জঙ্গিবাদ ও নিয়মতান্ত্রিকতার সংজ্ঞা নতুন করে বলার দরকার হয় না। যারা নির্বাচন চায়, গণতন্ত্র চায়, জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়, তাদের সাথে উন্মত্ততার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করতে আগ্রহী জঙ্গিদের পার্থক্য দুধের শিশুও বোঝে। অতীতে যেমন সিরাজ শিকদারের সর্বহারা দল বা জাসদের গণবাহিনী জঙ্গি পন্থায় ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে এখন এমনটি কেউ চাইছে কি চাইছে না, তা নিয়ে খিচুরি পাকানো হচ্ছে। এই উদ্দেশ্যমূলক জটিলতার কারণ কি?
বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য বা লাতিন আমেরিকার মতো উতপ্ত স্থানও নয়। সেখানে যেমন নানা জঙ্গি, সশস্ত্র গ্রুপ প্রকাশ্যে যুদ্ধ করছে। এসব গ্রুপ রহস্যজনক। এদের উত্থান ও বিকাশ বিতর্কিত। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী চক্রকে সন্দেহ করা হয় বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপকে তৈরির কারিকর হিসেবে। তালেবান বা আইএস সংক্রান্ত বিষয় বুঝতে হলে সা¤্রাজ্যবাদী কারসাজি সম্পর্কেও জানতে হবে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট, জঙ্গিবাদের তাত্ত্বিক দর্শন ইত্যাদি না জেনে বাজার গরম করার মতো কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য মহৎ হতে পারে কিনা, সে প্রশ্নও রয়েছে।
বাজার-গরম কথাগুলো জঙ্গিবাদের তাত্ত্বিক দর্শন না জেনে বলা হচ্ছে, এমনটিও বিশ্বাস করা যায় না। রাজনীতির মাঠে বা পত্র-পত্রিকায়-পন্ডিত মহলে হাল আমলে যারা জঙ্গিবাদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তারা প্রায়-সকলেই একদা জঙ্গিবাদী রাজনীতির হোতা। ফলে তারা জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিতত্ত্ব জানেন না, এটা মানা যায় না। জেনেই তারা বক্তৃতা এবং পত্রিকার কলামে জঙ্গিবাদের ভীতি উৎপাদন করছেন। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দলসমূহকে অহেতুক জঙ্গি বানানোর কোশেশ করছেন। যারা একদা লাল বই হাতে নিয়ে ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ বলে মানুষ মেরেছে, গলা কেটেছে, তারাই এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে চেঁচাচ্ছে। এই ভোলবাজির ফন্দিসর্বস্ব কুরাজনীতির কারণ অনুসন্ধান করা বাংলাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতির স্বার্থে অতীব জরুরি কাজ।
জঙ্গিবাদ নিয়ে মতলববাজির পেছনে কয়েকটি কারণ লক্ষ্য করলেই অনুধাবণ করা যায় :
১. বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদের নামে মাতামাতি করছে। সাম্রাজ্যবাদের জন্য সব সময়ই লড়াই করার একটি প্রতিপক্ষ লাগে। তা না হলে অস্ত্রের ব্যবসা, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, দখলদারিত্ব, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি করা যায় না। সমাজতন্ত্রের লজ্জাষ্কর পতনের পর একক বিশ্বশক্তির সামনে একটি শত্রুর দরকার ছিল। এবং ইসলামের উত্থান থেকে আতঙ্কিত হয়ে তারা মুসলমানদের মধ্যে জঙ্গি তালাশ করছে। এমন কি, ইসলামী নাম দিয়ে বহু গ্রুপ বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হানাহানি বাধিয়েছে। অতএব জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বললে পশ্চিমা প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে এবং তাদের দয়া-দাক্ষিণ্য-করুণাও পাওয়া যাবে। দুনিয়ালোভী রাজনীতিবিদ ও পন্ডিতরা এখন পশ্চিমা প্রভুদের পোঁ-ধরতে গিয়ে শৃগাল-সুলভ যৌথতায় জঙ্গিবাদ বিষয়ক চর্চা করতে করতে গলা ফাটাচ্ছে।
২. স্বাধীনতার পর সদ্য-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছিল বামপন্থী জঙ্গিবাদীদের দ্বারা। সেইসব নানাবর্ণা বাম জঙ্গিদের সাধারণ ভাষায় বলা হতো নকশাল। ‘নকশাল এলো’ ‘নকশাল এলো’ বলে আওয়ামী লীগকে তখন ভয় দেখানো হতো। এখন ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে বন্ধুত্বের ভান ধরেছে তারাই, যারা তখন নকশালঘেঁষা ছিল। এই নাটকীয় কাজটি করা হতে পারে, তাদের অতীত পাপস্খলনের প্রয়োজনে। কিংবা যারা শত শত আওয়ামী নেতা-কর্মী হত্যা করেছিল, হাট-বাজার-থানা লুট করেছিল, তাদের সে কালিমা ঢাকার প্রয়াস স্বরূপ। নতুন কারো ওপর দোষ চাপানো গেলে অতীতের দোষ চাপা পড়বে এবং নিজেদেরও শুদ্ধ করা যাবে, এটাই তাদের ফন্দি।
৩. ফন্দিবাজদের মৌলিক আদর্শ নাস্তিক্যবাদ। ইসলাম তাদের প্রধান শত্রু। জঙ্গিবাদ বিষয়ক জটিলতা তৈরি করলে পশ্চিমা প্রভুদের দয়া, সরকারের সহানুভূতি, নিজের পাপমোচনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বারোটা বাজানো যাবে, এই চারমুখী উদ্দেশ্য তাদের কুকর্ম, প্রোপাগান্ডা ও উত্তেজনা ছড়ানোর নেপথ্যে কাজ করছে। কিন্তু মূলধারার ইসলাম সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত জঙ্গিবাদ বা সশস্ত্র পথে অগ্রসর হয় নি; মানবতাবাদ, কল্যাণ, শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতার পথে অগ্রসর হয়েছে। এ সত্যটি তারা জানে। তাই জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে কাজের কাজ কিছুই না করে ইসলামকে ঠেকানোর মতো কুকর্মটিও তারা করছে বিদ্বেষমূলকভাবে।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক নানা জটিলতা, সত্য-মিথ্যা ও বিভ্রান্তির পরেও ইসলাম সর্বাবস্থায় শান্তির ধর্ম। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের স্থান ইসলামে নেই। বাংলাদেশে শত-সহস্র মসজিদ, মাদরাসা, মাজার, খানকা শত শত বছর ধরে মানুষকে দ্বীন, ধর্ম, তাহজিব, তমুদ্দুন শিক্ষা দিচ্ছে। ইসলামের আলোকে এই বিশ্বাসী, শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আছে। শত বছরেও যে অভিযোগ কেউ করে নি; আজকে হঠাৎ সেটাই করা হচ্ছে কেন? আলেম-উলামা, দ্বীনদার নাগরিক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ করে জঙ্গিদের ঘাঁটি হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ বিশ্বাস করা অসম্ভব। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে বসবাসকারী মানুষ প্রতিদিন তাদেরকে দেখছে। জনগণকে এসব গেলানো যাবে না। কিন্তু কিছুটা বিভ্রান্ত করা যাবে এবং ইসলামপন্থীদের বিতর্কিত বানানো সম্ভব হবে বলেই প্রতিপক্ষ চালাচ্ছে এহেন প্রচারণা।
অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে যেসব দল ইসলামকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এদের তো আত্মগোপনে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতার দরকার হয় না। জনপ্রিয় দলকে জনবিচ্ছিন্ন জঙ্গি হতে হবে কেন? কোনো কা-জ্ঞানেও তো একথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা কখনোই জঙ্গিতত্ত্বকে বিশ্বাস বা পালন করে নি; করবেও না। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিবর্গ চরম আক্রমণ, আক্রোস ও হামলা-নির্যাতন সহ্য করেও জঙ্গি হন নি বা সশস্ত্র-জঙ্গিপন্থা গ্রহণ করেন নি। জনগণকে সাথে নিয়ে আস্থা ও ভালোবাসার পথে ইসলামকে নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তখন জঙ্গি বা নকশাল হয়েছিল কারা, সেটাও কারো অজানা নয়। ভালো বা মন্দ পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থীরা ধৈর্য্য ও নিয়মতান্ত্রিকতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন। এটাই বাংলাদেশের গৌরবময়, শান্তিবাদী রাজনৈতিক ঐতিহ্য, যা প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ বিশেষ। শত ষড়যন্ত্র, প্রচারণা, মিথ্যাচার ও জটিলার মাধ্যমেও এই সত্যনিষ্ট ইতিহাসকে মুছে ফেলা যাবে না; ইসলামের গণমুখী ও শান্তিবাদী মূলধারাকে কখনোই বিভ্রান্ত করা যাবে না। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নানা দল-উপদল বানিয়ে জলঘোলা করা হলেও মূলধারার ইসলামের কোনোই ক্ষতি করা সম্ভব হবে না। সাম্রাজ্যবাদী এহেন অপচেষ্টা অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমানেও পরাজিতই হবে।
অথচ ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস এটাই যে, জনগণের মূলস্রোতের বাইরে গিয়ে জঙ্গিত্ব গ্রহণ করে বিজয় কখনোই এবং কোনো দেশেই সম্ভব হয় না। স্বাধীনতার পরে কারা জঙ্গিবাদ গ্রহণ করেছিল, আত্মগোপনে গিয়ে সরকার পতনের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছিল, অকাতরে মানুষ মেরেছিল, আওয়ামী নেতা-কর্মীদের হত্যা ও নিধন করেছিল, সে কথা কারো অজানা নয় এবং তাদের পতন কাহিনীও কারো অজ্ঞাত নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে চরম অধৈর্য ও অসহিষ্ণু হয়ে কারা সেদিন নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস ও পতনের কারণ হয়েছিল, সেটাও ইতিহাসের ছাত্ররা জানে। বাংলাদেশের মানুষও সেসব বিভীষিকাপূর্ণ দিনের কথা ভুলে যায় নি। সেদিন তারা কেবল আওয়ামী লীগেরই পতন সাধন করে নি; বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল; নিজেদেরকেও হটকারী আর ফতুর প্রমাণিত করেছিল। উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ও অগ্রযাত্রাকে সশস্ত্র-রক্তাক্ত-জঙ্গিবাদী পথে ঠেলে দিয়েছিল। হাজার হাজার তরুণ-যুবককে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়ার বদলে হটকারিতা, রোমান্টিক বিপ্লববাদ, জঙ্গি মানসিকতায় কলুষিত করেছিল। এমন কি, আজীবন গণতন্ত্রের কাণ্ডারী মহান নেতাকে একদলীয় স্বৈরাচারে পরিণত করে বাকশাল নামক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমলে গণতন্ত্রের ক্ষতির জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগের চেয়ে এই জঙ্গিবাদী আক্রমণকারীদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। সে দিন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের অনুঘটক ছিল সেইসব জঙ্গিত্ববাদী ব্যক্তি ও দলসমূহ।
এটা আশার কথা যে, আওয়ামী লীগ একদলীয় বাকশালের যুগ পেরিয়ে আবার গণতান্ত্রিক পথে ফিরে এসেছে। দলটি এখন আদর্শ হিসেবে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রকেই কাগজে-কলমে হলেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের সামনে এখন গণতন্ত্র বিনির্মাণের বড় দায়িত্ব রয়েছে। কেননা, ১/১১-এর সময় যেভাবেই হোক গণতন্ত্রের ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। গণতন্ত্রের এই পতনের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারে বা বিরোধী দলে অবস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলকে অস্বীকার করা যায় না। এই গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উপরই বর্তায়। এ কাজ একা সরকারি দল বা একাকী বিরোধী দল করবে, এমন নয়। সঠিক ও সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিরই কাম্য। এ কাজ করতে দেয়ার মধ্যেই গণতন্ত্রের লাভ, দেশ ও জাতির কল্যাণ। নানা বাহানায় এ কাজটি বিলম্বিত করা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের উত্তরণের কাজকে চাপা দেয়ার জন্য যারা চক্রান্ত করছে, তারা নানা বিষয়ক জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে মূল রাজনৈতিক ফোকাস থেকে সবার দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত, এটা অনুধাবন করতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
দেশ ও বিদেশে সবাই এটাও বুঝতে পারছে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংক্রান্ত কাজসমূহ সঠিকভাবে হচ্ছে না। হচ্ছে না, ফন্দিবাজদের কারণে এবং গণতন্ত্রের পরীক্ষিত শত্রুদের চক্রান্তের ফলে। যারা স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগকে জঙ্গি হামলায় নাস্তানাবুদ করেছিল তারাই যদি এখন ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে যাকে-তাকে আক্রান্ত করার মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিস্থিতি জটিল করে, তাহলে গণতন্ত্রের অগ্রাভিযান কিভাবে হবে? জঙ্গিত্বের ধোয়া তুলে নিয়মতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক দলসমূহ, শান্তিপ্রিয় ইসলামপন্থীদের খতমের গোপন ষড়যন্ত্র চালালে গণতন্ত্র এগিয়ে যাওয়ার বদলে জটিলাবর্তে ঘুরপাক খাবে। আবার নানা উত্তেজনা ছড়িয়ে টুপি-দাড়িওয়ালা আর ইসলামপন্থীদের নাজেহাল করার মাধ্যমে সামাজিক অঙ্গনে সরকারের ইমেজ হানি করার ফলে নাস্তিক্যবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। এই অপশক্তি আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে চায়। এরাই সবাইকে নিয়ে একসাথে চলে গণতন্ত্রের মহামিলন হতে দিচ্ছে না। অতীতে যেমন তারা নব্য স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের শেকড় কর্তন করেছিল; এখন গণতান্ত্রিকতার পথে কালাপাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে, সরকার ও বিরোধী দল নির্বিশেষে, সবাইকে এদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। স্বাধীনতার পর যেমন তারা সরাসরি তৎপর হয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পরিস্থিতিকে রক্তাক্ত করে অবশেষে একদলীয় ব্যবস্থা ডেকে এনেছিল; এরাই এখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা জানে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রিয় ভোটে জামানত রাখার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাদের প্রতি জনগণের নূন্যতম আস্থা ও সমর্থন নেই। অতএব তারা গণতন্ত্রকে চাইতেই পারে না। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করাই নানামুখী অপপ্রচারের বিষ ও বীজ বুকে লালন করা ছদ্মবেশীদের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামপন্থীরা সর্বাবস্থায় গণতন্ত্রকেই কামনা করে। রাজনৈতিক শক্তিসমূহ কেন এই দূরাত্মার ছলে বিভ্রান্ত হবে? স্বাধীনতার পর তারা মহান নেতা ও তার দলকে অস্থির ও বিপদগ্রস্ত করে একদলীয় স্তরে ঠেলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের মাথায় চড়ে এখন তারা কোনো চক্রান্ত সফল করবে? উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা ও জটিলতা সৃষ্টি করা যে অগণতান্ত্রিক অপশক্তির হীন ষড়যন্ত্র, এটা যত তাড়াতাড়ি অনুভব করা যাবে, তত তাড়াতাড়িই গণতন্ত্র বিকাশের কাজটি ত্বরান্বিত হবে।
এটা ঠিক যে লাইনচ্যুত গণতন্ত্র এসব হটকারিদের কিছু ফায়দা দেবে। ভোটে যেহেতু জয়ী হওয়া যাবে না, সেহেতু ভোটবিহীন অবস্থাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। সে কারণেই তারা গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার পথ ও পরিবেশ নষ্ট করছে। গণতান্ত্রিক দলসমূহ, বিশেষত নিয়মতান্ত্রিক-গণতন্ত্রমনা-জনপ্রিয়-মূলধারারা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের ধোয়াশা তৈরি করছে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার মানুষ সবাই সবাইকে চেনে-জানে; কে কি, সেটাও কারো কাছে অজানা নয়। অতএব অপশক্তির কুপ্রচারণায় সাময়িক জলঘোলা সৃষ্টি হলেও হতে পারে; সত্য মিথ্যায়, মিথ্যা সত্যে পরিণত হবে না।
প্রশ্ন হলো, ষড়যন্ত্রকারীদের সৃষ্ট জঙ্গি বিষয়ক জটিলতায় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কি লাভ হবে? কারণ বাংলাদেশে বিশ্বস্বীকৃত ও জনসমর্থিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি কাজ তাদের সামনে রয়েছে। গণতন্ত্রকে সঠিক লাইনে আনায় কৃতিত্ব কি তাদের জন্য ভালো? নাকি গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত অবস্থায় হটকারিদের মিথ্যাচার, মাতামাতি আর জঙ্গিতত্ত্বের কাল্পনিক আতঙ্কে দিশেহারা হওয়ার মাধ্যমে অতীতের মতো আবারো কোনো একদলীয়-স্বৈরতান্ত্রিক গহ্বরে হারানোর মধ্যে ফায়দা?
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী, গণতান্ত্রিক দলকে ঠান্ডা মাথায় ও সুবিবেচনার সঙ্গে এসব প্রশ্নে উত্তর নির্ধারণ করতে হবে। গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে হবে এবং বন্ধু বেশে শত্রুদের ব্যাপারে সদা-সতর্ক হতে হবে। অন্য কারো মনে না থাকলেও তো আওয়ামী লীগের এটা মনে থাকার কথা যে, পনের আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটেছিল ঘরের শত্রু বিভীষণের দ্বারা। অতীতে ‘নকশাল এলো’ ‘নকশাল এলো’র মতো এখন এসব ঘরের শত্রুগণ মিথ্যাবাদী রাখালের মতো ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে জটিলতা ও কাল্পনিক আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে তলে তলে কোন বিপদ ডেকে আনছে? অতএব, সাধু সাবধান!
বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য বা লাতিন আমেরিকার মতো উতপ্ত স্থানও নয়। সেখানে যেমন নানা জঙ্গি, সশস্ত্র গ্রুপ প্রকাশ্যে যুদ্ধ করছে। এসব গ্রুপ রহস্যজনক। এদের উত্থান ও বিকাশ বিতর্কিত। সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী চক্রকে সন্দেহ করা হয় বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপকে তৈরির কারিকর হিসেবে। তালেবান বা আইএস সংক্রান্ত বিষয় বুঝতে হলে সা¤্রাজ্যবাদী কারসাজি সম্পর্কেও জানতে হবে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপট, জঙ্গিবাদের তাত্ত্বিক দর্শন ইত্যাদি না জেনে বাজার গরম করার মতো কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য মহৎ হতে পারে কিনা, সে প্রশ্নও রয়েছে।
বাজার-গরম কথাগুলো জঙ্গিবাদের তাত্ত্বিক দর্শন না জেনে বলা হচ্ছে, এমনটিও বিশ্বাস করা যায় না। রাজনীতির মাঠে বা পত্র-পত্রিকায়-পন্ডিত মহলে হাল আমলে যারা জঙ্গিবাদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার, তারা প্রায়-সকলেই একদা জঙ্গিবাদী রাজনীতির হোতা। ফলে তারা জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিতত্ত্ব জানেন না, এটা মানা যায় না। জেনেই তারা বক্তৃতা এবং পত্রিকার কলামে জঙ্গিবাদের ভীতি উৎপাদন করছেন। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির দলসমূহকে অহেতুক জঙ্গি বানানোর কোশেশ করছেন। যারা একদা লাল বই হাতে নিয়ে ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ বলে মানুষ মেরেছে, গলা কেটেছে, তারাই এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে চেঁচাচ্ছে। এই ভোলবাজির ফন্দিসর্বস্ব কুরাজনীতির কারণ অনুসন্ধান করা বাংলাদেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতির স্বার্থে অতীব জরুরি কাজ।
জঙ্গিবাদ নিয়ে মতলববাজির পেছনে কয়েকটি কারণ লক্ষ্য করলেই অনুধাবণ করা যায় :
১. বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিগুলো জঙ্গিবাদের নামে মাতামাতি করছে। সাম্রাজ্যবাদের জন্য সব সময়ই লড়াই করার একটি প্রতিপক্ষ লাগে। তা না হলে অস্ত্রের ব্যবসা, রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, দখলদারিত্ব, অনুপ্রবেশ ইত্যাদি করা যায় না। সমাজতন্ত্রের লজ্জাষ্কর পতনের পর একক বিশ্বশক্তির সামনে একটি শত্রুর দরকার ছিল। এবং ইসলামের উত্থান থেকে আতঙ্কিত হয়ে তারা মুসলমানদের মধ্যে জঙ্গি তালাশ করছে। এমন কি, ইসলামী নাম দিয়ে বহু গ্রুপ বানিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হানাহানি বাধিয়েছে। অতএব জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বললে পশ্চিমা প্রভুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে এবং তাদের দয়া-দাক্ষিণ্য-করুণাও পাওয়া যাবে। দুনিয়ালোভী রাজনীতিবিদ ও পন্ডিতরা এখন পশ্চিমা প্রভুদের পোঁ-ধরতে গিয়ে শৃগাল-সুলভ যৌথতায় জঙ্গিবাদ বিষয়ক চর্চা করতে করতে গলা ফাটাচ্ছে।
২. স্বাধীনতার পর সদ্য-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বড় আঘাত পেয়েছিল বামপন্থী জঙ্গিবাদীদের দ্বারা। সেইসব নানাবর্ণা বাম জঙ্গিদের সাধারণ ভাষায় বলা হতো নকশাল। ‘নকশাল এলো’ ‘নকশাল এলো’ বলে আওয়ামী লীগকে তখন ভয় দেখানো হতো। এখন ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে আওয়ামী লীগকে ভয় দেখিয়ে বন্ধুত্বের ভান ধরেছে তারাই, যারা তখন নকশালঘেঁষা ছিল। এই নাটকীয় কাজটি করা হতে পারে, তাদের অতীত পাপস্খলনের প্রয়োজনে। কিংবা যারা শত শত আওয়ামী নেতা-কর্মী হত্যা করেছিল, হাট-বাজার-থানা লুট করেছিল, তাদের সে কালিমা ঢাকার প্রয়াস স্বরূপ। নতুন কারো ওপর দোষ চাপানো গেলে অতীতের দোষ চাপা পড়বে এবং নিজেদেরও শুদ্ধ করা যাবে, এটাই তাদের ফন্দি।
৩. ফন্দিবাজদের মৌলিক আদর্শ নাস্তিক্যবাদ। ইসলাম তাদের প্রধান শত্রু। জঙ্গিবাদ বিষয়ক জটিলতা তৈরি করলে পশ্চিমা প্রভুদের দয়া, সরকারের সহানুভূতি, নিজের পাপমোচনের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের বারোটা বাজানো যাবে, এই চারমুখী উদ্দেশ্য তাদের কুকর্ম, প্রোপাগান্ডা ও উত্তেজনা ছড়ানোর নেপথ্যে কাজ করছে। কিন্তু মূলধারার ইসলাম সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত জঙ্গিবাদ বা সশস্ত্র পথে অগ্রসর হয় নি; মানবতাবাদ, কল্যাণ, শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতার পথে অগ্রসর হয়েছে। এ সত্যটি তারা জানে। তাই জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ বলে কাজের কাজ কিছুই না করে ইসলামকে ঠেকানোর মতো কুকর্মটিও তারা করছে বিদ্বেষমূলকভাবে।
জঙ্গিবাদ বিষয়ক নানা জটিলতা, সত্য-মিথ্যা ও বিভ্রান্তির পরেও ইসলাম সর্বাবস্থায় শান্তির ধর্ম। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদের স্থান ইসলামে নেই। বাংলাদেশে শত-সহস্র মসজিদ, মাদরাসা, মাজার, খানকা শত শত বছর ধরে মানুষকে দ্বীন, ধর্ম, তাহজিব, তমুদ্দুন শিক্ষা দিচ্ছে। ইসলামের আলোকে এই বিশ্বাসী, শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত আছে। শত বছরেও যে অভিযোগ কেউ করে নি; আজকে হঠাৎ সেটাই করা হচ্ছে কেন? আলেম-উলামা, দ্বীনদার নাগরিক তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো হঠাৎ করে জঙ্গিদের ঘাঁটি হয়ে গেছে, এমন অভিযোগ বিশ্বাস করা অসম্ভব। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে বসবাসকারী মানুষ প্রতিদিন তাদেরকে দেখছে। জনগণকে এসব গেলানো যাবে না। কিন্তু কিছুটা বিভ্রান্ত করা যাবে এবং ইসলামপন্থীদের বিতর্কিত বানানো সম্ভব হবে বলেই প্রতিপক্ষ চালাচ্ছে এহেন প্রচারণা।
অন্যদিকে রাজনীতির ময়দানে যেসব দল ইসলামকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে কাজ করছে, তাদের সঙ্গে আছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এদের তো আত্মগোপনে গিয়ে জঙ্গি তৎপরতার দরকার হয় না। জনপ্রিয় দলকে জনবিচ্ছিন্ন জঙ্গি হতে হবে কেন? কোনো কা-জ্ঞানেও তো একথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বরং ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থীরা কখনোই জঙ্গিতত্ত্বকে বিশ্বাস বা পালন করে নি; করবেও না। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রাজনৈতিক কারণে ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তিবর্গ চরম আক্রমণ, আক্রোস ও হামলা-নির্যাতন সহ্য করেও জঙ্গি হন নি বা সশস্ত্র-জঙ্গিপন্থা গ্রহণ করেন নি। জনগণকে সাথে নিয়ে আস্থা ও ভালোবাসার পথে ইসলামকে নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তখন জঙ্গি বা নকশাল হয়েছিল কারা, সেটাও কারো অজানা নয়। ভালো বা মন্দ পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থীরা ধৈর্য্য ও নিয়মতান্ত্রিকতার পথে অগ্রসর হচ্ছেন। এটাই বাংলাদেশের গৌরবময়, শান্তিবাদী রাজনৈতিক ঐতিহ্য, যা প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ বিশেষ। শত ষড়যন্ত্র, প্রচারণা, মিথ্যাচার ও জটিলার মাধ্যমেও এই সত্যনিষ্ট ইতিহাসকে মুছে ফেলা যাবে না; ইসলামের গণমুখী ও শান্তিবাদী মূলধারাকে কখনোই বিভ্রান্ত করা যাবে না। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে নানা দল-উপদল বানিয়ে জলঘোলা করা হলেও মূলধারার ইসলামের কোনোই ক্ষতি করা সম্ভব হবে না। সাম্রাজ্যবাদী এহেন অপচেষ্টা অতীতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, বর্তমানেও পরাজিতই হবে।
অথচ ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস এটাই যে, জনগণের মূলস্রোতের বাইরে গিয়ে জঙ্গিত্ব গ্রহণ করে বিজয় কখনোই এবং কোনো দেশেই সম্ভব হয় না। স্বাধীনতার পরে কারা জঙ্গিবাদ গ্রহণ করেছিল, আত্মগোপনে গিয়ে সরকার পতনের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেছিল, অকাতরে মানুষ মেরেছিল, আওয়ামী নেতা-কর্মীদের হত্যা ও নিধন করেছিল, সে কথা কারো অজানা নয় এবং তাদের পতন কাহিনীও কারো অজ্ঞাত নয়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে চরম অধৈর্য ও অসহিষ্ণু হয়ে কারা সেদিন নিজেদের ক্ষতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস ও পতনের কারণ হয়েছিল, সেটাও ইতিহাসের ছাত্ররা জানে। বাংলাদেশের মানুষও সেসব বিভীষিকাপূর্ণ দিনের কথা ভুলে যায় নি। সেদিন তারা কেবল আওয়ামী লীগেরই পতন সাধন করে নি; বাংলাদেশের গণতন্ত্রেরও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল; নিজেদেরকেও হটকারী আর ফতুর প্রমাণিত করেছিল। উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ও অগ্রযাত্রাকে সশস্ত্র-রক্তাক্ত-জঙ্গিবাদী পথে ঠেলে দিয়েছিল। হাজার হাজার তরুণ-যুবককে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শিক্ষা দেয়ার বদলে হটকারিতা, রোমান্টিক বিপ্লববাদ, জঙ্গি মানসিকতায় কলুষিত করেছিল। এমন কি, আজীবন গণতন্ত্রের কাণ্ডারী মহান নেতাকে একদলীয় স্বৈরাচারে পরিণত করে বাকশাল নামক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করেছিল। স্বাধীনতা-পরবর্তী আমলে গণতন্ত্রের ক্ষতির জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগের চেয়ে এই জঙ্গিবাদী আক্রমণকারীদের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। সে দিন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের অনুঘটক ছিল সেইসব জঙ্গিত্ববাদী ব্যক্তি ও দলসমূহ।
এটা আশার কথা যে, আওয়ামী লীগ একদলীয় বাকশালের যুগ পেরিয়ে আবার গণতান্ত্রিক পথে ফিরে এসেছে। দলটি এখন আদর্শ হিসেবে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র নয়, গণতন্ত্রকেই কাগজে-কলমে হলেও বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগের সামনে এখন গণতন্ত্র বিনির্মাণের বড় দায়িত্ব রয়েছে। কেননা, ১/১১-এর সময় যেভাবেই হোক গণতন্ত্রের ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়েছে। গণতন্ত্রের এই পতনের জন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারে বা বিরোধী দলে অবস্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর ভুলকে অস্বীকার করা যায় না। এই গণতন্ত্রকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উপরই বর্তায়। এ কাজ একা সরকারি দল বা একাকী বিরোধী দল করবে, এমন নয়। সঠিক ও সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিরই কাম্য। এ কাজ করতে দেয়ার মধ্যেই গণতন্ত্রের লাভ, দেশ ও জাতির কল্যাণ। নানা বাহানায় এ কাজটি বিলম্বিত করা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের উত্তরণের কাজকে চাপা দেয়ার জন্য যারা চক্রান্ত করছে, তারা নানা বিষয়ক জটিলতা সৃষ্টির মাধ্যমে মূল রাজনৈতিক ফোকাস থেকে সবার দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত, এটা অনুধাবন করতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
দেশ ও বিদেশে সবাই এটাও বুঝতে পারছে যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র সংক্রান্ত কাজসমূহ সঠিকভাবে হচ্ছে না। হচ্ছে না, ফন্দিবাজদের কারণে এবং গণতন্ত্রের পরীক্ষিত শত্রুদের চক্রান্তের ফলে। যারা স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগকে জঙ্গি হামলায় নাস্তানাবুদ করেছিল তারাই যদি এখন ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে যাকে-তাকে আক্রান্ত করার মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিস্থিতি জটিল করে, তাহলে গণতন্ত্রের অগ্রাভিযান কিভাবে হবে? জঙ্গিত্বের ধোয়া তুলে নিয়মতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক দলসমূহ, শান্তিপ্রিয় ইসলামপন্থীদের খতমের গোপন ষড়যন্ত্র চালালে গণতন্ত্র এগিয়ে যাওয়ার বদলে জটিলাবর্তে ঘুরপাক খাবে। আবার নানা উত্তেজনা ছড়িয়ে টুপি-দাড়িওয়ালা আর ইসলামপন্থীদের নাজেহাল করার মাধ্যমে সামাজিক অঙ্গনে সরকারের ইমেজ হানি করার ফলে নাস্তিক্যবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। এই অপশক্তি আসলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে চায়। এরাই সবাইকে নিয়ে একসাথে চলে গণতন্ত্রের মহামিলন হতে দিচ্ছে না। অতীতে যেমন তারা নব্য স্বাধীন দেশে গণতন্ত্রের শেকড় কর্তন করেছিল; এখন গণতান্ত্রিকতার পথে কালাপাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহকে, সরকার ও বিরোধী দল নির্বিশেষে, সবাইকে এদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। স্বাধীনতার পর যেমন তারা সরাসরি তৎপর হয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পরিস্থিতিকে রক্তাক্ত করে অবশেষে একদলীয় ব্যবস্থা ডেকে এনেছিল; এরাই এখন গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত। তারা জানে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনপ্রিয় ভোটে জামানত রাখার ক্ষমতাও তাদের নেই। তাদের প্রতি জনগণের নূন্যতম আস্থা ও সমর্থন নেই। অতএব তারা গণতন্ত্রকে চাইতেই পারে না। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করাই নানামুখী অপপ্রচারের বিষ ও বীজ বুকে লালন করা ছদ্মবেশীদের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, ইসলামপন্থীরা সর্বাবস্থায় গণতন্ত্রকেই কামনা করে। রাজনৈতিক শক্তিসমূহ কেন এই দূরাত্মার ছলে বিভ্রান্ত হবে? স্বাধীনতার পর তারা মহান নেতা ও তার দলকে অস্থির ও বিপদগ্রস্ত করে একদলীয় স্তরে ঠেলে দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের মাথায় চড়ে এখন তারা কোনো চক্রান্ত সফল করবে? উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা ও জটিলতা সৃষ্টি করা যে অগণতান্ত্রিক অপশক্তির হীন ষড়যন্ত্র, এটা যত তাড়াতাড়ি অনুভব করা যাবে, তত তাড়াতাড়িই গণতন্ত্র বিকাশের কাজটি ত্বরান্বিত হবে।
এটা ঠিক যে লাইনচ্যুত গণতন্ত্র এসব হটকারিদের কিছু ফায়দা দেবে। ভোটে যেহেতু জয়ী হওয়া যাবে না, সেহেতু ভোটবিহীন অবস্থাই তাদের জন্য মঙ্গলজনক। সে কারণেই তারা গণতন্ত্রের সঠিক চর্চার পথ ও পরিবেশ নষ্ট করছে। গণতান্ত্রিক দলসমূহ, বিশেষত নিয়মতান্ত্রিক-গণতন্ত্রমনা-জনপ্রিয়-মূলধারারা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের ধোয়াশা তৈরি করছে। বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার মানুষ সবাই সবাইকে চেনে-জানে; কে কি, সেটাও কারো কাছে অজানা নয়। অতএব অপশক্তির কুপ্রচারণায় সাময়িক জলঘোলা সৃষ্টি হলেও হতে পারে; সত্য মিথ্যায়, মিথ্যা সত্যে পরিণত হবে না।
প্রশ্ন হলো, ষড়যন্ত্রকারীদের সৃষ্ট জঙ্গি বিষয়ক জটিলতায় গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কি লাভ হবে? কারণ বাংলাদেশে বিশ্বস্বীকৃত ও জনসমর্থিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি কাজ তাদের সামনে রয়েছে। গণতন্ত্রকে সঠিক লাইনে আনায় কৃতিত্ব কি তাদের জন্য ভালো? নাকি গণতন্ত্রের লাইনচ্যুত অবস্থায় হটকারিদের মিথ্যাচার, মাতামাতি আর জঙ্গিতত্ত্বের কাল্পনিক আতঙ্কে দিশেহারা হওয়ার মাধ্যমে অতীতের মতো আবারো কোনো একদলীয়-স্বৈরতান্ত্রিক গহ্বরে হারানোর মধ্যে ফায়দা?
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী, গণতান্ত্রিক দলকে ঠান্ডা মাথায় ও সুবিবেচনার সঙ্গে এসব প্রশ্নে উত্তর নির্ধারণ করতে হবে। গণতন্ত্রের শত্রু-মিত্র চিহ্নিত করতে হবে এবং বন্ধু বেশে শত্রুদের ব্যাপারে সদা-সতর্ক হতে হবে। অন্য কারো মনে না থাকলেও তো আওয়ামী লীগের এটা মনে থাকার কথা যে, পনের আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটেছিল ঘরের শত্রু বিভীষণের দ্বারা। অতীতে ‘নকশাল এলো’ ‘নকশাল এলো’র মতো এখন এসব ঘরের শত্রুগণ মিথ্যাবাদী রাখালের মতো ‘জঙ্গি এলো’ ‘জঙ্গি এলো’ বলে জটিলতা ও কাল্পনিক আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে তলে তলে কোন বিপদ ডেকে আনছে? অতএব, সাধু সাবধান!
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন