বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

দেশের ভাবমূর্তির দায়


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের বলেছেন, তারা যেন এমন আচরণ করেন, যাতে বিদেশে বাংলাদেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এর আগেও তিনি ইতালীর মিলান ভ্রমণকালে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের উদ্দেশে একই রকম আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ কথা সত্য যে, প্রবাসে যেসব বাংলাদেশী বসবাস করেন, কিংবা যারা সেখানে কর্মরত, তাদের সকলকেই এক একটি বাংলাদেশ বলে বিবেচনা করা হয়। ফলে দায়িত্বটি বেড়ে যায় অনেক। পরিষ্কার রাস্তায় কোনো বাংলাদেশী যদি একটি চকলেটের খোসাও ফেলেন, তবে তার দুর্নাম গোটা বাংলাদেশেরই হয়। এটাই নিয়ম। কখনও একজন ব্যক্তিকে দিয়ে বিদেশীরা গোটা বাংলাদেশের রুচি ও আচার-আচরণ পরিমাপ করেন। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানকে সাধুবাদই জানাতে হয়।
কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশীদেরই, নাকি সরকারেরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। ভাবমূর্তির প্রশ্ন শুধুমাত্র বিদেশেই নয় বা বিদেশীদের কাছেই নয়, সেটি দেশের ভেতরেও অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ। আর দেশের ভেতরে বা বাইরে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তুলে ধরার বা উজ্জ্বল করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। সরকার সে দায়িত্ব কতটা পালন করছে, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। এই সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর নিয়েও সে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই সফরে যাবার আগে আমরা সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্রকে এই বলে ঢাকঢোল পেটাতে শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী যাওয়া মাত্রই সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুলে দেয়া হবে। এ নিয়ে সকলের মধ্যে একটু আশারও সঞ্চার হয়েছিল। অনির্বাচিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীও বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তার বিরল হাসিমুখে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে আমিরাতের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
তার এই কথা শুনে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানে আগ্রহীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে যারা বাংলাদেশের জনশক্তি নেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সবচেয়ে বেশি জনশক্তি নিত সৌদি আরব। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালেশিয়া ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। প্রতি বছর এই চারটি দেশে ৮ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ‘আঁতাতে’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে, এই দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিক নিরুৎসাহিত করতে থাকে। এখন এসব দেশ বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১২ সালে আমিরাতের বিপক্ষে রাশিয়াকে ভোট দেয়ার পর আমিরাত বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। তারা বাংলাদেশীদের জন্য ট্রানজিট ভিসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এতে কি দেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?
এরপর অনির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন আমিরাত সফরের ঘোষণা দিলেন এবং শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন খুব সঙ্গত কারণেই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, নিশ্চয় কূটনৈতিক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়ে গেছে। কিন্তু সফরকালে দেখা গেল, এটি শুধুই পুরনো নিয়মে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার আয়োজন মাত্র। শ্রমবাজার নিয়ে বা শ্রমিক নিয়ে তেমন কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা সেখানে হয়নি। এ-ও যেন জনপ্রতিনিধিত্বহীন অনির্বাচিত সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার আর একটি অপপ্রয়াস মাত্র।
কূটনৈতিক রেওয়াজ অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য সরকারপ্রধান সফর করে থাকেন বা করতে পারেন। কিন্তু সে ধরনের কোনো গ্রাউন্ড ওয়ার্কের নজির আমরা দেখতে পেলাম না। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে হাজির হলেই, আলাদীনের দৈত্যর মতো সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। আবারও প্লেন বোঝাই করে বাংলাদেশী শ্রমিকরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাতারে কাতারে যেতে শুরু করবেন। কিন্তু কূটনীতি এমন সহজ অংক নয়। সেদিক থেকে ক্যারিয়ার ডিপলোম্যাট মাহমুদ আলীও যে সম্পূর্ণ আনাড়ি সেটিও প্রমাণিত হয়ে গেল। নিতান্তই করুণা হিসাবে আমিরাত ঘোষণা করেছে, একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তারা ১ হাজার নারী শ্রমিক নেবেন, যা আমাদের অর্থনীতিতে কোনো অবদানই রাখতে পারবে না। এতেও কি বাংলাদেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হলো।
এ বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছে। বিশ্ব সমাজ এই প্রহসনমূলক নির্বাচন বাতিল করে সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সরকার সেদিকে মোটেও কর্ণপাত করছে না; বরং এ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে, একেবারে অগ্নীশর্মা হয়ে তাদের ইয়াহিয়ার দোসর বলতে কসুর করছেন না। যেমন করেননি ইতালীর মিলান থেকে ফিরে বিবিসির সংবাদদাতাকে। এই সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, তা ওরকম পদে অধিষ্ঠিত কারও জন্য মানানসই নয়। সংলাপ প্রশ্নে এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বলেছিলেন, কেন আবার নির্বাচন দিতে হবে? ‘খুনী’ বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।
ঢাকায় সংলাপ প্রশ্নে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ওদের সঙ্গে সংলাপের জন্য আপনাদের এত আকুলি-বিকুলি কোনো? বিএনপি আপনাদের কী দিয়েছে? যেন তিনি জানেনই যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, তাদের ভরাডুবি একেবারেই নিশ্চিত। জনগণ এই সরকারের বিরুদ্ধে কতটা তাঁতিয়ে রয়েছে, তা বোঝা গেল অধ্যাপক গোলাম আযমের দাফন থেকে। তার নামাযে জানাযায় শরীক হতে লাখ লাখ লোক বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশের এলাকায় সমবেত হয়েছিলেন, শরীক হয়েছেন। পরদিন ২৬ অক্টোবর রোববার রাসূলুল্লাহ (সা.), হজ্ব ও তবলিগ জামাত সম্পর্কে কটূক্তি করায় আওয়ামী লীগের সদ্য অপসারিত মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে হরতাল ডেকে ছিল ইসলামী দলসমূহ। সত্যি সত্যি সে হরতালে কোনো পিকেটিং ছিল না। দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করেনি। তারপরও শান্তিপূর্ণভাবেই মানুষ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। হরতাল পালন করেছে। এ-ও ছিল এই সরকারকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাখ্যান। তাই ভয় তো এই সরকার পাবেই।
উপরন্তু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে নেতা, পাতি নেতারা ধারাবাহিকভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদগার করে যাচ্ছে। নিউইয়র্কে লতিফ সিদ্দিকী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তার উম্মতদের ডাকাত বলে অভিহিত করেন। হজ্বকে বলেন অকর্মণ্যদের সমাবেশ ও অপচয়। তাবলিগ জামাতকেও একইভাবে কটূক্তি করেন। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেন। ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হজের বিরুদ্ধে এমন কটূক্তি করে বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমানের বিশ্বাসে আঘাত করেছেন ঐ মন্ত্রী। এতে কি শেখ হাসিনার বা তার সরকারের কিংবা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশ্ব এ নিয়ে প্রতিনিয়তই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। দৈনিক ২০/২৫ জন মানুষ খুন হচ্ছেন। ১০/১৫ জন গুম হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থের লোভে যাকে তাকে, যখন তখন তুলে এনে জিম্মি করছে। মুক্তিপণ আদায় করছে। গুলী করে ফেলে রাখছে। এর একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরং বিচারের নামে টালবাহানা ও কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যপারে আটককৃতরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তারপরও কালক্ষেপণের জন্য কত ভুল পথে কত কি যে করা হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর ফলে এখন সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, এই হত্যাকান্ডের বিচার পাওয়ার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ।
প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখা যায়, কোনো না কোনো পরিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করছেন যে, তাদের সন্তানকে ধরে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর পাওয়া গেছে লাশ কিংবা হদিসই পাওয়া যায়নি অপহৃতের। ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে বিনা দোষে গুলী করে পঙ্গু করে দিয়েছে র‌্যাব। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, র‌্যাব-পুলিশের আনা অভিযোগের কোনোটাই সত্য নয়। আদালত সকল অভিযোগ থেকে লিমনকে খালাস দিয়েছেন। লিমনকে গুলী করার পর যথা নিয়মে একটি ক্রসফয়ারের কেচ্ছা সাজানো হয়েছিল। ফায়ারের প্রমাণ মিলেছে। ক্রসফায়ারের প্রমাণ মেলেনি। এসব ঘটনার পর ক্রসফায়ার বিষয়টাকে কেউ আর বিশ্বাস করছে না। ঠান্ডা মাথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুলী করে হত্যার ঘটনা বলে মনে করছে। এই অবস্থা কি বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে?
এদিকে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল দুদক, যাদের অন্তত তিনজন কানাডার আদালতে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মামলা দায়ের হলে দুদকের কর্মকর্তা আদালতে গিয়ে বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নিরূপায় আদালত তাদের দায়মুক্তি ঘোষণা করেছে। এত বড় কেলেঙ্কারির নায়কদের এইভাবে দায়মুক্ত করে দেয়ায় কি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
আমিরাত সফরকালে প্রধানমত্রী খালিজ টাইমস ও গালফ নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জামায়াত আর কোনো হুমকি নয়। তিনি আর যা বলেছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়- জামায়াতকে এমনভাবে শায়েস্তা করা হয়েছে যে, তাদের আর ‘পা শক্ত করে দাঁড়ানোর মতে ক্ষমতা’ আর নেই। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এখনও প্রতিদিন জামায়াত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন, হত্যা-হামলা কোনো চালানো হচ্ছে? রিমান্ডে নিয়ে কেন তাদরে নেতা-কর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শুধু জামায়াতই নয়, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করার জন্য একইভাবে প্রতিদিন কেনো নির্যাতন চালানো হচ্ছে? কেন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ডজন ডজন মামলা করা হচ্ছে? হামলা, গ্রেফতার চালানো হচ্ছে? এতে কি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে?
আসলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায়িত্ব প্রবাসীদের চেয়ে, দেশে সরকারের অনেক বেশি। সে দায়িত্ব পালনে অনির্বাচিত দখলদার সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads