অনেক দুঃসংবাদের মধ্যে মানুষ যদি মাঝে মধ্যে দু’একটা সুসংবাদ পায় তা হলে আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের বেলায় সম্প্রতি এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। প্রতিদিন পত্রিকার পৃষ্ঠা উল্টালে অপরাধপ্রবণতা, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক সংবাদ ছাড়া আশাব্যঞ্জক কোনো খবর আমাদের নজরে পড়ে না। ক্ষমতাসীন দল ও তার অংগ সংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লুণ্ঠন, প্রকাশ্যে মা-মেয়েকে ধর্ষণ, ছেলের সামনে মায়ের শ্লীলতাহানি, অস্ত্রবাজি, সম্পত্তি জবরদখল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপকর্ম, হত্যা গুম, বিরোধী রাজনীতিকদের জেল-জুলুম নির্যাতন, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি নেতিবাচক সংবাদগুলো বাংলাদেশের ইতিবাচক সাফল্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে হতাশার অতল গহ্বরে ঠেলে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আমরা যখন অনেক কিছুই ভুলে যেতে বসেছি ঠিক তখনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার (Champion of the Earth) চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ বা ‘বিশ্ব বিজয়ীর পুরস্কার প্রাপ্তি’ অনেকের মনেই আনন্দ উচ্ছ্বাসের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করেছে। বলাবাহুল্য, ২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি Policy leadership, science and innovation, Entrepreneural vision, Inspiration and Action প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এই পুরস্কারটি প্রবর্তন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগে ২০০৮ সালে পরিবেশ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার জন্য আতিক রহমান নামক একজন বাংলাদেশী এই পুরস্কারটি পেয়েছিলেন। অনুরূপভাবে ২০০৫ সালে অন্যদের সাথে অল চায়না ইয়ুথ ফেডারেশনের ঝাও ঝিয়াং, আরব আমীরাতের শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান, ভুটানের রাজা জিং মে শিং, ২০০৬ সালে মিসরের মোহাম্মদ আল আসরি, ২০০৭ সালে আলজিরিয়ার শরীফ রহমানী, জর্দানের প্রিন্স হাসান বিন তালাল, ২০০৮ সালে ইয়েমেনের আবদুল কাদের বা-জামাল ও বাংলাদেশের আতিক রহমানসহ আরো ছয়জন, ২০০৯ ভারতের তুলশী তাঁতী, ২০১০ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ এই পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। অতীতে এই পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন সিলভিয়া আর্লি, ম্যারিও মলিনা, সুসিলো বাংবাং, টমী রিমেঙ্গেসাউ, ফিলিপ কালডেরন, সাখিয়া এলবার্গডজ, আল গোর, মিখাইল গর্বাচেভ, মেরিনা সিলভা প্রমুখ। এই পুরস্কারে ভূষিত অনেকেই নিজ দেশে এখন নিন্দিত।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এ বছর যারা ‘চ্যাম্পিয়ন অব আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইউনিলিভারের সিইও পল পলম্যান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, ব্রাজিলের প্রসাধনী তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান Natara এবং দক্ষিণ আফ্রিকার Black Mamba Anti-Poaching unit, শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্য পশুপাখী নিধন ও ক্রয়বিক্রয় বিরোধী অভিযানের জন্য এই পুরস্কারটি পেয়েছেন।
কিছুকাল আগে খ্যাতনামা একটি আন্তর্জাতিক সর্বজন স্বীকৃত বেশকিছু মানদণ্ড বিবেচনা করে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী নিকৃষ্ট শহরসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল এবং তা মিডিয়ার বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মন আরো খারাপ হয়েছিল তখন যখন মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতে ঢাকা মহানগরীর বিশাল অঙ্গ পদ্মা মেঘনা যমুনার আকার ধারণ করেছিল এবং শুধু ঢাকা নয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামেরও হাজার হাজার বাড়িঘর দোকানপাট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। আমার এলাকায় গত পঞ্চাশ বছরে আমি কখনো বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নিমজ্জিত হতে দেখিনি কিন্তু এবার হয়েছে এবং মাসাধিককাল পানি নামেনি; জলাবদ্ধতায় হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করেছে। এই বন্যা ও জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ এ বছর যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে অতীতে তা কখনো দেখা যায়নি। সড়ক-মহাসড়ক ও পল্লী অঞ্চলের রাস্তাঘাটসমূহ এখন অবজ্ঞার শিকার। প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশসহ আমাদের জাতীয় জীবনের এমন কোনো খাত নেই যার মধ্যে সুশাসনের কোনো চিহ্ন আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সহনশীলতা, স্বাধীন চলাফেরা, উঠাবসা, নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করা বা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুভূতির প্রকাশ কোনো কিছুর পরিবেশই বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। আপনি আপনার বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সুখ-দুঃখের কথা বলবেন, শলা পরামর্শ করবেন, এই পরিবেশ এখন বিঘ্নিত, নিরাপত্তা নির্বাসনে। পরিবেশ না থাকুক দেশ বসবাসের অনুপযোগী নিকৃষ্টতম ভূখণ্ডের তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করুক তাতে কিছু আসে যায় না। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির তরফ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। টাইম ম্যাগাজিনের গত ২৮ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় জাফরি পিফার ‘Good leaders don’t have to be good’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণাকর্মের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, মানুষের কল্যাণ, বিনয় বা মিথ্যাচার নয় নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা বা নেতৃত্ব নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন নিন্দিতদের নন্দিত হতে দেখি তখন হতাশ হয়ে পড়ি। জেফরি ম্যাকিয়া ভেলির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “Following virtue often leads to .. ruin ... whereas pursuing what appears to be vice results in security and well being”. তিনি এখানে অধর্মকে ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে পুণ্য প্রায়শই ধ্বংস ডেকে আনে এবং পাপ নিরাপত্তা ও কল্যাণ এনে দেয়। পাশ্চাত্যকে যারা এখন চালাচ্ছেন তারা এই নীতিতেই বিশ্বাসী বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের পাপ-পুণ্যবোধ ও প্রত্যাশার সাথে তাদের ধ্যান ধারণার মিল হওয়া কখনো সম্ভব হতে পারে না। পুরস্কারের বিষয়টিও এই দৃষ্টিতে দেখাটা উত্তম।
॥দুই॥
সম্প্রতি একজন ইতালীয় নাগরিক ও একজন জাপানী নাগরিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সরকারের একটা অংশ এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারা বামপন্থীরা সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি শক্তিধর দেশ কর্তৃক সৃষ্ট বলে কথিত আইএস সন্ত্রাসীদের এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে বিবৃতি দিচ্ছেন। আবার আইএস এর নামে এর দায় স্বীকার করে ঘোষণা দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বিদেশী হত্যায় বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ অত্যন্ত সহজ হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কেউ কেউ আবার বলছেন যে, তদন্তাধীন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে বিএনপি-জামায়াতের উপর দোষ চাপিয়ে আসল অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। বলাবাহুল্য, গোয়েন্দাদের তরফ থেকে ইতালীর নাগরিক হত্যার ক্লু বের করার জন্য তারা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তাদের সন্দেহভাজন একজন অপরাধী ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছে। তিনি কে এবং কোন দলের লোক প্রধানমন্ত্রীর জানা থাকলে তা প্রকাশ করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। কয়েক বছর আগে সৌদী দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। তার হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি এবং হবার লক্ষণও নেই। এ প্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বা বাংলাদেশের মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে চায় তারা বা তাদের বন্ধু কোনে রাষ্ট্রে গোয়েন্দাদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের নাম বলতে পারছেন না। সত্য কোনটি বলা মুস্কিল। তবে সরকারের কিছু মন্ত্রী-উপমন্ত্রী ও নেতানেত্রীর জঙ্গি জঙ্গি খেলা এবং দু’জন বিদেশী নাগরিকের নির্মম হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের যে দুর্নাম ছড়িয়েছে তা মুছতে অনেকদিন সময় লেগে যেতে পারে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের বিনাভোটে নির্বাচিত আইন প্রণেতারা আইন মানেন না ও জানেন না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন ভঙ্গ করেন, ভাড়ায় মানুষ খুন করেন, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জনগণের নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থায় দেশে যখন মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত, সুশাসন অনুপস্থিত এবং দেশ মগের মুল্লুক তখন কে কাকে মারে তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আবার প্রধানমন্ত্রীর অর্বাচীন ঘোষণা তাকে আরো কঠিন করে তোলে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উক্তির উল্লেখ না করে পারছি না। লন্ডনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে, তিনি বা তার দল পুনরায় ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিক নেতাদের সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন। এ প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা যদি আওয়ামী লীগে প্রেমিক খোঁজেন তাহলে বিএনপি’র ফালুর কি হবে।’ কথাটা ইঙ্গিতময় এবং সুরুচির পরিচায়ক নয়। সম্ভবত একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোভা পায় না। আমরা ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনি নিয়ে বসবাস করি। আমাদের নেতাদের কাছ থেকে আরো রুচিশীল কথাবার্তা কি আশা করতে পারি না?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এ বছর যারা ‘চ্যাম্পিয়ন অব আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইউনিলিভারের সিইও পল পলম্যান, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, ব্রাজিলের প্রসাধনী তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান Natara এবং দক্ষিণ আফ্রিকার Black Mamba Anti-Poaching unit, শেষোক্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্য পশুপাখী নিধন ও ক্রয়বিক্রয় বিরোধী অভিযানের জন্য এই পুরস্কারটি পেয়েছেন।
কিছুকাল আগে খ্যাতনামা একটি আন্তর্জাতিক সর্বজন স্বীকৃত বেশকিছু মানদণ্ড বিবেচনা করে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী নিকৃষ্ট শহরসমূহের মধ্যে দ্বিতীয় নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল এবং তা মিডিয়ার বদৌলতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন মনটা অত্যন্ত খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মন আরো খারাপ হয়েছিল তখন যখন মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাতে ঢাকা মহানগরীর বিশাল অঙ্গ পদ্মা মেঘনা যমুনার আকার ধারণ করেছিল এবং শুধু ঢাকা নয় বন্দরনগরী চট্টগ্রামেরও হাজার হাজার বাড়িঘর দোকানপাট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। আমার এলাকায় গত পঞ্চাশ বছরে আমি কখনো বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর নিমজ্জিত হতে দেখিনি কিন্তু এবার হয়েছে এবং মাসাধিককাল পানি নামেনি; জলাবদ্ধতায় হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করেছে। এই বন্যা ও জলাবদ্ধতায় বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ এ বছর যে দুর্ভোগের শিকার হয়েছে অতীতে তা কখনো দেখা যায়নি। সড়ক-মহাসড়ক ও পল্লী অঞ্চলের রাস্তাঘাটসমূহ এখন অবজ্ঞার শিকার। প্রাকৃতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশসহ আমাদের জাতীয় জীবনের এমন কোনো খাত নেই যার মধ্যে সুশাসনের কোনো চিহ্ন আছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, সহনশীলতা, স্বাধীন চলাফেরা, উঠাবসা, নিরাপত্তা নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করা বা সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুভূতির প্রকাশ কোনো কিছুর পরিবেশই বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। আপনি আপনার বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সুখ-দুঃখের কথা বলবেন, শলা পরামর্শ করবেন, এই পরিবেশ এখন বিঘ্নিত, নিরাপত্তা নির্বাসনে। পরিবেশ না থাকুক দেশ বসবাসের অনুপযোগী নিকৃষ্টতম ভূখণ্ডের তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করুক তাতে কিছু আসে যায় না। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির তরফ থেকে পুরস্কার পেয়েছেন তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। টাইম ম্যাগাজিনের গত ২৮ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় জাফরি পিফার ‘Good leaders don’t have to be good’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণাকর্মের বরাত দিয়ে তিনি বলেছেন, মানুষের কল্যাণ, বিনয় বা মিথ্যাচার নয় নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখা বা নেতৃত্ব নির্বাচনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন নিন্দিতদের নন্দিত হতে দেখি তখন হতাশ হয়ে পড়ি। জেফরি ম্যাকিয়া ভেলির উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, “Following virtue often leads to .. ruin ... whereas pursuing what appears to be vice results in security and well being”. তিনি এখানে অধর্মকে ধর্মের উপরে স্থান দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে পুণ্য প্রায়শই ধ্বংস ডেকে আনে এবং পাপ নিরাপত্তা ও কল্যাণ এনে দেয়। পাশ্চাত্যকে যারা এখন চালাচ্ছেন তারা এই নীতিতেই বিশ্বাসী বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে আমাদের পাপ-পুণ্যবোধ ও প্রত্যাশার সাথে তাদের ধ্যান ধারণার মিল হওয়া কখনো সম্ভব হতে পারে না। পুরস্কারের বিষয়টিও এই দৃষ্টিতে দেখাটা উত্তম।
॥দুই॥
সম্প্রতি একজন ইতালীয় নাগরিক ও একজন জাপানী নাগরিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সরকারের একটা অংশ এবং ঝোপ বুঝে কোপ মারা বামপন্থীরা সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি শক্তিধর দেশ কর্তৃক সৃষ্ট বলে কথিত আইএস সন্ত্রাসীদের এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে বিবৃতি দিচ্ছেন। আবার আইএস এর নামে এর দায় স্বীকার করে ঘোষণা দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বিদেশী হত্যায় বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ অত্যন্ত সহজ হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়। কেউ কেউ আবার বলছেন যে, তদন্তাধীন বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে বিএনপি-জামায়াতের উপর দোষ চাপিয়ে আসল অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। বলাবাহুল্য, গোয়েন্দাদের তরফ থেকে ইতালীর নাগরিক হত্যার ক্লু বের করার জন্য তারা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবং বলেছেন যে, তাদের সন্দেহভাজন একজন অপরাধী ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছে। তিনি কে এবং কোন দলের লোক প্রধানমন্ত্রীর জানা থাকলে তা প্রকাশ করা উচিত বলে অনেকে মনে করেন। কয়েক বছর আগে সৌদী দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন। তার হত্যাকারীদের বিচার এখনো হয়নি এবং হবার লক্ষণও নেই। এ প্রেক্ষিতে অনেকে মনে করেন যারা বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বা বাংলাদেশের মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে দুনিয়ার কাছে তুলে ধরতে চায় তারা বা তাদের বন্ধু কোনে রাষ্ট্রে গোয়েন্দাদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের নাম বলতে পারছেন না। সত্য কোনটি বলা মুস্কিল। তবে সরকারের কিছু মন্ত্রী-উপমন্ত্রী ও নেতানেত্রীর জঙ্গি জঙ্গি খেলা এবং দু’জন বিদেশী নাগরিকের নির্মম হত্যাকাণ্ড বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের যে দুর্নাম ছড়িয়েছে তা মুছতে অনেকদিন সময় লেগে যেতে পারে। আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমাদের বিনাভোটে নির্বাচিত আইন প্রণেতারা আইন মানেন না ও জানেন না, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইন ভঙ্গ করেন, ভাড়ায় মানুষ খুন করেন, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। জনগণের নিরাপত্তা নেই। এই অবস্থায় দেশে যখন মানুষের মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত, সুশাসন অনুপস্থিত এবং দেশ মগের মুল্লুক তখন কে কাকে মারে তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। আবার প্রধানমন্ত্রীর অর্বাচীন ঘোষণা তাকে আরো কঠিন করে তোলে। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি উক্তির উল্লেখ না করে পারছি না। লন্ডনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে, তিনি বা তার দল পুনরায় ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিক নেতাদের সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন। এ প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা যদি আওয়ামী লীগে প্রেমিক খোঁজেন তাহলে বিএনপি’র ফালুর কি হবে।’ কথাটা ইঙ্গিতময় এবং সুরুচির পরিচায়ক নয়। সম্ভবত একজন দায়িত্বশীল প্রধানমন্ত্রীর মুখে শোভা পায় না। আমরা ছেলে মেয়ে, নাতি নাতনি নিয়ে বসবাস করি। আমাদের নেতাদের কাছ থেকে আরো রুচিশীল কথাবার্তা কি আশা করতে পারি না?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন