। এরই মধ্যে অনেক দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী, তাকে আর নতুন নতুন ‘দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করার জন্য কষ্ট করতে হবে না!
আহমদ আশিকুল হামিদ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads