গত ৮ অক্টোবর আমার নিজ জেলা ফেনী সফরে গিয়েছিলাম। সেখানকার একটি খবর আমার কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক বলে মনে হয়েছে। ফেনী জেলা শহরের একটি নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী উপলক্ষে ঐ দিন তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী অনুষ্ঠানের আগের দিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আশপাশের গলিতে রাতের বেলায় ১১টি গাড়ি ভর্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য গোটা এলাকা ঘিরে ফেলে এবং তল্লাশি চালায়। এতে সারা এলাকায় ত্রাস ছড়িয়ে পড়ে। যৌথ বাহিনী কয়েক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করে। পর দিন প্রশাসনের তরফ থেকে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বন্ধ ও সংক্ষিপ্ত করার জন্য ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করা হয় বলে জানা যায়। কিন্তু তাদের পক্ষে হাজার হাজার ছাত্র/অভিভাবকের অনুষ্ঠানমুখী জন¯্রােত বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। খবরটি শুনে আমি হতভম্ব না হয়ে পারিনি। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকবে, অতীতে ছিল এখনো আছে। তাই বলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতিভা বিকাশের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবো কেন? শত ফুল ফুটতে দেব না কেন? আমি সরকার এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ধরনের আত্মঘাতী তৎপরতা বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করবো।
পাঠকদের অনেকেরই মনে থাকার কথা যে চলতি বছর মার্চ মাসে খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে জড়িত ৩৫ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাদের কোনও অপরাধ ছিল না। তারা মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সেখানে ১৭ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আয়োজিত একটি আঞ্চলিক ক্যাম্পে অংশ গ্রহণ করছিল। তারা সকলেই ছিল খুলনা বিভাগের বিভিন্ন স্কুল ও মাদরাসার প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এই অনুষ্ঠানে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব মনিরুজ্জামান প্রধান অতিথি এবং কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শ্রী নিবাস চন্দ্র মাঝির সালাম গ্রহণ করার কথা ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি এই ক্যাম্প পরিচালনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়েছিল এবং তারা পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝিকে কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে সালাম গ্রহণ করার অনুরোধ করে, সশরীরে দাওয়াতও করেছিল এবং তিনি যথাসময়ে অর্থাৎ ১৭ মার্চ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠানে হাজির হবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। দাওয়াতপত্রে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখা গেছে যে পুলিশ কমিশনার নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে নিজে না এসে অনুষ্ঠানে তার বাহিনীকে পাঠিয়ে দেন। তারা অনুষ্ঠানস্থল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং ক্যাম্প থেকে শিশু-কিশোরসহ ১১০ জনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান। অভিযোগ অনুযায়ী দৌলতপুর থানার ওসি ক্যাম্প থেকে নগদ ৫৬ হাজার টাকা, ৩টি ল্যাপটপ, একটি ডেস্কটপ, একটি ট্যাব, একটি ক্যামেরা ও ৩৪টি মোবাইলও নিয়ে যান। গ্রেফতারকৃত ১১০ জন শিশু-কিশোরের মধ্যে ৩৫জন ছাড়া বাকীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন যে শিশু-সংগঠনের নামে আঞ্চলিক ক্যাম্প সংগঠনের অছিলায় তারা সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা সৃষ্টির সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। এখন কথা হচ্ছে, এই শিশু-কিশোররা রাজনীতি, ষড়যন্ত্র আর নাশকতার কি বুঝে? এদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের সহপাঠী প্রায় ২০/৩০ জন শিশু-কিশোর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল এবং অভ্যাগত অতিথিদের অনেকে তাদের মাথায় পানি ঢেলে নিজ নিজ বাড়িতে তাদের পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে এদের গ্রেফতার করে পুলিশ কি পেলো? পুলিশ কমিশনারকে কুচকাওয়াজের প্রধান অতিথি করে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে কেউ সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা করে? পুলিশ কমিশনার যা করলেন তা কি শিক্ষিত মার্জিত দায়িত্বশীল কোনও সরকারি কর্মকর্তার কাজ? শিশু-কিশোরদের কাজে তিনি রোল মডেল হবার কথা ছিল কিন্তু হলেন প্রতারক ও মিথ্যাবাদী। তিনি দাওয়াত নিলেন, তার নাম দাওয়াত পত্রে ছাপা হলো, নিশ্চয়ই তার সম্মতিতেই। কিন্তু যে আচরণ করলেন তা সভ্য মানুষের আচরণ নয়।
খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও পাকিস্তান আমলের একজন মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের নানা ফেনী কোর্টের একজন মোক্তার ছিলেন। কথিত আছে কোর্টে আসা যাওয়াকালে তিনি স্কুলের ছেলেদের সালাম করতেন। তাদের সালাম দেয়ার সুযোগ দিতেন না। তার বন্ধু-বান্ধবরা এতে আপত্তি করলে তিনি বলতেন, এই ছাত্র শিশু- কিশোররা লেখাপড়া শিখে একদিন হাকিম হয়ে এই আদালতে আসবে। আর মোক্তার হিসেবে আমি আসামীর জামিন দেয়ার জন্য তাদের মুখাপেক্ষী হবো। তাই আগেভাগে তাদের সাথে খাতির করে নিচ্ছি। কথাটার মধ্যে যেমন কৌতুক রস ছিল তেমনি তাৎপর্যও ছিল। ছেলেদের এর মাধ্যমে তিনি আদব কায়দা যেমন শেখাতেন তেমনি ছেলেরাও তাকে সম্মানের চোখে দেখতে শিখতো। আমাদের সরকারি প্রশাসনের সাথে যারা জড়িত তারা এই সত্যটুকু কি উপলব্ধি করতে পারেন না?
[২]
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে সন্ত্রাস, কারচুপি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট (মতান্তরে মহাচোর) সরকারের প্রভাবশালী অনেক নেতানেত্রী ও মন্ত্রী-উপমন্ত্রী এখন নতুন একটি শ্লোগান দিতে শুরু করেছেন। শ্লোগানটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্র নয় উন্নয়নই জাতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।’ ম্লোগানটি আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা গ্রামেগঞ্জে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে বলে জানা গেছে। তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা অন্নবস্ত্রের-যোগাযোগের, গণতন্ত্রের নয়। কিন্তু কথাগুলো শুনতে ভাল লাগলেও তাদের এই প্রচারণা মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলছে বলে অভিজ্ঞমহল জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত সাত বছরের শাসনামলে তারা দেখেছেন যে আওয়ামী গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকেই শুধু পদদলিত করেনি বরং জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি খাতকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ছেড়েছে। তারা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দু’টোই ধ্বংস করেছেন। গণপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সর্বত্র এখন অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ দলীয় নেতা ও দলদাসদের অবাধ বিচরণ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে চলছে সীমাহীন লুটপাট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনসমূহ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি ও ব্যভিচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। একজন কবি ও আর্টিস্টের ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এক দরজা দিয়ে শিক্ষা লাভের জন্য মানুষের বাচ্চা ঢুকছে অন্য দরজা দিয়ে তারা পশুর বাচ্চা হয়ে বেরিয়ে আসছে। এগুলোর নাম কি উন্নয়ন? আওয়ামী লীগ কি এই উন্নয়নকেই গণতন্ত্রের ওপর প্রাধান্য দেয়ার জন্য মানুষকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে আমি নোয়াখালী গিয়েছিলাম, শহরে ড্রেনেজের কোনও ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। মাইজদী শহরের প্রধান সড়কের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই জলাবদ্ধতা। রাস্তাঘাট নেই, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এতিমখানা দেখার শখ ছিল: কিন্তু পারিনি। ভেতরে গাড়ি নেয়া যায় না আবার পায়ে হেঁটে কাদা মাড়িয়ে যেতেও পারিনি। মাইজদী বাজারে ঢুকেছিলাম, বেশি দূর যাওয়া যায়নি। সারা বাজারে কাদা। বলাবাহুল্য, মাইজদী বাজারের কয়েকশ’ গজ দূরেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আবার পৌর সভার দফতরও বেশি দূরে নয়। সরকারের প্রশাসন ও উন্নয়ন এজেন্সি ছাড়াও এমপি সাবরা আছেন। তাদের কাজ কি আমি বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে লাকসাম হয়ে ঢাকা এসেছি। রাস্তার দু’ধারে বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ি, লাঙ্গলকোট, নাথেরপেটুয়া, মনোহরগঞ্জের অবস্থা যা দেখলাম গত ৫০ বছরে তা দেখিনি। যে জমিতে এই মওসুমে রবিশস্য চাষের প্রস্তুতি চলতো এবং চাষ হতো সে সব জমি এখন পানির নিচে। অনেক বাড়ির উঠানেও পানি। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে লোকজন এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করে। জমি থেকে পানি নামছে না; স্থবির হয়ে আছে। লোকজনকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, তারা জানালেন এলাকার খালগুলো সব দখল হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভরাট করে ভোগ দখল করছেন। পানি নিষ্কাশনের কোনও রাস্তা নেই। এই অবস্থা আমি সারা অঞ্চলে দেখেছি। মানুষ যে কি কষ্টে আছে তার খোঁজ নেয়ার কেউ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, হামলা, মামলা প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঘর ও এলাকা ছাড়া করেছে। নিজেরা দণ্ডেমুণ্ডের কর্তা সেজে বসেছেন। তারা এখন সম্রাট। এলাকার খোঁজখবর নেবে কে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট পাবার তাগিদ থাকে, মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়। বিনা ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগ থাকলে অথবা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গৌণ হয়ে পড়লে এই জবাবদিহিতার আর কি কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে? শাসক দল মানুষকে এখন আর মানুষ বলে মনে করেন বলে মনে হয় না। রাজধানীর উড়াল সড়ক ও মহাসড়ক ভিত্তিক ফ্লাইওভারের ন্যায় হাজার-লক্ষ কোটি টাকার মেঘা প্রজেক্টের পারসেন্টেজ ও নামে-বেনামে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ খেয়ে তারাই মোটা হচ্ছেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না। আর এটা উন্নয়নও নয়। ফ্লাইওভারের নির্মাণ পর্বে গার্ডার ভেঙ্গে যারা মরছেন তারাও সাধারণ মানুষ, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী নন। কাজেই সাধারণ মানুষের দুঃখ তারা বুঝবেন কেমন করে?
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা, মৌলিক মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা প্রভৃতি মানুষের জন্মগত অধিকার এবং এগুলোর অনুশীলন পশু ও মানুষের ব্যবধান নির্ণয় করে। একটা কুকুরকে খাবার দিলে সে ঘুমায়, কিন্তু মানুষ তা করে না। সে অপরাপর দায়িত্বও পালন করে। করতে চায়। মানুষ নৈতিক জীব, পশু নৈতিক জীব নয়। মানুষ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, আচার-ব্যভিচার, সুকৃতি-দুষ্কৃতি বুঝে, পশু বুঝে না। কাজেই কেউ যদি তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে চায়, তাদের সাথে প্রতারণা করে তারা তা বুঝতে পারে এবং আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত করে। এ জন্য ডিক্টেটর অথবা তথাকথিত বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটররাও দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারেননি। জুলুম-শোষণ মানবিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খায় না। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমলে এদেশে উন্নয়ন কম হয়নি। তখন আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মৌলিক মানবাধিকার ও বাক এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তখন যদি উন্নয়ন গণতন্ত্রের তুলনায় বেশি মূল্যবান না হয়ে থাকে তাহলে এখন হবে কেন? আর যারা এখন এসব কথা বলেন, তারা প্রতারক হিসেবে শাস্তি পাবেন না কেন।
[তিন]
ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস এর নাম শুনেননি রাজনীতি সচেতন এমন লোক গত শতকে খুবই কম পাওয়া যেতো। তিনি নামকরা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দোর্দ- প্রতাপের সাথে দেশ শাসন করেছেন। আমি ১৯৯৬, ১৯৯৭ সালে এবং ২০০১ সালে তিনবার ফিলিপাইন সফর করেছি। প্রথমবার লস ব্যানসের ইউপিএলবিতে ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সৌজন্যে তখন এবং পরবর্তী দু’বারের সফরে ফিলিপাইনের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রতিষ্ঠান দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। মার্কোসের আমলে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ব্যাপক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। কিন্তু তার সরকার ছিল একনায়কসুলভ কর্তৃত্ববাদী প্রকৃতির; বিরোধিতা বা ভিন্নমত তিনি সহ্য করতেন না। উন্নয়ন তিনি করেছেন ঠিকই কিন্তু দেশটিকে সাথে সাথে তিনি দুর্নীতি-ব্যভিচারের আঁস্তাকুড়েও পরিণত করেছিলেন, যা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা একুইনো জুনিয়ারকে হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণ তাকে টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ১৯৪৯-১৯৫৯ পর্যন্ত প্রতিনিধি সভার সদস্য, ১৯৫৯ থেকে ’৬৫ সাল পর্যন্ত সিনেটের সদস্য হিসেবে দেশের অনেক সেবা করেছিলেন। কিন্তু গণবিস্ফোরণ তার এই সেবার কোনো মূল্যায়নই করেনি। কেননা তিনি মানুষের উপর জুলুম করেছিলেন এবং তার, তার পরিবারের ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক শাসন বহাল রাখেন। ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণে (তাদের ভাষায় চবড়ঢ়ষবং চড়বিৎ) ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তাকে হাওয়াই দ্বীপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মার্কিন আদালতে মামলা হয়। আদালত যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা তার অর্থের দুই বিলিয়ন ডলার ফিলিপাইন সরকারকে ফেরত প্রদানের আদেশ দেন। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে হনু লুলুতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার লাশ এখনো ইলোকস নটে Refrigerated crypt-এ রাখা আছে। কেননা ফিলিপাইন সরকার এখনো পর্যন্ত দেশে এনে তার লাশ দাফনের অনুমতি দেয়নি। দুনিয়ার জালেম স্বৈরশাসকদের এই ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে আমি মনে করি।
পাঠকদের অনেকেরই মনে থাকার কথা যে চলতি বছর মার্চ মাসে খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে একটি শিশু-কিশোর সংগঠনের সাথে জড়িত ৩৫ জন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তাদের কোনও অপরাধ ছিল না। তারা মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সেখানে ১৭ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আয়োজিত একটি আঞ্চলিক ক্যাম্পে অংশ গ্রহণ করছিল। তারা সকলেই ছিল খুলনা বিভাগের বিভিন্ন স্কুল ও মাদরাসার প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্র। বয়স ছিল ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। এই অনুষ্ঠানে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব মনিরুজ্জামান প্রধান অতিথি এবং কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শ্রী নিবাস চন্দ্র মাঝির সালাম গ্রহণ করার কথা ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরানুযায়ী জাতীয় শিশু-কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি এই ক্যাম্প পরিচালনার জন্য স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়েছিল এবং তারা পুলিশ কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝিকে কুচকাওয়াজে বিশেষ অতিথি হিসেবে সালাম গ্রহণ করার অনুরোধ করে, সশরীরে দাওয়াতও করেছিল এবং তিনি যথাসময়ে অর্থাৎ ১৭ মার্চ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠানে হাজির হবার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। দাওয়াতপত্রে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখা গেছে যে পুলিশ কমিশনার নির্ধারিত তারিখ ও সময়ে নিজে না এসে অনুষ্ঠানে তার বাহিনীকে পাঠিয়ে দেন। তারা অনুষ্ঠানস্থল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেন এবং ক্যাম্প থেকে শিশু-কিশোরসহ ১১০ জনকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যান। অভিযোগ অনুযায়ী দৌলতপুর থানার ওসি ক্যাম্প থেকে নগদ ৫৬ হাজার টাকা, ৩টি ল্যাপটপ, একটি ডেস্কটপ, একটি ট্যাব, একটি ক্যামেরা ও ৩৪টি মোবাইলও নিয়ে যান। গ্রেফতারকৃত ১১০ জন শিশু-কিশোরের মধ্যে ৩৫জন ছাড়া বাকীদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি ও পুলিশ কমিশনার বলেছিলেন যে শিশু-সংগঠনের নামে আঞ্চলিক ক্যাম্প সংগঠনের অছিলায় তারা সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা সৃষ্টির সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছে। এখন কথা হচ্ছে, এই শিশু-কিশোররা রাজনীতি, ষড়যন্ত্র আর নাশকতার কি বুঝে? এদের যখন গ্রেফতার করা হয় তখন তাদের সহপাঠী প্রায় ২০/৩০ জন শিশু-কিশোর অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল এবং অভ্যাগত অতিথিদের অনেকে তাদের মাথায় পানি ঢেলে নিজ নিজ বাড়িতে তাদের পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে এদের গ্রেফতার করে পুলিশ কি পেলো? পুলিশ কমিশনারকে কুচকাওয়াজের প্রধান অতিথি করে প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে কেউ সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র ও নাশকতা করে? পুলিশ কমিশনার যা করলেন তা কি শিক্ষিত মার্জিত দায়িত্বশীল কোনও সরকারি কর্মকর্তার কাজ? শিশু-কিশোরদের কাজে তিনি রোল মডেল হবার কথা ছিল কিন্তু হলেন প্রতারক ও মিথ্যাবাদী। তিনি দাওয়াত নিলেন, তার নাম দাওয়াত পত্রে ছাপা হলো, নিশ্চয়ই তার সম্মতিতেই। কিন্তু যে আচরণ করলেন তা সভ্য মানুষের আচরণ নয়।
খ্যাতনামা সাহিত্যিক ও পাকিস্তান আমলের একজন মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের নানা ফেনী কোর্টের একজন মোক্তার ছিলেন। কথিত আছে কোর্টে আসা যাওয়াকালে তিনি স্কুলের ছেলেদের সালাম করতেন। তাদের সালাম দেয়ার সুযোগ দিতেন না। তার বন্ধু-বান্ধবরা এতে আপত্তি করলে তিনি বলতেন, এই ছাত্র শিশু- কিশোররা লেখাপড়া শিখে একদিন হাকিম হয়ে এই আদালতে আসবে। আর মোক্তার হিসেবে আমি আসামীর জামিন দেয়ার জন্য তাদের মুখাপেক্ষী হবো। তাই আগেভাগে তাদের সাথে খাতির করে নিচ্ছি। কথাটার মধ্যে যেমন কৌতুক রস ছিল তেমনি তাৎপর্যও ছিল। ছেলেদের এর মাধ্যমে তিনি আদব কায়দা যেমন শেখাতেন তেমনি ছেলেরাও তাকে সম্মানের চোখে দেখতে শিখতো। আমাদের সরকারি প্রশাসনের সাথে যারা জড়িত তারা এই সত্যটুকু কি উপলব্ধি করতে পারেন না?
[২]
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে সন্ত্রাস, কারচুপি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে বিজয়ী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট (মতান্তরে মহাচোর) সরকারের প্রভাবশালী অনেক নেতানেত্রী ও মন্ত্রী-উপমন্ত্রী এখন নতুন একটি শ্লোগান দিতে শুরু করেছেন। শ্লোগানটি হচ্ছে ‘গণতন্ত্র নয় উন্নয়নই জাতীয় সমৃদ্ধির চাবিকাঠি।’ ম্লোগানটি আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীরা গ্রামেগঞ্জে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে বলে জানা গেছে। তারা বলে বেড়াচ্ছেন যে, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা অন্নবস্ত্রের-যোগাযোগের, গণতন্ত্রের নয়। কিন্তু কথাগুলো শুনতে ভাল লাগলেও তাদের এই প্রচারণা মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলছে বলে অভিজ্ঞমহল জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের গত সাত বছরের শাসনামলে তারা দেখেছেন যে আওয়ামী গণতন্ত্রের নামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানুষের মৌলিক মানবাধিকারকেই শুধু পদদলিত করেনি বরং জাতীয় জীবনের প্রত্যেকটি খাতকেও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে ছেড়েছে। তারা গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন দু’টোই ধ্বংস করেছেন। গণপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা ও নির্বাচন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সর্বত্র এখন অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ দলীয় নেতা ও দলদাসদের অবাধ বিচরণ। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে চলছে সীমাহীন লুটপাট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনসমূহ চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস, দখলবাজি ও ব্যভিচারের কেন্দ্রে পরিণত করেছে। একজন কবি ও আর্টিস্টের ভাষ্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের এক দরজা দিয়ে শিক্ষা লাভের জন্য মানুষের বাচ্চা ঢুকছে অন্য দরজা দিয়ে তারা পশুর বাচ্চা হয়ে বেরিয়ে আসছে। এগুলোর নাম কি উন্নয়ন? আওয়ামী লীগ কি এই উন্নয়নকেই গণতন্ত্রের ওপর প্রাধান্য দেয়ার জন্য মানুষকে মোটিভেট করার চেষ্টা করছে। কয়েকদিন আগে আমি নোয়াখালী গিয়েছিলাম, শহরে ড্রেনেজের কোনও ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলে বাড়িঘর তলিয়ে যায়। মাইজদী শহরের প্রধান সড়কের পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই জলাবদ্ধতা। রাস্তাঘাট নেই, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও এতিমখানা দেখার শখ ছিল: কিন্তু পারিনি। ভেতরে গাড়ি নেয়া যায় না আবার পায়ে হেঁটে কাদা মাড়িয়ে যেতেও পারিনি। মাইজদী বাজারে ঢুকেছিলাম, বেশি দূর যাওয়া যায়নি। সারা বাজারে কাদা। বলাবাহুল্য, মাইজদী বাজারের কয়েকশ’ গজ দূরেই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। আবার পৌর সভার দফতরও বেশি দূরে নয়। সরকারের প্রশাসন ও উন্নয়ন এজেন্সি ছাড়াও এমপি সাবরা আছেন। তাদের কাজ কি আমি বুঝতে পারিনি। ফেরার পথে বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে লাকসাম হয়ে ঢাকা এসেছি। রাস্তার দু’ধারে বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ি, লাঙ্গলকোট, নাথেরপেটুয়া, মনোহরগঞ্জের অবস্থা যা দেখলাম গত ৫০ বছরে তা দেখিনি। যে জমিতে এই মওসুমে রবিশস্য চাষের প্রস্তুতি চলতো এবং চাষ হতো সে সব জমি এখন পানির নিচে। অনেক বাড়ির উঠানেও পানি। ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে লোকজন এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করে। জমি থেকে পানি নামছে না; স্থবির হয়ে আছে। লোকজনকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলাম, তারা জানালেন এলাকার খালগুলো সব দখল হয়ে গেছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভরাট করে ভোগ দখল করছেন। পানি নিষ্কাশনের কোনও রাস্তা নেই। এই অবস্থা আমি সারা অঞ্চলে দেখেছি। মানুষ যে কি কষ্টে আছে তার খোঁজ নেয়ার কেউ আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, হামলা, মামলা প্রভৃতির মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঘর ও এলাকা ছাড়া করেছে। নিজেরা দণ্ডেমুণ্ডের কর্তা সেজে বসেছেন। তারা এখন সম্রাট। এলাকার খোঁজখবর নেবে কে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোট পাবার তাগিদ থাকে, মানুষকে জবাবদিহি করতে হয়। বিনা ভোটে নির্বাচিত হবার সুযোগ থাকলে অথবা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গৌণ হয়ে পড়লে এই জবাবদিহিতার আর কি কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে? শাসক দল মানুষকে এখন আর মানুষ বলে মনে করেন বলে মনে হয় না। রাজধানীর উড়াল সড়ক ও মহাসড়ক ভিত্তিক ফ্লাইওভারের ন্যায় হাজার-লক্ষ কোটি টাকার মেঘা প্রজেক্টের পারসেন্টেজ ও নামে-বেনামে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকার ভুয়া ঋণ খেয়ে তারাই মোটা হচ্ছেন, দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না। আর এটা উন্নয়নও নয়। ফ্লাইওভারের নির্মাণ পর্বে গার্ডার ভেঙ্গে যারা মরছেন তারাও সাধারণ মানুষ, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী নন। কাজেই সাধারণ মানুষের দুঃখ তারা বুঝবেন কেমন করে?
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও তার চর্চা, মৌলিক মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা, মতামতের স্বাধীনতা প্রভৃতি মানুষের জন্মগত অধিকার এবং এগুলোর অনুশীলন পশু ও মানুষের ব্যবধান নির্ণয় করে। একটা কুকুরকে খাবার দিলে সে ঘুমায়, কিন্তু মানুষ তা করে না। সে অপরাপর দায়িত্বও পালন করে। করতে চায়। মানুষ নৈতিক জীব, পশু নৈতিক জীব নয়। মানুষ ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, আচার-ব্যভিচার, সুকৃতি-দুষ্কৃতি বুঝে, পশু বুঝে না। কাজেই কেউ যদি তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে চায়, তাদের সাথে প্রতারণা করে তারা তা বুঝতে পারে এবং আঘাতের বদলে প্রত্যাঘাত করে। এ জন্য ডিক্টেটর অথবা তথাকথিত বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটররাও দুনিয়ায় টিকে থাকতে পারেননি। জুলুম-শোষণ মানবিক মূল্যবোধের সাথে খাপ খায় না। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের আমলে এদেশে উন্নয়ন কম হয়নি। তখন আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মৌলিক মানবাধিকার ও বাক এবং মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিলাম। তখন যদি উন্নয়ন গণতন্ত্রের তুলনায় বেশি মূল্যবান না হয়ে থাকে তাহলে এখন হবে কেন? আর যারা এখন এসব কথা বলেন, তারা প্রতারক হিসেবে শাস্তি পাবেন না কেন।
[তিন]
ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিনান্ড মার্কোস এর নাম শুনেননি রাজনীতি সচেতন এমন লোক গত শতকে খুবই কম পাওয়া যেতো। তিনি নামকরা একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দোর্দ- প্রতাপের সাথে দেশ শাসন করেছেন। আমি ১৯৯৬, ১৯৯৭ সালে এবং ২০০১ সালে তিনবার ফিলিপাইন সফর করেছি। প্রথমবার লস ব্যানসের ইউপিএলবিতে ৬ মাসের একটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশগ্রহণ করেছি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সৌজন্যে তখন এবং পরবর্তী দু’বারের সফরে ফিলিপাইনের বেশিরভাগ এলাকা ও প্রতিষ্ঠান দেখার আমার সুযোগ হয়েছে। মার্কোসের আমলে দেশটিতে যে অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ব্যাপক অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত ঈর্ষণীয়। কিন্তু তার সরকার ছিল একনায়কসুলভ কর্তৃত্ববাদী প্রকৃতির; বিরোধিতা বা ভিন্নমত তিনি সহ্য করতেন না। উন্নয়ন তিনি করেছেন ঠিকই কিন্তু দেশটিকে সাথে সাথে তিনি দুর্নীতি-ব্যভিচারের আঁস্তাকুড়েও পরিণত করেছিলেন, যা ছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। স্বৈরশাসক হিসেবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তিনি পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছেন এবং বিরোধীদলীয় নেতা একুইনো জুনিয়ারকে হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণ তাকে টিকে থাকতে দেয়নি। তিনি ১৯৪৯-১৯৫৯ পর্যন্ত প্রতিনিধি সভার সদস্য, ১৯৫৯ থেকে ’৬৫ সাল পর্যন্ত সিনেটের সদস্য হিসেবে দেশের অনেক সেবা করেছিলেন। কিন্তু গণবিস্ফোরণ তার এই সেবার কোনো মূল্যায়নই করেনি। কেননা তিনি মানুষের উপর জুলুম করেছিলেন এবং তার, তার পরিবারের ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি সামরিক শাসন বহাল রাখেন। ১৯৮৬ সালের গণবিস্ফোরণে (তাদের ভাষায় চবড়ঢ়ষবং চড়বিৎ) ক্ষমতাচ্যুত হবার পর তাকে হাওয়াই দ্বীপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মার্কিন আদালতে মামলা হয়। আদালত যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা তার অর্থের দুই বিলিয়ন ডলার ফিলিপাইন সরকারকে ফেরত প্রদানের আদেশ দেন। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে হনু লুলুতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু তার লাশ এখনো ইলোকস নটে Refrigerated crypt-এ রাখা আছে। কেননা ফিলিপাইন সরকার এখনো পর্যন্ত দেশে এনে তার লাশ দাফনের অনুমতি দেয়নি। দুনিয়ার জালেম স্বৈরশাসকদের এই ঘটনা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে বলে আমি মনে করি।
ড. মোঃ নূরুল আমিন
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন