কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে আর এর জবাবে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন- এই মুহূর্তে মহাজোট সরকার সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী চক্রের ভয়াবহ বিপদ ও দুর্নীতির বিষ থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে মহাসংগ্রাম চালাচ্ছে এমন সময় কোন ব্যক্তির এমন কিছু বলা উচিত না যেটা ইতিহাসের সাথে জড়িত- এর মানে আমরা কি বুঝবো। এই কথা থেকে তো এটাই বোঝা যাচ্ছে যে, জনাব মাহবুব উল হক হানিফের কথাটাই তাহলে ঠিক। এখানে জনাব ইনু কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, প্রথমত জঙ্গিবাদের কথা, দ্বিতীয়ত দুর্নীতি এবং তৃতীয়ত গণতন্ত্র। কিন্তু মজার বিষয় হলো বাংলাদেশ সরকার বলেছেন যে দেশে কোন জঙ্গি নাই তাহলে ইনু সাহেব জঙ্গির গন্ধ পেলেন কোথায়! আর দুর্নীতির সাথে তারা লড়ছেন কার সাথে, তারাইতো দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। অন্যদিকে ইনু সাহেবদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মানায় না। কারণ তাদের শ্লোগানই হলো “বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস”। যাদের ক্ষমতার উৎসই হলো বন্দুকের নল তারা জনগণের মতামতের কোন তোয়াক্কাই যে করবে না এটা বোঝার জন্য কোন ডিগ্রির প্রয়োজন হয় না।
আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবো যে, জাসদ তাদের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত কোন গঠনমূলক কাজ করেনি। যার সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে কুষ্টিয়ায়। ১ অক্টোবরের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিকের খবর হলো “কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িতে জাসদের হামলা”। খবরে প্রকাশ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় জাসদ সমর্থকরা। এ সময় এলাকার কমপক্ষে ৩৫টি বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। এতে আহত হয় অন্তত ৮ জন।
হামলার শিকার ফরিদ হোসেন জানান- “রাতে জাসদ সমর্থকরা ফিল্মি স্টাইলে এলাকায় ঢুকে প্রথমে বসতবাড়ির বৈদ্যুতিক মিটার ভেঙে ফেলে। এতে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ হয়ে পুরো এলাকা আঁধারে ঢেকে যায়। এরপর বসতবাড়িতে ঢুকে হামলা এবং লুটপাট চালায় তারা।”
রূপজান বেগম নামে এক নারী বলেন- “ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ঘরের টিনের বাক্সে টাকা রেখেছিলেন। সেই টাকাও দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে।”
ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদার আবুল কালাম বলেন- “তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বেশ কিছুদিন ধরে জাসদের স্থানীয় নেতারা তাকে জাসদে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছেন। দল ত্যাগে রাজি না হওয়ায় তার দোকান লুট করা হয়েছে।”
যদিও আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপরিউক্ত ঘটনাটি অনেক বড় কিছু মনে হবে কিন্তু আসলে জাসদের কাছে এটা তেমন কোন ঘটনাই না। যেখানে এক সময়ের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার রাস্তা পরিষ্কার করেছিল সেখানে এসব ঘটনাতো একেবারেই তুচ্ছ। এখন আসুন আমরা তাদের অতীত ইতিহাসটা একটু জেনে আসি।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে তাদের পথ চলা শুরু হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা খুনোখুনির দিকে মনোযোগ দেয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছেন- ১৯৭২ সালের ২৮ ডিসেম্বর খুলনায় জেলা আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবু সুফিয়ানসহ দু’জন চরমপন্থীর হাতে নিহত হন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ চরমপন্থীদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন শতাধিক। একই সালের মার্চে সংসদ নির্বাচনের পর গুপ্তহত্যা ও গুপ্তঘাতকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঐ বছরের জুন পর্যন্ত চরমপন্থীদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত মাত্র ১৭ মাসে গুপ্তহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯২৫ টিতে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে ৬০টি।
এরপর ১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের বিষয়টি জাসদ তার রাজনীতির আশু লক্ষ্য হিসেবে হাজির করে এবং সে অনুযায়ী প্রণীত হয় আন্দোলনের সকল কর্মসূচি। এরই অংশ হিসেবে একই সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এর কর্মসূচি তারা গ্রহণ করে। কর্মসূচির এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে তাদের একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়, শুধু তাই নয় পরিস্থিতি সামাল দিতে একপর্যায়ে রক্ষীবাহিনীকেও তলব করা হয়। সেই রক্ষীবাহিনীর গুলীতে প্রায় ২২/২৩ জন জাসদ কর্মী নিহত হন।
জাসদের এক সময়ের সক্রিয় কর্মী, কলামিস্ট ও আলোচিত রাজনৈতিক গ্রন্থ “জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি”র লেখক মহিউদ্দিন আহমদ একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন- একটি দল যদি মনে করে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তাহলে তারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিতে পারে, এমনটাই মনে করছিল জাসদ। (এরই অংশ হিসেবে) জাসদ একসময়ে গণবাহিনী গঠন করে। ঢাকা শহরে গণবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি বাহিনীর কমান্ডার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি চলছিল। রাষ্ট্রপতি আসবেন- গণবাহিনী ভাবলো এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। ১৪ আগস্ট গণবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে তিনটি বোমা ফাটালো। এ বোমা সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণবাহিনী সিটির কমান্ডার আনোয়ার হোসেন। যিনি বর্তমান সরকারের আমলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ওই দিন লাইব্রেরি, কলাভবনের মাঝামাঝিতে কার্জন হলের সামনে টাইমবোমা হামলা করা হলো। তখন জাসদ এক ধরনের বোমা বানাতো। এর নাম ছিল “নিখিল” বোমা (বোমা বানাতে গিয়ে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার নামেই বোমার নাম রাখা হয়)। গরিব পরিবার থেকে আসা এই মেধাবী ছাত্র বুয়েটের লেকচারার ছিলেন। ড. আনোয়ার হোসেন কেমিস্ট্রি ভালো বোঝেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। তার চ্যান্সেলর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) যাতে নির্বিঘ্নে ক্যাম্পাসে আসতে না পারেন সে জন্য বোমা ফাটালেন।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রসঙ্গ তুলে এনে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন- কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বাহিনীটি কিসের জন্য? এটি কি বঙ্গবন্ধুকে চুমু খাওয়ার জন্য? তবে জাসদই যে হত্যাকাণ্ডের পথ সৃষ্টি করেছে এ অভিযোগ একপেশে। তবে জাসদের একটি ভূমিকা ছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ আরো বলেন- বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে অস্থিরতা, একাধিক এমপি সহ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা আর বিভিন্ন স্থানে লুটপাটের জন্য জাসদই দায়ী, তাছাড়া জাসদের হাতে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মরেছে তা নয়, জাসদেরও অনেক নেতা-কর্মী প্রতিপক্ষের রোষানলে প্রাণ হারিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক জনাব নঈম নিজাম লিখেছেন- ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর আঃ জলিল, আঃ রব, কর্নেল (অবসর) তাহেরসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির জন্য জাসদ ভারতীয় দুতাবাসে কমান্ডো হামলা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল হাইকমিশনারকে হাইজ্যাক করে দাবি আদায় করা।
কিন্তু হাইকমিশনের নিরাপত্তারক্ষীরা সে হামলা তছনছ করে দেন। পাল্টা প্রতিরোধে ঝরে পড়ে জাসদের কয়েক কর্মীর প্রাণ। আটক হন অনেকে।
উপরে উল্লেখিত কথাগুলো আমার নয়। এসব কথা খোদ জাসদের। একটা দল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা কোন গঠনমূলক কাজ করতে পারে নাই। তাদের কাজ ছিল সর্বদাই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু মজার বিষয় হলো এসব কু-কর্মের জন্য দু’একজন ছাড়া তাদের কোন নেতাকেই কখনো আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি! কোন না কোনভাবে তারা পার পেয়ে গেছেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন, যিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বন্দুক ধরেছিলেন, সময়ের পরিবর্তনে তারাই এখন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন!
এবার একটু খেয়াল করুন, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত জাসদের গঠনমূলক কোন কাজ নেই। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে- এই চিন্তা নিয়েই তারা তাদের কর্মসূচি পালন করে আসছে। যেহেতু গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হলে জনমতের প্রয়োজন তাই তারা এই পথে হাটতে নারাজ। শক্তি প্রয়োগ করে, বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে চায়, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশ সরকার যদি তাদের ব্যাপারে সচেতন না হন তাহলে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে মাশুল দিতে হয়েছিল সেভাবে তাঁর কন্যাকেও যে ভুলের মাশুল দিতে হবে না তা তো নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটি উক্তি উল্লেখ করেই লেখায় ইতি টানতে চাচ্ছি- বিশিষ্ট লেখক আহমদ ছফা সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এ “জাসদের রাজনীতি একটি সেন্টিমেন্টাল মূল্যায়ন” শীর্ষক নিবন্ধে দলীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতা, হঠকারিতা ও সুবিধাবাদী নীতির জন্য মূল তিনজন নেতাকে দায়ী করেন। তিনি লেখেন- বহু তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন ও রক্তের বিনিময়ে এই স্বনামখ্যাত ‘বিপ্লবী’ নেতারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। বিপ্লব ছেড়ে কেউ কেউ সরকারের দালালিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন।
আহমদ ছফা জাসদ রাজনীতির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সংযোগ ও সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করে বলেন- আজকাল অনেক বুদ্ধিজীবী কথায় কথায় জাসদের অনেক সমালোচনা করেন, অথচ একালে তারাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জাসদ কর্মীদের রাজনৈতিক তালিম দিতে এগিয়ে যেতেন। আমি যখন জাসদের সমালোচনা করি তখন মনে হয় আমার বুকে ছুরি চালাচ্ছি। এ ব্যর্থতা ও ভন্ডামির জন্য তিন নেতা আ স ম আব্দুর রব, মেজর (অব.) জলিল ও সিরাজুল ইসলাম খানকে যদি খুন করতে পারতাম তাহলে নিজের এ অনুতাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।”
জাসদের উপর কতটা রাগান্বিত হলে আহমদ ছফার মতো একজন মানুষ উপরে উল্লিখিত মন্তব্য করতে পারেন তা সহজে অনুমেয়।
আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবো যে, জাসদ তাদের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত কোন গঠনমূলক কাজ করেনি। যার সর্বশেষ প্রকাশ ঘটেছে কুষ্টিয়ায়। ১ অক্টোবরের প্রায় সকল জাতীয় দৈনিকের খবর হলো “কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িতে জাসদের হামলা”। খবরে প্রকাশ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়িতে হামলা চালায় স্থানীয় জাসদ সমর্থকরা। এ সময় এলাকার কমপক্ষে ৩৫টি বাড়ি ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়। এতে আহত হয় অন্তত ৮ জন।
হামলার শিকার ফরিদ হোসেন জানান- “রাতে জাসদ সমর্থকরা ফিল্মি স্টাইলে এলাকায় ঢুকে প্রথমে বসতবাড়ির বৈদ্যুতিক মিটার ভেঙে ফেলে। এতে বিদ্যুৎ লাইন বন্ধ হয়ে পুরো এলাকা আঁধারে ঢেকে যায়। এরপর বসতবাড়িতে ঢুকে হামলা এবং লুটপাট চালায় তারা।”
রূপজান বেগম নামে এক নারী বলেন- “ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ঘরের টিনের বাক্সে টাকা রেখেছিলেন। সেই টাকাও দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে গেছে।”
ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদার আবুল কালাম বলেন- “তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বেশ কিছুদিন ধরে জাসদের স্থানীয় নেতারা তাকে জাসদে যোগ দিতে চাপ দিচ্ছেন। দল ত্যাগে রাজি না হওয়ায় তার দোকান লুট করা হয়েছে।”
যদিও আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে উপরিউক্ত ঘটনাটি অনেক বড় কিছু মনে হবে কিন্তু আসলে জাসদের কাছে এটা তেমন কোন ঘটনাই না। যেখানে এক সময়ের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার রাস্তা পরিষ্কার করেছিল সেখানে এসব ঘটনাতো একেবারেই তুচ্ছ। এখন আসুন আমরা তাদের অতীত ইতিহাসটা একটু জেনে আসি।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে তাদের পথ চলা শুরু হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা খুনোখুনির দিকে মনোযোগ দেয়। বিশিষ্ট সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনে লিখেছেন- ১৯৭২ সালের ২৮ ডিসেম্বর খুলনায় জেলা আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা আবু সুফিয়ানসহ দু’জন চরমপন্থীর হাতে নিহত হন। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ চরমপন্থীদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন শতাধিক। একই সালের মার্চে সংসদ নির্বাচনের পর গুপ্তহত্যা ও গুপ্তঘাতকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ঐ বছরের জুন পর্যন্ত চরমপন্থীদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত মাত্র ১৭ মাসে গুপ্তহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৯২৫ টিতে। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে ৬০টি।
এরপর ১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই শেখ মুজিব সরকারকে উৎখাতের বিষয়টি জাসদ তার রাজনীতির আশু লক্ষ্য হিসেবে হাজির করে এবং সে অনুযায়ী প্রণীত হয় আন্দোলনের সকল কর্মসূচি। এরই অংশ হিসেবে একই সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এর কর্মসূচি তারা গ্রহণ করে। কর্মসূচির এক পর্যায়ে পুলিশের সাথে তাদের একটি খণ্ড যুদ্ধ হয়, শুধু তাই নয় পরিস্থিতি সামাল দিতে একপর্যায়ে রক্ষীবাহিনীকেও তলব করা হয়। সেই রক্ষীবাহিনীর গুলীতে প্রায় ২২/২৩ জন জাসদ কর্মী নিহত হন।
জাসদের এক সময়ের সক্রিয় কর্মী, কলামিস্ট ও আলোচিত রাজনৈতিক গ্রন্থ “জাসদের উত্থান-পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি”র লেখক মহিউদ্দিন আহমদ একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেছেন- একটি দল যদি মনে করে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যেতে পারবে না, তাহলে তারা সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিতে পারে, এমনটাই মনে করছিল জাসদ। (এরই অংশ হিসেবে) জাসদ একসময়ে গণবাহিনী গঠন করে। ঢাকা শহরে গণবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন। তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি বাহিনীর কমান্ডার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন। একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি চলছিল। রাষ্ট্রপতি আসবেন- গণবাহিনী ভাবলো এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। ১৪ আগস্ট গণবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা ১১টা থেকে ১টার মধ্যে তিনটি বোমা ফাটালো। এ বোমা সরবরাহ করেছিলেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গণবাহিনী সিটির কমান্ডার আনোয়ার হোসেন। যিনি বর্তমান সরকারের আমলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ওই দিন লাইব্রেরি, কলাভবনের মাঝামাঝিতে কার্জন হলের সামনে টাইমবোমা হামলা করা হলো। তখন জাসদ এক ধরনের বোমা বানাতো। এর নাম ছিল “নিখিল” বোমা (বোমা বানাতে গিয়ে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার নামেই বোমার নাম রাখা হয়)। গরিব পরিবার থেকে আসা এই মেধাবী ছাত্র বুয়েটের লেকচারার ছিলেন। ড. আনোয়ার হোসেন কেমিস্ট্রি ভালো বোঝেন। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। তার চ্যান্সেলর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) যাতে নির্বিঘ্নে ক্যাম্পাসে আসতে না পারেন সে জন্য বোমা ফাটালেন।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার প্রসঙ্গ তুলে এনে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন- কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা বাহিনীটি কিসের জন্য? এটি কি বঙ্গবন্ধুকে চুমু খাওয়ার জন্য? তবে জাসদই যে হত্যাকাণ্ডের পথ সৃষ্টি করেছে এ অভিযোগ একপেশে। তবে জাসদের একটি ভূমিকা ছিল।
মহিউদ্দিন আহমদ আরো বলেন- বঙ্গবন্ধু সরকারের সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে অস্থিরতা, একাধিক এমপি সহ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা আর বিভিন্ন স্থানে লুটপাটের জন্য জাসদই দায়ী, তাছাড়া জাসদের হাতে শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মরেছে তা নয়, জাসদেরও অনেক নেতা-কর্মী প্রতিপক্ষের রোষানলে প্রাণ হারিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক জনাব নঈম নিজাম লিখেছেন- ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর আঃ জলিল, আঃ রব, কর্নেল (অবসর) তাহেরসহ গ্রেফতারকৃত নেতাদের মুক্তির জন্য জাসদ ভারতীয় দুতাবাসে কমান্ডো হামলা চালায়। তাদের টার্গেট ছিল হাইকমিশনারকে হাইজ্যাক করে দাবি আদায় করা।
কিন্তু হাইকমিশনের নিরাপত্তারক্ষীরা সে হামলা তছনছ করে দেন। পাল্টা প্রতিরোধে ঝরে পড়ে জাসদের কয়েক কর্মীর প্রাণ। আটক হন অনেকে।
উপরে উল্লেখিত কথাগুলো আমার নয়। এসব কথা খোদ জাসদের। একটা দল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা কোন গঠনমূলক কাজ করতে পারে নাই। তাদের কাজ ছিল সর্বদাই ধ্বংসাত্মক। কিন্তু মজার বিষয় হলো এসব কু-কর্মের জন্য দু’একজন ছাড়া তাদের কোন নেতাকেই কখনো আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি! কোন না কোনভাবে তারা পার পেয়ে গেছেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন, যিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বন্দুক ধরেছিলেন, সময়ের পরিবর্তনে তারাই এখন আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন!
এবার একটু খেয়াল করুন, ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত জাসদের গঠনমূলক কোন কাজ নেই। যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে- এই চিন্তা নিয়েই তারা তাদের কর্মসূচি পালন করে আসছে। যেহেতু গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হলে জনমতের প্রয়োজন তাই তারা এই পথে হাটতে নারাজ। শক্তি প্রয়োগ করে, বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে চায়, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য অশনি সংকেত। বাংলাদেশ সরকার যদি তাদের ব্যাপারে সচেতন না হন তাহলে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে মাশুল দিতে হয়েছিল সেভাবে তাঁর কন্যাকেও যে ভুলের মাশুল দিতে হবে না তা তো নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুতরাং সময় থাকতে সাবধান হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটি উক্তি উল্লেখ করেই লেখায় ইতি টানতে চাচ্ছি- বিশিষ্ট লেখক আহমদ ছফা সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এ “জাসদের রাজনীতি একটি সেন্টিমেন্টাল মূল্যায়ন” শীর্ষক নিবন্ধে দলীয় রাজনৈতিক ব্যর্থতা, হঠকারিতা ও সুবিধাবাদী নীতির জন্য মূল তিনজন নেতাকে দায়ী করেন। তিনি লেখেন- বহু তরুণের সম্ভাবনাময় জীবন ও রক্তের বিনিময়ে এই স্বনামখ্যাত ‘বিপ্লবী’ নেতারা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে একাধিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। বিপ্লব ছেড়ে কেউ কেউ সরকারের দালালিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখছেন।
আহমদ ছফা জাসদ রাজনীতির সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সংযোগ ও সহমর্মিতার কথা উল্লেখ করে বলেন- আজকাল অনেক বুদ্ধিজীবী কথায় কথায় জাসদের অনেক সমালোচনা করেন, অথচ একালে তারাই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে জাসদ কর্মীদের রাজনৈতিক তালিম দিতে এগিয়ে যেতেন। আমি যখন জাসদের সমালোচনা করি তখন মনে হয় আমার বুকে ছুরি চালাচ্ছি। এ ব্যর্থতা ও ভন্ডামির জন্য তিন নেতা আ স ম আব্দুর রব, মেজর (অব.) জলিল ও সিরাজুল ইসলাম খানকে যদি খুন করতে পারতাম তাহলে নিজের এ অনুতাপ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতাম।”
জাসদের উপর কতটা রাগান্বিত হলে আহমদ ছফার মতো একজন মানুষ উপরে উল্লিখিত মন্তব্য করতে পারেন তা সহজে অনুমেয়।
মোঃ আবু তাহের
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন