শেখ হাসিনা কয়েকবার হজ ও ওমরাহ করেছেন।
হিজাব পরে তার উড়োজাহাজ থেকে নামার দৃশ্য নিশ্চয়ই বহু বাংলাদেশীর মনে আছে।
স্ববিরোধিতা এখানে যে, পৌনে ছয় বছর আগে ক্ষমতা পেয়ে তার সরকার
ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছেন বলা চলে। ইসলামপন্থী একটি দলকে ধ্বংস করার
সব কল্পনীয় কৌশল তিনি প্রয়োগ করে দেখেছেন। অনেকে বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্নবিদ্ধ একটি ট্রাইব্যুনালে
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে দলটির নেতাদের ফাঁসি দেয়ার
প্রক্রিয়াও শুরু করা হয়েছিল নেতৃত্বশূন্য করে দলটিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশের মানুষ কি ভুলে গেছে যে, এক
কালে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে তাদের রাজনীতিতে একটা বড় পুঁজি ছিল এই দলটি?
সামরিক শাসক লে. জে. এরশাদ ১৯৮৬ সালে
বিশ্ববাসীর চোখে ধুলো দেয়ার আশায় ৬ মে সংসদ নির্বাচন ডেকেছিলেন। ১৯ এপ্রিল বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাপ প্রভৃতি সব স্বৈরতন্ত্রবিরোধী দল এক বৈঠকে সে নির্বাচন
বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত দু’দিন পরে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে ঘোষণা করে। ১৯৯৫-৯৬ সালে
আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সাথে নিয়ে তত্ত্বাবধায়কপদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য দেশজোড়া
হরতাল, অবরোধ ও নৈরাজ্য শুরু করে। বেশ কয়েকজন লোক সে আন্দোলনে মারা
গিয়েছিলেন। দেশের অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছিল। বলা যেতে পারে, বিশেষ কোনো মহলকে খুশি করার গরজেই জামায়াত সম্বন্ধে আওয়ামী
লীগের নীতি ১৮০ ডিগ্রি মোড় নিলো।
পৌনে ছয় বছর আগে তাদের গদিপ্রাপ্তির অনেকখানি কৃতিত্ব ভারতের
পাওনা। তিনি সেটা জানেন ও বোঝেন এবং বিগত পৌনে ছয় বছর সে জন্য কৃতজ্ঞতা দেখানোর
কোনো চেষ্টারই ত্রুটি তারা রাখেননি। এমনকি বিনা মাশুলে বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদী ও বন্দর ব্যবহারের অবাধ অধিকার
ভারতকে দিয়ে দিয়েছেন। অনেকের মতে, সবই দেয়া হয়ে গেছে ভারতকে। আমাদের
সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি বজায় আছে কি না অনেকে নিশ্চিত হতে পারছেন না।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ২০১১ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে ভারতবিরোধী করে তুলছে জামায়াত। তার পর থেকে
জামায়াতকে ধ্বংস করার পাশাপাশি বাংলাদেশী ইসলামপ্রেমী মানুষের বিরুদ্ধেও নির্যাতন-নিপীড়ন
শুরু হয়ে গেছে। সেকুলারিজমের নামে ধর্মকে নির্বাসিত করার একটা চেষ্টা চলছে বলে অনেকেই
মনে করেন। যারা টুপি পরে মসজিদে নামাজ পড়তে যান, তাদের
বিরুদ্ধে সরকারের গোয়েন্দারা অহরহ লেগে আছে। শুধু ধার্মিক হওয়ার কারণে হাজার হাজার
মানুষ ধরপাকড় ও নির্যাতন সহ্য করেছে। এখনো কারাবন্দী হয়ে আছে অনেকে। আরো
সাম্প্রতিক কালে সজীব ওয়াজেদ জয় এ কথাও বলেছেন যে, মসজিদের
ভেতরে মুসল্লিদের ওপর নজরদারির জন্য গোয়েন্দা ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের পাঠানো হয়।
অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষ নির্ভয়ে আল্লাহর বন্দিগিও করতে পারছে না।
শুধু নামাজ পড়াই যথেষ্ট নয়
এখন হিন্দুদের দুর্গাপূজার মওসুম। দুই
বছর আগে ঢাকায় পূজামণ্ডপে বাংলাদেশে ফসল ভালো হওয়ার জন্য তারাই ‘মা-দুর্গা’কে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের হিন্দুদের মন জয় করে তারা ভারতেরই মন জয় করতে
চেয়েছিলেন। এই ধরনের অবিবেচক উক্তি বাংলাদেশের মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। তার পর
থেকে সাধারণ মানুষের মন থেকে সে ধারণা ধরনের অপনোদনের জন্যই বোধ করি সরকারের
প্রচারযন্ত্রগুলো থেকে প্রায়ই প্রচার চালানো হয়, কে
বা কারা দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন এবং নিয়মিত কুরআন শরিফ তেলাওয়াত করেন।
আমরা আশা করব, তারা অবশ্যই জানেন ইসলামে নির্দেশিত অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্যগুলো
নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াতের মধ্যেই সীমিত নয়। সত্য বলা, মিথ্যা পরনিন্দা বা গিবত না করা, পরের
সম্পত্তি আত্মসাৎ না করা; সর্বোপরি আল্লাহর সৃষ্ট মানুষের প্রাণ
রক্ষা ও সম্মান করাও ইসলামের বিধি। ধর্ম সম্বন্ধে আমি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার
বিশ্বাস,
এই নির্দেশগুলো অমান্য করা ব্যক্তির
নামাজ পড়া কিংবা কুরআন তেলাওয়াত প্রকৃত মুসলমান ও ধার্মিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।
বিগত পৌনে ছয় বছরে বাংলাদেশে কত লোকের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছে, দুর্নীতি করে কত হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, কত নারী ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়েছে, সরকারি নির্দেশ ও পৃষ্ঠপোষকতায় কত মানুষ গুম ও খুন হয়েছে; তার হিসাব কে দেবে?
সংসদের ভেতরে ও বাইরে স্বয়ং স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি
জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে যেসব অকথ্য গালিগালাজ ও মিথ্যা অপবাদ দেয়া
হয়, আমার ধারণায় সেসবই গিবতের পর্যায়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের এক নেতাকে
দলের জ্যেষ্ঠ নেতা সাজেদা চৌধুরীই ‘এ কালের
সর্বশ্রেষ্ঠ বেয়াদব’ বলেছেন। বেয়াদবিতে আরো কেউ কেউ কম যান
না। নেতৃত্ব এদের কাউকে সংযত করার চেষ্টা করেছেন বলে শুনিনি। আমি ভাবছি, এ-পর্যায়ের যে দুই মন্ত্রী হজ করতে গেছেন তারা কি হজ আদায় করার
আগে তাদের সরকারের গণবিরোধী কৃতকর্মের জন্য তাওবা করবেন অথবা দেশে ফিরে আর গিবত
করা থেকে বিরত থাকবেন।
ইসলাম এবং মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের ওপর
সবচেয়ে জঘন্য আঘাত হেনেছেন সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী আবদুল লতিফ
সিদ্দিকী। সরকার প্রধান ১৮৫ জনের যে বিরাট দলবল নিয়ে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন তাদের
একজন ছিলেন এই লতিফ সিদ্দিকী। নিউ ইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে নিউ ইয়র্ক টাঙ্গাইল
সমিতির সদস্যদের সাথে মতবিনিময়কালে তিনি একযোগে ইসলাম, কুরআন ও রাসূলুল্লাহ হজরত মুহাম্মদ সা:-এর বিরুদ্ধে অ্যাটম
বোমা ছুড়েছেন।
ইসলামের বিরুদ্ধে অ্যাটম বোম
কালেমা, নামাজ, রোজা ও জাকাতের মতো হজও কুরআন শরিফের সুস্পষ্ট নির্দেশ এবং
মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করেন কুরআন সরাসরি আল্লাহ তায়ালার বাণী। কিন্তু আবদুল লতিফ
সিদ্দিকী প্রকাশ্যে হজের প্রতি বিরোধিতা ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে
ইসলামীরও বিরোধী। তবে তার চেয়েও হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী।’ তিনি বলেন, ‘এই হজে যে কত ম্যানপাওয়ার (জনশক্তি) নষ্ট
হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনো কাম (কাজ) নাই। এদের
কোনো প্রোডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে। শুধু খাচ্ছে আর দেশের টাকা দিয়ে আসছে।’
হজের উৎপত্তি সম্বন্ধে তার থিওরি জাহির
করতে গিয়ে লতিফ সিদ্দিকী মহানবী সা: সম্বন্ধে কুৎসিত কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি
বলেন, ‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ খুব বুদ্ধিমান ছিল। সে চিন্তা করল
এই আরব জাজিরাতের লোকেরা কিভাবে চলবে। তারা তো ছিল ডাকাত। তখন একটা ব্যবস্থা করল
যে আমার অনুসারীরা প্রতি বছর একবার একসাথে মিলিত হবে। এর মাধ্যমে একটা আয়-ইনকামের
ব্যবস্থা হবে।’
বাংলাদেশে টেলিভিশনের টকশোগুলোতে
অংশগ্রহণকারীদের তিনি অশ্রাব্য এবং উচ্চারণের অযোগ্য ভাষায় গালি দেন। তাদের তিনি ‘টকমারানী’ বলে বর্ণনা করেন।
শুধু ইসলামই নয়, কোনো
ধর্ম সম্বন্ধে কোনো নাস্তিককেও আমি এমন ইতর মন্তব্য করতে শুনিনি। বিশ্বের বহু দেশ
থেকে লাখ লাখ বিশ্বাসী প্রতি বছর ঢাকার অদূরে তুরাগ নদের তীরে সমবেত হয়ে প্রার্থনা
করেন, মুসলিম বিশ্ব ও মানবজাতির কল্যাণ কামনা করেন। বাংলাদেশের ১৪ কোটি
মানুষ বিশ্বাসী মুসলমান। সারা বিশ্বে ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের সংখ্যা সর্বশেষ হিসাব
অনুযায়ী ২০০ কোটি আট লাখ। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন বহু ভিন্নধর্মী ইসলাম ধর্মকে বরণ
করছেন। এদের কারো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধা থাকলেও আবদুল লতিফ
সিদ্দিকী এমন জঘন্য উক্তি করতে পারতেন না।
মানীর অপমান আল্লাহর অবমাননা
দেশে একটা বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ হচ্ছে ‘মানীর মান খোদায় রাখে’। অর্থাৎ যারা
প্রকৃতই শ্রদ্ধার পাত্র, আল্লাহও তাদের দয়া প্রদর্শন করেন। বিগত
পৌনে ছয় বছর ধরে লক্ষ করছি, সরকারের লোকেরা কাউকে শ্রদ্ধা করায়
বিশ্বাস করেন না। আওয়ামী লীগের নেতারা, সরকারের
মন্ত্রীরা অনর্গল রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি মুখে বিষ্ঠা বর্ষণ করে যাচ্ছেন। সাধারণ
মানুষ আশা করে,
সরকারের যিনি প্রধান তিনি তার অধীনদের
আচার-ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সংযত করবেন। বর্তমান সময়ে ঘটছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
সরকারপ্রধান নিজেও বিরোধীদের প্রতি গিবতে অংশ নিচ্ছেন। তার থেকে মন্ত্রীরা এই
ইঙ্গিতই পাচ্ছেন যে তাদের গালিগালাজ সরকারপ্রধান কানে মধু বর্ষণই করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কান ও মন পাওয়ার আশায় তাদের মধ্যে ইতর উক্তি ও আচরণের প্রতিযোগিতা
শুরু হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। সুরা ও মাদকের প্রভাবে দুর্বলমতি মানুষ অনেক সময়
উল্টাপাল্টা বেফাঁস কথা বলে ফেলে। কিন্তু আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মনে কোনো আক্ষেপ
কিংবা অনুশোচনা আছে বলে মনে হয় না। নিউ ইয়র্ক থেকে তিনি মেক্সিকোতে গিয়েছিলেন।
সেখান থেকে বিবিসি রেডিওকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিচ্ছি। দায়িত্ব নেবো না মানে? আমি যা বলব, তার দায়িত্ব নেবো না, কে বলল আপনাকে? আমি
একজন দায়িত্বশীল লোক।’ লোকটার একগুঁয়েমি ও স্পর্ধা অবাক হওয়ার
মতো।
কথা হচ্ছে, মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সম্বন্ধে সরকারপ্রধান ও দলীয়
নেত্রী কী ব্যবস্থা নেন। তার সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত দরাজ
হাতে মিথ্যা মামলা করছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই কথায় কথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার
অভিযোগ করছেন বিরোধীদলীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বিশ্বের সব
মহাদেশে ছড়িয়ে থাকা ২০০ কোটিরও বেশি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করেছেন। উৎসাহ না
হলেও অন্তত প্রশ্রয় দেয়ার কারণে অনেকেই সে জন্য কিছুটা দায়ী।
মুসলিম দেশগুলোর প্রতি ভ্রান্তনীতি
অনুসরণ করে সরকার তাদের সাথে অসদ্ভাব সৃষ্টি করেছেন। তার পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেসব দেশে আমাদের শ্রমিকদের কর্মসংস্থান এবং সেসব দেশ থেকে
রেমিট্যান্সে ধস নামার মাধ্যমে। বিশ্ব মুসলিমের ধর্মানুভূতিতে আঘাতের উপযুক্ত
প্রতিবিধান না হলে বাংলাদেশকে আরো চড়া মূল্য দিতে হবে।
বাংলাদেশের আইনেও (সম্ভবত ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারা) কারো
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার শাস্তি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড। সেটা একজনের
ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর আঘাতের বেলায়ও প্রযোজ্য। আলোচ্য ক্ষেত্রে ২০০ কোটি মানুষের
ধর্মীয় অনুভূতিতে মারাত্মক আঘাত হানা হয়েছে। সে জন্য লতিফ সিদ্দিকীর আরো গুরুদণ্ড
হওয়া উচিত। সরকার ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের মুসলমানদের মনে এ ধারণা সৃষ্টি করেছে যে, তাদের হাতে ইসলাম নিরাপদ নয়। তারা বিপন্ন বোধ করছে। লতিফ সিদ্দিকী
দেশে ফেরা মাত্রই তাকে গ্রেফতার করে তার গুরুদণ্ডের বিধান করা না হলে ১৪ কোটি
মুসলমান নিশ্চুপ থাকবে বলে মনে হয় না।
সিরাজুর রহমান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন