শুক্রবার, ২ অক্টোবর, ২০১৫

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা


ইতালীয় নাগরিক তাবেলা সিসারের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আবারও প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অশুভ রাজনীতি শুরু হয়েছে। এই কর্মকাণ্ডে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অংশ নিয়েছেন। নিউইয়র্কে তিনি বলেছেন, বিএনপি নেতা ড. আবদুল মঈন খানকে জিজ্ঞাসা করলেই নাকি হত্যা সম্পর্কে সবকিছু জানা যাবে! মঈন খানের ব্যাপারে দেশে ফিরে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানিয়ে রেখেছেন তিনি। এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা মাত্র এবং ক্ষমতাসীনরা এ কাজটি অনেক উপলক্ষেই করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় ও সুশাসনে ব্যর্থ হলে এবং হত্যাকাণ্ডের মতো কোনো কিছু ঘটলেই তারা সব দোষ প্রতিপক্ষের ওপর চাপানোর এবং নিজেরা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। ইতালীয় নাগরিকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান নিয়েছেন তারা। অথচ বিদেশীদের শুধু নয়, কারো হত্যাকাণ্ডেরই দায় এড়াতে পারে না সরকার। জঙ্গিবাদ নিয়ে মন্ত্রীদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের উল্লেখ করে মির্জা আলমগীর বলেছেন, কেউ বলছেন দেশে জঙ্গিবাদ আছে আবার কেউ বলছেন জঙ্গিবাদ নেই। এ ধরনের বক্তব্য ও অবস্থানের কারণেই আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। বিদেশীরা পর্যন্ত নিহত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতির জন্য সরকারকে দায়ী করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, সবকিছুর পেছনে রয়েছে সুশাসন ও গণতন্ত্রের অভাব। এজন্য গণতন্ত্রের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মির্জা আলমগীর প্রসঙ্গক্রমে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা পরিত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে সরকারের উদ্দেশে বলেছেন, ইতালীয় নাগরিকের হত্যাকারীদের অবশ্যই গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তি দিতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে।
আমরা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করি। কারণ, অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কিছু ঘটলেই ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার পাশাপাশি প্রতিপক্ষের, বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন। উদাহরণ দেয়ার জন্য ২০১২ সালের ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর পাবর্ত্য চট্টগ্রামের রামুতে সংঘটিত ধ্বংসাত্মক ঘটনাপ্রবাহের কথা স্মরণ করা যায়। সেবার উত্তম কুমার নামের এক বৌদ্ধ যুবককে দিয়ে ইসলাম বিরোধী চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ উস্কানি দেয়া হয়েছিল। এরই সূত্র ধরে ওই অঞ্চলে সহিংসতা ঘটেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা বিএনপি-জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করে বসেছিলেন। ঘটনাক্রমে সে সময়ও প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের অধিবেশন উপলক্ষে নিউইয়র্কেই অবস্থান করছিলেন! কোনো রকম তদন্ত বা অনুসন্ধানের অপেক্ষা না করে কক্সবাজারের সহিংসতার জন্য তিনি বিএনপির এমপিসহ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দায়ী করেছিলেন। এর ফলে অপরাধী সন্ত্রাসীরা তো পার পেয়ে গেছেই, একযোগে দুর্নামের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশও। তাদের কৌশল অবশ্য ধরা পড়ে গিয়েছিল। ক’দিন পর, ১২ অক্টোবর চট্টগ্রামে জাতীয় হিন্দু মহাজোটের নেতারা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনরাই সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে প্রত্যক্ষভাবে মদদ দিয়েছেন।
বস্তুত পরবর্তীকালের অনুসন্ধান এবং তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণেও পরিষ্কার হয়েছিল, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নির্যাতন চালানোর মাধ্যমে ‘সংখ্যালঘুদের’ বিতাড়িত করার পদক্ষেপ আসলে আওয়ামী লীগের লোকজনই নিয়েছিল। এ সত্য জানাজানি হতেও সময় লাগেনি যে, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ও হানাহানিকে আওয়ামী লীগ সব সময় রাজনীতির ‘কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। বোঝাতে চায়, ইসলামী দলগুলো তো বটেই, বিএনপির মতো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী দলও সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে! অন্যদিকে ইতিহাস কিন্তু এই দাবিকে অসত্য প্রমাণ করেছে। দেখা গেছে, বিএনপির কোনো আমলে তো বটেই, বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলেও ‘সংখ্যালঘুদের’ ওপর কোনো ধরনের নির্যাতন চালানো হয়নি। বাস্তবে ‘সংখ্যালঘুদের’ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তরিকতাও কেবল বিএনপি-জামায়াত জোটেরই রয়েছে।
রামুসহ কক্সবাজারের এ অভিজ্ঞতার আলোকেই বিএনপি নেতা ড. মঈন খান হয়তো ইতালীয় নাগরিক হত্যার বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকবেন। কারণ পুলিশ, প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা প্রমাণ করেছে, দূরপ্রসারী উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্য নিয়েই পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই সহিংসতা ঘটানো হয়েছিল। স্মরণ করা দরকার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন ‘ঘটনাক্রমে’ (?) সেদিনই রামুতে সহিংসতা শুরু হয়েছিল। ২৮ সেপ্টেম্বরের ওই ভাষণে ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপি-জামাযাতের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মদতে ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে নাকি জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিস্তার ঘটেছিল! তার সরকারই যে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করেছে সে তথ্যটিও প্রধানমন্ত্রী গলা উঁচিয়েই জানান দিয়েছিলেন। ভাষণটির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শুধু তার নিজের দেশকেই ছোট করেননি, একথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশে কথিত ইসলামী জঙ্গিদের অস্তিত্ব ও তৎপরতা রয়েছে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকলেই বাংলাদেশের কথিত ইসলামী জঙ্গিদের দমন ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এজন্যই তাকে বারবার ক্ষমতায় আনা দরকার এবং এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত তার পক্ষে ভূমিকা পালন করা! মাত্র বছর তিনেক আগের এ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান পর্যায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টার অভিযোগ এনেছেন। আমরা মনে করি না যে, এই অভিযোগের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ রয়েছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads