বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৫

দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রসঙ্গে


সরকার হঠাৎ করেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেয়া এ সিদ্ধান্তের মূলকথা হলো, সকল সিটি করপোরেশন এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন হবে দলীয় ভিত্তিতে। প্রার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে এবং দলীয় মনোনয়ন ছাড়া কেউই প্রার্থী হতে পারবেন না। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোকেও আগে থেকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত থাকতে হবে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় সরকার সংক্রান্ত সকল আইন সংশোধন করা হবে। ওদিকে মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরদিনই একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দলীয় ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারের সিদ্ধান্তটি স্বাভাবিক কারণেই সকল মহলে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তটিকে ‘মহা দুরভিসন্ধিমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন অভিযোগ করেছেন, বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতি ও নির্বাচনের বাইরে রাখার উদ্দেশ্যেই দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্ষমতাসীনরা। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানও একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, দলবাজি ষোলকলায় পরিপূর্ণ করে বাকশাল কায়েমের নীলনকশা থেকেই সিদ্ধান্তটি নেয়া হয়েছে। সুশীল সমাজের পাশাপাশি দেশের বিশিষ্টজনেরাও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ বলেছেন, দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের উদ্দেশ্য সরকারের গোপন নীলনকশা বাস্তবায়ন করা। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করা হলে প্রতিক্রিয়া গ্রামাঞ্চলের শান্তিপূর্ণ নির্বাচন বিঘিœত ও বিনষ্ট হবে। সংঘাত ও হানাহানি ছড়িয়ে পড়বে আর এটাই সরকারের উদ্দেশ্য। প্রফেসর এমাজউদ্দিন আরো বলেছেন, এই সরকারের আমলে আমরা গণতন্ত্র, সুশাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাবোধ হারিয়েছি। আর কিছু হারাতে চাই না। এবার সময় এসেছে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন প্রশ্নে গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ বলেছেন, সিদ্ধান্তটি কার্যকর হলে সেটা হবে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকের শামিল। অন্যদিকে সরকারের বিভিন্ন যুক্তিকে খোড়া, অসার ও অযৌক্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, নামে নির্দলীয় হলেও বিদ্যমান স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একটি দৃঢ় রাজনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন করা হলে শৃংখলা তো প্রতিষ্ঠিত হবেই না, উল্টো রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন বাণিজ্য আরো রমরমা হবে। সুতরাং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে নতুন করে রাজনৈতিক চাদরে ঢেকে ফেলার দরকার নেই।
এভাবেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নেয়া সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন সকল মহল। এমন প্রতিক্রিয়াই অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ, বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। এর ফলে কোনো দলের পক্ষেই সরাসরি এমন দাবি করা সম্ভব হয়নি যে, দলটির এতজন মেয়র বা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তটি আইনে পরিণত হলে এবং সে অনুযায়ী সত্যি দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজিত হলে দলগত পরিচিতি দেয়াটা সহজ হয়ে উঠবে। পর্যবেক্ষকদের মতে এখানেই রয়েছে সরকারের আসল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে এখন এমনকি শিশু-কিশোরদেরকেও বুঝিয়ে বলতে হয় না। ধরেই নেয়া হয় যে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত দলগুলোকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না। কোথাও দেয়া হলেও তাদের বিজয় ছিনতাই করা হবে নয়তো কিছুদিনের ব্যবধানে নির্বাচিতদের বরখাস্ত করবে সরকারÑ যেমনটি বিগত মাসগুলোতে দেখা গেছে। সরকারবিরোধী মেয়র ও চেয়ারম্যানদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে বরখাস্ত করেছে সরকার। প্রতিটি এলাকায় তাদের স্থলে আওয়ামী লীগের লোকজনকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, ক্ষমতাসীনরা এখন আর কোনো বাঁকা পথে হাঁটতে চাচ্ছেন না। সবকিছু তারা ‘আইনসম্মতভাবে’ করতে চাচ্ছেন বলেই এসেছে নতুন সিদ্ধান্ত। অথচ এ ধরনের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা ও বিতর্ক করা এবং সবশেষে সংসদের মাধ্যমে আইনে পরিণত করা দরকার। এটাই সংবিধানের নির্দেশনা। অন্যদিকে সংসদে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সংসদকে পাশ কাটিয়ে আইনটি সরাসরি ওপর থেকে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। সংশয়ের সৃষ্টিও হয়েছে একই কারণে। আবারও আলোচনায় এসে গেছে বাকশাল। বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকেই শুধু অভিযোগ ওঠেনি, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন, প্রশ্নসাপেক্ষ আইনের আড়াল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসলে তার মরহুম পিতার পথেই পা বাড়াতে চাচ্ছেন। নির্বাচনের নামে এমন অবস্থা সৃষ্টি করাই তার লক্ষ্য, যখন ইউনয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে কেবল আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচিত’ প্রতিনিধিরাই থাকবেন। বিশ্ববাসীকেও বোঝানে যাবে, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলেরই জনসমর্থন নেই। তেমন পরিস্থিতিতে অঘোষিতভাবে হলেও বাকশালের মতো একদলীয় স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আমরা কিন্তু বিষয়টিকে এত সহজ মনে করি না। ক্ষমতাসীনদের উচিত কল্পনার স্বর্গ থেকে নেমে আসা এবং দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি বাতিল করা। কারণ, বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক মারার চেষ্টা জনগণ কিছুতেই মেনে নেবে না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads