গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী নতুন মাত্রায় গ্রেফতার-নির্যাতন ও দলন-পীড়ন শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। গণমাধ্যমসমূহের রিপোর্ট এবং ভুক্তভোগী পরিবারসমূহের অভিযোগ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গণপরিবহন থেকে নামিয়ে, গভীর রাতে বাড়িঘর ঘেরাও করে এবং এমনকি হাটবাজার কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বিনা ওয়ারেন্টে ধরে নিয়ে তাদের ওপর নানা রকম নির্যাতন চালাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের গুম করে দিচ্ছে; আবার কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন গুম করে রাখার পর হঠাৎ করে দূর দূরান্তের কোনও এলাকায় হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতন শেষে থানায় সোপর্দ করছে। দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ও বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর থেকে এ যাবত জামায়াত-শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মামলা রুজু করা হয়েছে। রুজুকৃত মিথ্যা মামলাসমূহের মধ্যে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য বহন, নাশকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার অভিযোগও রয়েছে। বলাবাহুল্য এই সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে জামায়াত শিবিরের প্রায় ৫ লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩৫ হাজার মামলা রুজু করেছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই জামিনে ছিলেন এবং সরকার এ যাবত তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ প্রমাণ করে একটি মামলাও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কোনও প্রকার কারণ প্রদর্শন ছাড়াই বিভিন্ন জেলায় তাদের অনেকের জামিন বাতিল করে পুনরায় তাদের জেলখানায় পাঠানো শুরু হয়েছে। ফলে নির্দোষ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। একইভাবে ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গলাকেটে, পিটিয়ে এবং কণ্ঠরোধ করে মানুষ হত্যা, বোমাবাজি, নারীর সম্ভ্রমহানি, বিদেশী নাগরিক হত্যা, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোর্ট কাচারীতে রাজনৈতিক মামলার আধিক্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, খুনি ও সাধারণ অপরাধীদের বিচার করার কোনও ফুরসত বিচারকরা পাচ্ছেন না। সরকারের প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে রাজনৈতিক মামলাসমূহেরও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আবার অপরাধীরা যদি সরকারি দলের হয় তাহলে তাদের তো সাত খুন মাফ। এই অবস্থায় দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামগঞ্জ এবং ওয়ার্ড পাড়ায় বিরোধী দল দমনে সরকারি ও বেসরকারি অপরাধীদের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও সরকার হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাংঘাতিক অবনতি ঘটেছে এবং সরকার তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শহর নগর গ্রামগঞ্জে সাম্প্রতিককালে যৌথ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শোনা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, যেহেতু সরকারের কোনও গণভিত্তি নেই, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন এবং দুর্নীতি ও অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেহেতু তারা এখন তাদের ছায়া দেখেও ভয় পান। দু’চারজন লোককে কোথাও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কথাবার্তা বলতে দেখলেও তারা মনে করেন তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা ষড়যন্ত্র করছেন। এতই আতঙ্কে তারা সারা দেশের মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন এবং তাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আবার কোনও কোন বিশ্লেষকদের ধারণা ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খাতসমূহকে ধ্বংস করে সরকার বিপদে পড়েছেন, সকল দল ও জনগণের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের উপর দেশ-বিদেশের চাপ রয়েছে। ইমেজ রক্ষার স্বার্থে তারাও হয়তো একটা নির্বাচনের কথা ভাবছেন। কিন্তু তার আগে ময়দানকে তারা বিরোধী দলমুক্ত করতে চান। জামায়াতকে তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পান। কেননা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা শহর-নগর ও গ্রামেগঞ্জে এই দলটির শিকড় কত গভীরে প্রোথিত তারা তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস, ভয়ভীতি, হত্যা-গুম এবং হামলা-মামলা ও গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে দলটিকে দমিয়ে রাখতে চান। দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিতে তারা জামায়াতের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন তাদের আতঙ্কিত ও বেপরোয়া করে তুলেছে। এই অবস্থায় জামায়াত ঠেকানোর জন্য তারা দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছেন। এটা একদিকে তাদের ভয় অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও লুটপাট অব্যাহত রাখার অপচেষ্টার একটা বেপরোয়া অভিব্যক্তি বলে আমার বিশ্বাস।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করেছেন এবং সেটা হচ্ছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়ার সরকারি অপচেষ্টার প্রাথমিক প্রস্তুতি। আমীরে জামায়াত ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা এবং বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলায় ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে। মামলা চলাকালে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা তাদের ফাঁসির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জনাব মুজাহিদের আইনজীবীরা তার পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছিলেন। আপিলে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। এই রায়টি আইন বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট। কেননা এতে কাকে হত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায় শাস্তি দেয়া হয়েছিল তার উল্লেখ নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না তেমনি শাস্তির অনুকূলে অপরাধের উল্লেখও সুনির্দিষ্ট ছিল না। খ্যাতনামা বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ান ও যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং লর্ড সভার নেতা লর্ড কার্লাইল এই রায়কে জনাব মুজাহিদের প্রতি বিরাট অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বাংলাদেশের এই আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দফতরের সাথে তুলনা করেছেন। অনেকের দৃষ্টিতে এই আদালত বিচারের নয়, ফাঁসির আদালত। এগুলো আমার নয় জনগণের এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে এই ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ মেলে সুুুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার লক্ষ্যে জনাব মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের পর পুলিশ কর্তৃক তার আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনিরের বাড়ি তল্লাশি ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী এডভোকেট আসাদ উদ্দিনকে গ্রেফতার ও হয়রানি এটাই প্রমাণ করে যে সরকার চান না যে তারা ন্যায় বিচার পান। অবশ্য শুরু থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ইসলামবিদ্বেষী এই সরকারের আচরণে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে জামায়াত নেতাদের নিশ্চিহ্ন করাই তাদের লক্ষ্য, এই দলটির নেতৃত্ব ধ্বংস করতে পারলে দলটিও ধ্বংস হবে এবং দেশে শক্তিশালী আদর্শ ভিত্তিক কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী দল না থাকলে তাদের ক্ষমতায় যাবার রাস্তা নিষ্কণ্টক থাকবে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে ১৯৭১ সালে জামায়াত যুদ্ধের কোনও অংশ ছিল না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যারা যুদ্ধরত বাহিনী বা তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য এবং যুদ্ধরত অবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে আইনে বর্ণিত তফসিলে উল্লেখিত অপরাধ করে তারাই যুদ্ধাপরাধী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অথবা তার কোনও ছাত্র সংগঠন এ ধরনের কোনও বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। বাংলাদেশ হবার পর ৩৯ বছরের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের জন্য বাংলাদেশের কোনও থানায় বা আদালতে মামলাও হয়নি। তারা এই দেশের সাধারণ ও আইনানুগ নাগরিক হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠান ও পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। পক্ষান্তরে সরকার ও সরকারি দল আইনে বর্ণিত সামরিক বাহিনী আধা সামারিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য বাক্যটির সাথে ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ শব্দ যোগ করে আইন সংশোধন করে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইন করে মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি স্থগিত রেখে তাদের বিচার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ত্রিদেশীয় কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াত নেতাদের বিচারের উদ্যোগ তখনি প্রমাণ করেছিল যে এটা বিচার নয়, বিচারের নামে প্রহসন ও রাজনৈতিক জিঘাংসার বাস্তবায়ন। এই জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামানকে শহীদ করা হয়েছে। এখন পরবর্তী পরিকল্পনায় তারা জামায়াত মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীকে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্যই সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পুনরায় গ্রেফতার নির্যাতন শুরু করা হয়েছে বলে মানুষের ধারণা। দেশে বিদেশে সকল ঈমানদার ব্যক্তিদের ও সংগঠনসমূহকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি।
শহর নগর গ্রামগঞ্জে সাম্প্রতিককালে যৌথ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শোনা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, যেহেতু সরকারের কোনও গণভিত্তি নেই, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন এবং দুর্নীতি ও অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেহেতু তারা এখন তাদের ছায়া দেখেও ভয় পান। দু’চারজন লোককে কোথাও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কথাবার্তা বলতে দেখলেও তারা মনে করেন তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা ষড়যন্ত্র করছেন। এতই আতঙ্কে তারা সারা দেশের মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন এবং তাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আবার কোনও কোন বিশ্লেষকদের ধারণা ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খাতসমূহকে ধ্বংস করে সরকার বিপদে পড়েছেন, সকল দল ও জনগণের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের উপর দেশ-বিদেশের চাপ রয়েছে। ইমেজ রক্ষার স্বার্থে তারাও হয়তো একটা নির্বাচনের কথা ভাবছেন। কিন্তু তার আগে ময়দানকে তারা বিরোধী দলমুক্ত করতে চান। জামায়াতকে তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পান। কেননা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা শহর-নগর ও গ্রামেগঞ্জে এই দলটির শিকড় কত গভীরে প্রোথিত তারা তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস, ভয়ভীতি, হত্যা-গুম এবং হামলা-মামলা ও গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে দলটিকে দমিয়ে রাখতে চান। দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিতে তারা জামায়াতের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন তাদের আতঙ্কিত ও বেপরোয়া করে তুলেছে। এই অবস্থায় জামায়াত ঠেকানোর জন্য তারা দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছেন। এটা একদিকে তাদের ভয় অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও লুটপাট অব্যাহত রাখার অপচেষ্টার একটা বেপরোয়া অভিব্যক্তি বলে আমার বিশ্বাস।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করেছেন এবং সেটা হচ্ছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়ার সরকারি অপচেষ্টার প্রাথমিক প্রস্তুতি। আমীরে জামায়াত ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা এবং বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলায় ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে। মামলা চলাকালে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা তাদের ফাঁসির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জনাব মুজাহিদের আইনজীবীরা তার পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছিলেন। আপিলে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। এই রায়টি আইন বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট। কেননা এতে কাকে হত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায় শাস্তি দেয়া হয়েছিল তার উল্লেখ নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না তেমনি শাস্তির অনুকূলে অপরাধের উল্লেখও সুনির্দিষ্ট ছিল না। খ্যাতনামা বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ান ও যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং লর্ড সভার নেতা লর্ড কার্লাইল এই রায়কে জনাব মুজাহিদের প্রতি বিরাট অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বাংলাদেশের এই আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দফতরের সাথে তুলনা করেছেন। অনেকের দৃষ্টিতে এই আদালত বিচারের নয়, ফাঁসির আদালত। এগুলো আমার নয় জনগণের এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে এই ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ মেলে সুুুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার লক্ষ্যে জনাব মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের পর পুলিশ কর্তৃক তার আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনিরের বাড়ি তল্লাশি ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী এডভোকেট আসাদ উদ্দিনকে গ্রেফতার ও হয়রানি এটাই প্রমাণ করে যে সরকার চান না যে তারা ন্যায় বিচার পান। অবশ্য শুরু থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ইসলামবিদ্বেষী এই সরকারের আচরণে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে জামায়াত নেতাদের নিশ্চিহ্ন করাই তাদের লক্ষ্য, এই দলটির নেতৃত্ব ধ্বংস করতে পারলে দলটিও ধ্বংস হবে এবং দেশে শক্তিশালী আদর্শ ভিত্তিক কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী দল না থাকলে তাদের ক্ষমতায় যাবার রাস্তা নিষ্কণ্টক থাকবে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে ১৯৭১ সালে জামায়াত যুদ্ধের কোনও অংশ ছিল না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যারা যুদ্ধরত বাহিনী বা তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য এবং যুদ্ধরত অবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে আইনে বর্ণিত তফসিলে উল্লেখিত অপরাধ করে তারাই যুদ্ধাপরাধী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অথবা তার কোনও ছাত্র সংগঠন এ ধরনের কোনও বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। বাংলাদেশ হবার পর ৩৯ বছরের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের জন্য বাংলাদেশের কোনও থানায় বা আদালতে মামলাও হয়নি। তারা এই দেশের সাধারণ ও আইনানুগ নাগরিক হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠান ও পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। পক্ষান্তরে সরকার ও সরকারি দল আইনে বর্ণিত সামরিক বাহিনী আধা সামারিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য বাক্যটির সাথে ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ শব্দ যোগ করে আইন সংশোধন করে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইন করে মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি স্থগিত রেখে তাদের বিচার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ত্রিদেশীয় কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াত নেতাদের বিচারের উদ্যোগ তখনি প্রমাণ করেছিল যে এটা বিচার নয়, বিচারের নামে প্রহসন ও রাজনৈতিক জিঘাংসার বাস্তবায়ন। এই জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামানকে শহীদ করা হয়েছে। এখন পরবর্তী পরিকল্পনায় তারা জামায়াত মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীকে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্যই সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পুনরায় গ্রেফতার নির্যাতন শুরু করা হয়েছে বলে মানুষের ধারণা। দেশে বিদেশে সকল ঈমানদার ব্যক্তিদের ও সংগঠনসমূহকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি।
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন