এখন চার দিকে চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘নিজের ঢোল নিজে পেটানো’র একধরনের মহোৎসব। সরকার সমর্থক মুদ্রণ গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সেই মহোৎসবে যোগ দিয়েছে মহাসমারোহে। এর ওপর সরকারি টেলিভিশন তো যথারীতি আছেই। এরপরও প্রচার-প্রচারণার পরিধি ও তীব্রতা বাড়ানোর জন্য সরকারদলীয় চেষ্টাসাধ্যিরও কমতি নেই। প্রতিটি অফিস-আদালতের সীমানা-দেয়ালের পাশ ঘেঁষে স্থায়ীভাবে টানানো আছে উন্নয়নের ফিরিস্তির শত শত বিলবোর্ড। অতিসম্প্রতি রাজধানীজুড়ে উঠেছে শত শত নতুন দর্শনীয় বিলবোর্ড। সর্বশেষ চটকদার এসব বিলবোর্ড রাজধানীর সড়কের দু’পাশে শোভা পাচ্ছে ঢাকার দুই নতুন মেয়রের উদ্যোগসূত্রে। এসব বিলবোর্ডে উন্নয়নের যেসব ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, তা দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। অচিরেই বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মসূচি নেয়ার মতো কোনো স্থান-খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সম্ভবত সরকারের এক মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, আর কয় বছর পর বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সর্বশেষ আদমশুমারি ২০১১ এবং খানার আয়-ব্যয় নির্ধারণ জরিপ ২০১০ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সবচেয়ে বেশি গরিব কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। এ জেলার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই গরিব শ্রেণীর। বরিশাল ছাড়া বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এসব অঞ্চলে প্রাথমিক স্কুল শেষ করা শিশুদের সংখ্যাও কম। আগামী কয় বছরের মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের কোন জাদুর কাঠি সরকারের হাতে আছে, তা জানি না।
এ সরকার বেশ বড়গলায় প্রচার করে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয় বছর আগেই দাবি করেছেন, দেশের মানুষ এখন দিনে তিন বেলা নয়, পাঁচ বেলা খায়। সর্বসাম্প্রতিক বিশ্ব খাদ্য দিবসের আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, দেশে এখন ভাত পেতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য গত শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। একই দিনে ওই দৈনিকটি সাংবাদিক মশিউল আলমের উন্নয়নবিষয়ক একটি লেখা সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ করে। লেখাটির শিরোনাম : ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ ও ভাত খাওয়ার গল্প। এ লেখার শুরুতেই লেখক পঞ্চগড় শহরের একটি খাবার হোটেলের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এভাবে : ‘পঞ্চগড় শহরের এক খাবার হেটেলে সাতসকালে দেখেছিলাম লোকজন ভাত খাচ্ছে। সাদা ভাত, নুন আর একটুখানি সবজি কিংবা মুগডাল। সবজি ও মুগডালের পরিমাণ এতই কম যে, তা দিয়ে একথালা ভাত খাওয়া যায় না।... এখানে ১০ জন যদি ভাত খেতে আসে, তাদের পাঁচ বা ছয়জন ভাত খায়। অন্যরা রুটি পরোটা।’ তার পুরো লেখায় এখানে ভাত খেতে আসা শ্রমজীবী মানুষের ভাত খাওয়ার করুণ চিত্রটিই ফুটে উঠেছে, যা একই সাথে কৃষিমন্ত্রীর ‘দেশে এখন আর ভাত পেতে বেশি কষ্ট হয় না’ বক্তব্যের অসারতাই প্রমাণ করে। স্থানাভাবে এর বিস্তারিতে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে বলা দরকার, এই লেখক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন : ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশের জোগান আসে ভাত ও আলুজাতীয় খাবার থেকে। এটি দরিদ্র মানুষের খাবার; পুষ্টির অভাবে ভোগে প্রধানত এরাই। তাহলে ধরে নিতে হয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অপুষ্টি দূর করতে কাজে আসছে না। অপুষ্টি দূর করতে হলে তাদের খাবারের তালিকায় মাছ, গোশত, দুধ, ডিম ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার যোগ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কে করবে?’
প্রশ্নটা আমারও। যারা লোক-দেখানো উন্নয়নের জারি গেয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, এ ধরনের মৌল প্রশ্নের সমাধান হয় না। কারণ, তাদের উন্নয়ন-ভাবনা সংজ্ঞায়িত হয় ভিন্নভাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের উন্নয়নই এদের কাছে অগ্রাধিকার পায়। এ জন্যই এরা সীমিত গণতন্ত্রের আওতায় উন্নয়নের কথা বলে। উন্নয়ন প্রশ্নে জনপুষ্টি নিশ্চিত করার কথা এদের কাছে সেকেন্ডারি প্রশ্ন। মশিউল আলমের লেখায় উল্লেখ আছে, উল্লিখিত খাবার হোটেলে আসা একজন এই লেখককে জানিয়েছেন, তিনি গত বছরের কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবার আশায় ছিলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোরবানির ঈদে আবার গরুর গোশতের স্বাদ নেয়ার। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা কমেনি। পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০-৯২ সময়ে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৬০ লাখ। ২০০০-০২ সময়ে তা কমে দাঁড়ায় দুই কোটি ৭৭ লাখ, ২০০৫-০৭ তা আরো কমে হয় দুই কোটি ৪৩ লাখ। কিন্তু ২০১০-১২ সময়ে তা আবার বেড়ে হয় দুই কোটি ৬৫ লাখ। এই হচ্ছে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার নমুনা।
আসলে আমাদের সরকার যদি সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে তা উপলব্ধিতে রাখত, তবে বুঝত একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলাই হচ্ছে প্রকৃত দেশোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ জন্য প্রয়োজন যাবতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে দেশে সব মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার জোগানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্মের জন্য সুশিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, ধনী-গরিব সবার জন্য সুলভ ও সিন্ডিকেটমুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, মানুষের কর্মসংস্থানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে মানুষের ভাতকাপড় নিশ্চিত করা, দেশকে বিদ্যমান অসহিষ্ণু রাজনীতি থেকে বের করে আনা, দুর্নীতির অবসান ঘটানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বহু মত-পথের সম্মিলন ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সূচনা করা, যাবতীয় দলীয় গোঁয়ার্তুমির অবসান, দেশকে বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা ও মূল্যবোধ প্রশ্নে আপসহীন থাকা, দেশে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের মন পাঠ করে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত নেয়া এবং এমনই ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, ভিন্ন কোনো পথে নয়। তা না করে আমাদের সরকার হাঁটছে ভিন্ন পথে।
এরা কোনো রাখঢাক না করেই বলছেন, গণতন্ত্র নাই বা থাকল, উন্নয়ন হলেই হলো। আবার এদেরই কেউ কেউ বলছেন, এখন থেকে দেশে চলবে সীমিত গণতন্ত্র। আর এর মধ্য দিয়েই এরা দেশকে উন্নয়নের চরমে নিয়ে পৌঁছাবেন। তখন দেশবাসী ভুলে যাবে সরকারবিরোধীদের। আর এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে এ সরকারের স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি। আসলে এরা মনে করছেন কয়েকটি ফাইওভার, ওভারব্রিজ, কালভার্ট, বড় কয়টি সেতু, সুদৃশ্য ভবন, সরকারি অফিস-আদালতের পুরনো দেয়াল ও ফটক ভেঙে সুদৃশ্য করে তোলা, রঙিন ফুটপাথ করে দেয়া, আর কয়েক শ’ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মাধ্যমে কয়েক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো কিংবা বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা ইত্যাদি ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে এ সরকারের উন্নয়নের চিত্রটা বেশ ভালোভাবেই জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে তোলা যাবে। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন হবে পাশাপাশি বিলবোর্ড টানানো কর্মসূচিটাও অব্যাহত রাখা।
আসলে প্রকৃত উন্নয়ন যাকে বলা হয়, তা এর মাধ্যমে হওয়ার নয়। কারণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রথম ও অবিকল্প পথ হচ্ছে, দেশে গণতন্ত্রের পথকে অবাধ করা, দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিতর্কহীন একটি সরকার কায়েম এবং যাবাতীয় সরকারি প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা। এখানে আমাদের ব্যর্থতা ষোলো আনা বলেই আমারা ছুটছি লোক-দেখানো মেকি উন্নয়নের পেছনে। আর এর মাধ্যমে কার্যত আমরা আমাদের পিছিয়ে পড়াটাকেই নিশ্চিত করছি। তথ্য পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে সে সত্যেরই প্রতিফলন মেলে। আর সরকারি বিলবোর্ডগুলোর অসারতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
সরকার দাবি করছে, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।’ ইদানীং সরকারের টানানো বিলবোর্ডে এমনটিই লেখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তখন, যখন এর পরনির্ভরশীলতা কমবে, ঋণের বোঝা লাঘব হবে এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান তা বলে না। ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্টে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে মানুষের সম্পদ বেড়েছে তিন গুণ। আর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের ঋণের বোঝাও। বর্তমানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ঋণের পরিমাণ ৬৪ ডলার। ১৫ বছর আগে তা ছিল ২৪ ডলার। যখন একটি দেশের ঋণের বোঝা বাড়ে, তখন সে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এমনটি কী করে বলা যায়? আরেকটি প্রশ্ন সহজেই তোলা যায় যে সম্পদ বেড়েছে বলে বলা হয়েছে, সে সম্পদ কাদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বা হচ্ছে। জনগণের বদ্ধমূল ধারণা, ক্ষমতাসীনেরাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি আর দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। সাধারণ মানুষ হচ্ছে সম্পদ-বঞ্চিত। এভাবে দেশে এক ধরনের সম্পদবৈষম্য গড়ে উঠেছে। এর নাম উন্নয়ন নয়। তাই দেশের ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর এ ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষকেই বয়ে বেড়াতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, তিন মাসের ব্যবধানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ৬৩৫ জন। খবর নিলে দেখা যাবে, এই নতুন কোটিপতি কারা। এরা কারা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মরহুম হাবিবুর রহমান ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলে গেছেন, দেশটা চলে গেছে বাজিকরদের হাতে। এর বাইরে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগও গণমাধ্যমসূত্রে দেশবাসী অনেক জেনেছে। এ প্রসঙ্গে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল।
পত্রিকায় দেখলাম, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বরগুনার আমতলীর পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান ৪০ কোটি টাকার সরকারি জমিতে বাড়ি ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন। এ ধরনের মতিয়ার রহমানদের সংখ্যা সরকারি দলে অগুনতি। এরাই আসলে রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছেন, এমন ধারণা সাধারণ মানুষের। তিন-চার দিন আগের ঘটনা। সাবেক এক এমপির কিশোর ভাতিজা গাড়ি চাপায় গুলশানে চারজনকে আহত করে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়েছিল। এখন সেখান থেকে এদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনার ছয় দিন পরও কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ গাড়িটি আটক করলেও ঘটনার নায়ক এই ভাতিজাকে পুলিশই নিরাপদে পৌঁছে দেয়। পত্রিকার খবরÑ এখন পুলিশের মাধ্যমে আপসরফার প্রক্রিয়া চলছে। কাছাকাছি সময়ের আরেক ঘটনা একজন ধর্ষককে জনতা হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলেও পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ এই ধর্ষক সরকারি দলের কেউ। দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। সরকারকে বুঝতে হবে, উন্নয়নের আরেক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে আইনের শাসন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আইনের শাসন বলতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর কারণে-অকারণে দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা আর ঘরবাড়িছাড়া করা। সাথে ক্রসফায়ার, গুম, অপহরণের অভিযোগও কম নয়। আসলে দেশের উন্নয়ন এ পথে নয়। এগুলা দেশকে পিছিয়ে নেয়ারই অনুষঙ্গ।
দেশের উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার উন্নয়নও অপরিহার্য। সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু সে দিকে আমাদের সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। দেশে বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন কঠোরভাবে জারি রেখে দেশকে কার্যত পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে হাজার হাজার লোক। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নে অপরিহার্য শিক্ষক নিয়োগে সরকারের আগ্রহ সে তুলনায় অনেক কম। গত পরশু একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনো অর্ধলাখ পদে শিক্ষক নেই। এ দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ তাদের কাক্সিক্ষত বিষয় ও কোর্সে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা দেশের বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে থেকে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে করে দেয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার ভিত নড়বড়ে করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের মারামারি ও প্রকাশ্য অস্ত্রমহড়া এবং সরকার সমর্থক শিক্ষকদের দলাদলির জের ধরেই বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। এসবের সচিত্র প্রতিবেদন জড়িতদের নাম-ঠিকানা ভাঙিয়ে গণমাধ্যমে ছাপা হলেও প্রতিকার নেই। এসব জিইয়ে দেশোন্নয়নের চিন্তা চরম বোকামি বৈ কিছু নয়।
আমরা আজ বড়গলায় দাবি করছি : ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল’। রোল মডেল কথাটি ১৯৫৫-১৯৬০ সময় পরিধিতে মূলত ব্যক্তি প্রশ্নেই সূচিত। আর তাই রোল মডেলের সংজ্ঞাটি দেয়া হয় এভাবে : Role model is a person whose behavior, example, or success is or can be emulated by others, especially by younger people- Dictionary.com. এর অর্থ সরল। আমরা সেই ব্যক্তিকেই রোল মডেল বিবেচনা করব যার আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য হবে অন্যদের কাছে, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে অনুসরণীয়, তার সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রয়াসে। এখানে ব্যক্তি বা পারসন শব্দটির জায়গায় একটি দেশের কথা বিবেচনা করলে বলতে হয়, একটি দেশ রোল মডেল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে তখন, যখন এই দেশটির তথা দেশটি সরকারের আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য অনুসরণ করে অন্য দেশগুলো এই দেশটির সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের বাংলাদেশ কি সেই অনুসরণীয় আচরণ, উদাহরণ ও সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? স্বভাবতই প্রশ্ন আসে অন্যান্য দেশ আমাদের কী উদাহরণ অনুসরণ করবে? এরা কি আমাদের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা পার্লামেন্ট নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করবে, যেখানে অর্ধেকরও বেশি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন, নির্বাচনের আগেই নির্ধারিত হয়ে যাবে কোন দল ক্ষমতায় যাবে; এমন ব্যবস্থা কায়েম করবে, যেখানে দেশে দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন বর্জন করতে হবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো অদ্ভুতুড়ে গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টি করবে, যেটি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে, সরকারের কথায় উঠবে, বসবে? এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজির পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে? তাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য আমদানি করবে? ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রমহড়া চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দলীয় স্বার্থে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সংবিধানের কাটাছেঁড়ার সংস্কৃতি চালু করবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের মতো ক্রসফায়ার, গুম অপহরণের উদাহরণ সৃষ্টি করবে? এরা কি বিরোধী দল নিঃশেষ করার নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নেবে? এরা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আমাদের কাছ থেকে আমদানি করবে? এরা কি জাতীয় বিভাজনের কোনো বাংলাদেশী মডেল অনুসরণ করবে? এরা প্রশাসনকে আমাদের মতো দলীয়করণ করবে? এরা কি দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দুর্নীতির মাধ্যমে পুকুরচুরির ব্যবস্থা চালু করবে? বাংলাদেশকে রোল মডেল করে তোলার দাবিদারেরা এসব প্রশ্নের ও এমনই আরো হাজারো প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন?
সম্ভবত সরকারের এক মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, আর কয় বছর পর বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সর্বশেষ আদমশুমারি ২০১১ এবং খানার আয়-ব্যয় নির্ধারণ জরিপ ২০১০ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সবচেয়ে বেশি গরিব কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। এ জেলার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই গরিব শ্রেণীর। বরিশাল ছাড়া বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এসব অঞ্চলে প্রাথমিক স্কুল শেষ করা শিশুদের সংখ্যাও কম। আগামী কয় বছরের মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের কোন জাদুর কাঠি সরকারের হাতে আছে, তা জানি না।
এ সরকার বেশ বড়গলায় প্রচার করে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয় বছর আগেই দাবি করেছেন, দেশের মানুষ এখন দিনে তিন বেলা নয়, পাঁচ বেলা খায়। সর্বসাম্প্রতিক বিশ্ব খাদ্য দিবসের আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, দেশে এখন ভাত পেতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য গত শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। একই দিনে ওই দৈনিকটি সাংবাদিক মশিউল আলমের উন্নয়নবিষয়ক একটি লেখা সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ করে। লেখাটির শিরোনাম : ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ ও ভাত খাওয়ার গল্প। এ লেখার শুরুতেই লেখক পঞ্চগড় শহরের একটি খাবার হোটেলের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এভাবে : ‘পঞ্চগড় শহরের এক খাবার হেটেলে সাতসকালে দেখেছিলাম লোকজন ভাত খাচ্ছে। সাদা ভাত, নুন আর একটুখানি সবজি কিংবা মুগডাল। সবজি ও মুগডালের পরিমাণ এতই কম যে, তা দিয়ে একথালা ভাত খাওয়া যায় না।... এখানে ১০ জন যদি ভাত খেতে আসে, তাদের পাঁচ বা ছয়জন ভাত খায়। অন্যরা রুটি পরোটা।’ তার পুরো লেখায় এখানে ভাত খেতে আসা শ্রমজীবী মানুষের ভাত খাওয়ার করুণ চিত্রটিই ফুটে উঠেছে, যা একই সাথে কৃষিমন্ত্রীর ‘দেশে এখন আর ভাত পেতে বেশি কষ্ট হয় না’ বক্তব্যের অসারতাই প্রমাণ করে। স্থানাভাবে এর বিস্তারিতে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে বলা দরকার, এই লেখক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন : ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশের জোগান আসে ভাত ও আলুজাতীয় খাবার থেকে। এটি দরিদ্র মানুষের খাবার; পুষ্টির অভাবে ভোগে প্রধানত এরাই। তাহলে ধরে নিতে হয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অপুষ্টি দূর করতে কাজে আসছে না। অপুষ্টি দূর করতে হলে তাদের খাবারের তালিকায় মাছ, গোশত, দুধ, ডিম ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার যোগ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কে করবে?’
প্রশ্নটা আমারও। যারা লোক-দেখানো উন্নয়নের জারি গেয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, এ ধরনের মৌল প্রশ্নের সমাধান হয় না। কারণ, তাদের উন্নয়ন-ভাবনা সংজ্ঞায়িত হয় ভিন্নভাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের উন্নয়নই এদের কাছে অগ্রাধিকার পায়। এ জন্যই এরা সীমিত গণতন্ত্রের আওতায় উন্নয়নের কথা বলে। উন্নয়ন প্রশ্নে জনপুষ্টি নিশ্চিত করার কথা এদের কাছে সেকেন্ডারি প্রশ্ন। মশিউল আলমের লেখায় উল্লেখ আছে, উল্লিখিত খাবার হোটেলে আসা একজন এই লেখককে জানিয়েছেন, তিনি গত বছরের কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবার আশায় ছিলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোরবানির ঈদে আবার গরুর গোশতের স্বাদ নেয়ার। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা কমেনি। পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০-৯২ সময়ে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৬০ লাখ। ২০০০-০২ সময়ে তা কমে দাঁড়ায় দুই কোটি ৭৭ লাখ, ২০০৫-০৭ তা আরো কমে হয় দুই কোটি ৪৩ লাখ। কিন্তু ২০১০-১২ সময়ে তা আবার বেড়ে হয় দুই কোটি ৬৫ লাখ। এই হচ্ছে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার নমুনা।
আসলে আমাদের সরকার যদি সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে তা উপলব্ধিতে রাখত, তবে বুঝত একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলাই হচ্ছে প্রকৃত দেশোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ জন্য প্রয়োজন যাবতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে দেশে সব মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার জোগানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্মের জন্য সুশিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, ধনী-গরিব সবার জন্য সুলভ ও সিন্ডিকেটমুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, মানুষের কর্মসংস্থানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে মানুষের ভাতকাপড় নিশ্চিত করা, দেশকে বিদ্যমান অসহিষ্ণু রাজনীতি থেকে বের করে আনা, দুর্নীতির অবসান ঘটানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বহু মত-পথের সম্মিলন ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সূচনা করা, যাবতীয় দলীয় গোঁয়ার্তুমির অবসান, দেশকে বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা ও মূল্যবোধ প্রশ্নে আপসহীন থাকা, দেশে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের মন পাঠ করে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত নেয়া এবং এমনই ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, ভিন্ন কোনো পথে নয়। তা না করে আমাদের সরকার হাঁটছে ভিন্ন পথে।
এরা কোনো রাখঢাক না করেই বলছেন, গণতন্ত্র নাই বা থাকল, উন্নয়ন হলেই হলো। আবার এদেরই কেউ কেউ বলছেন, এখন থেকে দেশে চলবে সীমিত গণতন্ত্র। আর এর মধ্য দিয়েই এরা দেশকে উন্নয়নের চরমে নিয়ে পৌঁছাবেন। তখন দেশবাসী ভুলে যাবে সরকারবিরোধীদের। আর এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে এ সরকারের স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি। আসলে এরা মনে করছেন কয়েকটি ফাইওভার, ওভারব্রিজ, কালভার্ট, বড় কয়টি সেতু, সুদৃশ্য ভবন, সরকারি অফিস-আদালতের পুরনো দেয়াল ও ফটক ভেঙে সুদৃশ্য করে তোলা, রঙিন ফুটপাথ করে দেয়া, আর কয়েক শ’ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মাধ্যমে কয়েক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো কিংবা বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা ইত্যাদি ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে এ সরকারের উন্নয়নের চিত্রটা বেশ ভালোভাবেই জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে তোলা যাবে। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন হবে পাশাপাশি বিলবোর্ড টানানো কর্মসূচিটাও অব্যাহত রাখা।
আসলে প্রকৃত উন্নয়ন যাকে বলা হয়, তা এর মাধ্যমে হওয়ার নয়। কারণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রথম ও অবিকল্প পথ হচ্ছে, দেশে গণতন্ত্রের পথকে অবাধ করা, দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিতর্কহীন একটি সরকার কায়েম এবং যাবাতীয় সরকারি প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা। এখানে আমাদের ব্যর্থতা ষোলো আনা বলেই আমারা ছুটছি লোক-দেখানো মেকি উন্নয়নের পেছনে। আর এর মাধ্যমে কার্যত আমরা আমাদের পিছিয়ে পড়াটাকেই নিশ্চিত করছি। তথ্য পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে সে সত্যেরই প্রতিফলন মেলে। আর সরকারি বিলবোর্ডগুলোর অসারতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
সরকার দাবি করছে, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।’ ইদানীং সরকারের টানানো বিলবোর্ডে এমনটিই লেখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তখন, যখন এর পরনির্ভরশীলতা কমবে, ঋণের বোঝা লাঘব হবে এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান তা বলে না। ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্টে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে মানুষের সম্পদ বেড়েছে তিন গুণ। আর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের ঋণের বোঝাও। বর্তমানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ঋণের পরিমাণ ৬৪ ডলার। ১৫ বছর আগে তা ছিল ২৪ ডলার। যখন একটি দেশের ঋণের বোঝা বাড়ে, তখন সে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এমনটি কী করে বলা যায়? আরেকটি প্রশ্ন সহজেই তোলা যায় যে সম্পদ বেড়েছে বলে বলা হয়েছে, সে সম্পদ কাদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বা হচ্ছে। জনগণের বদ্ধমূল ধারণা, ক্ষমতাসীনেরাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি আর দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। সাধারণ মানুষ হচ্ছে সম্পদ-বঞ্চিত। এভাবে দেশে এক ধরনের সম্পদবৈষম্য গড়ে উঠেছে। এর নাম উন্নয়ন নয়। তাই দেশের ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর এ ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষকেই বয়ে বেড়াতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, তিন মাসের ব্যবধানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ৬৩৫ জন। খবর নিলে দেখা যাবে, এই নতুন কোটিপতি কারা। এরা কারা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মরহুম হাবিবুর রহমান ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলে গেছেন, দেশটা চলে গেছে বাজিকরদের হাতে। এর বাইরে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগও গণমাধ্যমসূত্রে দেশবাসী অনেক জেনেছে। এ প্রসঙ্গে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল।
পত্রিকায় দেখলাম, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বরগুনার আমতলীর পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান ৪০ কোটি টাকার সরকারি জমিতে বাড়ি ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন। এ ধরনের মতিয়ার রহমানদের সংখ্যা সরকারি দলে অগুনতি। এরাই আসলে রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছেন, এমন ধারণা সাধারণ মানুষের। তিন-চার দিন আগের ঘটনা। সাবেক এক এমপির কিশোর ভাতিজা গাড়ি চাপায় গুলশানে চারজনকে আহত করে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়েছিল। এখন সেখান থেকে এদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনার ছয় দিন পরও কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ গাড়িটি আটক করলেও ঘটনার নায়ক এই ভাতিজাকে পুলিশই নিরাপদে পৌঁছে দেয়। পত্রিকার খবরÑ এখন পুলিশের মাধ্যমে আপসরফার প্রক্রিয়া চলছে। কাছাকাছি সময়ের আরেক ঘটনা একজন ধর্ষককে জনতা হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলেও পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ এই ধর্ষক সরকারি দলের কেউ। দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। সরকারকে বুঝতে হবে, উন্নয়নের আরেক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে আইনের শাসন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আইনের শাসন বলতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর কারণে-অকারণে দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা আর ঘরবাড়িছাড়া করা। সাথে ক্রসফায়ার, গুম, অপহরণের অভিযোগও কম নয়। আসলে দেশের উন্নয়ন এ পথে নয়। এগুলা দেশকে পিছিয়ে নেয়ারই অনুষঙ্গ।
দেশের উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার উন্নয়নও অপরিহার্য। সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু সে দিকে আমাদের সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। দেশে বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন কঠোরভাবে জারি রেখে দেশকে কার্যত পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে হাজার হাজার লোক। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নে অপরিহার্য শিক্ষক নিয়োগে সরকারের আগ্রহ সে তুলনায় অনেক কম। গত পরশু একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনো অর্ধলাখ পদে শিক্ষক নেই। এ দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ তাদের কাক্সিক্ষত বিষয় ও কোর্সে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা দেশের বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে থেকে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে করে দেয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার ভিত নড়বড়ে করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের মারামারি ও প্রকাশ্য অস্ত্রমহড়া এবং সরকার সমর্থক শিক্ষকদের দলাদলির জের ধরেই বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। এসবের সচিত্র প্রতিবেদন জড়িতদের নাম-ঠিকানা ভাঙিয়ে গণমাধ্যমে ছাপা হলেও প্রতিকার নেই। এসব জিইয়ে দেশোন্নয়নের চিন্তা চরম বোকামি বৈ কিছু নয়।
আমরা আজ বড়গলায় দাবি করছি : ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল’। রোল মডেল কথাটি ১৯৫৫-১৯৬০ সময় পরিধিতে মূলত ব্যক্তি প্রশ্নেই সূচিত। আর তাই রোল মডেলের সংজ্ঞাটি দেয়া হয় এভাবে : Role model is a person whose behavior, example, or success is or can be emulated by others, especially by younger people- Dictionary.com. এর অর্থ সরল। আমরা সেই ব্যক্তিকেই রোল মডেল বিবেচনা করব যার আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য হবে অন্যদের কাছে, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে অনুসরণীয়, তার সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রয়াসে। এখানে ব্যক্তি বা পারসন শব্দটির জায়গায় একটি দেশের কথা বিবেচনা করলে বলতে হয়, একটি দেশ রোল মডেল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে তখন, যখন এই দেশটির তথা দেশটি সরকারের আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য অনুসরণ করে অন্য দেশগুলো এই দেশটির সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের বাংলাদেশ কি সেই অনুসরণীয় আচরণ, উদাহরণ ও সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? স্বভাবতই প্রশ্ন আসে অন্যান্য দেশ আমাদের কী উদাহরণ অনুসরণ করবে? এরা কি আমাদের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা পার্লামেন্ট নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করবে, যেখানে অর্ধেকরও বেশি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন, নির্বাচনের আগেই নির্ধারিত হয়ে যাবে কোন দল ক্ষমতায় যাবে; এমন ব্যবস্থা কায়েম করবে, যেখানে দেশে দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন বর্জন করতে হবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো অদ্ভুতুড়ে গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টি করবে, যেটি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে, সরকারের কথায় উঠবে, বসবে? এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজির পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে? তাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য আমদানি করবে? ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রমহড়া চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দলীয় স্বার্থে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সংবিধানের কাটাছেঁড়ার সংস্কৃতি চালু করবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের মতো ক্রসফায়ার, গুম অপহরণের উদাহরণ সৃষ্টি করবে? এরা কি বিরোধী দল নিঃশেষ করার নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নেবে? এরা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আমাদের কাছ থেকে আমদানি করবে? এরা কি জাতীয় বিভাজনের কোনো বাংলাদেশী মডেল অনুসরণ করবে? এরা প্রশাসনকে আমাদের মতো দলীয়করণ করবে? এরা কি দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দুর্নীতির মাধ্যমে পুকুরচুরির ব্যবস্থা চালু করবে? বাংলাদেশকে রোল মডেল করে তোলার দাবিদারেরা এসব প্রশ্নের ও এমনই আরো হাজারো প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন?
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন