বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন
সূত্রে আসা সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ইতালি সফর শেষে দেশে ফিরে গত
বৃহস্পতিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তাতে তিনি তার স্বভাবসুলভ
হাস্য কৌতুক করে বাছাই করা আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকদের আনন্দ দিয়েছেন। আমরা
টেলিভিশনের পর্দায় সে সম্মেলন দেখে কৃতার্থ বোধ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের
সংবাদ সম্মেলনে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ। সংবাদপত্রের যেসব সাংবাদিককে
আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাদের সাংবাদিক পরিচয়ের চেয়ে দলীয়
পরিচয়ে চেনেন সমাজের লোকজন। ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারেন, তথাকথিত সংবাদ সম্মেলনে এমন সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। এটা
সুকুমার রায়ের ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ ছড়ার
মতো। করে নাকো ফুঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস, সে রকম গোটা দুই সাপ নিয়ে আসার নির্দেশ। সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো, তেড়েমেড়ে
ডাণ্ডা করে দেবো ঠাণ্ডা। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন এখন ফুঁসফাঁস ঢুসঢাস না
করাদের এক আমোদ বৈঠক।
এমন একটি পপিচুস (পরস্পর পিঠ চুলকানো সমিতি) আয়োজিত হলে হাস্যরসের জন্ম হওয়া তো অনিবার্য হয়ে ওঠে। হয়ও। আর আমরা দু’নয়ন ভরে তা উপভোগ করি। এসব এমবেডেড সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ও জবাবের ধারা একই। প্রকৃত সাংবাদিকদের মতো প্রশ্ন করতে পারেন না বা করতে চান না। সম্ভবত বিধানও নেই। সেখানে একই লোক সাবধানী তৈলমর্দনমূলক প্রশ্ন করেন। শেখ হাসিনা যেমন খুশি জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রীও তৃপ্ত, এমবেডেড সাংবাদিকরাও তৃপ্ত। এভাবেই অনেক দিন যাবৎ চলছে। ২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
আওয়ামী ঘরানার একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিএনপির সাথে সরকার কোনো আলোচনায় বসছে কি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, প্রশ্নটি ছিল খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত। আসলে তা ছিল শেখ হাসিনাকে তার শ্লেষাত্মক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং সে জবাবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। সুযোগটি লুফে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বারবার ওই খুনিদের সাথে বসার জন্য এত আকুলিবিকুলি কেন? বিএনপি কী দিয়েছে? প্রতিদিন বোমার আওয়াজ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি না শুনলে আপনাদের ভালো লাগে না, নাকি শান্তিতে থাকতে ভালো লাগে না? যারা রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে চলে গেছে, তাদের জন্য আপনাদের এত দরদ কেন? সংলাপ প্রশ্নে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে, এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাইবার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে, তখন কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার আসে কেন?
কেন যে ‘দরদ’, সে বিষয়ে উপস্থিত ‘সাংবাদিকেরা’ আর কোনো কথা বলেননি। সেটাই স্বাভাবিক।
এরপর তিনি ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ছিলাম, তাই অনেক কিছু করতে পারিনি। এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে। এবার দেশের মানুষের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, দেশের একটি মানুষের ক্ষতি করলে খবর আছে। যে যেখানে পারেন, সেখানেই তাদের প্রতিরোধ করবেন। আমরা আপনাদের সাথে আছি। আবার একই অনুষ্ঠানে তিনি হজ, তাবলিগ ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কটূক্তি করায় সম্প্রতি অপসারিত আওয়ামী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার দাবিতে সম্মিলিত ইসলামি দলগুলোর হরতাল আহ্বানের সমালোচনা করে বলেন, যখনই মামলার (খালেদা জিয়ার) তারিখ পড়ে, তখনই হুমকি ধমকি আর হরতালের ঘোষণা আসে। তিনি যেহেতু দুর্নীতি করেছেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন, তাই মামলার হাজিরা থেকে বাঁচার জন্য হরতাল ডাকা হয়। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। না হলে মামলার মোকাবেলা করতে ভয় কিসের?
তিনি বলেন, দেশী বিদেশী যারাই এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যেসব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ দেশে অবস্থান করে সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলেছেন তাদের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা একটি প্রশ্নও তোলেননি। বরং সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এখনো যারা সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন, তারা হয় কূপমণ্ডূপতায় ভুগছেন আর না হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন। বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের তরফ থেকে সংলাপের তাগিদ দেয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান বিরোধী দল তো সংসদের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখেছে। তারা তো ফাইল ছোড়াছুড়ি করছে না। আর যে দল নির্বাচনই করেনি, তাদের নিয়ে তো কারো মাথাব্যথা নেই।
পরে রেল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, রেলের জন্য খরচটাও বেড়ে গিয়েছিল। খরচ বাড়ার কারণে বিশ্বব্যাংক যখন এগিয়ে এলো, তাদের সহযোগিতা নিতে গেলাম। পরে একটা সময় দুর্নীতি-টুর্নীতি, হাবিজাবি বলেটলে চেষ্টা করল এটাকে ঠেকাতে। দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের কথা বলে বিশ্বব্যাংক প্রথমে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। অনেক নাটকীয়তার পর গত বছর জানুয়ারিতে ওই প্রকল্পে তাদের অর্থ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। তিনি বলেন, এটা অন্য কারণে, প্রকৃত দুর্নীতি কোনো কিছুই হয়নি। কেউ বের করতে পারেনি; কিন্তু বিষয়টা ছিল একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি গাড়ি পোড়াল বা রেল পোড়াল, ঠিক সেই রকম উদ্দেশ্যে কোনো কোনো মহল থেকে এ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমরা সেটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু করব।
প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক কথাই বলেছেন। ধারাবাহিকভাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। দেশের কোনো সেক্টরেই যে স্বাভাবিক অবস্থা নেই চোখ কান খোলা রাখলে যে কেউ সে সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন। রাজনীতিতে যে দলন-পীড়ন এখন চলছে, তা অনেকাংশে ১৯৭২-৭৫ সালের দমন-পীড়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দল বলতে তিনি জাতীয় পার্টিকে মিন্ করতে অনেক স্বস্তিবোধ করছেন। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের আগে বানরের পিঠা ভাগাভাগির মতো সংসদের আসনগুলো এরশাদ-হাসিনা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিরোধী দল সদস্যরা সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। তাকে সিএমএইচে বন্দী রেখে রওশনকে দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেখিয়ে এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। জাতীয় পার্টির যারা সংসদ সদস্য ঘোষিত হয়েছেন তাদের অনেকে জানতেনই না যে তারা এমপি হয়েছেন। সে রকম একটি বিরোধী দলকে প্রকৃত বিরোধী দল বলতে শেখ হাসিনা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেমন অনুগত সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। এ বিরোধী দলের প্রধান গুণ তারা প্রশ্ন করে না ও ফাইল ছোড়াছুড়ি করে না। যার যার নিজের নিজের ধান্ধায় তারা ব্যস্ত আছেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এমন এক বিরোধী দল চান যারা কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করবে না। দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেলেও না। অন্যায়, জোরজবরদস্তি, জুলুম, নির্যাতন হলেও প্রশ্ন করবে না। যেমন করে না জাতীয় পার্টি। ফলে তার দরকার জাতীয় পার্টি মার্কা বিরোধী দলই। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা স্মরণ করতে পারেন যে, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তিনি কী করেছেন।
এবার আশা যায় প্রধানমন্ত্রীর আকুলিবিকুলি নিয়ে। বিএনপির সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, খুনিদের সাথে বসার জন্য সাংবাদিকদের এত আকুলিবিকুলি কেন? তিনি বলতে চেয়েছেন যে, বিএনপি আমলে প্রতিদিন বোমা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি হতো। এখন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিকদের কি সেটা ভালো লাগছে না? শান্তি যে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন প্রতিদিন ১৫-২০ জন করে দেশে মানুষ খুন হচ্ছে। সে খুন হচ্ছে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক কলহ প্রভৃতি নিয়ে। মুক্তিপণের জন্য প্রতিদিন অপহৃত হচ্ছে শিশুসহ বহু সংখ্যক মানুষ। সে মুক্তিপণ আদায়কারীর তালিকায় যোগ দিয়েছে দলীয়কৃত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। এসব বাহিনীর লোকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জীবন দিচ্ছে বা পঙ্গুত্ব বরণ করছে প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ। তারপরও তিনি বলতে চাইছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন এমন দাবি তুললেন, প্রকৃত সাংবাদিক কেউ হাজির থাকলে তাকে এই চিত্র স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, সংলাপ প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাওয়ার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে তখন কি কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার এ কথা আসে কেন? তারপর বরাবরের মতোই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রভৃতি ঘটনা উত্থাপন করে বলেন, খালেদা জিয়া সহযোগী। তার ছেলে আসামি। কেউ প্রশ্ন করল না এ মামলায় তো তারেক রহমান আসামি ছিলেন না। পরে কেন জবরদস্তিমূলকভাবে তাকে আসামি করা হলো? প্রশ্নকর্তা বিবিসির সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন দেশে যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রয়েছে, তা যারা চাইবে না, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা যারাÑ তারাই খুনিদের সাথে বসার কথা বলে। তার এই বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব থেকে বিবিসির ওই সাংবাদিক পর্যন্ত ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মায় পরিণত হলো। সাবাস শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেছেন, মামলায় হাজিরা দিতে খালেদা জিয়ার ভয়। এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন এই জন্য কোর্টে যেতে ভয়। মামলায় হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করুন চুরি করেননি। আমাদের প্রশ্ন মামলায় হাজিরা দিতে তিনি কি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? তার ডেকে আনা সামরিক সরকার তার এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আঁতাতের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমেই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তুলে নিয়েছিলেন; কিন্তু বহাল রেখে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও আরো কিছু মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। একইভাবে বিএনপি নেতাদের এক একজনের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার কোনোটা যুক্তির বিচারে টেকে না। উপরন্তু বিচার বিভাগ দলীয়করণের ফলে এখন মানুষ ন্যায়বিচার নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। ন্যায়বিচার তিরোহিত। জানমালের নিরাপত্তা শূন্যের কোঠায়। অর্থনীতি ধ্বংসোন্মুখ। জনশক্তি ও গার্মেন্ট রফতানিতে ধস। এর সমাধান জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, গণতন্ত্র। আর এখন সেটা নেই বলেই সাংবাদিকদের এমন আকুলিবিকুলি।
এমন একটি পপিচুস (পরস্পর পিঠ চুলকানো সমিতি) আয়োজিত হলে হাস্যরসের জন্ম হওয়া তো অনিবার্য হয়ে ওঠে। হয়ও। আর আমরা দু’নয়ন ভরে তা উপভোগ করি। এসব এমবেডেড সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ও জবাবের ধারা একই। প্রকৃত সাংবাদিকদের মতো প্রশ্ন করতে পারেন না বা করতে চান না। সম্ভবত বিধানও নেই। সেখানে একই লোক সাবধানী তৈলমর্দনমূলক প্রশ্ন করেন। শেখ হাসিনা যেমন খুশি জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রীও তৃপ্ত, এমবেডেড সাংবাদিকরাও তৃপ্ত। এভাবেই অনেক দিন যাবৎ চলছে। ২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
আওয়ামী ঘরানার একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিএনপির সাথে সরকার কোনো আলোচনায় বসছে কি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, প্রশ্নটি ছিল খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত। আসলে তা ছিল শেখ হাসিনাকে তার শ্লেষাত্মক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং সে জবাবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। সুযোগটি লুফে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বারবার ওই খুনিদের সাথে বসার জন্য এত আকুলিবিকুলি কেন? বিএনপি কী দিয়েছে? প্রতিদিন বোমার আওয়াজ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি না শুনলে আপনাদের ভালো লাগে না, নাকি শান্তিতে থাকতে ভালো লাগে না? যারা রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে চলে গেছে, তাদের জন্য আপনাদের এত দরদ কেন? সংলাপ প্রশ্নে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে, এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাইবার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে, তখন কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার আসে কেন?
কেন যে ‘দরদ’, সে বিষয়ে উপস্থিত ‘সাংবাদিকেরা’ আর কোনো কথা বলেননি। সেটাই স্বাভাবিক।
এরপর তিনি ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ছিলাম, তাই অনেক কিছু করতে পারিনি। এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে। এবার দেশের মানুষের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, দেশের একটি মানুষের ক্ষতি করলে খবর আছে। যে যেখানে পারেন, সেখানেই তাদের প্রতিরোধ করবেন। আমরা আপনাদের সাথে আছি। আবার একই অনুষ্ঠানে তিনি হজ, তাবলিগ ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কটূক্তি করায় সম্প্রতি অপসারিত আওয়ামী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার দাবিতে সম্মিলিত ইসলামি দলগুলোর হরতাল আহ্বানের সমালোচনা করে বলেন, যখনই মামলার (খালেদা জিয়ার) তারিখ পড়ে, তখনই হুমকি ধমকি আর হরতালের ঘোষণা আসে। তিনি যেহেতু দুর্নীতি করেছেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন, তাই মামলার হাজিরা থেকে বাঁচার জন্য হরতাল ডাকা হয়। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। না হলে মামলার মোকাবেলা করতে ভয় কিসের?
তিনি বলেন, দেশী বিদেশী যারাই এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যেসব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ দেশে অবস্থান করে সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলেছেন তাদের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা একটি প্রশ্নও তোলেননি। বরং সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এখনো যারা সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন, তারা হয় কূপমণ্ডূপতায় ভুগছেন আর না হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন। বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের তরফ থেকে সংলাপের তাগিদ দেয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান বিরোধী দল তো সংসদের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখেছে। তারা তো ফাইল ছোড়াছুড়ি করছে না। আর যে দল নির্বাচনই করেনি, তাদের নিয়ে তো কারো মাথাব্যথা নেই।
পরে রেল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, রেলের জন্য খরচটাও বেড়ে গিয়েছিল। খরচ বাড়ার কারণে বিশ্বব্যাংক যখন এগিয়ে এলো, তাদের সহযোগিতা নিতে গেলাম। পরে একটা সময় দুর্নীতি-টুর্নীতি, হাবিজাবি বলেটলে চেষ্টা করল এটাকে ঠেকাতে। দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের কথা বলে বিশ্বব্যাংক প্রথমে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। অনেক নাটকীয়তার পর গত বছর জানুয়ারিতে ওই প্রকল্পে তাদের অর্থ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। তিনি বলেন, এটা অন্য কারণে, প্রকৃত দুর্নীতি কোনো কিছুই হয়নি। কেউ বের করতে পারেনি; কিন্তু বিষয়টা ছিল একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি গাড়ি পোড়াল বা রেল পোড়াল, ঠিক সেই রকম উদ্দেশ্যে কোনো কোনো মহল থেকে এ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমরা সেটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু করব।
প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক কথাই বলেছেন। ধারাবাহিকভাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। দেশের কোনো সেক্টরেই যে স্বাভাবিক অবস্থা নেই চোখ কান খোলা রাখলে যে কেউ সে সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন। রাজনীতিতে যে দলন-পীড়ন এখন চলছে, তা অনেকাংশে ১৯৭২-৭৫ সালের দমন-পীড়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দল বলতে তিনি জাতীয় পার্টিকে মিন্ করতে অনেক স্বস্তিবোধ করছেন। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের আগে বানরের পিঠা ভাগাভাগির মতো সংসদের আসনগুলো এরশাদ-হাসিনা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিরোধী দল সদস্যরা সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। তাকে সিএমএইচে বন্দী রেখে রওশনকে দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেখিয়ে এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। জাতীয় পার্টির যারা সংসদ সদস্য ঘোষিত হয়েছেন তাদের অনেকে জানতেনই না যে তারা এমপি হয়েছেন। সে রকম একটি বিরোধী দলকে প্রকৃত বিরোধী দল বলতে শেখ হাসিনা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেমন অনুগত সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। এ বিরোধী দলের প্রধান গুণ তারা প্রশ্ন করে না ও ফাইল ছোড়াছুড়ি করে না। যার যার নিজের নিজের ধান্ধায় তারা ব্যস্ত আছেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এমন এক বিরোধী দল চান যারা কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করবে না। দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেলেও না। অন্যায়, জোরজবরদস্তি, জুলুম, নির্যাতন হলেও প্রশ্ন করবে না। যেমন করে না জাতীয় পার্টি। ফলে তার দরকার জাতীয় পার্টি মার্কা বিরোধী দলই। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা স্মরণ করতে পারেন যে, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তিনি কী করেছেন।
এবার আশা যায় প্রধানমন্ত্রীর আকুলিবিকুলি নিয়ে। বিএনপির সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, খুনিদের সাথে বসার জন্য সাংবাদিকদের এত আকুলিবিকুলি কেন? তিনি বলতে চেয়েছেন যে, বিএনপি আমলে প্রতিদিন বোমা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি হতো। এখন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিকদের কি সেটা ভালো লাগছে না? শান্তি যে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন প্রতিদিন ১৫-২০ জন করে দেশে মানুষ খুন হচ্ছে। সে খুন হচ্ছে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক কলহ প্রভৃতি নিয়ে। মুক্তিপণের জন্য প্রতিদিন অপহৃত হচ্ছে শিশুসহ বহু সংখ্যক মানুষ। সে মুক্তিপণ আদায়কারীর তালিকায় যোগ দিয়েছে দলীয়কৃত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। এসব বাহিনীর লোকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জীবন দিচ্ছে বা পঙ্গুত্ব বরণ করছে প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ। তারপরও তিনি বলতে চাইছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন এমন দাবি তুললেন, প্রকৃত সাংবাদিক কেউ হাজির থাকলে তাকে এই চিত্র স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, সংলাপ প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাওয়ার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে তখন কি কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার এ কথা আসে কেন? তারপর বরাবরের মতোই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রভৃতি ঘটনা উত্থাপন করে বলেন, খালেদা জিয়া সহযোগী। তার ছেলে আসামি। কেউ প্রশ্ন করল না এ মামলায় তো তারেক রহমান আসামি ছিলেন না। পরে কেন জবরদস্তিমূলকভাবে তাকে আসামি করা হলো? প্রশ্নকর্তা বিবিসির সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন দেশে যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রয়েছে, তা যারা চাইবে না, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা যারাÑ তারাই খুনিদের সাথে বসার কথা বলে। তার এই বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব থেকে বিবিসির ওই সাংবাদিক পর্যন্ত ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মায় পরিণত হলো। সাবাস শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেছেন, মামলায় হাজিরা দিতে খালেদা জিয়ার ভয়। এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন এই জন্য কোর্টে যেতে ভয়। মামলায় হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করুন চুরি করেননি। আমাদের প্রশ্ন মামলায় হাজিরা দিতে তিনি কি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? তার ডেকে আনা সামরিক সরকার তার এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আঁতাতের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমেই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তুলে নিয়েছিলেন; কিন্তু বহাল রেখে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও আরো কিছু মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। একইভাবে বিএনপি নেতাদের এক একজনের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার কোনোটা যুক্তির বিচারে টেকে না। উপরন্তু বিচার বিভাগ দলীয়করণের ফলে এখন মানুষ ন্যায়বিচার নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। ন্যায়বিচার তিরোহিত। জানমালের নিরাপত্তা শূন্যের কোঠায়। অর্থনীতি ধ্বংসোন্মুখ। জনশক্তি ও গার্মেন্ট রফতানিতে ধস। এর সমাধান জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, গণতন্ত্র। আর এখন সেটা নেই বলেই সাংবাদিকদের এমন আকুলিবিকুলি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন