শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

ব্যাংক খাতের ৮ হাজার কোটি টাকা হাওয়া


ব্যাংক খাতের ৮ হাজার কোটি টাকা হাওয়া

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ


পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ব্যাংকগুলোর আট হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হাওয়া হয়ে গেছে। তারা যে দামে শেয়ার কিনেছিল গত ৩১ ডিসেম্বর বিক্রি করলে তাতে আট হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হতো। তবে প্রকৃতপক্ষে এ লোকসানের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, ডিসেম্বর প্রান্তিকের শেয়ারধারণের হিসাব চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হিসাবে বাজারমূল্যের চেয়ে আরো কমতে পারে। 
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর লোকসানের ধকল কাটাতে গিয়ে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফা কমে গেছে। সামনে ব্যাংকগুলো লোকসানে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালে ব্যাংকগুলো অস্বাভাবিক মুনাফা করেছিল। পুঁজিবাজারে মুনাফার অংশ থেকে নগদ লভ্যাংশ দিতে ব্যাংকগুলোর ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। এতে ব্যাংকগুলোর হাতে বাড়তি অর্থ ছিল। এই বাড়তি অর্থ (রিটেইন আর্নিং) দিয়ে ব্যাংকগুলো ২০১১ সালের লোকসানের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করেছে। 
সূত্র জানিয়েছে, কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা থেকে ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়েছে। কিন' পুঁজিবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরে ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ লোকসান করবে তার প্রভিশন রাখতে মুনাফা দিয়ে কুলাবে না। এতে ব্যাংকগুলোর নিট লোকসান বেড়ে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার শেয়ার ছিল। কিন' বাজারদর কমতে কমতে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে এসে তা ১২ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। তবে চূড়ান্ত হিসাবে আরো কমতে পারে।
জানা গেছে, ২০১০ সালের শেষের দিকে পুুঁজিবাজারে ধস শুরু হওয়ার পর অনেক ব্যাংক তাদের কেনা শেয়ার ছেড়ে দিয়েছিল। এতে ওই বছর ব্যাংকগুলোর মুনাফা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। কোনো কোনো ব্যাংকের ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন' ২০১১ সালে ব্যাংকগুলোর মুনাফার প্রবৃদ্ধি কমে যায়। বাজারে যেসব ব্যাংকের বেশি শেয়ার ছিল সেগুলোর মুনাফার হার আগের বছরের তুলনায় অস্বাভাবিক হারে কমে যায়। কিন' কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী আগের বছর পুঁজিবাজারের মুনাফার লভ্যাংশ দিতে না পারায় তা ব্যাংকগুলোর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেয়। গত বছরের শেষে ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে যে পরিমাণ লোকসান দেয়, তার প্রভিশন সংরক্ষণ করে আগের বছরের রিটেইন আর্নিং দিয়ে। কিন' পুঁজিবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী বছরে মুনাফার পরিবর্তে ব্যাংকগুলো লোকসানের সম্মুখীন হবে।
এ পরিসি'তি থেকে উত্তরণে আস'ার সঙ্কট কাটাতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস'া নেয়ার দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। একই সাথে সব মার্জিন ঋণের ওপর সুদ মওকুফ, তারল্যপ্রবাহ বাড়াতে এসএলআর ও সিআরআর হার কমানো এবং ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও অর্থাৎ সিডিআর হার নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা সহজ করার দাবি জানানো হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংক ও সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই বর্তমান বিভিন্ন শেয়ারের বাজারদর অনুযায়ী পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকৃত অর্থের গড়ে ৩৫ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ হাওয়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ তারা যে দরে শেয়ার কিনেছিল ওই দিন বিক্রি করলে সমপরিমাণ অর্থ ফেরত পাবে না। এর মধ্যে এ মুহূর্তে বিক্রি করলে কোনো একটি ব্যাংকের ৫০ শতাংশ লোকসান দিতে হবে। এটা শুধু ব্যাংকের নিজস্ব বিনিয়োগের চিত্র। কিন' সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিসি'তি আরো খারাপ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মার্চেন্ট ব্যাংকিং শাখার প্রধান নয়া দিগন্তকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের অংশের প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যাংকের। বৃহস্পতিবার বাজারদর অনুযায়ী বিক্রি করলে প্রায় ৫০ শতাংশ লোকসান গুনতে হবে। আর সামগ্রিক পোর্টফোলিও বিবেচনায় নিলে প্রায় ৬০ শতাংশ লোকসান হবে।
অপর একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী জানান, তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগকৃত অর্থের মধ্যে আড়াই শ’ কোটি টাকাই ব্যাংকের। এ মুহূর্তে বিক্রি করলে প্রায় ৪৫ শতাংশ লোকসান গুনতে হবে।
তৃতীয় প্রজন্মের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান জানান, তার ব্যাংকের সিকিউরিটিজের মাধ্যমে তারা শেয়ারধারণ করেছিলেন প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। কিন' এ মুহূর্তে তা বিক্রি করলে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি লোকসান দিতে হবে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিসি'তির উন্নতি না হলে বছরের শেষে ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক মুনাফা কমে যাবে। কমে যাবে সরকারের করপোরেট ট্যাক্স।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো মার্চেন্ট ব্যাংক ও সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে বিনিয়োগ করেছে, বছরের শেষে ওই প্রতিষ্ঠান লোকসান দিলে ব্যাংকের মুনাফা দিতে পারবে না। আর এ লোকসানের অংশ প্রভিশন রাখতে হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। কোনো ব্যাংকের প্রভিশন বা মূলধন ঘাটতি থাকলে নীতিমালা অনুযায়ী ওই ব্যাংক তার শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ দিতে পারে না। আর প্রভিশন সংরক্ষণের পর যে অংশ বাকি থাকবে তার ওপর লভ্যাংশ দিতে পারবে। এতে কমে যাবে ব্যাংকের নিট মুনাফা।
একটি ব্যাংকের এমডি জানান, লোকসানের অংশ মুনাফা থেকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। আর প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গেলে মুনাফা কমে যাবে। আর মুনাফা কম হলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে। কারণ ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করে, তার সাড়ে ৪২ শতাংশ সরকার করপোরেট ট্যাক্স হিসেবে আদায় করে। মুনাফা কমে গেলে সরকারের করপোরেট ট্যাক্সও কমে যাবে। অপর দিকে ব্যাংকগুলোকে বছরের শেষে ডিভিডেন্ড কম দিতে হবে।
বর্তমান পরিসি'তি উত্তরণের জন্য ভুক্তভোগীরা বিনিয়োগকারীদের আস'ার সঙ্কট কাটাতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
একটি সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নয়া দিগন্তকে জানান, পুঁজিবাজারে অনাস'া সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস'া নিতে হবে। একই সাথে তারল্য সরবরাহ বাড়াতে যেসব ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য হাতে রয়েছে, সেগুলোকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগমুখী করতে হবে। 
ব্যাংকগুলোর তারল্য সরবরাহ বাড়াতে আমানতের ওপর যে অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তাসঞ্চিতি বা এসএলআর ও সিআরআর সংরক্ষণ করতে হয়, তা কমাতে হবে। বর্তমানে প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ১৯ শতাংশ এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে ১৫ দিন অন্তে ৬ শতাংশ নগদ অর্থাৎ সিআরআর এবং ১৩ শতাংশ সম্পদ। প্রসঙ্গত ১ শতাংশ সিআরআর কমালে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা কম রাখতে হয়। অর্থাৎ ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের হাতে থাকবে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ঋণ ও আমানতের অনুপাত (সিডিআর) রয়েছে ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা আমানত থাকলে তার ৮৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। একটি ব্যাংকের এমডি জানান, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ আটকে যাওয়ায় কোনো কোনো ব্যাংকের ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে তা সমন্বয় করেছে। সিডিআর অনুপাত বাড়ানো হলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগসক্ষমতা বেড়ে যাবে। 
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যালান্সশিট রিপোর্টিং মার্ক টু মার্কেট ভিত্তিতে করা হয়। অর্থাৎ কোনো মার্চেন্ট ব্যাংক একটি কোম্পানি শেয়ার ১০০ টাকায় কিনল। দাম কমে তা ৯০ টাকা হলো। নীতিমালা অনুযায়ী ৯০ টাকা আসল এবং ১০ টাকা লোকসান হিসেবে দেখাতে হয়। দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের সিকিউরিটিজের প্রধান জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নীতিমালা শিথিল করা হলে ব্যাংকগুলোর মুনাফার ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তার দাবি অনুযায়ী ক্রয়মূল্য ও বাজারদর- এই দুইয়ের মধ্যে যেটি কম সেটিই ব্যালান্সশিট রিপোর্টিংয়ে ধরা হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকসানের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হবে না। নয়া দিগন্ত ২৪ মার্চ ২০১২ 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads