শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট মোচনে


দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভেতরে ভেতরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে, নানা ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কোরবানির ঈদের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় গণতান্ত্রিক জোট নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দেশব্যাপী গণআন্দোলনে নামবে, এটা তাদের আগের ঘোষণা। তার আগে ২০ দলীয় জোট বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন দ্বারা গত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচনে অটো-এমপি’দের নিয়ে গঠিত একদলীয় আওয়ামী সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিক সংলাপ চায়, এ-ও পুরনো কথা। আওয়ামী সরকার ২০ দলীয় জোটের এ দাবি মানতে কিছুতেই রাজি নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় জোটকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, মধ্যবর্তী কোনো নির্বাচন নয়, নয় কোনো সংলাপও। ফলে দেশের রাজনীতি একটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নের’ দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ আবারো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এতে সর্বমহলেই সঙ্গত উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। আওয়ামী একদলীয় অটো সরকারের তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারের নামে সর্বত্র আওয়ামী দলবাজি, অনিয়ম, অব্যবস্থা, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, চুরিচামারি, ডাকাতি, ছিনতাইবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজি, দখলবাজি, জালিয়াতি, প্রতারণা, আত্মসাৎ, অপহরণ, মুক্তিপণ, হত্যা, খুন-গুম, হামলা-মামলা, রিমান্ড-নির্যাতন, ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের গুরুতর অপরাধের কারণে দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী মহল পর্যন্ত সবাই অর্থনৈতিকভাবে অশ্বস্তি ও মহাসংকটের মধ্যে রয়েছে। এও ২০ দলীয় জোটের এবং গণতন্ত্রকামী সচেতন দেশবাসীর কথা।
আওয়ামী অগণতান্ত্রিক শাসন-শোষণে ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে এবং আর্থিক অনটনে অতিষ্ঠ হয়ে দিনাজপুরে একই পরিবারের তিনজন (পিতা, পুত্র, মাতা) আত্মহত্যা করেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ কী দুঃসহ অবস্থায় দিনাতিপাত করছে-, এ মর্মান্তিক ঘটনা থেকে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধিসহ জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বাড়ানো হচ্ছে, তাতে নিম্ন আয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যম আয়ের মানুষও আর নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারছে না। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার। সরকার এসব মানুষের হাতে কোনো কাজই দিতে পারেনি। ফলে তাদের নেই কোনো আয়-রোজগারও। তাই, তাদের কাছে জীবন দুর্বহ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বিগত পাঁচ-ছয় বছরে সারা দেশে আওয়ামী লুটেরাদের বেপরোয়া লুটপাটের একটা স্থায়ী বন্দোবস্তিতে পরিণত হয়েছে। উন্নয়ন কর্মসূচি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে নিয়মিত বাস্তবায়িত হলে গ্রাম পর্যায়ে কর্মজীবী (নারী-পুরুষ) মানুষের অন্তত কিছুটা হলেও উপায় হতে পারতো। এদিকে স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দেশে কোনো বিনিয়োগ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে চলছে স্মরণকালের খরা। প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, বিনিয়োগ মন্দা কাটিয়ে উঠা সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এতে আরো বলা হয়েছে, এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে সরকারের বাড়তি দরকার অন্তত ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ- যা এ মুহূর্তে অসম্ভব। বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন হলে দেশের অর্থনীতি গতিশীল হতে ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে পারে। ব্যাংকে বিপুল পরিমাণের টাকা অলস পড়ে আছে। বিদেশীরাও বিনিয়োগে আগ্রহী। কিন্তু অগণতান্ত্রিক সরকারের অপশাসনে, প্রশাসনের সর্বত্র আওয়ামীকরণে, অনিয়ম, অব্যবস্থা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, ঘুষ-দর্নীতি, প্রতারণা, জালিয়াতি, লুটপাট, পাচার এবং বড় বড় অর্থনৈতিক কেলেংকারি-অপরাধের কারণে এদেশে বিনিয়োগ না করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করছে।
ওদিকে গার্মেন্ট পণ্য ও জনশক্তি রফতানির আয় ক্রম হ্রাসমান। এ দু’টি খাতের কোনোটিতেই সুখবর নেই। অপর একটি প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৭৫ শতাংশই আবার চলে যায় বিদেশে। দাতা দেশ ও সংস্থার নানা রকম শর্তপূরণ, বিদেশী পরামর্শক নিয়োগ এবং সুদ পরিশোধে এ অর্থ চলে যায়। পাইপলাইনে রয়েছে বিপুল অংকের বৈদেশিক ঋণ। কিন্তু তা যথাসময়ে ছাড় হচ্ছে না। দাতা দেশগুলো প্রশাসনের আওয়ামী তল্পিবাহক আমলা-কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহকে ব্যবহার করে বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন দ্বারা বিগত ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা প্রহসনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় জানিয়ে অর্থছাড় প্রলম্বিত করছে। সরকারের আর্থিক সংকট চরমে উঠেছে। নানা খরচের ফিরিস্তি তৈরি করে এই সংকটকে আরো চরমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর্থিক চাহিদা পূরণে দেশের বিভিন্ন খাত থেকে মূল্য ও কর-খাজনা বাড়িয়ে যেমন কোটি কোটি টাকা তোলা হচ্ছে, তেমনি যাচ্ছেতাই শর্ত কবুল করে বৈদেশিক ঋণ আনার জন্য সদলবলে বিশ্বের দেশে দেশে ধরনা দিয়ে যাচ্ছে। গ্যাসের মূল্য শতভাগ বাড়ানো হবে বলে পেট্রোবাংলা প্রস্তাব দিয়েছে। অন্য এক প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্যাস কেটে সার কারখানায় দেয়া হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের সংকট ও লোডশেডিং বাড়ছে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমরা আগেও বহুবার লিখেছি, এখনো লিখছি- গ্যাস-বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সংস্থান করতে না পারলে বিনিয়োগ কখনোই উৎসাহিত হবে না। সরকারের অদক্ষতা ও ভ্রান্তনীতির কারণে শুধু গার্মেন্ট পণ্যই নয়, অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন ও রফতানিও হ্রাস পেয়েছে। সরকার ও সরকারি দলের প্রভাবশালীদের প্রতারণাপূর্ণ জোর প্রচার, প্রচারণা ও বৈষম্যনীতির কারণে এবং সর্বত্র সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, কমিশনবাজি, প্রতারণা, জালিয়াতি, ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচারের মহোৎসবে শত শত কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আরো শত শত শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে রয়েছে। সারাদেশে বেকার মানুষের মিছিল কেবলই বাড়ছে। এটাই কি আওয়ামী সরকারের আওয়ামী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মূল দর্শন? অর্থনৈতিক সংকট মোচনে বৈদেশিক ঋণ কার্যকর বলে প্রমাণিত না হলেও এবং দরিদ্র জনগণের ঘাড়ে ঋণের বোঝার পর বোঝা চাপলেও সরকার যদি রক্ষায় হন্যে হয়ে সেদিকেই দৌড়-ঝাঁপ দিচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এরপরও কি কাক্সিক্ষত ঋণ পাবে এবং তাতে কি গদি রক্ষা করা সম্ভব হবে?
দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের অভিমত নেতিবাচক। ধানাই-পানাই করে এবং জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবেই সুফল পাওয়া যাবে না। তাদের মতে, বিনিয়োগ বাড়ানোসহ ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের কোনো বিকল্প নেই। তারা আরো মনে করেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অস্থিরতার আশঙ্কা অর্থনৈতিক বিনিয়োগকে বিশেষভাবেই নিরুৎসাহিত করছে। এর অবসান ঘটাতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পথে সবাইকে অগ্রসর হতে হবে। যে রাজনৈতিক বিরোধ ও সংকট বিদ্যমান তার অবসানে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল- বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সাথে আনুষ্ঠানিক, গঠনমূলক সংলাপ ও সমঝোতা অপরিহার্য। উভয়পক্ষের সংলাপ, সমঝোতা ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়েই কেবল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার আকাক্সক্ষা পূরণ সম্ভব। এ ব্যাপারে সরকার ও সরকারি দলকেই উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই দেশ ও জাতির শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
বাঙ্গাল আবদুল কুদ্দুস 

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দেশের ভাবমূর্তির দায়


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের বলেছেন, তারা যেন এমন আচরণ করেন, যাতে বিদেশে বাংলাদেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এর আগেও তিনি ইতালীর মিলান ভ্রমণকালে সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশীদের উদ্দেশে একই রকম আহ্বান জানিয়েছিলেন। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ কথা সত্য যে, প্রবাসে যেসব বাংলাদেশী বসবাস করেন, কিংবা যারা সেখানে কর্মরত, তাদের সকলকেই এক একটি বাংলাদেশ বলে বিবেচনা করা হয়। ফলে দায়িত্বটি বেড়ে যায় অনেক। পরিষ্কার রাস্তায় কোনো বাংলাদেশী যদি একটি চকলেটের খোসাও ফেলেন, তবে তার দুর্নাম গোটা বাংলাদেশেরই হয়। এটাই নিয়ম। কখনও একজন ব্যক্তিকে দিয়ে বিদেশীরা গোটা বাংলাদেশের রুচি ও আচার-আচরণ পরিমাপ করেন। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বানকে সাধুবাদই জানাতে হয়।
কিন্তু দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায়িত্ব কি শুধুমাত্র প্রবাসী বাংলাদেশীদেরই, নাকি সরকারেরও কিছু দায়-দায়িত্ব আছে। ভাবমূর্তির প্রশ্ন শুধুমাত্র বিদেশেই নয় বা বিদেশীদের কাছেই নয়, সেটি দেশের ভেতরেও অত্যন্ত গূরুত্বপূর্ণ। আর দেশের ভেতরে বা বাইরে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তুলে ধরার বা উজ্জ্বল করার দায়িত্ব প্রধানত সরকারের। সরকার সে দায়িত্ব কতটা পালন করছে, সেটিও বিবেচনার দাবি রাখে। এই সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর নিয়েও সে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই সফরে যাবার আগে আমরা সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্রকে এই বলে ঢাকঢোল পেটাতে শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী যাওয়া মাত্রই সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার খুলে দেয়া হবে। এ নিয়ে সকলের মধ্যে একটু আশারও সঞ্চার হয়েছিল। অনির্বাচিত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীও বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন। তিনি তার বিরল হাসিমুখে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে আমিরাতের শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়ে যাবে।
তার এই কথা শুনে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানে আগ্রহীদের মধ্যে বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে যারা বাংলাদেশের জনশক্তি নেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সবচেয়ে বেশি জনশক্তি নিত সৌদি আরব। সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালেশিয়া ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। প্রতি বছর এই চারটি দেশে ৮ লাখ বাংলাদেশী শ্রমিকের কর্মসংস্থান হতো। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ‘আঁতাতে’র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে, এই দেশগুলো বাংলাদেশী শ্রমিক নিরুৎসাহিত করতে থাকে। এখন এসব দেশ বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১২ সালে আমিরাতের বিপক্ষে রাশিয়াকে ভোট দেয়ার পর আমিরাত বাংলাদেশী শ্রমিক নেয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। তারা বাংলাদেশীদের জন্য ট্রানজিট ভিসা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এতে কি দেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?
এরপর অনির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন আমিরাত সফরের ঘোষণা দিলেন এবং শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন খুব সঙ্গত কারণেই আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, নিশ্চয় কূটনৈতিক পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়ে গেছে। কিন্তু সফরকালে দেখা গেল, এটি শুধুই পুরনো নিয়মে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলার আয়োজন মাত্র। শ্রমবাজার নিয়ে বা শ্রমিক নিয়ে তেমন কোনো ফলপ্রসূ আলোচনা সেখানে হয়নি। এ-ও যেন জনপ্রতিনিধিত্বহীন অনির্বাচিত সরকারের স্বীকৃতি পাওয়ার আর একটি অপপ্রয়াস মাত্র।
কূটনৈতিক রেওয়াজ অনুযায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের জন্য সরকারপ্রধান সফর করে থাকেন বা করতে পারেন। কিন্তু সে ধরনের কোনো গ্রাউন্ড ওয়ার্কের নজির আমরা দেখতে পেলাম না। প্রধানমন্ত্রী হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে হাজির হলেই, আলাদীনের দৈত্যর মতো সকল সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। আবারও প্লেন বোঝাই করে বাংলাদেশী শ্রমিকরা সংযুক্ত আরব আমিরাতে কাতারে কাতারে যেতে শুরু করবেন। কিন্তু কূটনীতি এমন সহজ অংক নয়। সেদিক থেকে ক্যারিয়ার ডিপলোম্যাট মাহমুদ আলীও যে সম্পূর্ণ আনাড়ি সেটিও প্রমাণিত হয়ে গেল। নিতান্তই করুণা হিসাবে আমিরাত ঘোষণা করেছে, একটি কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে তারা ১ হাজার নারী শ্রমিক নেবেন, যা আমাদের অর্থনীতিতে কোনো অবদানই রাখতে পারবে না। এতেও কি বাংলাদেশের ভারমূর্তি উজ্জ্বল হলো।
এ বছর ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে প্রহসনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, পৃথিবীর মানুষ তা দেখেছে। বিশ্ব সমাজ এই প্রহসনমূলক নির্বাচন বাতিল করে সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচন দেয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে। সরকার সেদিকে মোটেও কর্ণপাত করছে না; বরং এ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে, একেবারে অগ্নীশর্মা হয়ে তাদের ইয়াহিয়ার দোসর বলতে কসুর করছেন না। যেমন করেননি ইতালীর মিলান থেকে ফিরে বিবিসির সংবাদদাতাকে। এই সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, তা ওরকম পদে অধিষ্ঠিত কারও জন্য মানানসই নয়। সংলাপ প্রশ্নে এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রে তিনি বলেছিলেন, কেন আবার নির্বাচন দিতে হবে? ‘খুনী’ বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।
ঢাকায় সংলাপ প্রশ্নে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ওদের সঙ্গে সংলাপের জন্য আপনাদের এত আকুলি-বিকুলি কোনো? বিএনপি আপনাদের কী দিয়েছে? যেন তিনি জানেনই যে, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে, তাদের ভরাডুবি একেবারেই নিশ্চিত। জনগণ এই সরকারের বিরুদ্ধে কতটা তাঁতিয়ে রয়েছে, তা বোঝা গেল অধ্যাপক গোলাম আযমের দাফন থেকে। তার নামাযে জানাযায় শরীক হতে লাখ লাখ লোক বায়তুল মোকাররম ও তার আশপাশের এলাকায় সমবেত হয়েছিলেন, শরীক হয়েছেন। পরদিন ২৬ অক্টোবর রোববার রাসূলুল্লাহ (সা.), হজ্ব ও তবলিগ জামাত সম্পর্কে কটূক্তি করায় আওয়ামী লীগের সদ্য অপসারিত মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে হরতাল ডেকে ছিল ইসলামী দলসমূহ। সত্যি সত্যি সে হরতালে কোনো পিকেটিং ছিল না। দোকানপাট বন্ধ করতে বাধ্য করেনি। তারপরও শান্তিপূর্ণভাবেই মানুষ তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। হরতাল পালন করেছে। এ-ও ছিল এই সরকারকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রত্যাখ্যান। তাই ভয় তো এই সরকার পাবেই।
উপরন্তু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে নেতা, পাতি নেতারা ধারাবাহিকভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদগার করে যাচ্ছে। নিউইয়র্কে লতিফ সিদ্দিকী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তার উম্মতদের ডাকাত বলে অভিহিত করেন। হজ্বকে বলেন অকর্মণ্যদের সমাবেশ ও অপচয়। তাবলিগ জামাতকেও একইভাবে কটূক্তি করেন। সেইসঙ্গে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কেও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বক্তব্য দেন। ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হজের বিরুদ্ধে এমন কটূক্তি করে বিশ্বের দেড়শ’ কোটি মুসলমানের বিশ্বাসে আঘাত করেছেন ঐ মন্ত্রী। এতে কি শেখ হাসিনার বা তার সরকারের কিংবা দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে?
বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিশ্ব এ নিয়ে প্রতিনিয়তই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। দৈনিক ২০/২৫ জন মানুষ খুন হচ্ছেন। ১০/১৫ জন গুম হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অর্থের লোভে যাকে তাকে, যখন তখন তুলে এনে জিম্মি করছে। মুক্তিপণ আদায় করছে। গুলী করে ফেলে রাখছে। এর একটি ঘটনারও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরং বিচারের নামে টালবাহানা ও কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ব্যপারে আটককৃতরা স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তারপরও কালক্ষেপণের জন্য কত ভুল পথে কত কি যে করা হচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর ফলে এখন সাধারণ মানুষের মনে বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, এই হত্যাকান্ডের বিচার পাওয়ার আশা অত্যন্ত ক্ষীণ।
প্রতিদিন সংবাদপত্রে দেখা যায়, কোনো না কোনো পরিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে অভিযোগ করছেন যে, তাদের সন্তানকে ধরে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারপর পাওয়া গেছে লাশ কিংবা হদিসই পাওয়া যায়নি অপহৃতের। ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনকে বিনা দোষে গুলী করে পঙ্গু করে দিয়েছে র‌্যাব। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়েছে, র‌্যাব-পুলিশের আনা অভিযোগের কোনোটাই সত্য নয়। আদালত সকল অভিযোগ থেকে লিমনকে খালাস দিয়েছেন। লিমনকে গুলী করার পর যথা নিয়মে একটি ক্রসফয়ারের কেচ্ছা সাজানো হয়েছিল। ফায়ারের প্রমাণ মিলেছে। ক্রসফায়ারের প্রমাণ মেলেনি। এসব ঘটনার পর ক্রসফায়ার বিষয়টাকে কেউ আর বিশ্বাস করছে না। ঠান্ডা মাথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গুলী করে হত্যার ঘটনা বলে মনে করছে। এই অবস্থা কি বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে?
এদিকে পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলায় ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল দুদক, যাদের অন্তত তিনজন কানাডার আদালতে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন। মামলা দায়ের হলে দুদকের কর্মকর্তা আদালতে গিয়ে বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নিরূপায় আদালত তাদের দায়মুক্তি ঘোষণা করেছে। এত বড় কেলেঙ্কারির নায়কদের এইভাবে দায়মুক্ত করে দেয়ায় কি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।
আমিরাত সফরকালে প্রধানমত্রী খালিজ টাইমস ও গালফ নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জামায়াত আর কোনো হুমকি নয়। তিনি আর যা বলেছেন, তার অর্থ দাঁড়ায়- জামায়াতকে এমনভাবে শায়েস্তা করা হয়েছে যে, তাদের আর ‘পা শক্ত করে দাঁড়ানোর মতে ক্ষমতা’ আর নেই। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে এখনও প্রতিদিন জামায়াত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন, হত্যা-হামলা কোনো চালানো হচ্ছে? রিমান্ডে নিয়ে কেন তাদরে নেতা-কর্মীদের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে। শুধু জামায়াতই নয়, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করার জন্য একইভাবে প্রতিদিন কেনো নির্যাতন চালানো হচ্ছে? কেন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন ডজন ডজন মামলা করা হচ্ছে? হামলা, গ্রেফতার চালানো হচ্ছে? এতে কি দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে?
আসলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দায়িত্ব প্রবাসীদের চেয়ে, দেশে সরকারের অনেক বেশি। সে দায়িত্ব পালনে অনির্বাচিত দখলদার সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

গ্রেফতার অভিযান বন্ধ হওয়া প্রয়োজন


নতুন পর্যায়ে আবারও চরম ফ্যাসিবাদী মনোভাবের ন্যক্কারজনক উন্মোচন ঘটাতে শুরু করেছে সরকার। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর; তথা ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার আগেই সরকার গ্রেফতার অভিযান শুরু করেছে। কোনো মামলা না থাকলেও ক’দিন আগে জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ ৬৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বলা হয়েছে, পুলিশের কাছে নাকি ‘তথ্য’ ছিল- যুবদলের এ নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালানোর ষড়যন্ত্র করছিলেন! বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তো বটেই, অনেক বেশি সংখ্যায় গ্রেফতার করা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের। এমন কোনো দিনের কথা বলা যাবে না, যেদিন অন্তত শয়ের অংকে গ্রেফতার না করা হচ্ছে। রাজধানী ও বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা পুলিশের ধাওয়ার মুখে রয়েছেন। যাকে যখন ইচ্ছা, তখনই ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ- এ যেন ‘যাকে পাও ধরো এবং জেলখানায় ভরো’ ধরনের ব্যাপার! গ্রেফতার করে এবং রিমান্ডে নিয়ে তাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে আসলে ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পনা সম্পর্কেই বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে। বলাবাহুল্য, সে পরিকল্পনায় গণতন্ত্রসম্মত সদিচ্ছার কোনো ইঙ্গিত নেই। সংঘাত এড়িয়ে সমঝোতা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চেষ্টা চালানোরও কোনো ইঙ্গিত নেই। অর্থাৎ সরকার যথারীতি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরতান্ত্রিক পন্থাতেই এগিয়ে যাচ্ছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দিক থেকে এটা অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়, কারণ নামে ‘নির্বাচিত’ এবং গণতান্ত্রিক হলেও প্রথম থেকেই সরকার বিরোধী দলকে দমনের কর্মকান্ডে ব্যস্ত রয়েছে। শুধু গ্রেফতারের কথাই-বা বলা কেন, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে দেশের কোথাও বাধাহীনভাবে কোনো মিছিল-সমাবেশও করতে দেয়া হচ্ছে না। নেতা-কর্মীদের পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং ঘরোয়া বৈঠককে পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের বিচিত্র অভিযোগে ভন্ডুল করা হচ্ছে। জঙ্গি-সন্ত্রাসী অ্যাখ্য দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ- যেমনটি ঘটেছে যুবদল সভাপতির ক্ষেত্রে। বলা দরকার, এ ব্যাপারে কিছুটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হুমকির আড়ালে হুকুম জারি করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সর্বশেষ গত ২৩ অক্টোবর আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের মূল কথায় তিনি বলেছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় একটি ‘ট্রানজিট সরকার’-এর প্রধান ছিলেন বলে ‘অনেক কিছু’ই করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে কারণেই বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো নাকি ইচ্ছেমতো মানুষ খুন করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এখন তার সরকার ‘নির্বাচিত’, তিনি নিজেও ‘নির্বাচিত’ প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং আন্দোলনের নামে আর মানুষ খুন করতে এবং সহিংসতা ঘটাতে দেবেন না তিনি। বক্তব্যের এ পর্যায়ে এসেই ‘একটা মানুষের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক’ বলে হুমকি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, এর পরিণতি কি হয় তা ‘দেখিয়ে’ ছাড়বেন তিনি! উদ্বেগের কারণ হলো, এ ধরনের হুমকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য ক্ষমতাসীনরা আগেও বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। এগুলো যে কেবলই কথার কথা নয়, সে সম্পর্কেও জনগণকে বুঝতে হয়েছে। প্রতিটি উপলক্ষেই তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তা তিনি করেও দেখান। বর্তমান পর্যায়েও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার যেভাবে গ্রেফতার ও দমন-নির্যাতন চালাচ্ছে তার ফলে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের পিঠ আসলে দেয়ালে ঠেকে গেছে। তা সত্ত্বেও ২০ দলীয় জোট এ পর্যন্ত যথেষ্ট নমনীয়তা দেখিয়ে এসেছে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন ও একতরফা নির্বাচনের পরও তেমন কোনো আন্দোলনই করেনি দলগুলো। অন্যদিকে সরকার শুধু দমন-নির্যাতন ও গ্রেফতারের অভিযানই চালাচ্ছে না, ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে সমঝোতায় আসারও নাম পর্যন্ত করছে না। বিদ্যমান সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে দাবি ২০ দলীয় জোট জানিয়েছে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ারও কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতাসীনরা বরং ২০১৯ সাল পর্যন্ত তো বটেই, আরো অনেক বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছেন। আমরা মনে করি, এভাবে চলতে থাকলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার সব সম্ভাবনা নস্যাৎ হয়ে যাবে। এজন্যই ক্ষমতাসীনদের উচিত অবিলম্বে গ্রেফতার অভিযান বন্ধ করা এবং বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ সব দলের নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিয়ে সমঝোতার পরিবেশ তৈরি করা। প্রধানমন্ত্রীকে একই সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার গঠনের বিধানও সংবিধানে যুক্ত করতে হবে- সব দল যেন বাধাহীনভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে ও কর্মসূচি পালন করতে পারে সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান পর্যায়ে তেমন সম্ভাবনা না থাকলেও আমরা আশা করতে চাই- সরকার শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসবে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর হুমকির জবাবে বেগম খালেদা জিয়া গণঅভ্যুত্থান এবং গণধোলাইয়ের যে পাল্টা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সে পরিণতি এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো- ফ্যাসিবাদী নীতি ও কর্মকান্ড পরিহার করে ২০ দলীয় জোটের দাবি মেনে নেয়া এবং গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসা।

মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

জোরজবরদস্তির গণতন্ত্র

তৃতীয় বিশ্বের শাসনব্যবস্থা, বিশেষ করে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে বা চালানো হচ্ছে, তা দেখে মহামতি সক্রেটিস-অ্যারিস্টটল-প্লেটো হয়তো ভিরমি খেতেন, নয়তো গণতন্ত্রের ধারণা ভিন্নভাবে লিখে যেতেন। আমাদের দেশের মতো ক’খানা গণতান্ত্রিক দেশের গণতন্ত্র দেখলে লাস্কি-সিডনি-টয়েনবি কিংবা বার্কার-স্টুয়ার্ট মিলরা কী লিখতেন বোঝা দায়। আর গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন মানেই অবাধ নির্বাচন সবই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কথা। কিন্তু এসব দেশের নির্বাচন-শাসনব্যবস্থা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের হালহকিকত দেখে জাঁদরেল রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তাদের ছাত্রদের কিভাবে গণতন্ত্রের ধারণা দিতেন, তা কল্পনা করা কঠিন। কিংবা যেসব পণ্ডিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন রাখার প্রবক্তা, তারা এসব দেশের নির্বাচন কমিশনের কায়কারবার দেখে হুঁশও হারিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু এসব দেশের মানুষের এ নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমজনতা এসব থেকে অনেক দূরে। বুদ্ধিজীবীদের ঠিক কী ভূমিকা সেটাও আমাদের দেশে অনুধাবন করা কঠিন। খবর বেরিয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলের জনাপঞ্চাশেক মেয়েকে রাতভর রুমে আটকে রাখা হয়েছিল পরের দিন বিকেল ৩টার সভায় হাজির হতে বাধ্য করার জন্য। কোনো একজন বেরসিক খবরটা ফাঁস করেছেন। একই ঘটনা, একই দিনে বুয়েটেও ঘটেছে। একটি হল চারতলায় সম্প্রসারিত হয়েছে। সেখানে চল্লিশজন ছাত্রকে থাকতে দেয়া হয়েছে। থাকতে যেহেতু দেয়াই হয়েছে, সুতরাং শোকদিবসের অনুষ্ঠানে যেতেই হবে। তাদেরও পুরো রাত কোথাও যেতে দেয়া হয়নি যদিও এই খবর কাগজে আসেনি। বদরুন্নেছা কলেজের মেয়েদেরও ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিছিলে আসতে বাধ্য করা হয় এবং এটি অনেক দিন ধরেই ঘটছে। হলে অবস্থানকারীদের ক্ষেত্রেই চিত্রটা প্রকট। একই দশা ইডেনে এটি কাগজে আসার দরকার নেই। একটু খোঁজ নিলেই হয়। এর আগে ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে ইডেনের মেয়েদের লং-ড্রাইভে যেতে বাধ্য করার সংবাদ ছাপা হয়েছে। আমরা পারিও বটে না হলে সেঞ্চুরিয়ান মানিককে ভুলে যাই কী করে! এই মানিকও কিন্তু একটি ছাত্রসংগঠনের সাথেই সম্পৃক্ত ছিল। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূর অস্ত, বরং বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়েছে। এখন হলগুলো একটি মাত্র ছাত্রসংগঠনের দখলে, তাদেরই নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভিন্ন মতের হলে হল, এমনকি ভার্সিটিছাড়া করা মুহূর্তের ব্যাপার। সরকারি দলের ছাত্রসংগঠন ও তাদের নেতারা কোনো রকমের প্রতিযোগিতায় যেতে আগ্রহী নন। তাই তাদের মুরব্বি-দল যখন ক্ষমতায়, তখন কেবল তারাই থাকবেন। হলে যারা থাকবেন, তাদের যেহেতু দয়া করে থাকতে দেয়া হচ্ছে, সুতরাং তাদের কথার অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই এই হচ্ছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চর্চা। যারা ছাত্ররাজনীতিকে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক চর্চার সূতিকাগার মনে করেন, কী বলবেন তারা? হলে হলেই নয়, টেন্ডার কিংবা চাকরি পেতেও তারা প্রতিযোগিতায় যেতে নারাজ। সঠিক অর্থে নির্বাচন করে ছাত্রসংসদে বসা এবং ঠিক ঠিক একটি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেও আগ্রহী মানুষের অভাব দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্রই এখন উল্টো পথে হাঁটছে। অদ্ভুত হলেও সত্য যে, বুয়েটেও শোনা যায়, দল ক্ষমতায়; এখন আমরাই হলে থাকব, তোমরা বেরিয়ে যাও আমরাই শেষ কথা। বিপদে পড়েছেন নতুন ভিসি এমনিতে ক’জনকে ডিঙিয়ে তাকে দেয়া হয়েছে। সেটা কোনো ব্যাপার হয়তো নয়। কারণ পছন্দটা সর্বোচ্চপর্যায়ের। তেয়াত্তরের অধ্যাদেশে ভিসি নিয়োগের জন্য কী সব নির্বাচন-টির্বাচনের কথা আছে, তা নিয়ে আর কোনো পক্ষকে কথা বলতে শোনা যায় না। নতুন ভিসি নাকি বলেছেন, বুয়েট সব ছাত্রের জন্যই উন্মুক্ত, এটি হবে সহাবস্থানের জায়গা। বিপদটা এ জায়গায়। সোনার ছেলেরা চাইছে, আমরাই শেষ কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও একটি দলের ছাত্র-ছাত্রী ব্যতিরেকে অন্য কারো স্থান নেই গণতন্ত্রের উর্বর চারণভূমি তো! ডাকসু নির্বাচন এলেই কথাটি জোরেশোরে উচ্চারিত হতো। এখন ডাকসুই নেই। ছেলেমেয়েরা নিয়মিত টাকা দিচ্ছে (তার নাকি হিসাবও ঠিকমতো নেই, হায়!)। স্বৈরাচার এরশাদের সময়েও ডাকসুর নির্বাচন হতে দেখা গেছে। এখন কেবল ডাকসু নয়, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নির্বাচিত সংসদ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই বা কেন, জেলা পরিষদ কিংবা ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েই বা কী ব্যাখ্যা? ব্যাখ্যা হয়তো আছে যিনি কিছু করেন, সেটার ব্যাখ্যাও তার থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে। যেমন এই দেশের সর্বশেষ নির্বাচন যুক্তির তো শেষ দেখি না; এই মিছিলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও যোগ দিয়েছেন। ঢাবি কিংবা বুয়েটে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য কারো মিছিল শেষ কবে দেখা গেছে তা গবেষণা করেও বের করা কঠিন হবে। অথচ বুয়েটে ক’বছর আগেও চরম ডান-চরম বাম নিয়ে নির্বাচিত ইউকসু ছিল। এখন গণতন্ত্রের চরম উৎকর্ষের সময় একটি ছাত্রসংগঠন থাকাই যে বাঞ্ছনীয়; কী বলেন! জাতীয় রাজনীতি থেকে ছাত্ররাজনীতি ভিন্ন হয় কী করে! ছাত্রদলের সুসময়েও একই চিত্র দেখা গেছে। হলের সিট দখল, ক্যান্টিনে বিনে পয়সায় ভোজ আর পাশের মার্কেট-বস্তি থেকে নগদ আদায়। তখন তাদের লোকবলের অভাব ছিল না। নিমেষেই মিছিল-মিটিং লোকাকীর্ণ হয়ে উঠত। এখন! ছাত্রদল একটা জুতসই মিছিলও বের করতে পারে না। যারা তখন দুধ-মাখন-ননি কিংবা গুড়-বাতাসা খেয়েছে, কারো খোঁজ নেই। আবার কেউ কেউ আখের গুছিয়ে আরাম-আয়েশে সময় পার করছেন। জোরজবরদস্তি করে সাময়িক উদ্দেশ্য হাসিল করা যায় এই যেমন মিটিংয়ে ছাত্রছাত্রী জড়ো করা, হলে আধিপত্য কায়েম ইত্যাদি। টেন্ডার চাঁদাবাজি কিংবা তদবির-দালালি করে পকেটে হয়তো নগদ আসে, কিন্তু জোরপূর্বক সভাসমিতিতে মানুষ জড়ো করে আখেরে লাভ হয় না রুমে ফিরতে ফিরতেই মনে মনে খেস্তিখেউড় আওড়ায়। ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের নেতারা এসব বুঝলে ভালো। জাতির জনকের শোকসভায় ছেলেমেয়েদের জোর করে নিতে হবে আর সে জন্য তাদের রাতভর আটকে রাখতে হবে, যাতে অন্যত্র যেতে না পারে, অর্থাৎ তাদের শোকসভায় যেতেই হবে এটি এই সময়ের জন্য মানানসই নয় কেমন তেতো লাগে শুনতে। কারো চেতনায় আঘাত করতে না পারলে এভাবে জোরজবরদস্তি করে সভায় নিয়ে কোনো দল বা কোনো ব্যক্তির ওপর আস্থা-শ্রদ্ধা-ভক্তি সৃষ্টি করা কঠিন। মত ও পথ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এ ব্যাপারে বরং ছাত্র ইউনিয়ন-শিবির একটু এগিয়ে; জোরজবরদস্তিটা এখনো সেভাবে পেয়ে বসেনি তাদের। কেবল ছাত্রদের কিংবা ছাত্রসংগঠনের কথাই বা কেন এখন তো সারা দেশেই জোরজবরদস্তির গণতন্ত্র চলছে। সামরিক জান্তা কিংবা একনায়কতন্ত্রের অনুকরণে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই জোরজবরদস্তির শাসন চলছে। কোথাও কোথাও আবার তাতে গণতন্ত্রের লেবাস লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু ঢাবি আর বুয়েট নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও কেবল একটি দল মিছিল-মিটিং করতে পারবে। অনেক উপজেলায়ও তাই। এখন পার্টিতন্ত্রই বড় কথা নয় আমরাই সব। একদল-একনেতা; কেবল সংবিধানে অন্তর্ভুক্তি বাদ আছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম-শাসনামলে আমরা আর ওরার খুব প্রচলন ছিল। এখানে সেটিও নেই, আছে আমরাতন্ত্র। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পদ-পদোন্নতি, টেন্ডার, ভর্তি সর্বত্রই পার্টিতন্ত্র। সরকার বদলের বৈধ পন্থার নাম নির্বাচন জোরদবরদস্তি থেকে মুক্ত ছিল পনেরো বছর। সেটাতেও জিনের আসর লেগেছে। গত কিংবা আগামী নির্বাচন এরশাদীয় মডেলের যে হবে না, তা কে বলবে! সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের নাম গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই ভোটের অধিকার। গণতন্ত্র মানেই সব দলের সহাবস্থান। সব দল যেমন ভাবছে না তাদের সহাবস্থান আছে; তেমনি আমজনতা ভোটের অধিকার হারিয়ে দিশেহারা। সংসদ মানেই সরকারি দল আর বিরোধী পক্ষ। কিন্তু আমাদের সংসদের এই হাল দেখে এই সময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কী লিখবেন বোঝা দায়। এর আগে তো ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ কিংবা ‘লয়াল অপজিশন’ নামে শব্দগুলো এই দেশে চালু ছিল, এখন? এখানেও জোরজবরদস্তি এই জোরজবরদস্তির মধ্যে অন্যরা কিছু পেলেই বা মন্দ কিসে! তেমনটিই যে আমাদের গণতন্ত্রের সার কথা, শেষ কথা। আর এ জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নতুন করে কিছু একটা লিখতেই হবে। বদলে দিতে হবে গণতন্ত্র-নির্বাচন কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের সংজ্ঞা। নির্বাচনে ভোটাধিকারের বদলে লিখতে হবে পেশিশক্তি-নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব আর উর্দিধারীদের দাপট নিয়ে কয়েকটি অধ্যায়। ক্ষমতার জোরজবরদস্তিই হবে গণতন্ত্রের সারকথা-শেষ কথা। সে ক্ষেত্রে ‘আমরা আর ওরা’ নয় আমরাই শেষ কথা। 
সাদ সাকলান

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

২৮ অক্টোবরে গণতন্ত্রের কথা ভাবি : ভাবি শান্তি-প্রশান্তির কথা


জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রায় চার দশকে আমরা আমাদের ঘর সামলাতে সক্ষম হইনি। পারিনি শক্ত মাটিতে পা রেখে পথ চলতে। কে আমাদের বন্ধু এবং কে আমাদের শত্রু, তা-ও সঠিকভাবে চিনতে পারিনি। শোনা যায়, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের নামে যে প্রহসন সংঘটিত হয়, তার অদূরে এক বটগাছে বহুসংখ্যক শকুনি সেদিন যেভাবে চোখ মেলে তাকাচ্ছিল, আজও সেই বটগাছটিতে শকুনিদের উত্তর-পুরুষরা ডানা ঝাঁপটায় আর তেমনই বিস্ফারিত নয়নে আগ্রহভরে তাকিয়ে রয়েছে। কথাগুলো অভিযোগের সুরে বললেও কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না রেখেই বলছি, আমরা হতভাগ্য। যে রাষ্ট্রের জন্ম হলো মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে, সেই রাষ্ট্রের এমন বেহালদশা কেন? এখন পর্যন্ত কেন কোনো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান কর্তৃত্বব্যঞ্জক কর্তৃত্বের অধিকারী হলো না? কেন জাতীয় সংসদ অভিযোগ-প্রতি অভিযোগ এবং বাকবিতন্ডার ঊর্ধ্বে উঠে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দানের সংস্থায় রূপায়িত হলো না? কেন রাষ্ট্রের নির্বাহী কর্তৃত্ব প্রয়োগকারীরা এককভাবে পথচলার দুঃসাহস পাচ্ছেন? দেশের বিচার বিভাগ এখন পর্যন্ত কেন সব বিতর্কের ঊর্ধে? উঠে সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারল না? রাষ্ট্রের অন্যান্য সংস্থা কেন সংবিধানের দিকে না তাকিয়ে ক্ষমতাসীনদের দিকে দৃষ্টি রেখেই এখনো পথ চলে? এই ভাঙাচোরা, অনিশ্চিত ও অসহায় অবস্থায়, অনেক অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী টিকে রয়েছে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের শক্তিশালী এক মাধ্যমরূপে। রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার বৃহত্তর পরিম-লে এই যে বিসদৃশ অ্যাসিমেট্রি, তা-ই দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শকুনিদের দৃষ্টির জ্যোতিকেন্দ্রে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে পথে পা বাড়িয়েছে, সে পথ দুর্গম। সে পথ অগম্য। সে পথ ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত। মনে হয়, অনেকটা জেনেশুনেই দেশের রাজনীতিকরা রয়েছেন কণ্টকাকীর্ণ এই পথে। কেন, কীসের লোভে, কোন উদ্দেশ্যে তারা এই পথে পা বাড়িয়েছেন তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু যেজন্য রাজনীতি এবং যাদের জন্য রাজনীতি এবং যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির জন্ম তা যে এ পথে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়, তা সবাই জানেন। সব বুঝে-শুনে বাংলাদেশের রাজনীতির কুশীলবরা এই পথে চলেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তত্ত্বগত দিক থেকে তা ঠিক বটে, কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হয় এই ভেবে যে একজন রাজনৈতিক নেতা অন্যজনকে এতটুকু বিশ্বাস করেন না। একদল অন্য দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে দেশের দুটি বৃহৎ দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার তাপে রাজনীতির সৌকর্য এ দেশে প্রতিনিয়ত ঝলসে যাচ্ছে। সংঘাতের পথ প্রশস্ত হয়েছে। নির্মম হানাহানির মুখু ব্যাদানে জাতীয় অর্জনের বিরাট অংশ ক্ষয়ে যেতে বসেছে। এ অবস্থা অনাকাক্সিক্ষত, অবাঞ্ছিত।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটময়। আমার মনে হয় যে, বাংলাদেশের এই তেতাল্লিশ বছরের মধ্যে এমন অনিশ্চয়তা আর সৃষ্টি হয়নি। সব মহলেই একটা উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা। একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যেন চারদিক থেকে আমাদের গ্রাস করে ফেলছে। ক্ষমতাসীন দলের চিন্তাভাবনাটাই হলো এমন যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে তাদের খুব নিকট সম্পর্ক দেখি না। অতীতেও দেখিনি এবং এখনও দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এবং গণতন্ত্র যেন একসাথে চলতে পারে না।
বহুবার বলেছি, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ জয়যাত্রা শুরু করে গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। এ জাতি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। মাত্র আড়াই-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। এ কাজটিও সম্পন? হয় রাজনীতিকদের দ্বারাই। জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হয়ে ওঠে ধুলায়ধূসরিত। মানবাধিকার হয় ভূলুণ্ঠিত। অগণতান্ত্রিকতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় দেশটি। দীর্ঘ দুই দশকের সংগ্রাম-অভিযান এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নকুনভাবে এ দেশে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হয়, সব দল ও মতের ঐকমত্যের বিস্তৃত মোহনায়। পথহারা পথিক একবার যদি সেই পথের সন্ধান পায়, সবাই বিশ্বাস করেন, সেসব কিছু হারাতে পারে; কিন্তু আর হারায় না সেই পথ। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা পর্যালোচনা করে আমরাও সেই বিশ্বাসে ছিলাম বলীয়ান। প্রতিদিনের দলীয় কর্মকা-ের নিরিখে কিন্তু জাতি এখন অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। যে জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থকে প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছে, সেই জনগণও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চকণ্ঠকে দেখছেন গভীর সন্দেহের চোখে।
বাংলাদেশ এখন খুন-গুমের বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল বা বিরোধী মতকে দমন করতে শাসক দল কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতি তা ই বুঝিয়ে দিচ্ছে। ৫ জানুয়ারি যেনতেনভাবে নির্বাচন করে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন তারা কী জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছেন? যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দেয়নি, সেই নির্বাচনে গঠিত সরকারের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতাই বা কতটুকু। ৯০ এর পর দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন নিয়মতান্ত্রিকভাবেই মেয়াদ শেষে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছিল। পরপর ৩টি নির্বাচনই হয়েছিল নিদলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দেখার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৩টি নির্বাচনের কোনটিতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচিত হতে পারেনি। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালে তৎকালীন ৪ দলীয় জোট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া করেছিল, তা কিন্তু সফল হয়নি। সে সময় আমরা রাজপথে দেখলাম আন্দোলনের একটা ভিন্ন রূপ। সে সময় ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য রাজপথে পিটিয়ে মারা দৃশ্য কোন গণতন্ত্রকামী মানুষ মেনে নিতে পারে না। ২৮ অক্টোবর যে ঘটনা ঘটেছিল তা হঠাৎ ঘটেনি, এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। সেই চক্রান্তের মূল বিষয় ছিল বাংলাদেশকে একটা অকার্যকর ও পরনির্ভরশীল একটা রাষ্ট্রে পরিণত করা।
যেহেতু শাসনকারী এলিটরা সমাজের সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীভুক্ত, দল ও মতের বিভিন্ন তার কারণে তাদের মধ্যে কোনো কোনো সময় দ্বন্দ্বও দেখা দেয়। ক্ষমতালিপ্সা তখন মিলনসূত্র হিসেবে কাজ করে। কাজ চালানো গোছের ঐক্য গড়ে উঠতে বিলম্ব হয় না। এর ফলে দেখা যায়, ক’দিন আগেও যিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন, মন্ত্রী হওয়ার ডাক পেলে দল ত্যাগ করে অবিলম্বে তিনি ছুটে আসেন। কেউ কেউ দিনের বেলা সরকারবিরোধী অগ্নিবর্ষী বক্তৃতা দিচ্ছেন, সন্ধ্যা হলে তারাই ছোটেন বঙ্গভবনে। ক্ষমতাই যখন প্রধান লক্ষ্য তখন কপটতা, ভন্ডামি, ষড়যন্ত্র- সবই গ্রহণযোগ্য! সব কিছুই চলে সীমাহীন চতুরতার সঙ্গে, সমানতালে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের সম্পর্কে আমি বরাবর উচ্চ ধারণা পোষণ করে এসেছি। তাদের দক্ষতার জন্য নয়, বরং আন্তরিকতা এবং জনকল্যাণের প্রতি তাদের আগ্রহের জন্য। তাছাড়া দেশের রাজনীতিক ছাড়া রাষ্ট্রকে নিরাপদ কে রাখতে পারেন? কেই বা রাষ্ট্রকে অগ্রগতির পথে টেনে আনবেন? আমার অনুযোগ একটাই এবং তা হলো যখন জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন তখন তারা বিভক্ত, কিন্তু যখন বিভক্ত হওয়ার সময়, যেমন নিজেদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ের সময়, তখন তারা ঐক্যবদ্ধ হন। এখন প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের, ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তির। এ মুহূর্তে হিংসা বা প্রতিহিংসার রাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এখন মিলনের, অন্তরঙ্গ পরিবেশের, সহনশীলতার, সহযোগিতার, অভ্যন্তরের অপশক্তিকে বিনাশের এবং বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামলানোর। এখন ধীরস্থিরভাবে সঙ্কটের মোকাবিলা করতে হবে। সৃজনমূলক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এর প্রথম ও প্রধান পদক্ষেপ হবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের অজেয় করে তোলা- যেন জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে তারা ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণে সক্ষম হন।
প্রফেসর কোহাকের কথায়- ‘গণতন্ত্র হলো পরিপূর্ণতার, অসম্পূর্ণতার নয়। গণতন্ত্র হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধার, সংঘাত বা সংঘর্ষের নয়। গণতন্ত্র হলো আদর্শের, লোভের নয়। [‘Democracy is about maturity, not pettiness, about goodwill, not contentiousness; idealism, not greed]। সর্বোপরি গণতন্ত্র হলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের, সহযোগিতার, নির্মমতার নয়, নয় বৈরিতার। সাময়িকভাবে কোন কোন ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি-নৈতিকতা এবং জনকল্যাণমূলক বিধি বিধানের ভিত যদি শক্তিশালী হয় এবং জনগণ যদি চূড়ান্ত পর্যায়ে ন্যায়বিচার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে, তাহলে সঙ্কটও কেটে যায়। কেননা এগুলোই ন্যায়নিষ্ঠ রাষ্ট্রের বিভূষণ। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের হিংসাত্মক কার্যক্রম, প্রতিশোধমূলক আচরণ, বিশেষ করে হীন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় কৃত্যকদের লেলিয়ে দিলে এবং ফলে ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হলে সেই বিভূতি বিনষ্ট হয়। তখন সরকারের সফলতাকেও জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করে না।
এমাজউদ্দীন আহমদ 

রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এ কোন পথে সরকার!

সম্প্রতি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে এর  চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছেন আমাদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এর সপ্তাহ সময় ব্যবধানে ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। এ দুটি নির্বাচনে এ দুজনের সাফল্যের জন্য তারা ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখেন; কিন্তু এ সাফল্য তুলে ধরার জন্য বিলবোর্ড টানিয়ে এবং সভা-সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের দেশের থলেতে এ সাফল্য জমা হয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে, ৫ জানুয়ারি সম্পর্কে বিদেশীরা আর কোনো প্রশ্ন তুলছেন না এমনটি প্রচার এ সাফল্যের গুরুত্বকে অনেকটা ম্লান করে দিচ্ছে বলেই মনে হয়। আসলে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনে বাংলাদেশের কেউ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হলে কিংবা ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের কেউ নির্বাচিত হলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে কিংবা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে বৈধতা সনদ পেয়ে গেছে, তা ভাবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর একটি উদাহরণ, যে দিন সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টারপার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন, সে দিনটিতে যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে বলেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ছিল হতাশাজনক। গত ১৬ অক্টোবর যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের সরকারের এ অবস্থানের কথা জানানো হয়। এর আগে গত ২২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে বৈঠকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একইভাবে এ হতাশার কথা জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ : কান্ট্রি কেস স্টাডি আপডেটেডশীর্ষক এ রিপোর্টে যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি ছাড়াও বলা হয়Ñ বাংলাদেশের মিডিয়া বা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বিধিনিষেধের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারের সমালোচনাকারী বা ভিন্নমতাবলম্বীদের আটক করা হচ্ছে। এ বছরই তৈরি করা হয়েছে নতুন কিছু নীতি ও আইন। এতে সুশীলসমাজ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সীমিত করা হয়েছে, যা উদ্বেগজনক। এমনই নানা অভিযোগ রয়েছে এ রিপোর্টে। সরকার যতই বলুক, এ সরকার বিদেশী মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে গেছে, এ সরকার ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিদেশে কোনো প্রশ্ন নেই; বাস্তবে কিন্তু এর কোনো প্রমাণ মিলছে না। বরং বাস্তবে আমরা এমন সব ঘটনা ঘটতে দেখতে পাচ্ছি, যা সরকারপক্ষের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণিত করার জন্য যথেষ্ট। সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, সংসদ সদস্যদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী দাতারা। বর্তমান সংসদের পেছনে টাকা খরচ করাকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়েই প্রকল্প গুটিয়ে নিতে শুরু করেছেন দাতারা। বর্তমান সংসদে অর্ধেকেরও বেশি সদস্য অনির্বাচিত হওয়ার প্রসঙ্গটি সামনে এনেই তাদের এ অনাগ্রহের বিষয়টি দাতারা মৌখিকভাবে সংসদ সচিবালয়কে জানিয়ে দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। এরই মধ্যে ইউএনডিপি ও নেদারল্যান্ডসের অর্থায়নে পরিচালিত আইপিডি প্রকল্প বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি মাঝপথেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটি অব্যাহত রাখার জন্য সংসদ সচিবালয়ের অনুরোধে দাতারা কোনো সাড়া দেননি। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ আরো কয়েকটি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আগ্রহ নেই দাতাদের। উপরন্তু চলমান প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে; কিন্তু সম্প্রতি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফিরে আমাদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী যখন বলেন, বর্তমান সংসদ নিয়ে দেশের বাইরে কারো কোনো প্রশ্ন নেই, তখন সংসদের প্রতি দাতাদের এই মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে কী জবাব দেবেন তিনি। বর্তমান সরকার ও এর কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্নের এখানেই শেষ নয়, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্নের শেষ এখানেই থেমে নেই। বাংলাদেশে বিরোধী দলমত ও ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের ওপর সরকার চরম দমনপীড়ন চালিয়ে দেশবাসীর মতামতকে উপেক্ষা করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছে। বিষয়টি এখন আর কোনো রাখঢাক করে বলা হচ্ছে না। বরং সরকারি দলের নেতারা বলছেন, যারা এর আগে নির্বাচনের কথা বলে তারা মূর্খ। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী রীতিমতো বিরোধী জোটের নেত্রীর প্রতি নানা ধরনের বাক্যবাণ ছুড়ে সরকারবিরোধীদের দমনে চরম কঠোরতার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন এবং বলছেন, ‘আর একজনের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, তার পরিণতি কী হয় দেখবে।সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে বর্তমান সরকার যে মরিয়া এবং এ কাজে দলীয়ভাবে র‌্যাব-পুলিশের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে, তা এখন দেশী-বিদেশী সব মহলের কাছে স্পষ্ট। সম্প্রতি ছাত্রদলের নতুন কমিটির ২২ জন নেতাকর্মী গ্রেফতারের পর গত পরশু আবার যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ ৬৩ জনের গ্রেফতার সরকারের সেই দমনপীড়ন পরিকল্পনারই অংশ বলে দেশবাসী মনে করে। বলা হচ্ছে, পুলিশের কাছে সন্দেহ হয়েছে, এরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। এভাবে সন্দেহের বশে এর আগে কত আটক-গ্রেফতার, মামলা-হামলা হয়েছে, অমানবিক পুলিশি নির্যাতন চলেছে; তার ইয়ত্তা নেই। বিদেশী মহল এ ব্যাপারে বারবার সরকারকে হুঁশিয়ার করে র‌্যাব-পুলিশকে দায়মুক্তি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে; কিন্তু সরকার ড্যামকেয়ার। বিদেশী বিভিন্ন মহলের উপরোধ-অনুরোধ আমলে নেয়নি, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে সরকার পুলিশ-র‌্যাবের ব্যবহার আরো জোরাল করে তুলছে সময়ের সাথে। এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে এবার বিভিন্ন দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশের পুলিশের কাছে আর কোনো অস্ত্র বিক্রি করবে না। গত ২০ অক্টোবর পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের পুলিশের ব্যবহারের অস্ত্র বিক্রি করতে রাজি নয়। সম্প্রতি মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশের পুলিশের জন্য গোলাবারুদ রফতানিতে যুক্তরাজ্য এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশও জারি করেছে একই  ধরনের অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা। তবে এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের পর ইতালিও এই নিষেধাজ্ঞা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতর। বাধ্য হয়ে গোলাবারুদের বিকল্প বাজারের সন্ধানে নেমেছে সরকার। তবে ওইসব দেশের মতো মানসম্পন্ন গোলাবারুদ সরবরাহকারী খুঁজে পাওয়া  যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যে এখন গণতন্ত্রের আকাল, তা সরকারের বাইরে থাকা সব মহলই বলছে। মাঝে মধ্যে বর্তমান সরকারে থাকা শরিক দলের নেতাদের মুখ থেকে মুখ ফসকে তা বেরিয়ে আসছে। গত ১৬ অক্টোবর বর্তমান সরকারের শরিক দল, আবার একই সাথে অদ্ভুত বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন ‘দেশে এখন একদলের গণতন্ত্র, প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার গণতন্ত্র চলছে। দেশের কোথাও সুশাসন নেই। সর্বত্র দলীয়করণ, দুঃশাসন ও দুর্নীতির মহোৎসব চলছে। যে গণতন্ত্রে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই, মানুষ নিরাপদে ঘুমাতে পারে না, তা জনগণের গণতন্ত্র নয়; এক পার্টির গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র আমরা চাই না।কিন্তু সরকারে থেকে ও একই সাথে বিরোধী দলে থেকে গাছেও খেয়ে তলায়ও কুড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে এ ধরনের সমালোচনা করার মতো অবস্থান ধরে রাখা অন্তত এ সরকারের আমলে সম্ভব হতে পারে না। ফলে এর মাত্র পাঁচ দিন পর এরশাদের মুখে শোনা গেল সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ উচ্চারণ। এবার তিনি শিরীন শারমিন চৌধুরী ও সাবের হোসেন চৌধুরীর উল্লিখিত নির্বাচনী বিজয় উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো এক অভিনন্দন বার্তায় বলেছেন, ‘...বঙ্গবন্ধুর কারণে বাংলাদেশের পরিচয়, তেমনি শেখ হাসিনার জন্য বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরিচয়...।আসলে আওয়ামী লীগের বাইরে সরকারি জোটে যারা আছেন, তাদেরকে এভাবেই তোতাপাখির বোল নিয়ে প্রতিদিন সরকারের গুডবুকে থাকার প্রয়াস চালাতে হয়। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, তার ৯ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ কি পরিচয়হীন ছিল? আর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কি সে পরিচয় উদ্ধার করেছেন? বিবেকবান সব মানুষের এক কথা সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মধ্যবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই নিহিত আজকের বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান। আর এ জন্য অপরিহার্য হচ্ছে রাজনৈতিক সংলাপে বসে সর্বমহলের কাছে সম্মত একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনী ব্যবস্থা। সূত্রায়ন, সরকারবিরোধী ২০ দলীয় জোটসহ সরকারের বাইরে থাকা বাকি সব রাজনৈতিক দল-গোষ্ঠীর দাবি এটিই; কিন্তু সরকারপক্ষের এক কথাÑ কোনো সংলাপ নয়, কোনো নির্বাচন নয়। নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই। কেউ নির্বাচনে এলে আসবে, না এলে ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন, দলীয় সরকারের অধীনে। কিন্তু বিবেকবান মানুষের কথাÑ মধ্যবর্তী নির্বাচনের কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশ-বিদেশে কারো কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অর্ধেকেরও বেশি আসনের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জনগণ এ নির্বাচন বর্জন করেছে বলেই এমনটি ঘটেছে। সরকার নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের সর্বসম্মত পদ্ধতি বদলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করে অবাধ নির্বাচনের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। সরকার বলছে, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিএনপি নেত্রীর পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে। বিএনপি দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই যদি হয়, তবে সরকার মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে ভয় পাচ্ছে কেন? সরকার সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনপদ্ধতি প্রণয়নের জন্য সংলাপে যেতে চাচ্ছে না কেন? আসলে সরকার মুখে যাই বলুক, বাস্তবে জানে সরকার নানা অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক কর্মকাণ্ডসহ দুর্নীতি-দুঃশাসনের সূত্রে নিজেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই অবাধ ও নিরপেক্ষ মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে সরকারের এত ভীতি ও অনীহা; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের এই অবস্থান থেকে বেরিয়ে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে গণতন্ত্রের পথেই হাঁটতেই হবে। নইলে জটিলতা আর জাতীয় দুর্ভোগ শুধু বেড়েই চলবে। আর সরকার নিজেই ডেকে আনবে নিজের জন্য বিপদের পর বিপদ। বিরোধী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের দমনপীড়নের মাধ্যমে এ জটিলতার কোনো সমাধান নেইÑ এটাই বাস্তবতা, এটাই শেষ কথা। সরকার বুঝতে পারছে কি না জানি না জনগণ, এমনকি দেশের বাইরের মহলের মনেও প্রশ্ন উঠেছেÑ এ কোন পথে হাঁটছে সরকার? চার দিকে এত কথা, তবুও সরকার কিছুই আমলে নিচ্ছে না। সরকার যেন পণ করে বসেছে, বাইরের মানুষ যা বলবে, যে দিকে যেতে বলবে, যেতে হবে ঠিক এর উল্টো দিকে। এরই প্রতিফলন সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে, কথাবার্তায়। এর শেষ কোথায়, এর জবাব কারো জানা নেই। অতএব সময়ের অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সব শেষে আরেকটি কথাÑ এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব সরকারই দাবি করে আসছে বাংলাদেশ একটি উদার গণতন্ত্রের দেশ, এমনকি বর্তমান সরকারও তেমনটি দাবি করে থাকে। উদারবাদী গণতন্ত্রের ধারক-বাহক বলে আমরা যারা দাবি করি, তারা এই উদারবাদী গণতন্ত্র তথা লিবারেলিজমের সংজ্ঞা ও পরিধি সম্পর্কে কতটুকু সচেতন, সে প্রশ্ন অনায়াসেই তোলা যায়। আমরা মনে হয় ভুলে গেছি, লিবারেলিজম এখন একটি রাজনৈতিক দর্শন, যা গড়ে উঠেছে লিবার্টিনামের অনুষঙ্গের ওপর। যে লিবার্টিশব্দটিতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয় কাসিক্যাল লিবারেলিজমে। সাধারণত এই লিবার্টিবলতে নাগরিকসাধারণের জন্য নিশ্চিত রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা। ধর্মতত্ত্বে লিবার্টি হচ্ছে পাপের বন্ধন থেকে মুক্তি। সাধারণ লিবারেলিজম (উদারবাদী) কিংবা কাসিক্যাল লিবারেলিজমই বলি, তা এমন একটি রাজনৈতিক দর্শন, যেখানে প্রাথমিক তাগিদ দেয়া হয় সরকারের ক্ষমতা সীমিত করার মাধ্যমে ব্যক্তিস্বাধীনতা বিকল্পহীনভাবে নিরাপদ করা। যুক্তরাষ্ট্রে বিংশ শতাব্দীর আগে কাসিক্যাল লিবারেলিজম নামের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দর্শনটি ছিল থমাস জেফারসন ও সে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণায় স্বাক্ষরকারীদের রাজনৈতিক দর্শন। তখনকার দিনে সেখানকার মানুষ বিশ্বাস করত, নাগরিকসাধারণের অধিকারের উৎস সরকার। মানুষ ভাবত তারা সে অধিকারই পাবে, যা নির্বাচিত সরকার তাদের দেবে; কিন্তু ব্রিটিশ দার্শনিক জন লকিকে অনুসরণ করে জেফারসন অভিমত দেন, বিষয়টি তা নয়। সরকারের দেয়া অধিকারের বাইরেও জনগণের অধিকার আছে। জনগণ সরকার গঠন করতে পারে এবং সরকার বাতিলও করতে পারে। আর একটি বৈধ সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য, জনগণের এসব অধিকার নিরাপদ করা। ভুললে চলবে না, এর ব্যত্যয় গণতন্ত্রের ব্যত্যয়। বিবেকবানেরা বলছেন, বাংলাদেশে বারবার এর ব্যত্যয় ঘটছে, সেই সূত্রে সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট; যার শিকার গোটা জাতি। এ থেকে উত্তরণের আন্তরিক প্রয়াসে প্রয়াসী ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই এ হুঁশিয়ারিটি বিবেকবান মানুষের। 
গোলাপ মুনীর

শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৪

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কেন এত আকুলিবিকুলি

বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচন সূত্রে আসা সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ইতালি সফর শেষে দেশে ফিরে গত বৃহস্পতিবার গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। তাতে তিনি তার স্বভাবসুলভ হাস্য কৌতুক করে বাছাই করা আওয়ামী ঘরানার সাংবাদিকদের আনন্দ দিয়েছেন। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় সে সম্মেলন দেখে কৃতার্থ বোধ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের সংবাদ সম্মেলনে অনেক টেলিভিশন চ্যানেল নিষিদ্ধ। সংবাদপত্রের যেসব সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তাদের সাংবাদিক পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয়ে চেনেন সমাজের লোকজন। ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিতে পারেন, তথাকথিত সংবাদ সম্মেলনে এমন সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। এটা সুকুমার রায়ের বাবুরাম সাপুড়েছড়ার মতো। করে নাকো ফুঁসফাঁস, মারে নাকো ঢুসঢাস, সে রকম গোটা দুই সাপ নিয়ে আসার নির্দেশ। সেই সাপ জ্যান্ত, গোটা দুই আনতো, তেড়েমেড়ে ডাণ্ডা করে দেবো ঠাণ্ডা। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন এখন ফুঁসফাঁস ঢুসঢাস না করাদের এক আমোদ বৈঠক।
এমন একটি পপিচুস (পরস্পর পিঠ চুলকানো সমিতি) আয়োজিত হলে হাস্যরসের জন্ম হওয়া তো অনিবার্য হয়ে ওঠে। হয়ও। আর আমরা দুনয়ন ভরে তা উপভোগ করি। এসব এমবেডেড সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন ও জবাবের ধারা একই। প্রকৃত সাংবাদিকদের মতো প্রশ্ন করতে পারেন না বা করতে চান না। সম্ভবত বিধানও নেই। সেখানে একই লোক সাবধানী তৈলমর্দনমূলক প্রশ্ন করেন। শেখ হাসিনা যেমন খুশি জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রীও তৃপ্ত, এমবেডেড সাংবাদিকরাও তৃপ্ত। এভাবেই অনেক দিন যাবৎ চলছে। ২৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি।
আওয়ামী ঘরানার একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন, বিএনপির সাথে সরকার কোনো আলোচনায় বসছে কি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, প্রশ্নটি ছিল খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত। আসলে তা ছিল শেখ হাসিনাকে তার শ্লেষাত্মক বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেয়া এবং সে জবাবের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন তিনি। সুযোগটি লুফে নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বারবার ওই খুনিদের সাথে বসার জন্য এত আকুলিবিকুলি কেন? বিএনপি কী দিয়েছে? প্রতিদিন বোমার আওয়াজ আর অস্ত্রের ঝনঝনানি না শুনলে আপনাদের ভালো লাগে না, নাকি শান্তিতে থাকতে ভালো লাগে না? যারা রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে চলে গেছে, তাদের জন্য আপনাদের এত দরদ কেন? সংলাপ প্রশ্নে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে, এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাইবার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে, তখন কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার আসে কেন?
কেন যে দরদ’, সে বিষয়ে উপস্থিত সাংবাদিকেরাআর কোনো কথা বলেননি। সেটাই স্বাভাবিক।
এরপর তিনি ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, নির্বাচনের আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ছিলাম, তাই অনেক কিছু করতে পারিনি। এখন নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আছে। এবার দেশের মানুষের গায়ে হাত দিয়ে দেখুক, দেশের একটি মানুষের ক্ষতি করলে খবর আছে। যে যেখানে পারেন, সেখানেই তাদের প্রতিরোধ করবেন। আমরা আপনাদের সাথে আছি। আবার একই অনুষ্ঠানে তিনি হজ, তাবলিগ ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে কটূক্তি করায় সম্প্রতি অপসারিত আওয়ামী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর গ্রেফতার দাবিতে সম্মিলিত ইসলামি দলগুলোর হরতাল আহ্বানের সমালোচনা করে বলেন, যখনই মামলার (খালেদা জিয়ার) তারিখ পড়ে, তখনই হুমকি ধমকি আর হরতালের ঘোষণা আসে। তিনি যেহেতু দুর্নীতি করেছেন, এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন, তাই মামলার হাজিরা থেকে বাঁচার জন্য হরতাল ডাকা হয়। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। না হলে মামলার মোকাবেলা করতে ভয় কিসের?
তিনি বলেন, দেশী বিদেশী যারাই এই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যেসব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এ দেশে অবস্থান করে সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলেছেন তাদের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা একটি প্রশ্নও তোলেননি। বরং সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এখনো যারা সরকারের বৈধতা নিয়ে কথা বলছেন, তারা হয় কূপমণ্ডূপতায় ভুগছেন আর না হয় বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বলছেন। বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের তরফ থেকে সংলাপের তাগিদ দেয়া হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান বিরোধী দল তো সংসদের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখেছে। তারা তো ফাইল ছোড়াছুড়ি করছে না। আর যে দল নির্বাচনই করেনি, তাদের নিয়ে তো কারো মাথাব্যথা নেই।
পরে রেল মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, রেলের জন্য খরচটাও বেড়ে গিয়েছিল। খরচ বাড়ার কারণে বিশ্বব্যাংক যখন এগিয়ে এলো, তাদের সহযোগিতা নিতে গেলাম। পরে একটা সময় দুর্নীতি-টুর্নীতি, হাবিজাবি বলেটলে চেষ্টা করল এটাকে ঠেকাতে। দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের কথা বলে বিশ্বব্যাংক প্রথমে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে। অনেক নাটকীয়তার পর গত বছর জানুয়ারিতে ওই প্রকল্পে তাদের অর্থ না নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। তিনি বলেন, এটা অন্য কারণে, প্রকৃত দুর্নীতি কোনো কিছুই হয়নি। কেউ বের করতে পারেনি; কিন্তু বিষয়টা ছিল একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। ঠিক যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি গাড়ি পোড়াল বা রেল পোড়াল, ঠিক সেই রকম উদ্দেশ্যে কোনো কোনো মহল থেকে এ ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছিল। আমরা সেটা চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। নিজের অর্থেই পদ্মা সেতু করব।
প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক কথাই বলেছেন। ধারাবাহিকভাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। দেশের কোনো সেক্টরেই যে স্বাভাবিক অবস্থা নেই চোখ কান খোলা রাখলে যে কেউ সে সত্য উপলব্ধি করতে পারবেন। রাজনীতিতে যে দলন-পীড়ন এখন চলছে, তা অনেকাংশে ১৯৭২-৭৫ সালের দমন-পীড়নকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিরোধী দল বলতে তিনি জাতীয় পার্টিকে মিন্ করতে অনেক স্বস্তিবোধ করছেন। ৫ জানুয়ারি প্রহসনের আগে বানরের পিঠা ভাগাভাগির মতো সংসদের আসনগুলো এরশাদ-হাসিনা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বিরোধী দল সদস্যরা সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা। জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত।
এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। তাকে সিএমএইচে বন্দী রেখে রওশনকে দিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেখিয়ে এক হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। জাতীয় পার্টির যারা সংসদ সদস্য ঘোষিত হয়েছেন তাদের অনেকে জানতেনই না যে তারা এমপি হয়েছেন। সে রকম একটি বিরোধী দলকে প্রকৃত বিরোধী দল বলতে শেখ হাসিনা অনেক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। যেমন অনুগত সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করায় তিনি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। এ বিরোধী দলের প্রধান গুণ তারা প্রশ্ন করে না ও ফাইল ছোড়াছুড়ি করে না। যার যার নিজের নিজের ধান্ধায় তারা ব্যস্ত আছেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনা এমন এক বিরোধী দল চান যারা কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করবে না। দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেলেও না। অন্যায়, জোরজবরদস্তি, জুলুম, নির্যাতন হলেও প্রশ্ন করবে না। যেমন করে না জাতীয় পার্টি। ফলে তার দরকার জাতীয় পার্টি মার্কা বিরোধী দলই। এ ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা স্মরণ করতে পারেন যে, বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় তিনি কী করেছেন।
এবার আশা যায় প্রধানমন্ত্রীর আকুলিবিকুলি নিয়ে। বিএনপির সাথে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে তিনি সাংবাদিকদের পাল্টা প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, খুনিদের সাথে বসার জন্য সাংবাদিকদের এত আকুলিবিকুলি কেন? তিনি বলতে চেয়েছেন যে, বিএনপি আমলে প্রতিদিন বোমা আর অস্ত্রের ঝনঝনানি হতো। এখন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাংবাদিকদের কি সেটা ভালো লাগছে না? শান্তি যে কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটি খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখন প্রতিদিন ১৫-২০ জন করে দেশে মানুষ খুন হচ্ছে। সে খুন হচ্ছে টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক কলহ প্রভৃতি নিয়ে। মুক্তিপণের জন্য প্রতিদিন অপহৃত হচ্ছে শিশুসহ বহু সংখ্যক মানুষ। সে মুক্তিপণ আদায়কারীর তালিকায় যোগ দিয়েছে দলীয়কৃত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। এসব বাহিনীর লোকদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জীবন দিচ্ছে বা পঙ্গুত্ব বরণ করছে প্রতিদিনই কেউ-না-কেউ। তারপরও তিনি বলতে চাইছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন এমন দাবি তুললেন, প্রকৃত সাংবাদিক কেউ হাজির থাকলে তাকে এই চিত্র স্মরণ করিয়ে দিতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, সংলাপ প্রশ্নে সাংবাদিকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, কাউকে যদি কেউ খুন করার চেষ্টা করে এবং হাতেনাতে ধরা পড়ে এবং বিচার চাওয়ার পরিবর্তে যদি বলা হয় আপস করতে তখন কি কেউ আপস করবে? করবে না। তাহলে বারবার এ কথা আসে কেন? তারপর বরাবরের মতোই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা প্রভৃতি ঘটনা উত্থাপন করে বলেন, খালেদা জিয়া সহযোগী। তার ছেলে আসামি। কেউ প্রশ্ন করল না এ মামলায় তো তারেক রহমান আসামি ছিলেন না। পরে কেন জবরদস্তিমূলকভাবে তাকে আসামি করা হলো? প্রশ্নকর্তা বিবিসির সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন দেশে যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রয়েছে, তা যারা চাইবে না, যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মা যারাÑ তারাই খুনিদের সাথে বসার কথা বলে। তার এই বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব থেকে বিবিসির ওই সাংবাদিক পর্যন্ত ইয়াহিয়ার প্রেতাত্মায় পরিণত হলো। সাবাস শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেছেন, মামলায় হাজিরা দিতে খালেদা জিয়ার ভয়। এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন এই জন্য কোর্টে যেতে ভয়। মামলায় হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করুন চুরি করেননি। আমাদের প্রশ্ন মামলায় হাজিরা দিতে তিনি কি খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? তার ডেকে আনা সামরিক সরকার তার এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একই অভিযোগে মামলা দায়ের করেছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আঁতাতের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমেই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো তুলে নিয়েছিলেন; কিন্তু বহাল রেখে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেও আরো কিছু মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। একইভাবে বিএনপি নেতাদের এক একজনের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার কোনোটা যুক্তির বিচারে টেকে না। উপরন্তু বিচার বিভাগ দলীয়করণের ফলে এখন মানুষ ন্যায়বিচার নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। ন্যায়বিচার তিরোহিত। জানমালের নিরাপত্তা শূন্যের কোঠায়। অর্থনীতি ধ্বংসোন্মুখ। জনশক্তি ও গার্মেন্ট রফতানিতে ধস। এর সমাধান জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, গণতন্ত্র। আর এখন সেটা নেই বলেই সাংবাদিকদের এমন আকুলিবিকুলি।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

Ads