শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

পথ চেয়ে আছে চট্টগ্রামের নিখোঁজ বিএনপি নেতা নজরুলের পরিবার




চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা নজরুল কি ফিরে আসবেন? তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন তিনি? গুপ্তহত্যার শিকার হলে তার লাশ কোথায়? প্রতিদিন এমন প্রশ্ন জাগে নজরুলের পরিবারের সদস্যদের মনে। র্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকধারীদের হাতে আটক হওয়ার পর থেকে অপেক্ষার প্রহর গোনা চলছে। নজরুলের স্ত্রী সামিন আরা সিদ্দিকী বলেন, ‘১৬ মাস ধরে আমরা পথ চেয়ে আছি। কিন্তু চট্টগ্রামের জনপ্রিয় এই বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান নজরুলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। আমরা তার পরিণতির কথা ভেবে উদ্বিগ্ন। গাজীপুরে অপহৃত হওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন তিনি।’
সূত্র জানায়, গাজীপুর থেকে নজরুলকে আটক করা হলেও পরিবারের সদস্যরা তখনই জানতে পারেন তাকে র্যাবের চট্টগ্রাম চান্দগাঁও ক্যাম্পে নেয়া হয়েছে। স্থানীয় বিএনপি নেতা, সাধারণ মানুষ ও আত্মীয়স্বজন তখন নজরুলের মুক্তির দাবিতে র্যাবের চান্দগাঁও ক্যাম্প ঘেরাও করেছিল। র্যাবের সঙ্গে ক্ষুব্ধ জনতার সংঘর্ষে আহত হয়েছিল ৩০ জন। র্যাবের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় তখন ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে তখনও স্বীকার করা হয়নি আটকের কথা। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, নজরুল ইসলামকে র্যাব আটক করেনি। তাদের ক্যাম্পেও এই নামে কাউকে আনা হয়নি।
কিন্তু নজরুল অপহৃত হওয়ার পর বিভিন্ন সূত্রে তার ঘনিষ্ঠজনরা নিশ্চিত ছিল, তাকে গাজীপুর থেকে আটক করে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও ক্যাম্পে নিয়ে আসে র্যাব। এমনকি তাকে ক্রসফায়ার করা হতে পারে—এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। ক্রসফায়ার থেকে রক্ষা করতে স্থানীয় জনতা তখন রাত জেগে র্যাব ক্যাম্প পাহারা দেন। পরিবারের অভিযোগ, ক্রসফায়ার থেকে রক্ষা করা গেলেও নজরুলকে ফিরে পাওয়া
যায়নি। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমের মতো নজরুলের একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তার স্বজনরা।
প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার গাজীপুর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বিএনপি নেতা ও করলডেঙ্গার ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচাকে সাদা পোশাকে অপহরণ করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর বাচা চেয়ারম্যানকে র্যাব কার্যালয়ে আনা হয়েছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বোয়ালখালীর কয়েকশ’ নারী-পুরুষ র্যাব ৭-এর বহদ্দারহাট কার্যালয় ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে।
অপহৃত নজরুলের বড় ভাই জাহিদুল হক ও মাইক্রোবাস চালক মো. বাবুলের বরাত দিয়ে স্ত্রী সামিন আরা সিদ্দিকী জানান, তার স্বামী মাইক্রোবাসে করে ঢাকার ফার্মগেট থেকে গাজীপুর যাচ্ছিলেন। রাত পৌনে ৮টার দিকে জয়দেবপুর থানার বাগড়া চৌরাস্তার মোড়ে তাকে বহনকারী গাড়িটি যানজটে আটকে পড়ে। এ সময় অজ্ঞাত ৪-৫ জন লোক এসে নিজেদের র্যাব সদস্য পরিচয় দিয়ে অস্ত্রের মুখে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তায় অপর পাশে দাঁড়ানো একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। নজরুল ইসলাম মামলাজনিত কারণে হাইকোর্টে যাওয়ার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন বলেন জানান তার স্ত্রী।
নজরুলের ভাই হামিদুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় জয়দেবপুর থানায় বাদী হয়ে তিনি একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন। অপহরণের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে স্থানীয় মনজুর আহমেদ বাবুলসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়, কিন্তু তাদের কাউকে পুলিশ আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তারা বরং আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হামিদুল ইসলাম বলেন, তার ভাই অপহৃত হওয়ায় তার ব্যবহৃত গাড়ি এবং দুটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। তবে তার ব্যক্তিগত মোবাইল সেটটি পাওয়া যায়নি। ওই ফোনের কললিস্ট পরীক্ষা করে এক মহিলাকে আটক করানো হলেও তার কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পারেনি। হামিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তার ভাইকে খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো তত্পরতাই চালায়নি।
নজরুল ইসলাম অপহৃত হওয়ার ঘটনায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নজরুল ইসলামের মুক্তি দাবি করা হয়। সে সময় বাচা চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও সন্তানরাও উপস্থিত ছিলেন। তারাও নজরুলকে সুস্থ অবস্থায় পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার জোর দাবি জানান সরকারের কাছে। পরিবারের সদস্যরা একাধিকবার সংবাদ সম্মেলন ও থানা পুলিশসহ আইনপ্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার কাছে ধরনা দিয়েছেন।
জানা যায়, বোয়ালখালী আহলা করলডাঙ্গা ইউনিয়নের পরপর তিন বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বাচা। আত্মীয়স্বজনরা জানান, র্যাবের লোকজন তাকে গাজীপুর থেকে ধরে চট্টগ্রাম নিয়ে আসে। আটকের পর র্যাব ৭-এর চান্দগাঁও কার্যালয়ে রাখা হয়। এ ব্যাপারে র্যাব ৭-এর চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা তখন বলেছিলেন, নজরুল ইসলাম নামে কোনো ব্যক্তিকে কোনো স্থান থেকে আটক বা গ্রেফতার করে আনা হয়নি। খবর পেয়ে নজরুল ইসলাম চেয়ারম্যানের ইউনিয়ন এলাকার লোকজন ও বোয়ালখালী বিএনপির কয়েক শ’ নেতাকর্মী চান্দগাঁওয়ের র্যাব কার্যালয়ের সামনে ও বহদ্দারহাট এলাকায় অবস্থান নেন। এলাকার লোকজন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের মুক্তির দাবিতে স্লোগান ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বোয়ালখালী থেকে ৪-৫শ’ বিএনপি নেতাকর্মী বাসে চট্টগ্রাম মহানগরীতে এসে চান্দগাঁওয়ে অবস্থিত র্যাবের ক্যাম্প ঘেরাও করেন। নজরুল ইসলামকে এই ক্যাম্পে রাখা হয়েছে—এমন গুজবের ভিত্তিতে তারা ক্যাম্প ঘেরাও করেন। এ সময় র্যাব সদস্যরা ঘেরাওকারীদের সরাতে বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। বিএনপি নেতাকর্মীরাও র্যাব কার্যালয় লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে র্যাবের ৩ সদস্যসহ ৩০ জন আহত হয়।
এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খখলা রক্ষাকারী বাহিনী সাদা পোশাকে তাকে গাজীপুর থেকে তুলে নিয়ে গেছে। তাকে গ্রেফতার কিংবা অপহরণ করা হয়েছে। তবে বিষয়টি গোপন রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নজরুল ইসলামকে ঢাকার আরেক বিএনপি নেতা চৌধুরী আলমের স্টাইলে ধরে নিয়ে গুম করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। এভাবে বিশেষ বাহিনী দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের দমানো যাবে না। এসব অপকর্মের পরিণতি একসময় সংশ্লিষ্টদের ভোগ করতেই হবে।
স্বজনদের অভিযোগ, শত চেষ্টার পরও নজরুলের খোঁজ মেলেনি। তাকে তাত্ক্ষকি ক্রসফায়ার থেকে রক্ষা করা গেলেও গুম থেকে রক্ষা করা যায়নি। বেঁচে থাকলেও তিনি কোথায় আছেন, তা তার পরিবার জানতে চায়। নজরুলের স্ত্রী বলেন, দেশে আইন আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তার স্বামীকে আইনের হাতে তুলে দেয়া হোক। তিনি এমন কোনো অপরাধ করেনি যে, গুম করে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি, র্যাবের ডিজিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে লিখিতিভাবে আবেদন করা হলেও এখন পর্যন্ত তার স্বামীর কোনো হদিস মেলেনি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads