শুক্রবার, ২৩ মার্চ, ২০১২

আজ ২৪ মার্চ—এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কালো দিন।


জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল হত্যা ও দুর্নীতির রাজনীতি


আজ ২৪ মার্চ—এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি কালো দিন। ১৯৮২ সালের এই তারিখে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। এ দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের দীর্ঘ ৯ বছরের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়। ওই বছর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদ তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। এরশাদ তার ৯ বছরের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রাম প্রতিহত করতে অনেক মানুষ হত্যা করেছেন। এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। তবে তার শাসনামলজুড়েই ছিল গণতন্ত্রকামী সংগ্রামীদের মৃত্যুর মিছিল।
অন্যদিকে নজিরবিহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে জেনারেল এরশাদ দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেন বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রপতি তথা ‘দরিদ্র
দেশের ধনী রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে। দুর্নীতি এবং বিদেশে অর্থপাচারের বেশ কিছু খবর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট লন্ডন অবজারভারে প্রকাশিত হয় ‘বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে প্রেম ও অসততা’ শিরোনামে একটি সংবাদ। এতে জেনারেল এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে কথিত মরিয়ম মততাজকে (মেরী বদরুদ্দীন) নিয়ে কেচ্ছা, কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় : ‘একটি দরিদ্র দেশের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং তার স্ত্রী রওশন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তুলেছেন। রওশন এরশাদ দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নিজেকে একজন ক্ষুদে ইমেলদা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন অসংখ্য সংবাদে দুর্নীতির সীমাহীন নজির পাওয়া যায়। আর এসব দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনেকেই—এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। জাহাজ ক্রয়, বিমান ক্রয় থেকে শুরু করে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও যে দুর্নীতির মূল প্রোথিত ছিল তা সহজেই ধারণা করা যায়। ফলে প্রকৃত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে কার্যত বহিষ্কৃত আর চামচারা সরকারি আনুকূল্যে লুটে নেন কোটি কোটি টাকা।’
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হলেন বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি দুর্নীতির দায়ে কারাভোগ করেছেন। বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত দুর্নীতিপরায়ণ এরশাদের পতনের পর বাসভবন থেকে উদ্ধার করা হয় ৭০ লাখ টাকা মূল্যের একটি হীরার জড়োয়া সেটসহ মালামালে পরিপূর্ণ ৩০টি ট্রাংক। এসব ট্রাংকের মধ্যে ছিল মূল্যবান কৃস্টাল সামগ্রী, ঝাড়বাতি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গহনাগাটি, দামি পারফিউম, ব্যক্তিগত এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য অনেক বিলাসী সামগ্রী। এছাড়া তার বাসভবনে এমন কিছু নিষিদ্ধ মালামাল পাওয়া যায়, যা একজন প্রেসিডেন্টের বাসভবনে থাকা কাম্য হতে পারে না।
সামরিক স্বৈরাচারী এরশাদ তার দীর্ঘ ৯ বছরের শাসনামলে আন্দোলন-সংগ্রাম ঠেকাতে বহু জাতীয় রাজনৈতিক নেতাসহ হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার করেন। অন্তরীণ করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সিনিয়র নেতাদের কারারুদ্ধ করেন এরশাদ। বর্তমানে মহাজোট সরকারের মূল দল আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদ, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রমুখও রেহাই পাননি।
তাই দুর্নীতিপরায়ণ স্বৈরাচারী এরশাদের পতনে দেশের সর্বস্তরের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ে। দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় বিজয়োত্সব। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শোকরানা দিবস পালন করে। আর বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে ঢাকেশ্বরী মন্দির, রমনা গির্জা ও কমলাপুল বৌদ্ধবিহারে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা ।
পতনের সিঁড়ি : সামরিক স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী প্রথম বড় ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, যা মধ্য ফেব্রুয়ারির আন্দোলন হিসেবে পরিচিত। আর এদিন থেকেই শুরু হয় সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ আমলের রক্তঝরার ইতিহাস। এদিন মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন কাঞ্চন, জাফর, জয়নাল, আইয়ুব, দিপালী ও ফারুক। ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোজাম্মেল পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংগ্রাম আহূত সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি সফল করতে ছাত্রদের একটি বিশাল বিক্ষোভ মিছিল সকাল ১১টার দিকে শিক্ষা ভবনের সামনে পৌঁছলে পুলিশ বাধা দেয়। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, জাফর এবং দিপালী সাহাসহ কয়েকজন। নিহতদের কয়েকজনের লাশ গুম করে সরকার। কিন্তু সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা এতটাই ব্যাপক ছিল যে এই বিক্ষোভ এবং ছাত্রহত্যার ঘটনার বিষয়ে পরদিন কোনো পত্রিকায় সরকারের প্রেসনোটের বাইরে অন্য কোনো খবর প্রকাশ হতে পারেনি।
অবিরাম রাজনৈতিক হত্যা : ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় হরতালের সমর্থনে মিছিল চলাকালে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন ও ইব্রাহিম সেলিম। ১ মার্চ সেলিম ও ইব্রাহিম হত্যার প্রতিবাদে ৭ দল ও ১৫ দল হরতাল ডাকে। সেই হরতালে নিহত হন শ্রমিক তাজুল ইসলাম। ২৭ সেপ্টেম্বরের হরতালে ঢাকার কালীগঞ্জে নিহত হন রাজনৈতিক নেতা ময়েজ উদ্দিন। এদিন স্বপন কুমার, নেত্রকোনায় তিতাস ও অপর একজন নিহত হন। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে একজন রিকশাওয়ালা ও ফুটপাতের একজন দোকানদার এবং ঢাকার বাইরে আরও দুজন নিহত হন। ২৪ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গায় ফজলুর রহমান নামে একজন নিহত হন। ২২ ডিসেম্বর রাজশাহীতে মিছিলে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় হলের বাবুর্চি আশরাফ, ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ ও পত্রিকার হকার আবদুল আজিজ।
১৯৮৫ : ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিলে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাউফুন বসুনিয়া। ১৯ মার্চ হরতাল চলাকালে এক কিশোরের মৃত্যু হয়। ২২ এপ্রিল মিছিলে বোমা হামলায় একজন, ৯ অক্টোবর তেজগাঁও পলিটেকনিকে ৪ জন, ৩০ অক্টোবর ছাত্রনেতা তিতাস, ৩১ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরে বিডিআরের গুলিতে ছাত্র স্বপন ও রমিজ নিহত হন। ৭ নভেম্বর আদমজী জুট মিলে ধর্মঘটে হামলায় ১৭ শ্রমিক এবং বিডিআরের গুলিতে তিন শ্রমিক নিহত হন।
১৯৮৬ : ৭ মে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিহত হয় ৫ জন, ১৪ মে হরতালে নিহত হন ৮ জন, ১৫ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনে নিহত হন ১১ জন, ১০ নভেম্বর হরতাল চলাকালে ঢাকার কাঁটাবন এলাকায় নিহত হয় সাহাদত নামে এক কিশোর ।
১৯৮৭ : ২২ জুলাই জেলা পরিষদ বিল প্রতিরোধ ও স্কপের হরতালে নিহত হন ৩ জন, ২৪ অক্টোবর শ্রমিক নেতা শামসুল আলম, ২৬ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কৃষক জয়নাল, ১ নভেম্বর কৃষক নেতা হাফিজুর রহমান মোল্লা, ১০ নভেম্বর নিহত হন যুবলীগ নেতা নূর হোসেন এবং ১১ নভেম্বর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আবুল ফাত্তাহ, ছাত্র বাবলু, যুবনেতা টিটো, শেরপুরের আমিন বাজারে পুলিশের গুলিতে উমেছা খাতুন, গোলাম মোহাম্মদ আসলাম, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোকন ও দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও তিনজন নিহত হন। এরপর ৫ ডিসেম্বর কক্সবাজারের চকরিয়ায় ছাত্রনেতা দৌলত খান নিহত হন।
১৯৮৮ : ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার জনসভায় আগত মিছিলে গুলিবর্ষণে নিহত হন ২২ জন। এরা হলেন ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, হোটেল কর্মচারী জিকে চৌধুরী, ছাত্র মহিউদ্দিন শামীম, বদরুল, শেখ মোহাম্মদ, সাজ্জাদ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন, আলবার্ট গোমেজ, আবদুল মান্নান, কাশেম, ডিকে দাস, কুদ্দুস, পংকজ বৈদ্য, চান মিঞা, হাসান, সমর দত্ত, পলাশ, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন ও সাহাদাত হোসেন। এ বছর ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় হামলায় নিহত হন ১৫ জন।
১৯৯০ : ১০ অক্টোবর সচিবালয়ে অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ছাত্রনেতা জেহাদ ও মনোয়ার, হকার জাকির এবং ভিক্ষুক দুলাল। ১৩ অক্টোবর পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র মনিরুজ্জামান ও সাধন চন্দ্র শীল। ২৭ অক্টোবর হরতাল চলাকালে ঢাকার বাইরে দুজন, ১৪ নভেম্বর আদমজীতে ১১ জন নিহত হয়। ২৬ নভেম্বর নিহত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চায়ের দোকানদার নিমাই। ২৭ নভেম্বর এরশাদের লেলিয়ে দেয়া গুণ্ডা বাহিনীর গুলিতে নিহত হন বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন। ২৮ ডিসেম্বর সারাদেশে পুুলিশের গুলিতে নিহত হয় ৫০ জন বিক্ষোভকারী। ২৯ নভেম্বর শাহজাহানপুরে ১ জন ও খিলগাঁওয়ে ২ জন নিহত হন। ৩০ নভেম্বর বিডিআরের গুলিতে রামপুরা ওয়াপদা রোডে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় নিহত হন মা।
১ ডিসেম্বর মিরপুরের ১০ নম্বর এলাকায় পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর গুলিতে ছাত্র জাফর, ইটভাঙা শ্রমিক আবদুল খালেক, মহিলা গার্মেন্টকর্মী ও নুরুল হুদাসহ ৭ জন এবং এক নম্বর এলাকায় আরও ৯ জন নিহত হন। এছাড়া জরুরি অবস্থা অমান্য করায় এদিন ডেমরায় ৩ জন, ইউসুফ মার্কেটে ১ জন, নীলক্ষেতে একজন, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে একজন, খুলনার খালিশপুরে মহাব্রজ, নারায়ণগঞ্জের মণ্ডলপাড়ায় এক কিশোর নিহত হয়, ৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম ও চাঁদপুরে পুলিশের গুলিতে দুজন, ২৭ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ময়মনসিংহে দুজন, রাজশাহীতে দুজন, ধানমন্ডিতে একজন ও জিগাতলায় একজন নিহত হন।
এরশাদের পতনের পর তার দুর্নীতি বিষয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে শত শত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো—
দুর্নীতি, লুটপাট-১
এরশাদ—গরিব দেশের
ধনী রাষ্ট্রপতি
জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসেছিলেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ’ ঘোষণার কথা বলে। কিন্তু দেশ-বিদেশে তিনিই চিহ্নিত হয়েছেন সবচেয়ে দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রপতি হিসেবে। ‘দরিদ্র দেশের ধনী রাষ্ট্রপতি’—এমন একটি কথা ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি এরশাদ সম্পর্কে এক সময় বলা হতো। ৯ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ অসংখ্য অভিযোগে অভিযুক্ত ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি। দুর্নীতি এবং বিদেশে অর্থপাচারের বেশ কিছু খবর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালেই বিদেশি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সে সময়ে দেশের পত্রিকার কণ্ঠ এমনই রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল যে, কেউ একটি শব্দও লিখতে পারেননি।
সে সময়েও ফিসফাস কথাবার্তা হয়েছে এ নিয়ে। কান থেকে কানে কথা ছড়িয়ে পড়েছিল দেশময়। ১৯৮৬ সালের ৩১ আগস্ট লন্ডন অবজারভারে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে প্রেম ও অসততা’ শিরোনামে একটি সংবাদ। এতে জেনারেল এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী বলে কথিত মরিয়ম মমতাজকে (মেরী বদরুদ্দীন) নিয়ে কেচ্ছা-কেলেঙ্কারির কথা ছাপা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল : এরশাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইজারল্যান্ডে। কম করে হলেও এসব ব্যাংকে এরশাদের সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ১৫ কোটি ডলার। এ খবরের অনুলিপি সে সময় হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফটোকপি মেশিনের বদৌলতে। ফটোকপি মেশিনগুলো ছিল দারুণরকম সচল। পুলিশ এবং গোয়েন্দারা তত্পর হয়ে উঠেছিল।
নজর রাখছিল ফটোকপি দোকানগুলোর ওপর। প্রেস ক্লাবের উল্টো দিকের একটি দোকানে নিরাপত্তার খাতিরে বিজ্ঞপ্তি সেঁটে রাখা হয়েছিল : এখানে ‘উহা’ ফটোকপি করা হয় না। ১৯৮৬ সালের পরে নিউইয়র্ক পোস্ট, লন্ডনের সানডে করেসপন্ডেন্ট, জাপানের সুকনপোস্ট, আসাহী শিম্বুন, জাপান টাইমস, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াসহ বিদেশী বেশকিছু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির খবর। কখনও মরিয়ম মমতাজকে নিয়ে সরস রিপোর্ট।
এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর একদিন সাইকেল চালিয়ে অফিসে গিয়েছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। দুর্নীতি এবং জাতীয় অভিযোগে গ্রেফতার করেছিলেন সাত্তার মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজনকে। আবার পরে এদেরই মন্ত্রী এবং মন্ত্রণাদাতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
এরশাদ কত কোটি টাকার মালিক এমন প্রশ্ন অনেক আগে থেকেই বহুল আলোচিত। আন্তর্জাতিক তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ারফ্যাক্সের প্রেসিডেন্ট হার্শম্যান জেনারেল এরশাদের ওপর তদন্ত শেষে মন্তব্য করে বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করেছেন বা করছেন এমন সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে পার্সেন্টজ গ্রহণ করা ছাড়াও রাষ্ট্রপতি এরশাদের বিরুদ্ধে দেশের জন্য দেয়া বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণও আমাদের কাছে আছে।
১৯৮৬ সালে লন্ডন অবজারভার—এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল : একটি দরিদ্র দেশের স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং তার স্ত্রী রওশন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দুর্নীতির পাহাড় গড়ে তুলেছেন। রওশন এরশাদ দেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে নিজেকে একজন ক্ষুদে ইমেলদা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এমন অসংখ্য সংবাদে দুর্নীতির সীমাহীন নজির পাওয়া যায়। আর এসব দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন অনেকেই এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। জাহাজ ক্রয়, বিমানক্রয় থেকে শুরু করে স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্যেও যে দুর্নীতির মূল প্রোথিত ছিল তা সহজেই ধারণা করা যায়। ফলে প্রকৃত ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে কার্যত বহিষ্কৃত, আর চামচারা সরকারি আনুকূল্যে লুটে নেন কোটি কোটি টাকা। (দৈনিক সংবাদ : ২২ ডিসেম্বর ’৯০)
দুর্নীতি লুটপাট—২
বিদেশী ব্যাংকে এরশাদের কোটি কোটি ডলার
গত ৯ বছরে কত দুর্নীতি হয়েছে দেশে? ক্ষমতাচুত্য রাষ্ট্রপতি কত অর্থসম্পদের মালিক? কত অর্থ তার রয়েছে বিদেশে এবং দেশে? এসব আলোচনা চলছে সর্বত্র। রয়েছে কৌতূহল। বিদেশী পত্র-পত্রিকা এবং অনুসন্ধানী সংস্থা ফেয়ারফ্যাক্স এর আগে এ ব্যাপারে কিছু খবরাখবর দিয়েছে।
চলতি বছরের পহেলা ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক পোস্ট এক প্রতিবেদনে এরশাদের লাখ লাখ ডলার বিদেশে পাচারের ঘটনাকে বিস্ময়কর বলে মন্তব্য করেছে। পত্রিকাটি বলেছে, এ অর্থ পাচারে সহায়তা করেছে বিসিসিআই ব্যাংক। এ ব্যাংকটি এরই মধ্যে সারাবিশ্বে বিতর্কিত। মাদক চোরাচালানের অর্থ পাচারের দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকটি অভিযুক্ত হয়। নিউইয়র্ক পোস্ট বলেছে, বিসিসিআই নিউইয়র্ক শাখার মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ লাখ লাখ ডলার পাচার করেছেন এমন তথ্যের প্রমাণ মিলেছে। আন্তর্জাতিক তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ারফ্যাক্সের প্রেসিডেন্ট মাইকেল হার্শম্যান এক তদন্ত শেষে বলেছেন, লাখ লাখ ডলার পাচারের ঘটনা প্রমাণিত সত্য।
ফেয়ারফ্যাক্স এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে বেশ বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছে। ভারতের বোফর্স কেলেঙ্কারির তদন্ত করেছিল এ ফেয়ারফ্যাক্স এবং মাইকেল হার্শম্যান নিজে। চলতি বছরের ১৫ জুলাই লন্ডনের ‘সানডে করেসপন্ডেন্ট’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হার্শম্যান জানান, তিনি জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগত খোঁজখবর এবং ব্যাংকের কাগজপত্র পর্যালোচনায় জানতে পেরেছেন যে, জেনারেল এরশাদ কম করে হলেও ১ কোটি ডলার বিদেশে পাচার করেছেন এ বিসিসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে।
অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান ‘ফেয়ারফ্যাক্স’কে জেনারেল এরশাদের অর্থ সম্পত্তি অনুসন্ধানের জন্য মরিয়ম মমতাজ নিয়োগ করেছিলেন। মরিয়ম মমতাজ— যিনি এরশাদের স্ত্রী বলে নিজেকে দাবি করেছেন এবং যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ এরই মধ্যে দিয়েছেন— তিনি এরশাদের অর্থসম্পদের অংশীদারিত্ব দাবি করেছেন।
মরিয়ম মততাজ সানডে করেসপন্ডেন্টের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, জেনারেল এরশাদ বিসিসিআই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা আগা হাসান আবেদীর সঙ্গে হারহামেশাই দেখা করতেন। মরিয়ম মমতাজ আরও দাবি করেছেন, জেনারেল তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন তিনি যদি কোনো সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন তবে বিসিসিআই হংকং শাখায় গচ্ছিত অর্থ তিনিই (মরিয়ম) পাবেন।
সানডে করেসপন্ডেন্টের রিপোর্টে বলা হয় : রাষ্ট্রপতি এরশাদ বৈদেশিক সাহায্যের লাখ লাখ ডলার আত্মসাত্ করে তা জমা করেছেন হংকং, সুইজারল্যান্ড, লন্ডন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেক ব্যাংকে। ১৯৮৬ সালে লন্ডন অবজারভার এক প্রতিবেদনে বলেছিল : এরশাদ তার কিছু মন্ত্রী এবং ঢাকায় কিছু প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর সহযোগিতায় সীমাহীন দুর্নীতি চালিয়েছেন। বিপুল অঙ্কের ব্যবসা থেকে ‘পার্সেন্টেজ’ গ্রহণ একটি সচরাচর ঘটনা ছিল। আমদানি, বিমান ও বিমানবন্দর, নির্মাণ, গ্যাস ও রাসায়নিক খাতসহ এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে জেনারেল ও তারা স্ত্রী লাভবান হননি। লন্ডন অবজারভার সে সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেনারেল মাহমুদুল হাসান, মমতা ওয়াহাব, এএইচজি মহিউদ্দীন, জিনাত মোশাররফসহ অনেকের নামই ছেপেছিল। (দৈনিক সংবাদ : ২৩ ডিসেম্বর ’৯০)
দুর্নীতি লুটপাট—৩
বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে কেলেঙ্কারি
বছর দুয়েক আগে ব্রিটেনের দুটি ঋণদাতা সংস্থা অভিযোগ উত্থাপন করেছিল, বাংলাদেশে দেয়া বিদেশী সাহায্য সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। সমাজের বিত্তশালী অংশ এ সাহায্য খেয়ে ফেলে। সাহায্য নিয়ে কারচুপি এবং দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল জাপানি পার্লামেন্ট ডায়েটেও। নৌযান ক্রয় নিয়ে ছিল এই অভিযোগ। এ দুই দেশ ছাড়া অন্য দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোও বিদেশী সাহায্যদাতাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রবণতা সরকারকে না দিয়ে এনজিওদের হাতে সাহায্যের অর্থ তুলে দেয়া হয়।
‘৮৭ সালে বন্যায় বিদেশী সাহায্য এসেছিল প্রচুর। অর্থ এবং নানা পণ্য সাহায্য দিয়েছিল বন্ধু দেশগুলো। সাহায্যের পণ্য দ্রব্যাদি পরে ঢাকার রাস্তায়ও বিক্রি হয়েছে। এ নিয়ে সে সময় দু’একটি কাগজ সংবাদ পরিবেশন করেছিল। কিন্তু সরকারি ধমকে আর এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। বন্যা ত্রাণের জন্য প্রাপ্ত অর্থ সাহায্য নিয়েও সে সময় নানা কথা বলেছিল রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো হিসাবপত্র প্রকাশিত হয়নি। চলতি বছরের ১৫ জুলাই লন্ডনের সানডে করেসপন্ডেন্ট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বিদেশী সাহায্য নিয়ে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছিল। ফেয়ারফ্যাক্সের প্রেসিডেন্ট মাইকেল হার্শম্যান এক অনুসন্ধান শেষে জানিয়েছেন, জেনারেল এরশাদ যে বিদেশী সাহায্য হাতিয়ে নিয়েছেন তার যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। জাপানি পণ্য ঋণ মওকুফ অনুদানের অধীনে ২৫০ কোটি ইয়েনে নৌযান ক্রয় নিয়ে কেলেঙ্কারির খবর সেদেশের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে অনেক। জাপানি পালামেন্টে এ নিয়ে আলোচনায় জাপানি বিদেশমন্ত্রী বলেন, বিদেশী সাহায্য জনগণের দেয়া কর। তাই বিদেশী সাহায্যের ব্যবহার সঠিকভাবে হয় কি না তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
ব্রিটিশ রফতানি ঋণ কর্মসূচির আওতায় কেনা এটিপি বিমান ক্রয় নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। লন্ডনের ইকনোমিস্ট সাপ্তাহিকীর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি মূল্যে এই বিমান ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। একই প্রতিবেদনে ইসলামী উন্নয়ন সংস্থার ঋণে জাহাজ ক্রয় নিয়েও অনিয়মের খবর দেয়া হয়েছে। বিদেশী সংস্থার ঋণ নিয়ে এ ধরনে কেলেঙ্কারি হয়েছে আরও অনেক ক্ষেত্রে। যার সামান্যই প্রকাশিত হয়েছে বিদেশী সংবাদপত্রে। আর এ ধরনের ঘটনা নিঃসন্দেহে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করেছে। (দৈনিক সংবাদ : ২৫ ডিসেম্বর ’৯০)
দুর্নীতি লুটপাট—৪
প্রতিটি বিমান ৬০ লাখ ডলার বেশি দামে ক্রয়
তিনটি অ্যাডভান্সড টারবো প্রপ (এটিপি) বিমান কিনে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কমপক্ষে ৬৩ কোটি টাকা। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ বিমান কেনার সঙ্গে ক্ষমতাচুত্য রাষ্ট্রপতি এরশাদসহ অনেকেই জাড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ অর্থ সাহায্য বাংলাদেশ বিমান তিনটি এটিপি বিমান কিনেছে ৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলারে। প্রতিটি এটিপি বিমান কিনতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আন্তর্জাতিক বাজারে এটিপির মূল্য অনেক কম। প্রতিটি ১ কোটি ৫ লাখ ডলার। ইকনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটির এক প্রতিবেদনে বাড়তি দামে বিমান ক্রয়ের কথা চলতি বছরের প্রকাশিত হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ সর্বশেষ যুক্তরাজ্য সফরকালে বিমান ক্রয়ের বিষয়টি পাকাপাকি হয়। জেনারেল এরশাদকে সে সময় রাজকীয় সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল ব্রিটেনে। একটি সূত্র জানায় ব্রিটিশ অ্যারোস্পস থেকে বিশ্বে সম্ভবত বাংলাদেশই প্রথম বিমান কিনেছে। বিমানের পরিচালকমণ্ডলীর সভায় এ বিমান কেনার আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছিল। বিমানের পাইলটদের পক্ষ থেকেও আপত্তি উত্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু কোনো আপত্তিই টেকেনি। বিমানের সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা আর্থিক দায়ের প্রেক্ষাপটে এই বিমান কেনা যুক্তিযুক্ত নয়—এমন অভিমতও জানানো হয় বিমানের পক্ষ থেকে। আর বিমানচালকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল এ বিমান ত্রুটিপূর্ণ, ঝুঁকিবহুল। এর প্রমাণ এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকবার যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে ২টি এটিপিতে। বিমান সূত্রে জানা গেছে, আরও একটি এটিপি এ মাসেই ঢাকায় আসবে। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ বিমান আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাড়তি মূল্যে কেনার উদ্দেশ্য সম্ভবত একটিই—দুর্নীতি এবং লুটপাট। (দৈনিক সংবাদ : ২৬ ডিসেম্বর ’৯০)

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads