আইনের আড়ালে দূরপ্রসারী এবং ভয়ংকর এক রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এগোতে শুরু করেছে সরকার। এজন্যই একদিকে চলছে গণগ্রেফতারের অভিযান অন্যদিকে দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে আইন সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রিসভা। বিষয় দুটিকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরার সদিচ্ছা থাকলে অবশ্যই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হতো না। গ্রেফতারের অভিযানও বন্ধ করা হতো। অন্যদিকে জেলার পাশাপাশি উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ধাওয়ার মুখে রেখেছে সরকার। রাজধানীর কথা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারবিরোধী হিসেবে সামান্য পরিচিতি থাকলেও পুলিশ বিশেষ করে তরুণ-যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের সব কারাগারেই এখন ‘ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই’ অবস্থা চলছে। দৈনিক সংগ্রাম ১০ অক্টোবর জানিয়েছে, দেশের ৬৮টি কারাগারই তিনগুণ বেশি বন্দীতে ঠাসা অবস্থায় রয়েছে। বন্দীরা কাটাচ্ছে মানবেতর জীবন। এদের বেশিরভাগই আবার রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। তাদের মধ্যে তাই বলে ক্ষমতাসীন দলের কাউকে পাওয়া যাবে না কোনো কারাগারে। কারণ, রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রথম থেকেই তাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। আওয়ামী অপরাধীদের অনেকে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। জিতেও এসেছেন। এর ঠিক উল্টোটি ঘটছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বেলায়।
সেদিকে যাওয়ার আগে সর্বশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক। একটি প্রধান তথ্য হলো, সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ১ অক্টোবর ঢাকায় আসার পথে সাভার থেকে তাকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টিও অস্বীকার করেছে। সে কারণে স্বজনদের আশংকা, তাকে সম্ভবত গুম করা হয়েছে। সত্যিই সেটা হয়ে থাকলে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীদের তালিকায় আরো একটি নাম যুক্ত হতে চলেছে বলা যায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও গুম করার ব্যাপারে ‘অতি উদার’ একই সরকারকে কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রমাণিত অপরাধীদের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সংযমী এমনকি অনিচ্ছুক দেখা যাচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের এমপি আমানুর রহমান খান রানার কথাই ধরা যাক। আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমদকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পাচ্ছে না! অন্যদিকে এমপি রানা কিন্তু একাধিকবার হাই কোর্টে গিয়ে হাজির হয়েছেন, তিনি এমনকি সংসদ ভবনে গিয়ে হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেছেন। একই অবস্থা চলছে ফারুক আহমদ হত্যা মামলার আসামী এবং এমপি রানার অন্য তিন ভাইয়ের ক্ষেত্রেও, যাদের মধ্যে একজন আবার টাঙ্গাইল সিটি করপোরেশনের মেয়র। প্রায় প্রকাশ্যেই তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু পুলিশই কেবল ‘খুঁজে’ পাচ্ছে না তাদের!
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন গাইবান্ধা-১ আসনের আওয়ামী এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। গত ২ অক্টোবর নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তিনি সুন্দরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শাহাদত হোসেনকে পায়ে গুলী করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এমপি লিটনের নিজের এলাকায় মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। থানায় হত্যা চেষ্টার জন্য মামলা হয়েছে। লিটনের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল। কিন্তু যাকে বলে আওয়ামী পুলিশ! আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ নাকি তাকে খুঁজে পায়নি। এ অবস্থারই সুযোগ নিয়ে গত ১২ অক্টোবর হাই কোর্টে আগাম জামিন নেয়ার জন্য একেবারে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন এমপি লিটন। মাননীয় বিচারপতিরা অবশ্য জামিন না দিয়ে তাকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে গাইবান্ধার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহে পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। কারণ, যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রচার করা হয়েছে সেই এমপি নিজেই পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে আদালতে পৌঁছেছেন, সেখান থেকে আবার চলেও গেছেন। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। অথচ এই একই পুলিশ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় রাজপথ থেকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে বেআইনীভাবে গ্রেফতার করেছিল। পরবর্তীকালে তাকে ফাঁসিও দেয়া হয়েছে। এতটাই আইন মেনে চলে আওয়ামী পুলিশ! একই কারণে দুই এমপি রানা ও লিটনের পাশাপাশি কক্সবাজারের এমপি বদিসহ আরো অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। কোনো কোনো মহিলা এমপি এবং তাদের সুপুত্ররাও রাস্তাঘাটে নির্বিচারে মানুষকে গুলী করে হত্যা করছে। কিন্তু কারো ব্যাপারেই পুলিশকে তৎপর দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে সে একই পুলিশের ভূমিকা মারাত্মক হয়ে উঠছে। সব মিলিয়েই সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির যে আরো বেশি অবনতি ঘটবে সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন নেতারা বেশ জোরের সঙ্গেই জানান দিয়ে চলেছেন। এই প্রচারণায় বিদেশে বসবাসকারী দু-চারজনও যোগ দিচ্ছেন- যাদের নাম নেয়াটাও বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, অনেক নাটকীয়তার পর ১৪ অক্টোবর এমপি লিটনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি করাগারে রয়েছেন।
দেশজুড়ে চলতে থাকা গণগ্রেফতার এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের বিষয়টিকে অবশ্যই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে আসলে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে। বলাবাহুল্য, সে পরিকল্পনায় গণতন্ত্রসম্মত সদিচ্ছার কোনো উপাদান বা ইঙ্গিত নেই। সমঝোতা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা চালানোরও কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সরকার যথারীতি ফ্যাসিস্ট পন্থাতেই পা বাড়াতে শুরু করেছে। ‘অবৈধ’ হিসেবে বর্ণিত এবং একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আগত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দিক থেকে এটা অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়। কারণ, নামে ‘নির্বাচিত’ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ হলেও প্রথম থেকেই সরকার বিরোধী দলের টুঁটি টিপে ধরার কর্মকান্ডেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুলিশ এবং পরবর্তীকালে র্যাবের সীমা ছাড়ানো দৌরাত্ম্যের কারণে দেশের কোনো এলাকাতেই বিরোধী দল কখনো বাধাহীনভাবে কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারেনি। এমনকি আইন মেনে আগে থেকে লিখিত অনুমতি নেয়ার পরও বিরোধী দলের অনেক কর্মসূচিকেই সরকার ভন্ডুল করে দিয়েছে। বিএনপির লংমার্চ ধরনের কোনো কোনো কর্মসূচিকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সরকার সারা দেশে যানবাহনের চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করিয়েছে, রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এখনো সরকারের সে ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকান্ডে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলো এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না। সরকার অঘোষিতভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে বিশেষ করে সময়ের জন্য। কারণ, নিন্দিত একদলীয় জাতীয় সংসদ নিয়ে কোনো রকম মীমাংসা হওয়ার আগেই সরকারের পক্ষ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা তথা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব নির্বাচন নাকি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই আয়োজন করা হবে। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনগুলো হবে দলীয় ভিত্তিতে। প্রার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে এবং দলীয় মনোনয়ন ছাড়া কেউই প্রার্থী হতে পারবেন না। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোকেও আগে থেকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত থাকতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত সকল আইন সংশোধন করা হচ্ছে। ওদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরদিনই একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দলীয় ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সকল মহলে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তটিকে ‘মহা দুরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করেছেন, বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি ও নির্বাচনের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যেই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, দলবাজি ষোলকলায় পরিপূর্ণ করে বাকশাল কায়েমের নীলনকশা থেকেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্টজনেরাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের উদ্দেশ্য সরকারের গোপন নীলনকশা বাস্তবায়ন করা।
এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এর ফলে কোনো দলের পক্ষেই সরাসরি এমন দাবি করা সম্ভব হয়নি যে, দলটির এতজন মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তটি আইনে পরিণত হলে এবং সে অনুযায়ী সত্যি দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজিত হলে দলগত পরিচিতি দেয়াটা সহজ হয়ে উঠবে। পর্যবেক্ষকদের মতে এখানেই রয়েছে সরকারের আসল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে এখন আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ধরেই নেয়া হয় যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না। কোথাও দেয়া হলেও তাদের বিজয় ছিনতাই করা হবে নয়তো কিছুদিনের ব্যবধানে নির্বাচিতদের বরখাস্ত করবে সরকার- যেমনটি বিগত মাসগুলোতে দেখা গেছে। সরকারবিরোধী মেয়র ও চেয়ারম্যানদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বরখাস্ত করেছে সরকার। প্রতিটি এলাকায় তাদের স্থলে আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ক্ষমতাসীনরা এখন আর কোনো বাঁকা পথে হাঁটতে চাচ্ছেন না। সবকিছু তারা ‘আইনসম্মতভাবে’ করতে চাচ্ছেন বলেই এসেছে দলীয় ভিত্তিতে স্থানী সরকার নির্বাচনের নতুন সিদ্ধান্ত। অথচ এ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা ও বিতর্ক করা এবং সবশেষে সংসদের মাধ্যমে আইনে পরিণত করা দরকার। এটাই সংবিধানের নির্দেশনা। অন্যদিকে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সংসদকে পাশ কাটিয়ে আইনটি সরাসরি ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। এর ফলে শুধু সংশয়েরই সৃষ্টি হয়নি, বাকশাল নিয়েও নতুন পর্যায়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, আইনের আড়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে তার মরহুম পিতার পথেই পা বাড়াতে চাচ্ছেন। পার্থক্য হলো, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করেছিলেন। উল্লেখ্য, তারও আগে ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এবং ব্যাপকভাবে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। ওই নির্বাচনে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করা হয়েছিল। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। সুতরং অমন একটি সংসদকে দিয়ে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো কোনো কঠিন বিষয় ছিল না- যদিও এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। শেখ মুজিব এতটাই ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা ছিলেন যে, তার সামনে ‘না’ বলার মতো সৎসাহস কারো ছিল না। প্রধান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে আগেই গৃহবন্দী করা হয়েছিল। ভাসানী ন্যাপসহ অন্য কয়েকটি দলের নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের জাসদ বাকশালকে সমর্থন দিয়েছিল সুকৌশলে। বলা হয়, স্বাধীনতার পর পর দেশে যখন সবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সরকারের বিরোধিতা শুরু হয়েছিল ঠিক তখনই রাজনৈতিক দলের নামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইনু সাহেবরা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ১৯৭২ সালে জাসদ এবং তথাকথিত ‘গণবাহিনীর’ প্রতিষ্ঠাই ঘটেছিল গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটানোর জন্য। সদ্য স্বাধীন দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে জাসদ একদিকে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোর সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল, অন্যদিকে সরকারকে উস্কানি দিয়েছিল হত্যার পথে পা বাড়াতে। মূলত জাসদ ও ‘গণবাহিনীর’ সশস্ত্র তৎপরতা প্রতিহত করার তাগিদ থেকেই মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রায় ৩৭ হাজার ছাত্র-যুবকের মৃত্যু ঘটেছিল। এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবকের মৃত্যুর জন্য মুজিব সরকারের পাশাপাশি দায়ী ছিল জাসদ ও তার ‘গণবাহিনী’। এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হয়, জাসদই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের হাতে বাকশাল গঠনের অজুহাত তুলে দিয়েছিল। বর্তমান পর্যায়ে খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো, মন্ত্রী ইনুসহ সে একই জাসদ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অংশ হিসেবে কাজ করে চলেছে। সুতরাং নতুন মোড়কে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন কায়েম করা এখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা অবশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তুলনায় তার পিতা মরহুম শেখ মুজিবুরর রহমান অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন । তা সত্ত্বেও তার সর্বশেষ কীর্তি বাকশাল টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। সে টানাটানির শেষ না হতেই শুরু হয়েছে আরো একটি কা- বা কীর্তি যুক্ত করার প্রচেষ্টা। পার্থক্য হলো, মরহুম শেখ মুজিব জাতীয় সংসদের আড়াল নিয়ে ওপর থেকে বাকশাল নামের একদলীয় স্বৈরশাসন চাপিয়েছিলেন, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদ তথা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে সবকিছু নিজের দখলে আনতে। এখন দেখার বিষয়, সব দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কারাগারে অথবা ধাওয়ার মুখে রেখে আয়োজিত একতরফা এবং একদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সকল স্থানীয় সরকার দখল করাটা সম্ভব হয় কি না। দেখার বিষয়, সাময়িকভাবে সেটা সম্ভব হলেও প্রধানমন্ত্রী কতদূর যেতে পারেন এবং জাতির ঘাড়ে আবারও বাকশাল ধরনের কোনো একদলীয় স্বৈরশাসন চেপে বসে কিনা। যা কিছুই ঘটুক না কেন সরকার অন্তত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসার চিন্তা করবে না- এ কথাটা নিশ্চিতভাবেই বলে রাখা যায়।
সেদিকে যাওয়ার আগে সর্বশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ সেরে নেয়া যাক। একটি প্রধান তথ্য হলো, সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ১ অক্টোবর ঢাকায় আসার পথে সাভার থেকে তাকে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর তার সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। শুধু তা-ই নয়, সরকার এবং আইন-শৃংখলা বাহিনী জামায়াতের এই নেতাকে গ্রেফতারের বিষয়টিও অস্বীকার করেছে। সে কারণে স্বজনদের আশংকা, তাকে সম্ভবত গুম করা হয়েছে। সত্যিই সেটা হয়ে থাকলে বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম ও ইলিয়াস আলীদের তালিকায় আরো একটি নাম যুক্ত হতে চলেছে বলা যায়। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও গুম করার ব্যাপারে ‘অতি উদার’ একই সরকারকে কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের প্রমাণিত অপরাধীদের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সংযমী এমনকি অনিচ্ছুক দেখা যাচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলের এমপি আমানুর রহমান খান রানার কথাই ধরা যাক। আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমদকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কিন্তু বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এবং সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। পুলিশ নাকি তাকে খুঁজেই পাচ্ছে না! অন্যদিকে এমপি রানা কিন্তু একাধিকবার হাই কোর্টে গিয়ে হাজির হয়েছেন, তিনি এমনকি সংসদ ভবনে গিয়ে হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেছেন। একই অবস্থা চলছে ফারুক আহমদ হত্যা মামলার আসামী এবং এমপি রানার অন্য তিন ভাইয়ের ক্ষেত্রেও, যাদের মধ্যে একজন আবার টাঙ্গাইল সিটি করপোরেশনের মেয়র। প্রায় প্রকাশ্যেই তৎপরতা চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু পুলিশই কেবল ‘খুঁজে’ পাচ্ছে না তাদের!
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন গাইবান্ধা-১ আসনের আওয়ামী এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। গত ২ অক্টোবর নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তিনি সুন্দরগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শাহাদত হোসেনকে পায়ে গুলী করেছেন। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এমপি লিটনের নিজের এলাকায় মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে। থানায় হত্যা চেষ্টার জন্য মামলা হয়েছে। লিটনের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল। কিন্তু যাকে বলে আওয়ামী পুলিশ! আদালতের আদেশ থাকা সত্ত্বেও পুলিশ নাকি তাকে খুঁজে পায়নি। এ অবস্থারই সুযোগ নিয়ে গত ১২ অক্টোবর হাই কোর্টে আগাম জামিন নেয়ার জন্য একেবারে সশরীরে হাজির হয়েছিলেন এমপি লিটন। মাননীয় বিচারপতিরা অবশ্য জামিন না দিয়ে তাকে ১৮ অক্টোবরের মধ্যে গাইবান্ধার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহে পুলিশের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। কারণ, যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে প্রচার করা হয়েছে সেই এমপি নিজেই পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে আদালতে পৌঁছেছেন, সেখান থেকে আবার চলেও গেছেন। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেনি। অথচ এই একই পুলিশ উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসার সময় রাজপথ থেকে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে বেআইনীভাবে গ্রেফতার করেছিল। পরবর্তীকালে তাকে ফাঁসিও দেয়া হয়েছে। এতটাই আইন মেনে চলে আওয়ামী পুলিশ! একই কারণে দুই এমপি রানা ও লিটনের পাশাপাশি কক্সবাজারের এমপি বদিসহ আরো অনেকেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছেন। কোনো কোনো মহিলা এমপি এবং তাদের সুপুত্ররাও রাস্তাঘাটে নির্বিচারে মানুষকে গুলী করে হত্যা করছে। কিন্তু কারো ব্যাপারেই পুলিশকে তৎপর দেখা যাচ্ছে না। বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষেত্রে সে একই পুলিশের ভূমিকা মারাত্মক হয়ে উঠছে। সব মিলিয়েই সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতির যে আরো বেশি অবনতি ঘটবে সে ব্যাপারে ক্ষমতাসীন নেতারা বেশ জোরের সঙ্গেই জানান দিয়ে চলেছেন। এই প্রচারণায় বিদেশে বসবাসকারী দু-চারজনও যোগ দিচ্ছেন- যাদের নাম নেয়াটাও বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে। উল্লেখ্য, অনেক নাটকীয়তার পর ১৪ অক্টোবর এমপি লিটনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি করাগারে রয়েছেন।
দেশজুড়ে চলতে থাকা গণগ্রেফতার এবং নিষ্ঠুর দমন-নির্যাতনের বিষয়টিকে অবশ্যই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে আসলে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে। বলাবাহুল্য, সে পরিকল্পনায় গণতন্ত্রসম্মত সদিচ্ছার কোনো উপাদান বা ইঙ্গিত নেই। সমঝোতা এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য চেষ্টা চালানোরও কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ সরকার যথারীতি ফ্যাসিস্ট পন্থাতেই পা বাড়াতে শুরু করেছে। ‘অবৈধ’ হিসেবে বর্ণিত এবং একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আগত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দিক থেকে এটা অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়। কারণ, নামে ‘নির্বাচিত’ এবং ‘গণতান্ত্রিক’ হলেও প্রথম থেকেই সরকার বিরোধী দলের টুঁটি টিপে ধরার কর্মকান্ডেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুলিশ এবং পরবর্তীকালে র্যাবের সীমা ছাড়ানো দৌরাত্ম্যের কারণে দেশের কোনো এলাকাতেই বিরোধী দল কখনো বাধাহীনভাবে কোনো মিছিল-সমাবেশ করতে পারেনি। এমনকি আইন মেনে আগে থেকে লিখিত অনুমতি নেয়ার পরও বিরোধী দলের অনেক কর্মসূচিকেই সরকার ভন্ডুল করে দিয়েছে। বিএনপির লংমার্চ ধরনের কোনো কোনো কর্মসূচিকে নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সরকার সারা দেশে যানবাহনের চলাচল পর্যন্ত বন্ধ করিয়েছে, রাজধানীকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। এখনো সরকারের সে ফ্যাসিস্ট নীতি ও কর্মকান্ডে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। বিএনপি ও জামায়াতের মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলো এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে পারছে না। সরকার অঘোষিতভাবে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। আপত্তি ও প্রতিবাদ উঠেছে বিশেষ করে সময়ের জন্য। কারণ, নিন্দিত একদলীয় জাতীয় সংসদ নিয়ে কোনো রকম মীমাংসা হওয়ার আগেই সরকারের পক্ষ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা তথা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব নির্বাচন নাকি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই আয়োজন করা হবে। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনগুলো হবে দলীয় ভিত্তিতে। প্রার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে এবং দলীয় মনোনয়ন ছাড়া কেউই প্রার্থী হতে পারবেন না। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোকেও আগে থেকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত থাকতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত সকল আইন সংশোধন করা হচ্ছে। ওদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরদিনই একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দলীয় ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশের সকল মহলে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তটিকে ‘মহা দুরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করেছেন, বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি ও নির্বাচনের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যেই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, দলবাজি ষোলকলায় পরিপূর্ণ করে বাকশাল কায়েমের নীলনকশা থেকেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্টজনেরাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের উদ্দেশ্য সরকারের গোপন নীলনকশা বাস্তবায়ন করা।
এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এর ফলে কোনো দলের পক্ষেই সরাসরি এমন দাবি করা সম্ভব হয়নি যে, দলটির এতজন মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তটি আইনে পরিণত হলে এবং সে অনুযায়ী সত্যি দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজিত হলে দলগত পরিচিতি দেয়াটা সহজ হয়ে উঠবে। পর্যবেক্ষকদের মতে এখানেই রয়েছে সরকারের আসল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে এখন আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ধরেই নেয়া হয় যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না। কোথাও দেয়া হলেও তাদের বিজয় ছিনতাই করা হবে নয়তো কিছুদিনের ব্যবধানে নির্বাচিতদের বরখাস্ত করবে সরকার- যেমনটি বিগত মাসগুলোতে দেখা গেছে। সরকারবিরোধী মেয়র ও চেয়ারম্যানদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বরখাস্ত করেছে সরকার। প্রতিটি এলাকায় তাদের স্থলে আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ক্ষমতাসীনরা এখন আর কোনো বাঁকা পথে হাঁটতে চাচ্ছেন না। সবকিছু তারা ‘আইনসম্মতভাবে’ করতে চাচ্ছেন বলেই এসেছে দলীয় ভিত্তিতে স্থানী সরকার নির্বাচনের নতুন সিদ্ধান্ত। অথচ এ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা ও বিতর্ক করা এবং সবশেষে সংসদের মাধ্যমে আইনে পরিণত করা দরকার। এটাই সংবিধানের নির্দেশনা। অন্যদিকে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সংসদকে পাশ কাটিয়ে আইনটি সরাসরি ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। এর ফলে শুধু সংশয়েরই সৃষ্টি হয়নি, বাকশাল নিয়েও নতুন পর্যায়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, আইনের আড়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে তার মরহুম পিতার পথেই পা বাড়াতে চাচ্ছেন। পার্থক্য হলো, ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের মাত্র ১১ মিনিট স্থায়ী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ইচ্ছা ও নির্দেশে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল। সংশোধনী পাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। চতুর্থ সংশোধনীর ফলে প্রচলিত সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল হয়ে যায়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেশে একটি মাত্র দল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংশোধনীর ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করেছিলেন। উল্লেখ্য, তারও আগে ১৯৭৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত এবং ব্যাপকভাবে বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছিল। ওই নির্বাচনে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতেই সকল ‘কম্ম’ সম্পন্ন করা হয়েছিল। ‘ওরে জিতাইয়া দে’, ‘ওরে হারাইয়া দে’ ধরনের নির্দেশ ও ধমকের জোরে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৭টি আসনেই জিতেছিল আওয়ামী লীগ। সুতরং অমন একটি সংসদকে দিয়ে জাতির ঘাড়ে বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চাপানো কোনো কঠিন বিষয় ছিল না- যদিও এ ধরনের মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোতে জনমত যাচাই এবং গণভোট অনুষ্ঠান করা গণতন্ত্রে একটি অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। কিন্তু একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের সময় জনগণের ম্যান্ডেট চাওয়া হয়নি। চতুর্থ সংশোধনী পাস করার পরও গণভোটের আয়োজন করা হয়নি। শেখ মুজিব এতটাই ক্ষমতাধর ও কর্তৃত্বপরায়ণ নেতা ছিলেন যে, তার সামনে ‘না’ বলার মতো সৎসাহস কারো ছিল না। প্রধান জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকে আগেই গৃহবন্দী করা হয়েছিল। ভাসানী ন্যাপসহ অন্য কয়েকটি দলের নেতারা ‘আন্ডারগ্রাউন্ডে’ যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, কয়েকজন পালিয়ে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুদের জাসদ বাকশালকে সমর্থন দিয়েছিল সুকৌশলে। বলা হয়, স্বাধীনতার পর পর দেশে যখন সবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও সরকারের বিরোধিতা শুরু হয়েছিল ঠিক তখনই রাজনৈতিক দলের নামে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ইনু সাহেবরা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, ১৯৭২ সালে জাসদ এবং তথাকথিত ‘গণবাহিনীর’ প্রতিষ্ঠাই ঘটেছিল গণতন্ত্রের বিনাশ ঘটানোর জন্য। সদ্য স্বাধীন দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে জাসদ একদিকে গণতান্ত্রিক বিরোধী দলগুলোর সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতিকে বাধাগ্রস্ত করেছিল, অন্যদিকে সরকারকে উস্কানি দিয়েছিল হত্যার পথে পা বাড়াতে। মূলত জাসদ ও ‘গণবাহিনীর’ সশস্ত্র তৎপরতা প্রতিহত করার তাগিদ থেকেই মুজিব সরকার রক্ষীবাহিনীকে মাঠে নামিয়েছিল। রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রায় ৩৭ হাজার ছাত্র-যুবকের মৃত্যু ঘটেছিল। এই বিপুল সংখ্যক ছাত্র-যুবকের মৃত্যুর জন্য মুজিব সরকারের পাশাপাশি দায়ী ছিল জাসদ ও তার ‘গণবাহিনী’। এ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা হয়, জাসদই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের হাতে বাকশাল গঠনের অজুহাত তুলে দিয়েছিল। বর্তমান পর্যায়ে খুবই লক্ষণীয় বিষয় হলো, মন্ত্রী ইনুসহ সে একই জাসদ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অংশ হিসেবে কাজ করে চলেছে। সুতরাং নতুন মোড়কে বাকশাল তথা একদলীয় শাসন কায়েম করা এখন সময়ের ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে কিছু কথা অবশ্য স্মরণ করিয়ে দেয়া দরকার। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তুলনায় তার পিতা মরহুম শেখ মুজিবুরর রহমান অনেক বেশি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাধর নেতা ছিলেন । তা সত্ত্বেও তার সর্বশেষ কীর্তি বাকশাল টেকেনি। না টেকার কারণ, জনগণ বাকশালকে গ্রহণই করেনি, প্রত্যাখ্যান করেছিল। দীর্ঘদিন ধরে এরই দায়ভার টানতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। সে টানাটানির শেষ না হতেই শুরু হয়েছে আরো একটি কা- বা কীর্তি যুক্ত করার প্রচেষ্টা। পার্থক্য হলো, মরহুম শেখ মুজিব জাতীয় সংসদের আড়াল নিয়ে ওপর থেকে বাকশাল নামের একদলীয় স্বৈরশাসন চাপিয়েছিলেন, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন ইউনিয়ন পরিষদ তথা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে সবকিছু নিজের দখলে আনতে। এখন দেখার বিষয়, সব দলকে বাইরে ঠেলে দিয়ে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের কারাগারে অথবা ধাওয়ার মুখে রেখে আয়োজিত একতরফা এবং একদলীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সত্যিই প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সকল স্থানীয় সরকার দখল করাটা সম্ভব হয় কি না। দেখার বিষয়, সাময়িকভাবে সেটা সম্ভব হলেও প্রধানমন্ত্রী কতদূর যেতে পারেন এবং জাতির ঘাড়ে আবারও বাকশাল ধরনের কোনো একদলীয় স্বৈরশাসন চেপে বসে কিনা। যা কিছুই ঘটুক না কেন সরকার অন্তত গণতন্ত্রসম্মত পথে ফিরে আসার চিন্তা করবে না- এ কথাটা নিশ্চিতভাবেই বলে রাখা যায়।
আহমদ আশিকুল হামিদ
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন