মহানবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.), ইসলাম, পবিত্র হজ্ব ও তাবলীগ সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক ও উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে যে নাটক বা ড্রামা’র সূচনা করেছিলেন সে নাটককেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহের এখনো অবসান হয়নি। বিষয়টিকে নিয়ে বরং রাজনৈতিক অর্থে খেলাধুলা যেমন চালানো হচ্ছে তেমনি আসরও ভালোই জমিয়ে তুলেছেন ক্ষমতাসীনরা। কথাটা বলার কারণ, লতিফ সিদ্দিকী নিউইয়র্কে তার নিজ জেলা টাঙ্গাইলবাসীদের এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলেন গত ২৮ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে ও সরকারের এক কোটি ৬০ লাখ টাকা বেতনের ‘উপদেষ্টা’ সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে উল্টো ‘জয় আবার কে’ বলেও ব্যঙ্গ-তামাশা করেছিলেন তিনি। মন্ত্রীর মুখে কথাটা শুনে হাসির রোল পড়ে গিয়েছিল ওই অনুষ্ঠানে। এর পরপর ঢাকায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত থেকে ওবায়দুল কাদের ও মাহবুব-উল আলম হানিফসহ কারো কারো মন্তব্যে মনে হয়েছিল, মন্ত্রিত্ব হারিয়ে ফেলেছেন লতিফ সিদ্দিকী। প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে। কিন্তু বাস্তবে এখনো, ১০ অক্টোবর পর্যন্তও বহাল তবিয়তে মন্ত্রীর পদে রয়েছেন তিনি।
এদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সংবিধানের বিধি-বিধান দেখাতে ও শেখাতে শুরু করেছেন। একটি সরকার কিভাবে চলে এবং একজন মন্ত্রীকে অপসারণের জন্য কোন ধরনের প্রসিডিউর বা নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয় সে সব বিষয়ে ‘দয়া করে’ পড়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেই যে একজন মন্ত্রীকে ‘বিদায়’ নিতে হবে সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভোলেননি শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে তিনি অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ফাইলটি প্রথমে পাঠাতে হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ হজ্ব¡ করতে গেছেন। শুধু তাই নয়, যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফাইলটি বঙ্গভবনে যাবে তার সচিব মহোদয়ও হজ্বেই রয়েছেন। সুতরাং লতিফ সিদ্দিকীর ‘কপাল পুড়তে’ আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। উল্লেখ্য, কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগ বা বিদায় সম্পর্কে সংবিধানের ৫৮(১-ক) ধারার নির্দেশনা হলো, ওই মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিলেই তা গৃহীত হবে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী এখনো বিদেশে থাকায় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা না দেয়ায় সংবিধানের ৫৮(১-ক) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, এমন অবস্থায় সংবিধানের ৫৮(২) ধারা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীকে পদত্যাগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ জানাতে পারেন। মন্ত্রী যদি অনুরোধ পালনে অসমর্থ হন বা রাজি না হন তাহলে তার মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন এবং তার ফলে মন্ত্রিত্ব হারাবেন লতিফ সিদ্দিকী। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন, আজকালের মধ্যে অর্থাৎ ১১ বা ১২ অক্টোবরের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ‘কার্যকর’ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এটুকুই অবশ্য সব নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ থেকেও তাকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে। কিন্তু দলের সভানেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে রেখেছেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি ‘গণতান্ত্রিক দল’ সেহেতু এর সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্যকে বহিষ্কার করতে বা বাদ দিতে হলে গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, তার বিশ্বাস, তিনি কিছু বললে দলের কেউ বিরোধিতা করবেন না। প্রধানমন্ত্রী শুধু বলেননি, অমন সাহসও কারো থাকার কথা নয়!
বলা দরকার, সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়েছে, লতিফ সিদ্দিকীর বিদায় পর্ব নিয়েও নাটকীয়তা যথেষ্টই করা হচ্ছে। প্রশ্নও উঠেছে সঙ্গত কারণেই। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো, এবারই প্রথম নয়, এর আগেও শেখ হাসিনার এই মন্ত্রী ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর এক সরকারি অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি হুকুম দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফের তেলাওয়াত বন্ধ করিয়েছিলেন। সেই থেকে তার উপস্থিতিতে কোনো অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেয়া হয় না। হুকুমটি মন্ত্রী এখনো বহাল রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও ইসলাম ও মুসলমানদের পাশাপাশি মসজিদ ও মাদরাসার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে এসেছেন। কেউ কেউ আবার বিশেষ ‘খ্যাতি’ও অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কথা উল্লেখ করতেই হবে। ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী ধারাবাহিক প্রচারণার এক পর্যায়ে তিনি এমনকি একথাও বলেছিলেন যে, দেশের কওমী মাদরাসাগুলো নাকি জঙ্গিদের ‘প্রজনন কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে এবং মসজিদের ইমামরা নাকি কেবল বেহেশতে যাওয়ার শিক্ষাই দেন! বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারও নাকি মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে! এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের অন্য সকলেও সময়ে সময়ে কম-বেশি জানান দিয়েছেন। উপলক্ষ পেলে এখনো জানান দেন তারা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কাউকেই কখনো ধমক দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন বলে জানা যায় না। এমনটিই যে সরকারের অবস্থা সে সরকারের একজন ‘প্রভাবশালী’ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন মন্ত্রী হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীর মুখে রাসূলুল্লাহ (সা.), ইসলাম, হজ্ব¡ ও তাবলীগ সম্পর্কে আপত্তিকর ও উস্কানিমূলক বক্তব্য অবশ্যই অস্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়। তবে তার একটি কথাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক থেকে মেক্সিকো যাওয়ার পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে নাকি একটি ‘সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব’ দিয়েছিলেন এবং তিনি নাকি ‘নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে’ সে ‘দায়িত্ব’টুকুই পালন করার চেষ্টা করেছেন! (১ অক্টোবর সংখ্যা দৈনিক প্রথম আলো দেখুন) এজন্যই তিনি অনুতপ্ত বা দুঃখিত যেমন নন, তেমনি রাজি নন বক্তব্য প্রত্যাহার করতেও। তবে, লতিফ সিদ্দিকী আরো বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ‘আদেশ দেন’ তাহলে তার নেত্রীর ‘সম্মানে’ তিনি তার নিউইয়র্কের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে রাজি আছেন। শেখ হাসিনার আদেশ ছাড়া ‘আর কোনো কিছুতেই আমি বক্তব্য প্রত্যাহার করবো না’ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন লতিফি সিদ্দিকী।
বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাকে যে ‘সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব’ দিয়েছিলেন বলে লতিফ সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন সে দায়িত্ব ঠিক কি বা কেমন ছিল তার উত্তর তিনি দেননি। আর দেননি বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা এখনো বেড়েই চলেছে। বলা হচ্ছে, লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়ে সুচিন্তিতভাবেই ঝামেলা বাঁধানো হয়েছিল, যাতে প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর এবং জাতিসংঘে তার ব্যর্থতা ও নিন্দনীয় বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় না ওঠে। কারণ, জাতিসংঘের একই অধিবেশনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদী ও নওয়াজ শরীফ যেখানে ২৫ ও ১৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন ১৮০ থেকে ২০০ জন! এদের পেছনে গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে অথচ এক শপিং করে বেড়ানো এবং আনন্দ-ফুর্তি করা ছাড়া কোনো কাজই ছিল না তাদের। ওদিকে সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণের মধ্য দিয়েও জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। পুরো ভাষণ জুড়েই তিনি তার সরকারের গুণকীর্তন করেছেন, নিজের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ইতিহাস শুনিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একই নিঃশ্বাসে দেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সমালোচনা করেছেন যথেচ্ছভাবে। ভাষণে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও চেয়ে বসেছেন তিনি।
দেশে ফেরার পরও অবাক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ৩ অক্টোবর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমনভাবে বলেছেন যা শুনে মনে হয়েছে যেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে তার কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে- যেন সে বৈঠক পূর্ব নির্ধারিতও ছিল! অথচ সত্য হলো, গত ২৭ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল নয়টা ১০ মিনিট থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য তাকে মহাসচিবের সঙ্গে ফটো সেশন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যাচার করা হয়েছিল বলে সবকিছু খোলাসা করে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র অফিসার জোসে লুই ডায়াজ। তিনি জানিয়েছেন, এটা ছিল একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং ফটো তোলার সুযোগ বা উপলক্ষ। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো বিবৃতিও প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে ৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন অতীতে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার আহবান জানিয়েছিলেন। এবার আলোচনায় তিনি কি কিছু বলেননি- এই প্রশ্নের জবাবে বাঁকা হাসি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার কিন্তু বলেন-টলেন নাই।’ কেন ‘বলেন-টলেন নাই’ তারও কারণ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না। খবরটুকু জানাতে গিয়ে ৪ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর এ উত্তরে সবাই হেসে ওঠেন।’
বর্তমান পর্যায়ে কথা বলতে হচ্ছে আসলে প্রধানমন্ত্রীর এই গালগল্পের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘বলেন-টলেন নাই’ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সম্মান দেখানোর কোনো উপাদান রয়েছে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। তবে মুখে যা-ই বলুন না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তার মাধ্যমে গঠিত তার বর্তমান সরকার যে এক ভারত ছাড়া কোনো দেশের কাছ থেকেই বৈধতা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি- সে কথাটা প্রধানমন্ত্রীই সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন। ‘তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না’ কথাটাও সত্য নয়। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকারসহ যেসব বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল এবং যেসব সমস্যার কারণে মহাসচিব বান কি মুন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দূতিয়ালী করার জন্য গত বছর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন সেগুলোর কোনোটিরই এখনো মীমাংসা হয়নি। মিস্টার তারানকোকে সামনে রেখে তৎপর হয়েছিলেন আসলে মহাসচিব বান কি মুন নিজেই। স্মরণ করা দরকার, ডিসেম্বরেই প্রথম নয়, তার আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বার কয়েক যোগাযোগ করেছিলেন। সমঝোতা ও সংলাপের আহবান জানিয়ে দুই নেত্রীর কাছে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তিনি ২০১৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। সে সময়ও, ১০ মে দুই নেত্রীর জন্য মহাসচিবের দুটি চিঠি নিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন মিস্টার তারানকো। তিনিও দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনড় মনোভাবের কারণে তারানকোর চেষ্টা সফল হতে পারেনি। এরপর ২৩ আগস্ট বান কি মুন দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় সমঝোতা আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য তাদের দু’জন করে প্রতিনিধিকে নিউইয়র্কে পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সম্মত হলেও প্রধানমন্ত্রী হননি বলে বান কি মুনের সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। মহাসচিব অবশ্য তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্রুত আরো জটিল ও ঘনীভূত হতে থাকা সংকটের মধ্যে ক্ষমতাসীনরা একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বান কি মুন আবারও তার একই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারানকোকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন ডিসেম্বরে।
ঢাকায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পালাক্রমে বৈঠক করেছিলেন মিস্টার তারানকো। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তো দফায় দফায় বসেছেনই, একই সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নির্বাচনে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও। আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে মুখ না খুললেও ঝানু এই কূটনীতিক ৯ ডিসেম্বর বলেছিলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতামুখী সদিচ্ছা এবং ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে সমস্যার জট খোলা সম্ভব হতে পারে। এ পর্যন্ত এসেই থেমে পড়েছিলেন মিস্টার তারানকো। ফলে আশাবাদী জনগণও থমকে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমি এবং আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য অনড় মনোভাব। এর প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছিল অনেক আগে থেকে। যেমন সংকটের সূচনা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে ছাড় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে কোনো কিছু হতে পারে কিন্তু ওই সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তাছাড়া শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল থাকলে তার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া ছাড় এবং ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। দিনের পর দিন ধরে অবরোধে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ।
অন্যদিকে মিস্টার তারানকোর সম্ভাব্য সাফল্যের সামনেও ক্ষমতাসীনরাই যথারীতি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বরের বৈঠকেও তারা নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রাখার জন্য জেদ ধরে বসেছিলেন। অথচ একথা সবারই জানা ছিল যে, শেখ হাসিনাই ছিলেন সব সমস্যার মূল কারণ। আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য তার অনড় মনোভাবের কারণেই দেশী-বিদেশী সব মহলের সব চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে। মিস্টার তারানকোর উপর্যুপরি অনুরোধকেও ক্ষমতাসীনরা পাশ কাটিয়েছেন। একই কারণে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি তারানকোর মাধ্যমে নেয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ। অমন এক ব্যর্থতার পরও বান কি মুন একেবারে নীরব হয়ে যাবেন এবং কিছুই ‘বলবেন না-টলবেন না’ কথাটা আদৌ সত্য হতে পারে কি না এবং ‘তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না’ বলেই পার পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীরই উচিত দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা। কারণ, বান কি মুন সেই জাতিসংঘের মহাসচিব- যে সংস্থাটির সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নানামুখী দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে রয়েছে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো কিছু বিষয়।
এদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সংবিধানের বিধি-বিধান দেখাতে ও শেখাতে শুরু করেছেন। একটি সরকার কিভাবে চলে এবং একজন মন্ত্রীকে অপসারণের জন্য কোন ধরনের প্রসিডিউর বা নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয় সে সব বিষয়ে ‘দয়া করে’ পড়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেই যে একজন মন্ত্রীকে ‘বিদায়’ নিতে হবে সে কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভোলেননি শেখ হাসিনা। সংবাদ সম্মেলনে তিনি অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ফাইলটি প্রথমে পাঠাতে হবে রাষ্ট্রপতির কাছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ হজ্ব¡ করতে গেছেন। শুধু তাই নয়, যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফাইলটি বঙ্গভবনে যাবে তার সচিব মহোদয়ও হজ্বেই রয়েছেন। সুতরাং লতিফ সিদ্দিকীর ‘কপাল পুড়তে’ আরো কয়েকদিন সময় লাগবে। উল্লেখ্য, কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগ বা বিদায় সম্পর্কে সংবিধানের ৫৮(১-ক) ধারার নির্দেশনা হলো, ওই মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিলেই তা গৃহীত হবে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী এখনো বিদেশে থাকায় এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা না দেয়ায় সংবিধানের ৫৮(১-ক) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, এমন অবস্থায় সংবিধানের ৫৮(২) ধারা অনুযায়ী লতিফ সিদ্দিকীকে পদত্যাগ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ জানাতে পারেন। মন্ত্রী যদি অনুরোধ পালনে অসমর্থ হন বা রাজি না হন তাহলে তার মন্ত্রিত্বের অবসান ঘটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে পরামর্শ দেবেন এবং তার ফলে মন্ত্রিত্ব হারাবেন লতিফ সিদ্দিকী। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, যেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হোক না কেন, আজকালের মধ্যে অর্থাৎ ১১ বা ১২ অক্টোবরের মধ্যে লতিফ সিদ্দিকীর মন্ত্রিত্বের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত ‘কার্যকর’ করার সম্ভাবনা রয়েছে। এটুকুই অবশ্য সব নয়। কারণ, আওয়ামী লীগ থেকেও তাকে বহিষ্কারের দাবি উঠেছে। কিন্তু দলের সভানেত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে রেখেছেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি ‘গণতান্ত্রিক দল’ সেহেতু এর সভাপতিমন্ডলীর একজন সদস্যকে বহিষ্কার করতে বা বাদ দিতে হলে গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, তার বিশ্বাস, তিনি কিছু বললে দলের কেউ বিরোধিতা করবেন না। প্রধানমন্ত্রী শুধু বলেননি, অমন সাহসও কারো থাকার কথা নয়!
বলা দরকার, সব মিলিয়েই পরিষ্কার হয়েছে, লতিফ সিদ্দিকীর বিদায় পর্ব নিয়েও নাটকীয়তা যথেষ্টই করা হচ্ছে। প্রশ্নও উঠেছে সঙ্গত কারণেই। এর পেছনে একটি বড় কারণ হলো, এবারই প্রথম নয়, এর আগেও শেখ হাসিনার এই মন্ত্রী ইসলাম ও মুসলমানদের ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর এক সরকারি অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি হুকুম দিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফের তেলাওয়াত বন্ধ করিয়েছিলেন। সেই থেকে তার উপস্থিতিতে কোনো অনুষ্ঠানে কুরআন তেলাওয়াত করতে দেয়া হয় না। হুকুমটি মন্ত্রী এখনো বহাল রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্য কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীও ইসলাম ও মুসলমানদের পাশাপাশি মসজিদ ও মাদরাসার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখে এসেছেন। কেউ কেউ আবার বিশেষ ‘খ্যাতি’ও অর্জন করেছেন। এদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের কথা উল্লেখ করতেই হবে। ইসলাম ও মুসলমান বিরোধী ধারাবাহিক প্রচারণার এক পর্যায়ে তিনি এমনকি একথাও বলেছিলেন যে, দেশের কওমী মাদরাসাগুলো নাকি জঙ্গিদের ‘প্রজনন কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে এবং মসজিদের ইমামরা নাকি কেবল বেহেশতে যাওয়ার শিক্ষাই দেন! বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তারও নাকি মাদরাসাকে কেন্দ্র করেই ঘটেছে! এ ব্যাপারে ক্ষমতাসীনদের অন্য সকলেও সময়ে সময়ে কম-বেশি জানান দিয়েছেন। উপলক্ষ পেলে এখনো জানান দেন তারা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কাউকেই কখনো ধমক দিয়েছেন বা নিষেধ করেছেন বলে জানা যায় না। এমনটিই যে সরকারের অবস্থা সে সরকারের একজন ‘প্রভাবশালী’ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিয়ভাজন মন্ত্রী হিসেবে লতিফ সিদ্দিকীর মুখে রাসূলুল্লাহ (সা.), ইসলাম, হজ্ব¡ ও তাবলীগ সম্পর্কে আপত্তিকর ও উস্কানিমূলক বক্তব্য অবশ্যই অস্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়। তবে তার একটি কথাকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। নিউইয়র্ক থেকে মেক্সিকো যাওয়ার পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে লতিফ সিদ্দিকী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে নাকি একটি ‘সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব’ দিয়েছিলেন এবং তিনি নাকি ‘নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে’ সে ‘দায়িত্ব’টুকুই পালন করার চেষ্টা করেছেন! (১ অক্টোবর সংখ্যা দৈনিক প্রথম আলো দেখুন) এজন্যই তিনি অনুতপ্ত বা দুঃখিত যেমন নন, তেমনি রাজি নন বক্তব্য প্রত্যাহার করতেও। তবে, লতিফ সিদ্দিকী আরো বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ‘আদেশ দেন’ তাহলে তার নেত্রীর ‘সম্মানে’ তিনি তার নিউইয়র্কের বক্তব্য প্রত্যাহার করতে রাজি আছেন। শেখ হাসিনার আদেশ ছাড়া ‘আর কোনো কিছুতেই আমি বক্তব্য প্রত্যাহার করবো না’ বলেও ঘোষণা দিয়েছেন লতিফি সিদ্দিকী।
বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী তাকে যে ‘সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব’ দিয়েছিলেন বলে লতিফ সিদ্দিকী উল্লেখ করেছেন সে দায়িত্ব ঠিক কি বা কেমন ছিল তার উত্তর তিনি দেননি। আর দেননি বলেই রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা এখনো বেড়েই চলেছে। বলা হচ্ছে, লতিফ সিদ্দিকীকে দিয়ে সুচিন্তিতভাবেই ঝামেলা বাঁধানো হয়েছিল, যাতে প্রধানমন্ত্রীর নিউইয়র্ক সফর এবং জাতিসংঘে তার ব্যর্থতা ও নিন্দনীয় বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় না ওঠে। কারণ, জাতিসংঘের একই অধিবেশনে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রনাথ মোদী ও নওয়াজ শরীফ যেখানে ২৫ ও ১৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন ১৮০ থেকে ২০০ জন! এদের পেছনে গরীব রাষ্ট্র বাংলাদেশের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে অথচ এক শপিং করে বেড়ানো এবং আনন্দ-ফুর্তি করা ছাড়া কোনো কাজই ছিল না তাদের। ওদিকে সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণের মধ্য দিয়েও জাতিকে লজ্জায় ডুবিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী। পুরো ভাষণ জুড়েই তিনি তার সরকারের গুণকীর্তন করেছেন, নিজের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ইতিহাস শুনিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একই নিঃশ্বাসে দেশের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সাবেক চারদলীয় জোট সরকারের সমালোচনা করেছেন যথেচ্ছভাবে। ভাষণে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, এই বিচারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও চেয়ে বসেছেন তিনি।
দেশে ফেরার পরও অবাক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ৩ অক্টোবর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এমনভাবে বলেছেন যা শুনে মনে হয়েছে যেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে তার কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে- যেন সে বৈঠক পূর্ব নির্ধারিতও ছিল! অথচ সত্য হলো, গত ২৭ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল নয়টা ১০ মিনিট থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য তাকে মহাসচিবের সঙ্গে ফটো সেশন করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যাচার করা হয়েছিল বলে সবকিছু খোলাসা করে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র অফিসার জোসে লুই ডায়াজ। তিনি জানিয়েছেন, এটা ছিল একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং ফটো তোলার সুযোগ বা উপলক্ষ। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ কোনো বিবৃতিও প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে ৩ অক্টোবরের সংবাদ সম্মেলনে রীতিমতো গল্প ফেঁদে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন অতীতে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার আহবান জানিয়েছিলেন। এবার আলোচনায় তিনি কি কিছু বলেননি- এই প্রশ্নের জবাবে বাঁকা হাসি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘এবার কিন্তু বলেন-টলেন নাই।’ কেন ‘বলেন-টলেন নাই’ তারও কারণ জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। বলেছেন, তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না। খবরটুকু জানাতে গিয়ে ৪ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর এ উত্তরে সবাই হেসে ওঠেন।’
বর্তমান পর্যায়ে কথা বলতে হচ্ছে আসলে প্রধানমন্ত্রীর এই গালগল্পের পরিপ্রেক্ষিতে। ‘বলেন-টলেন নাই’ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে সম্মান দেখানোর কোনো উপাদান রয়েছে কি না পাঠকরা তা ভেবে দেখতে পারেন। তবে মুখে যা-ই বলুন না কেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ও তার মাধ্যমে গঠিত তার বর্তমান সরকার যে এক ভারত ছাড়া কোনো দেশের কাছ থেকেই বৈধতা ও স্বীকৃতি অর্জন করতে পারেনি- সে কথাটা প্রধানমন্ত্রীই সবচেয়ে ভালোভাবে জানেন। ‘তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না’ কথাটাও সত্য নয়। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকারসহ যেসব বিষয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল এবং যেসব সমস্যার কারণে মহাসচিব বান কি মুন জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোকে দূতিয়ালী করার জন্য গত বছর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন সেগুলোর কোনোটিরই এখনো মীমাংসা হয়নি। মিস্টার তারানকোকে সামনে রেখে তৎপর হয়েছিলেন আসলে মহাসচিব বান কি মুন নিজেই। স্মরণ করা দরকার, ডিসেম্বরেই প্রথম নয়, তার আগেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠে সুষ্ঠু ও সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মহাসচিব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বার কয়েক যোগাযোগ করেছিলেন। সমঝোতা ও সংলাপের আহবান জানিয়ে দুই নেত্রীর কাছে প্রথম চিঠি লিখেছিলেন তিনি ২০১৩ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। সে সময়ও, ১০ মে দুই নেত্রীর জন্য মহাসচিবের দুটি চিঠি নিয়ে বিশেষ দূত হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন মিস্টার তারানকো। তিনিও দুই নেত্রীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনড় মনোভাবের কারণে তারানকোর চেষ্টা সফল হতে পারেনি। এরপর ২৩ আগস্ট বান কি মুন দুই নেত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন এবং সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় সমঝোতা আলোচনায় অংশ নেয়ার জন্য তাদের দু’জন করে প্রতিনিধিকে নিউইয়র্কে পাঠানোর অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া সম্মত হলেও প্রধানমন্ত্রী হননি বলে বান কি মুনের সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়। মহাসচিব অবশ্য তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন। দ্রুত আরো জটিল ও ঘনীভূত হতে থাকা সংকটের মধ্যে ক্ষমতাসীনরা একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বান কি মুন আবারও তার একই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল তারানকোকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন ডিসেম্বরে।
ঢাকায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে পালাক্রমে বৈঠক করেছিলেন মিস্টার তারানকো। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে তো দফায় দফায় বসেছেনই, একই সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নির্বাচনে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গেও। আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে মুখ না খুললেও ঝানু এই কূটনীতিক ৯ ডিসেম্বর বলেছিলেন, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতামুখী সদিচ্ছা এবং ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকলে সমস্যার জট খোলা সম্ভব হতে পারে। এ পর্যন্ত এসেই থেমে পড়েছিলেন মিস্টার তারানকো। ফলে আশাবাদী জনগণও থমকে গিয়েছিল। এর কারণ ছিল ক্ষমতাসীনদের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমি এবং আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য অনড় মনোভাব। এর প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছিল অনেক আগে থেকে। যেমন সংকটের সূচনা হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে ছাড় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক বা অন্য যে কোনো কিছু হতে পারে কিন্তু ওই সরকারকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হতে হবে। তাছাড়া শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল থাকলে তার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। বেগম খালেদা জিয়ার দেয়া ছাড় এবং ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থনের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। দিনের পর দিন ধরে অবরোধে অচল হয়ে পড়েছিল সারা দেশ।
অন্যদিকে মিস্টার তারানকোর সম্ভাব্য সাফল্যের সামনেও ক্ষমতাসীনরাই যথারীতি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিলেন। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বরের বৈঠকেও তারা নাকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রাখার জন্য জেদ ধরে বসেছিলেন। অথচ একথা সবারই জানা ছিল যে, শেখ হাসিনাই ছিলেন সব সমস্যার মূল কারণ। আবারও ক্ষমতায় আসার জন্য তার অনড় মনোভাবের কারণেই দেশী-বিদেশী সব মহলের সব চেষ্টাই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে গেছে। মিস্টার তারানকোর উপর্যুপরি অনুরোধকেও ক্ষমতাসীনরা পাশ কাটিয়েছেন। একই কারণে সফলতার মুখ দেখতে পারেনি তারানকোর মাধ্যমে নেয়া জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ। অমন এক ব্যর্থতার পরও বান কি মুন একেবারে নীরব হয়ে যাবেন এবং কিছুই ‘বলবেন না-টলবেন না’ কথাটা আদৌ সত্য হতে পারে কি না এবং ‘তারা বোধ হয় আর কোনো সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন না’ বলেই পার পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীরই উচিত দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা। কারণ, বান কি মুন সেই জাতিসংঘের মহাসচিব- যে সংস্থাটির সঙ্গে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নানামুখী দায়বদ্ধতা রয়েছে। বিশেষ করে রয়েছে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সুযোগ পাওয়া-না পাওয়ার মতো কিছু বিষয়।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন