জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রায় চার দশকে আমরা আমাদের ঘর সামলাতে সক্ষম হইনি। পারিনি শক্ত মাটিতে পা রেখে পথ চলতে। কে আমাদের বন্ধু এবং কে আমাদের শত্রু, তা-ও সঠিকভাবে চিনতে পারিনি। শোনা যায়, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের নামে যে প্রহসন সংঘটিত হয়, তার অদূরে এক বটগাছে বহুসংখ্যক শকুনি সেদিন যেভাবে চোখ মেলে তাকাচ্ছিল, আজও সেই বটগাছটিতে শকুনিদের উত্তর-পুরুষরা ডানা ঝাঁপটায় আর তেমনই বিস্ফারিত নয়নে আগ্রহভরে তাকিয়ে রয়েছে। কথাগুলো অভিযোগের সুরে বললেও কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না রেখেই বলছি, আমরা হতভাগ্য। যে রাষ্ট্রের জন্ম হলো মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে, সেই রাষ্ট্রের এমন বেহালদশা কেন? এখন পর্যন্ত কেন কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান কর্তৃত্বব্যঞ্জক কর্তৃত্বের অধিকারী হলো না? কেন জাতীয় সংসদ অভিযোগ-প্রতি অভিযোগ এবং বাকবিতন্ডার ঊর্ধ্বে উঠে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দানের সংস্থায় রূপায়িত হলো না? কেন রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রয়োগকারীরা এককভাবে পথচলার দুঃসাহস পাচ্ছেন? দেশের বিচার বিভাগ এখন পর্যন্ত কেন সব বিতর্কের ঊর্ধে? উঠে সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারল না? রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থা কেন সংবিধানের দিকে না তাকিয়ে ক্ষমতাসীনদের দিকে দৃষ্টি রেখেই এখনো পথ চলে? এই ভাঙাচোরা, অনিশ্চিত ও অসহায় অবস্থায়, অনেক অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী টিকে রয়েছে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের শক্তিশালী এক মাধ্যমরূপে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার বৃহত্তর পরিম-লে এই যে বিসদৃশ অ্যাসিমেট্রি, তা-ই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শকুনিদের দৃষ্টির জ্যোতিকেন্দ্রে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে পথে পা বাড়িয়েছে, সে পথ দুর্গম। সে পথ অগম্য। সে পথ ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত। মনে হয়, অনেকটা জেনেশুনেই দেশের রাজনীতিকরা রয়েছেন কণ্টকাকীর্ণ এই পথে। কেন, কীসের লোভে, কোন উদ্দেশ্যে তারা এই পথে পা বাড়িয়েছেন তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু যেজন্য রাজনীতি এবং যাদের জন্য রাজনীতি এবং যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির জন্ম তা যে এ পথে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়, তা সবাই জানেন। সব বুঝে-শুনে বাংলাদেশের রাজনীতির কুশীলবরা এই পথে চলেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তত্ত্বগত দিক থেকে তা ঠিক বটে, কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হয় এই ভেবে যে একজন রাজনৈতিক নেতা অন্যজনকে এতটুকু বিশ্বাস করেন না। একদল অন্য দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে দেশের দুটি বৃহৎ দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার তাপে রাজনীতির সৌকর্য এ দেশে প্রতিনিয়ত ঝলসে যাচ্ছে। সংঘাতের পথ প্রশস্ত হয়েছে। নির্মম হানাহানির মুখু ব্যাদানে জাতীয় অর্জনের বিরাট অংশ ক্ষয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটময়। আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশের এই তেতাল্লিশ বছরের মধ্যে এমন অনিশ্চয়তা আর সৃষ্টি হয়নি। সব মহলেই একটা উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যেন চারদিক থেকে আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। ক্ষমতাসীন দলের চিন্তাভাবনাটাই হলো এমন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তাদের খুব নিকট সম্পর্ক দেখি না। অতীতেও দেখিনি এবং এখনও দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র যেন একসাথে চলতে পারে না।
বহুবার বলেছি, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ জয়যাত্রা শুরু করে গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। এ জাতি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। মাত্র আড়াই-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। এ কাজটিও সম্পন? হয় রাজনীতিকদের দ্বারাই। জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হয়ে ওঠে ধুলায়ধূসরিত। মানবাধিকার হয় ভূলুণ্ঠিত। অগণতান্ত্রিকতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় দেশটি। দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রাম-অভিযান এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নকুনভাবে এ দেশে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হয়, সব দল ও মতের ঐকমত্যের বিস্তৃত মোহনায়। পথহারা পথিক একবার যদি সেই পথের সন্ধান পায়, সবাই বিশ্বাস করেন, সেসব কিছু হারাতে পারে; কিন্তু আর হারায় না সেই পথ। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা পর্যালোচনা করে আমরাও সেই বিশ্বাসে ছিলাম বলীয়ান। প্রতিদিনের দলীয় কর্মকা-ের নিরিখে কিন্তু জাতি এখন অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। যে জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছে, সেই জনগণও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চকণ্ঠকে দেখছেন গভীর সন্দেহের চোখে।
বাংলাদেশ এখন খুন-গুমের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল বা বিরোধী মতকে দমন করতে শাসক দল কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতি তা ই বুঝিয়ে দিচ্ছে। ৫ জানুয়ারি যেনতেনভাবে নির্বাচন করে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা কী জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন? যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি, সেই নির্বাচনে গঠিত সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাই বা কতটুকু। ৯০ এর পর দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মেয়াদ শেষে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। পরপর ৩টি নির্বাচনই হয়েছিল নিদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দেখার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৩টি নির্বাচনের কোনটিতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচিত হতে পারেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে তৎকালীন ৪ দলীয় জোট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া করেছিল, তা কিন্তু সফল হয়নি। সে সময় আমরা রাজপথে দেখলাম আন্দোলনের একটা ভিন্ন রূপ। সে সময় ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য রাজপথে পিটিয়ে মারা দৃশ্য কোন গণতন্ত্রকামী মানুষ মেনে নিতে পারে না। ২৮ অক্টোবর যে ঘটনা ঘটেছিল তা হঠাৎ ঘটেনি, এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। সেই চক্রান্তের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশকে একটা অকার্যকর ও পরনির্ভরশীল একটা রাষ্ট্রে পরিণত করা।
যেহেতু শাসনকারী এলিটরা সমাজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীভুক্ত, দল ও মতের বিভিন্ন তার কারণে তাদের মধ্যে কোনো কোনো সময় দ্বন্দ্বও দেখা দেয়। ক্ষমতালিপ্সা তখন মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করে। কাজ চালানো গোছের ঐক্য গড়ে উঠতে বিলম্ব হয় না। এর ফলে দেখা যায়, ক’দিন আগেও যিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেলে দল ত্যাগ করে অবিলম্বে তিনি ছুটে আসেন। কেউ কেউ দিনের বেলা সরকারবিরোধী অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দিচ্ছেন, সন্ধ্যা হলে তারাই ছোটেন বঙ্গভবনে। ক্ষমতাই যখন প্রধান লক্ষ্য তখন কপটতা, ভন্ডামি, ষড়যন্ত্র- সবই গ্রহণযোগ্য! সব কিছুই চলে সীমাহীন চতুরতার সঙ্গে, সমানতালে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে আমি বরাবর উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি। তাদের দক্ষতার জন্য নয়, বরং আন্তরিকতা এবং জনকল্যাণের প্রতি তাদের আগ্রহের জন্য। তাছাড়া দেশের রাজনীতিক ছাড়া রাষ্ট্রকে নিরাপদ কে রাখতে পারেন? কেই বা রাষ্ট্রকে অগ্রগতির পথে টেনে আনবেন? আমার অনুযোগ একটাই এবং তা হলো যখন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তখন তারা বিভক্ত, কিন্তু যখন বিভক্ত হওয়ার সময়, যেমন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সময়, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হন। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তির। এ মুহূর্তে হিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এখন মিলনের, অন্তরঙ্গ পরিবেশের, সহনশীলতার, সহযোগিতার, অভ্যন্তরের অপশক্তিকে বিনাশের এবং বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামলানোর। এখন ধীরস্থিরভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। সৃজনমূলক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এর প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের অজেয় করে তোলা- যেন জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে তারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হন।
প্রফেসর কোহাকের কথায়- ‘গণতন্ত্র হলো পরিপূর্ণতার, অসম্পূর্ণতার নয়। গণতন্ত্র হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার, সংঘাত বা সংঘর্ষের নয়। গণতন্ত্র হলো আদর্শের, লোভের নয়। [‘Democracy is about maturity, not pettiness, about goodwill, not contentiousness; idealism, not greed]। সর্বোপরি গণতন্ত্র হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের, সহযোগিতার, নির্মমতার নয়, নয় বৈরিতার। সাময়িকভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা এবং জনকল্যাণমূলক বিধি বিধানের ভিত যদি শক্তিশালী হয় এবং জনগণ যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায়বিচার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে, তাহলে সঙ্কটও কেটে যায়। কেননা এগুলোই ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রের বিভূষণ। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, প্রতিশোধমূলক আচরণ, বিশেষ করে হীন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কৃত্যকদের লেলিয়ে দিলে এবং ফলে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হলে সেই বিভূতি বিনষ্ট হয়। তখন সরকারের সফলতাকেও জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করে না।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে পথে পা বাড়িয়েছে, সে পথ দুর্গম। সে পথ অগম্য। সে পথ ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত। মনে হয়, অনেকটা জেনেশুনেই দেশের রাজনীতিকরা রয়েছেন কণ্টকাকীর্ণ এই পথে। কেন, কীসের লোভে, কোন উদ্দেশ্যে তারা এই পথে পা বাড়িয়েছেন তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু যেজন্য রাজনীতি এবং যাদের জন্য রাজনীতি এবং যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির জন্ম তা যে এ পথে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়, তা সবাই জানেন। সব বুঝে-শুনে বাংলাদেশের রাজনীতির কুশীলবরা এই পথে চলেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তত্ত্বগত দিক থেকে তা ঠিক বটে, কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হয় এই ভেবে যে একজন রাজনৈতিক নেতা অন্যজনকে এতটুকু বিশ্বাস করেন না। একদল অন্য দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে দেশের দুটি বৃহৎ দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার তাপে রাজনীতির সৌকর্য এ দেশে প্রতিনিয়ত ঝলসে যাচ্ছে। সংঘাতের পথ প্রশস্ত হয়েছে। নির্মম হানাহানির মুখু ব্যাদানে জাতীয় অর্জনের বিরাট অংশ ক্ষয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটময়। আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশের এই তেতাল্লিশ বছরের মধ্যে এমন অনিশ্চয়তা আর সৃষ্টি হয়নি। সব মহলেই একটা উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যেন চারদিক থেকে আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। ক্ষমতাসীন দলের চিন্তাভাবনাটাই হলো এমন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তাদের খুব নিকট সম্পর্ক দেখি না। অতীতেও দেখিনি এবং এখনও দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র যেন একসাথে চলতে পারে না।
বহুবার বলেছি, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ জয়যাত্রা শুরু করে গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। এ জাতি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। মাত্র আড়াই-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। এ কাজটিও সম্পন? হয় রাজনীতিকদের দ্বারাই। জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হয়ে ওঠে ধুলায়ধূসরিত। মানবাধিকার হয় ভূলুণ্ঠিত। অগণতান্ত্রিকতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় দেশটি। দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রাম-অভিযান এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নকুনভাবে এ দেশে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হয়, সব দল ও মতের ঐকমত্যের বিস্তৃত মোহনায়। পথহারা পথিক একবার যদি সেই পথের সন্ধান পায়, সবাই বিশ্বাস করেন, সেসব কিছু হারাতে পারে; কিন্তু আর হারায় না সেই পথ। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা পর্যালোচনা করে আমরাও সেই বিশ্বাসে ছিলাম বলীয়ান। প্রতিদিনের দলীয় কর্মকা-ের নিরিখে কিন্তু জাতি এখন অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। যে জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছে, সেই জনগণও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চকণ্ঠকে দেখছেন গভীর সন্দেহের চোখে।
বাংলাদেশ এখন খুন-গুমের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল বা বিরোধী মতকে দমন করতে শাসক দল কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতি তা ই বুঝিয়ে দিচ্ছে। ৫ জানুয়ারি যেনতেনভাবে নির্বাচন করে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা কী জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন? যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি, সেই নির্বাচনে গঠিত সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাই বা কতটুকু। ৯০ এর পর দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মেয়াদ শেষে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। পরপর ৩টি নির্বাচনই হয়েছিল নিদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দেখার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৩টি নির্বাচনের কোনটিতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচিত হতে পারেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে তৎকালীন ৪ দলীয় জোট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া করেছিল, তা কিন্তু সফল হয়নি। সে সময় আমরা রাজপথে দেখলাম আন্দোলনের একটা ভিন্ন রূপ। সে সময় ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য রাজপথে পিটিয়ে মারা দৃশ্য কোন গণতন্ত্রকামী মানুষ মেনে নিতে পারে না। ২৮ অক্টোবর যে ঘটনা ঘটেছিল তা হঠাৎ ঘটেনি, এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। সেই চক্রান্তের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশকে একটা অকার্যকর ও পরনির্ভরশীল একটা রাষ্ট্রে পরিণত করা।
যেহেতু শাসনকারী এলিটরা সমাজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীভুক্ত, দল ও মতের বিভিন্ন তার কারণে তাদের মধ্যে কোনো কোনো সময় দ্বন্দ্বও দেখা দেয়। ক্ষমতালিপ্সা তখন মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করে। কাজ চালানো গোছের ঐক্য গড়ে উঠতে বিলম্ব হয় না। এর ফলে দেখা যায়, ক’দিন আগেও যিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেলে দল ত্যাগ করে অবিলম্বে তিনি ছুটে আসেন। কেউ কেউ দিনের বেলা সরকারবিরোধী অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দিচ্ছেন, সন্ধ্যা হলে তারাই ছোটেন বঙ্গভবনে। ক্ষমতাই যখন প্রধান লক্ষ্য তখন কপটতা, ভন্ডামি, ষড়যন্ত্র- সবই গ্রহণযোগ্য! সব কিছুই চলে সীমাহীন চতুরতার সঙ্গে, সমানতালে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে আমি বরাবর উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি। তাদের দক্ষতার জন্য নয়, বরং আন্তরিকতা এবং জনকল্যাণের প্রতি তাদের আগ্রহের জন্য। তাছাড়া দেশের রাজনীতিক ছাড়া রাষ্ট্রকে নিরাপদ কে রাখতে পারেন? কেই বা রাষ্ট্রকে অগ্রগতির পথে টেনে আনবেন? আমার অনুযোগ একটাই এবং তা হলো যখন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তখন তারা বিভক্ত, কিন্তু যখন বিভক্ত হওয়ার সময়, যেমন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সময়, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হন। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তির। এ মুহূর্তে হিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এখন মিলনের, অন্তরঙ্গ পরিবেশের, সহনশীলতার, সহযোগিতার, অভ্যন্তরের অপশক্তিকে বিনাশের এবং বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামলানোর। এখন ধীরস্থিরভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। সৃজনমূলক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এর প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের অজেয় করে তোলা- যেন জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে তারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হন।
প্রফেসর কোহাকের কথায়- ‘গণতন্ত্র হলো পরিপূর্ণতার, অসম্পূর্ণতার নয়। গণতন্ত্র হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার, সংঘাত বা সংঘর্ষের নয়। গণতন্ত্র হলো আদর্শের, লোভের নয়। [‘Democracy is about maturity, not pettiness, about goodwill, not contentiousness; idealism, not greed]। সর্বোপরি গণতন্ত্র হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের, সহযোগিতার, নির্মমতার নয়, নয় বৈরিতার। সাময়িকভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা এবং জনকল্যাণমূলক বিধি বিধানের ভিত যদি শক্তিশালী হয় এবং জনগণ যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায়বিচার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে, তাহলে সঙ্কটও কেটে যায়। কেননা এগুলোই ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রের বিভূষণ। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, প্রতিশোধমূলক আচরণ, বিশেষ করে হীন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কৃত্যকদের লেলিয়ে দিলে এবং ফলে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হলে সেই বিভূতি বিনষ্ট হয়। তখন সরকারের সফলতাকেও জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করে না।
এমাজউদ্দীন আহমদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন