গত ২৪/২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে যে সংকট সৃষ্টি হয় সেই সংকট ঘনীভূত হয় ২৮ সেপ্টেম্বর ইটালীয় নাগরিক তাভেলা সিজারের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। সেই সংকট আরও চরম আকার ধারণ করে জাপানি নাগরিক হোশি কোনিওর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। সেই যে সংকট শুরু হয়েছে এই মুহূর্ত পর্যন্ত সেটি সমাধানের কোনো আলামত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং যতই দিন যাচ্ছে ততই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এই ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটলে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সতর্ক সিগন্যাল ডাউন করা হয়। কিন্তু এখন অর্থাৎ গতকাল ১০ অক্টোবর শনিবার দেখছি, সিগন্যাল আরও আপ হচ্ছে এবং রেড সিগন্যাল দেয়া হচ্ছে। শনিবারের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকায় রিপোর্ট করা হয়েছে যে, দেশে আরও জোরে শোরে বিদেশীদের ওপর হামলা হতে পারে। বাংলাদেশে অবস্থানরত পশ্চিমা নাগরিকদের ওপর আরও হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটি মনে করে, আসন্ন হামলা ‘নির্বিচারে’ হতে পারে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ভ্রমণে বৃটিশ নাগরিকদের আরও সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে গতকাল নতুন করে বার্তা দিয়েছে বৃটেন। ইউকে গভর্নমেন্টের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে সর্বশেষ জারি করা (৯ই অক্টোবর) ওই বার্তায় বলা হয়েছে, এখানে সন্ত্রাসবাদী হামলার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। সম্প্রতি দুজন বিদেশীকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড লেভান্ট (আইএসআইএল) ওই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। প্রতি বছর ৭৫ হাজার বৃটিশ নাগরিক বাংলাদেশ সফর করেন জানিয়ে ওই বার্তায় বাংলাদেশ ভ্রমণকারী বৃটিশ নাগরিকদের সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়, পশ্চিমা নাগরিকরা সমবেত হন, এমন হোটেল বা কনফারেন্স সেন্টারগুলোতে যাতায়াতে আরও সতর্ক হতে হবে। উল্লেখ্য, ঢাকায় একজন ইতালিয়ান এবং রংপুরে এক জাপানি নাগরিককে গুলী করে হত্যার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়াসহ পূর্ব ও পশ্চিমের বহু দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে তাদের নাগরিকদের গতিবিধি সীমিত রাখার পরামর্শ দিয়ে চলেছে। বৃটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার পূর্ব নির্ধারিত বাংলাদেশ সফর স্থগিত করেছেন। জাতিসংঘও তাদের বাংলাদেশস্থ কর্মকর্তাদের রংপুর সফরে যেতে বারণ করেছে। ঢাকার কূটনৈতিক জোনসহ বিভিন্ন এলাকায় দূতাবাসের পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় উদ্বিগ্ন দেশগুলোর তরফে তাদের নাগরিকদের জন্য ট্রাভেল এলার্ট নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে। বিদেশী নাগরিকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের তরফে দফায় দফায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক ও আলোচনা চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে থাকা প্রায় ২ লাখ ২৪ হাজার বিদেশী নাগরিকের নিরাপত্তায় সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ ব্রিফিংয়ে কূটনীতিকদের এ নিয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে তাদের উদ্বেগ-আতঙ্ক পুরোপুরি নিরসন হচ্ছে না। গত ৬ই অক্টোবরের জনাকীর্ণ ওই কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ের তিন দিনের মাথায় বৃটেন নতুন করে তাদের নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কবার্তা জারি করলো।
এদিকে আগামীকাল ১২ অক্টোবর কানাডিয়ান হাইকমিশন আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। তাদের অতিথিদের এরই মধ্যে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে এসব দেশের উদ্বেগ কাটেনি। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর জঙ্গি হামলা হতে পারে এমন তথ্য পেয়েছিল যুক্তরাজ্য। পরে সন্ত্রাস দমনে পারস্পরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে সেই তথ্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আদান-প্রদান করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়া সাবধান হয়ে সতর্কবার্তা জারি করে। এ তথ্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে আসেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা। তারা ঢাকায় থাকতেই গুলশানে কূটনৈতিক জোনে খুন হন ইতালিয়ান তাভেলা সিজার। বাতিল হয় অস্ট্রেলিয়ার সফর। এ ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় রংপুরে খুন হন জাপানি গবেষক হোশি কোনিও। সেই সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করছিল। আগের সেই সতর্ক বার্তাই গতকাল হালনাগাদ করে উচ্চ ঝুঁকির কথা বলেছে যুক্তরাজ্য। বিবিসি বাংলা এই হালনাগাদ বার্তাকেই নির্বিচারে হত্যার আশঙ্কা বলে অভিহিত করেছে।
॥ দুই ॥
এসব হাই এ্যালার্টের ফলে বিদেশীরা একদিকে যেমন চরম আতঙ্কে ভুগছেন অন্যদিকে তেমনি তারা নিজেদের শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছেন। নামকরা বিদেশী বার্তা সংস্থা এপির খবর মোতাবেক ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো ফাঁকা। অতিথিদের আলাপচারিতায় মুখর চিরাচরিত হোটেলের লবিগুলো নীরব হয়ে গেছে। উঁচু দেয়াল বেষ্টিত দূতাবাস প্রাঙ্গণগুলোতে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে আরও কঠোরভাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন বিদেশী পর্যটক আর অভিবাসীরা। দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিতে উগ্রপন্থিরা শক্ত অবস্থান অর্জন করছে কিনা আর বিদেশীরা নিরাপদ কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। ‘এক্সপ্যাটস স্পুক্ড আফটার টু ফরেইনার্স গানড ডাউন ইন বাংলাদেশ’- শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানিজ নাগরিক- উভয় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। তারা বরং দোষারোপ করছে বিরোধীদের। তাদের অভিযোগ, দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রে সমর্থন রয়েছে বিরোধীদের। এমন অভিযোগ বিরোধীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরাপত্তায় আস্থা কমে গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বার্তা সংস্থার রিপোর্টে আরও বলা হয়, দেশটির অর্থনীতি অনেকাংশে বিদেশী সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে হোটেল আর বিদেশী সম্প্রদায়ের জন্য খাদ্য সরবরাহকারী দোকানগুলো লোকসান দিতে শুরু করেছে। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে। আমাদের কিছু বুকিং বাতিল করতে হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনসহ কয়েকটি দেশ তাদের দূতাবাস কর্মীদের জনবহুল এলাকা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া চলাফেরার ক্ষেত্রে তাদের গাড়ি ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সরকারের দাবি, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করতে সরকার কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। আরও জোরালো নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকার ছয়টি জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে। আর পুলিশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্দেহভাজন কয়েক ডজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।
বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক না কেন নিজ নিজ দেশের সদর দফতরের নির্দেশনায় নিজেদের এক প্রকার গুটিয়ে নিয়েছেন বিদেশীরা। একের পর এক অনুষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি সফর বাতিলের পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা বিদেশীদের মধ্যে যাদের জরুরি প্রয়োজন নেই তাদের ইতিমধ্যেই দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাপান ও স্পেনসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের। জাতিসংঘ, ইউএস এইড, ইইউ, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার হয়ে বিভিন্ন জেলায় কাজ করা কর্মকর্তাদের আপাতত প্রকল্প পরিদর্শন থেকেও বিরত রাখা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীদের রাজধানীতে নিয়ে এসে কূটনৈতিক জোনের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা হয়েছে। প্রকাশ্যে সতর্কবার্তা দেয়া হোক বা না হোক প্রায় সব দেশেরই দূতাবাস কর্মকর্তা ও তাদের পরিজনদের সর্বদা সতর্ক রাখা হয়েছে। এতদিন ইচ্ছামতো হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে চলাফেরা করা বিদেশীরা এখন দলবদ্ধ হয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন এবং বাড়ি ফিরছেন। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে বসবাস করা বিদেশি নাগরিকরা ভীতসন্ত্রস্ত না হলেও সতর্ক থাকছেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা নেয়ার পরও বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভ্রমণ সতর্কতা প্রচার অব্যাহত রাখায় সৃষ্ট শঙ্কা থেকেই এ গুটিয়ে রাখা।
॥ তিন ॥
এসব মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যে বা যারা দায়ী, আজ ১৫ দিন হয়ে গেল, তাদেরকে শনাক্ত করা, চিহ্নিত করা বা গ্রেফতার করতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার দায়ভার সরকার চাপাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর ওপর। যখন এসব হত্যাকা- ঘটে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের খবর শুনেই কোন রূপ অনুসন্ধান বা তদন্ত ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুদূর নিউ ইয়র্কে বসে রায় দিলেন যে, এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বিএনপি জামায়াত। ঢাকায় এসে তিনি এক সংবাদ সম্মেলন করেন এবং সেখানেও তিনি ঘোষণা করেন যে, বিএনপি জামায়াত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে। কারণ, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আরেক ডিগ্রী ওপরে উঠে বলেন, তার কাছে তথ্য আছে যে, লন্ডনে বসে বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছেন। লন্ডনে বসবাসরত বিএনপি সূত্র থেকে তিনি এ খবর পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার পুত্রের এসব কথার পর আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা সেই তালে সারিন্দা বাজাতে শুরু করেছেন। তারা এখন আর রাখ ঢাক না করে বলছেন যে, বিএনপি ও জামায়াত সন্ত্রাসী দল। তাদের সাথে কোনো ঐক্য হতে পারে না।
এসব কথার পর যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই দ্রুত গতিতে ঘটছে। সরকার খুনিদের গ্রেফতার না করে শুরু করেছে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার অভিযান। বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীসহ ৪ দিনে প্রায় ৩ হাজার ৪৬৭ জনকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে বলে বিএনপি ও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮টি কারাগারে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বিশেষত যেসব কারাগারে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বন্দী আছেন, সেসব কারাগারে নিরাপত্তা দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি এসব বন্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া অন্য কাউকে দেখা করার সুযোগও দেয়া হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকারের তরফ থেকে এরকম বক্তব্যের পর সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। জাপানি নাগরিক হত্যা মামলায় রংপুর মহানগর বিএনপি নেতা রাশেদুন নবী খান বিপ্লবকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবীব-উন নবী খান সোহেলের ভাই। যশোরে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে নতুন করে মামলা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দুটি খুনের সঙ্গে কারা জড়িত এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু এখনও বলা হয়নি।
এখন এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই সরকার এসব গুরুতর সংকটের কোনো সমাধান চায় না। তারা এ সংকট দীর্ঘায়িত করতে চায় এবং এই সংকটকে পুুঁজি করে তাদের ক্ষমতার আয়ু বাড়াতে চায়। এজন্য তারা পথের সমস্ত কাঁটা উপড়ে ফেলতে চায়। তাই দুই বিদেশী হত্যাকা-কে উপলক্ষ্য করে সরকার সারা দেশে শুরু করেছে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক ধর-পাকড়। সারা দেশের রাজনৈতিক ফ্রন্টে বিরোধী দলসমূহ যখন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রীয় তখন মাত্র ৭ দিনে সাড়ে ৩ হাজার রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার অবশ্যই সুদূর প্রসারী তাৎপর্য বহন করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, সরকার দেশে সুনিশ্চিতভাবে এক দলীয় সরকারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশে সবচেয়ে বড় যেটি প্রশ্ন সেটি হলো, দেশে সরকার বিরোধী রাজনীতি চলতে দেয়া হবে কিনা।
এদিকে আগামীকাল ১২ অক্টোবর কানাডিয়ান হাইকমিশন আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস উদযাপনে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। তাদের অতিথিদের এরই মধ্যে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠান স্থগিত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে এসব দেশের উদ্বেগ কাটেনি। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রের খবর, সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর জঙ্গি হামলা হতে পারে এমন তথ্য পেয়েছিল যুক্তরাজ্য। পরে সন্ত্রাস দমনে পারস্পরিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে সেই তথ্য অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আদান-প্রদান করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়া সাবধান হয়ে সতর্কবার্তা জারি করে। এ তথ্যের ভিত্তিতেই বাংলাদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে আসেন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার কর্মকর্তারা। তারা ঢাকায় থাকতেই গুলশানে কূটনৈতিক জোনে খুন হন ইতালিয়ান তাভেলা সিজার। বাতিল হয় অস্ট্রেলিয়ার সফর। এ ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় রংপুরে খুন হন জাপানি গবেষক হোশি কোনিও। সেই সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরুৎসাহিত করছিল। আগের সেই সতর্ক বার্তাই গতকাল হালনাগাদ করে উচ্চ ঝুঁকির কথা বলেছে যুক্তরাজ্য। বিবিসি বাংলা এই হালনাগাদ বার্তাকেই নির্বিচারে হত্যার আশঙ্কা বলে অভিহিত করেছে।
॥ দুই ॥
এসব হাই এ্যালার্টের ফলে বিদেশীরা একদিকে যেমন চরম আতঙ্কে ভুগছেন অন্যদিকে তেমনি তারা নিজেদের শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছেন। নামকরা বিদেশী বার্তা সংস্থা এপির খবর মোতাবেক ঢাকার রেস্তোরাঁগুলো ফাঁকা। অতিথিদের আলাপচারিতায় মুখর চিরাচরিত হোটেলের লবিগুলো নীরব হয়ে গেছে। উঁচু দেয়াল বেষ্টিত দূতাবাস প্রাঙ্গণগুলোতে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে আরও কঠোরভাবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে দুই বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনায় আতঙ্কে রয়েছেন বিদেশী পর্যটক আর অভিবাসীরা। দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মনিরপেক্ষ দেশটিতে উগ্রপন্থিরা শক্ত অবস্থান অর্জন করছে কিনা আর বিদেশীরা নিরাপদ কিনা তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বার্তা সংস্থা এপি’র এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। ‘এক্সপ্যাটস স্পুক্ড আফটার টু ফরেইনার্স গানড ডাউন ইন বাংলাদেশ’- শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একজন ইতালিয়ান ও একজন জাপানিজ নাগরিক- উভয় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছে। তারা বরং দোষারোপ করছে বিরোধীদের। তাদের অভিযোগ, দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রে সমর্থন রয়েছে বিরোধীদের। এমন অভিযোগ বিরোধীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। নিরাপত্তায় আস্থা কমে গেলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। বার্তা সংস্থার রিপোর্টে আরও বলা হয়, দেশটির অর্থনীতি অনেকাংশে বিদেশী সহায়তা এবং বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যে হোটেল আর বিদেশী সম্প্রদায়ের জন্য খাদ্য সরবরাহকারী দোকানগুলো লোকসান দিতে শুরু করেছে। ঢাকার একটি পাঁচ তারকা হোটেলের ব্যবস্থাপক বলেন, ‘এসব হত্যাকাণ্ড আমাদের ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে। আমাদের কিছু বুকিং বাতিল করতে হয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও স্পেনসহ কয়েকটি দেশ তাদের দূতাবাস কর্মীদের জনবহুল এলাকা থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া চলাফেরার ক্ষেত্রে তাদের গাড়ি ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সরকারের দাবি, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করতে সরকার কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন। আরও জোরালো নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখ হাসিনার সরকার ছয়টি জঙ্গি গোষ্ঠীকে নিষিদ্ধ করেছে। আর পুলিশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্দেহভাজন কয়েক ডজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে।
বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক না কেন নিজ নিজ দেশের সদর দফতরের নির্দেশনায় নিজেদের এক প্রকার গুটিয়ে নিয়েছেন বিদেশীরা। একের পর এক অনুষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি সফর বাতিলের পাশাপাশি বাংলাদেশে থাকা বিদেশীদের মধ্যে যাদের জরুরি প্রয়োজন নেই তাদের ইতিমধ্যেই দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জাপান ও স্পেনসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে পর্যটক ও শিক্ষার্থীদের। জাতিসংঘ, ইউএস এইড, ইইউ, জাইকাসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার হয়ে বিভিন্ন জেলায় কাজ করা কর্মকর্তাদের আপাতত প্রকল্প পরিদর্শন থেকেও বিরত রাখা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবীদের রাজধানীতে নিয়ে এসে কূটনৈতিক জোনের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখা হয়েছে। প্রকাশ্যে সতর্কবার্তা দেয়া হোক বা না হোক প্রায় সব দেশেরই দূতাবাস কর্মকর্তা ও তাদের পরিজনদের সর্বদা সতর্ক রাখা হয়েছে। এতদিন ইচ্ছামতো হেঁটে বা সাইকেল চালিয়ে চলাফেরা করা বিদেশীরা এখন দলবদ্ধ হয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন এবং বাড়ি ফিরছেন। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে বসবাস করা বিদেশি নাগরিকরা ভীতসন্ত্রস্ত না হলেও সতর্ক থাকছেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা নেয়ার পরও বিভিন্ন রাষ্ট্রের ভ্রমণ সতর্কতা প্রচার অব্যাহত রাখায় সৃষ্ট শঙ্কা থেকেই এ গুটিয়ে রাখা।
॥ তিন ॥
এসব মর্মান্তিক ঘটনার জন্য যে বা যারা দায়ী, আজ ১৫ দিন হয়ে গেল, তাদেরকে শনাক্ত করা, চিহ্নিত করা বা গ্রেফতার করতে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার দায়ভার সরকার চাপাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর ওপর। যখন এসব হত্যাকা- ঘটে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের খবর শুনেই কোন রূপ অনুসন্ধান বা তদন্ত ছাড়াই তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুদূর নিউ ইয়র্কে বসে রায় দিলেন যে, এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বিএনপি জামায়াত। ঢাকায় এসে তিনি এক সংবাদ সম্মেলন করেন এবং সেখানেও তিনি ঘোষণা করেন যে, বিএনপি জামায়াত এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে। কারণ, তারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আরেক ডিগ্রী ওপরে উঠে বলেন, তার কাছে তথ্য আছে যে, লন্ডনে বসে বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করছেন। লন্ডনে বসবাসরত বিএনপি সূত্র থেকে তিনি এ খবর পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং তার পুত্রের এসব কথার পর আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা সেই তালে সারিন্দা বাজাতে শুরু করেছেন। তারা এখন আর রাখ ঢাক না করে বলছেন যে, বিএনপি ও জামায়াত সন্ত্রাসী দল। তাদের সাথে কোনো ঐক্য হতে পারে না।
এসব কথার পর যা আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই দ্রুত গতিতে ঘটছে। সরকার খুনিদের গ্রেফতার না করে শুরু করেছে রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার অভিযান। বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীসহ ৪ দিনে প্রায় ৩ হাজার ৪৬৭ জনকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে বলে বিএনপি ও বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর মোতাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ দেশের ৬৮টি কারাগারে হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বিশেষত যেসব কারাগারে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা বন্দী আছেন, সেসব কারাগারে নিরাপত্তা দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এমনকি এসব বন্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ স্বজন ছাড়া অন্য কাউকে দেখা করার সুযোগও দেয়া হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারাগার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরকারের তরফ থেকে এরকম বক্তব্যের পর সারা দেশে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে নতুন অভিযান শুরু হয়েছে। জাপানি নাগরিক হত্যা মামলায় রংপুর মহানগর বিএনপি নেতা রাশেদুন নবী খান বিপ্লবকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবীব-উন নবী খান সোহেলের ভাই। যশোরে নাশকতা পরিকল্পনার অভিযোগে নতুন করে মামলা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দুটি খুনের সঙ্গে কারা জড়িত এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু এখনও বলা হয়নি।
এখন এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এই সরকার এসব গুরুতর সংকটের কোনো সমাধান চায় না। তারা এ সংকট দীর্ঘায়িত করতে চায় এবং এই সংকটকে পুুঁজি করে তাদের ক্ষমতার আয়ু বাড়াতে চায়। এজন্য তারা পথের সমস্ত কাঁটা উপড়ে ফেলতে চায়। তাই দুই বিদেশী হত্যাকা-কে উপলক্ষ্য করে সরকার সারা দেশে শুরু করেছে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক ধর-পাকড়। সারা দেশের রাজনৈতিক ফ্রন্টে বিরোধী দলসমূহ যখন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রীয় তখন মাত্র ৭ দিনে সাড়ে ৩ হাজার রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার অবশ্যই সুদূর প্রসারী তাৎপর্য বহন করে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, সরকার দেশে সুনিশ্চিতভাবে এক দলীয় সরকারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন দেশে সবচেয়ে বড় যেটি প্রশ্ন সেটি হলো, দেশে সরকার বিরোধী রাজনীতি চলতে দেয়া হবে কিনা।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন