আমেরিকা থেকে ড. আলী রিয়াজ লিখেছেন যে, ভারত কর্তৃক নেপাল অবরোধ নিয়ে পাশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে যত আলোচনা হওয়ার এবং মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার কথা ছিল ততখানি আলোচনা হয়নি এবং ততখানি মিডিয়া কাভারেজ পায়নি। ড. আলী রিয়াজ সঠিক কথাই বলেছেন। প্রিন্ট মিডিয়াতে তাও কিছুটা আলোচনা হয়েছে এবং কিছুটা কাভারেজ পেয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে গেলে এ সম্পর্কে মোটামুটি নীরব থেকেছে। ব্যাপারটি একদিকে যেমন দুঃখজনক অন্যদিকে তেমনি রহস্যময়। নেপাল তার নিজস্ব সংবিধান রচনা করেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সেটি অনুমোদন করেছে। ভাল হোক খারাপ হোক, এটি তো তাদের সংবিধান। তারা নিজেরা সংবিধান বানিয়েছেন এবং সেই সংবিধান মোতাবেকই ভবিষ্যতে দেশ চালাবেন। এতে অন্য কারোর কিছু বলার কথা নয়। আমার মুরগি আমি আগায় জবাই করবো নাকি পেছনে জবাই করবো সেটি একান্তই আমার বিষয়। কিন্তু সেখানেও ভারত নাক গলিয়েছে। সংবিধান পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। তার আগেই নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে কয়েক দফা দৌড় ঝাঁপ করেছেন ভারতের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
অথচ গত ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে নেপালে চলছে এক ধরনের অবরোধ। নেপালের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে এই অবরোধ আরোপিত হলেও ২ কোটি ৭৮ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত নেপালের সবাই কম বেশি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব রিপোর্ট আসছে সেসব রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটিতে খাদ্য এবং জ্বালানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মানবতাবাদী সেবা সংস্থাগুলো বলছে যে সেই দেশে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। এই বিপর্যয়ের কথা আমরা খুব ভাল করে জানি না। কেন জানি না? কারণ আমাদের মিডিয়া তাদের দুঃখ দুর্দশার পূর্ণ চিত্র তুলো ধরছে না। কেন তুলে ধরছে না? কারণ নেপালী জনগণের দুর্দশার মূলে রয়েছে ভারত। যেভাবে নেপালের সংবিধান পাশ হয়েছে এবং যেভাবে সেটি চালু হয়েছে সেটি ভারতের মোটেই মনঃপূত হয়নি। সংবিধানের অন্তত ৭ টি জায়গা ভারত সংশোধন করতে বলেছিল। কিন্তু নেপালী পার্লামেন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ভারতের আপত্তি বা সুপারিশ আমলে নেয়নি। সুতরাং ভারত ক্ষেপে গিয়েছে। ক্ষেপে উঠে তারা নেপালের ওপর অবরোধ বসিয়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি অবরোধ।
নেপালে যে সংবিধান চালু হয়েছে সেটির কাঠামো হলো ফেডারেল। দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারত পছন্দ করেনি। দ্বিতীয়ত সংবিধানটি গণতান্ত্রিক। ভারত প্রথম থেকেই নেপালের গণতন্ত্রায়ন চায়নি। কারণ, নিখাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আধিপত্যবাদী শক্তি সেই গণতান্ত্রিক দেশটির ওপর প্রভুত্বের ছড়ি ঘুরাতে পারে না। সে কারণেই নেপালে একটি লিখিত গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু হোক, সেটি ভারত চায়নি। সেই সংবিধানের ভিত্তিতে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটাও চায়নি। তাই ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেপালে যখন সংবিধান চালু হলো এবং সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন ভারত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত সেখানে তেল সরবরাহ গত মাসে বন্ধ করে দেয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নেপাল গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের তেল-রাজনীতির হাতে বন্দী হয়ে আছে। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনই একমাত্র কোম্পানি যা নেপালের তেলের চাহিদা মেটাতো। জ্বালানি খাতে ভারতীয় কোম্পানিটির একতরফা দখলদারিত্বকে পুঁজি করে নেপালের রাজনীতিতে ভারত বিভিন্ন সময় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছিল। সবশেষে গত মাসে দেশটির নতুন লিখিত সংবিধান ভারতের পছন্দমত না হওয়ায় তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন। এতে নজিরবিহীন সংকটে পড়ে নেপালের অর্থনীতি। এর জের ধরেই তেলের বিকল্প সরবরাহের দিকে ঝুঁকে পড়ে নেপাল।
॥দুই॥
গত মাসে ভারত তেল সরবরাহ বন্ধের পরপরই সংকটে নিপতিত নেপালকে প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহের প্রস্তাব দেয় চীন। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে চীন থেকে তেল আমদানির চুক্তি করেছে নেপাল। এর একটি সুফল এই যে, নেপাল ভারতের আধিপত্যবাদী খপ্পর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার রাস্তা বের করেছে। এটি তার জন্য বলতে গেলে ছিলো একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, পৃথিবীতে নেপালই একমাত্র দেশ যেটি অফিসিয়ালি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত। অন্যদিকে পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ যার ১৩০ কোটি অধিবাসীর মধ্যে ১১২ কোটি হিন্দু। দ্বিতীয়ত নেপাল সম্পূর্ণভাবে স্থল পরিবেষ্টিত একটি দেশ যার চার ধারের কোথাও কোনো পানি বা সমুদ্র নেই। ভারত এতদিন নেপালের ওপর খবরদারি করে এসেছে। এখন সেটিরও অবসান হতে চলেছে। ভারতের দাদাগিরি আচরণের ফলে কোনো প্রতিবেশীর সাথেই তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারতের নিকট থেকে নেপালের শুধুমাত্র তেল আমদানিই বন্ধ হয়নি, নেপালে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতিও এখন আর নেপালে হামলা করতে পারছে না। কারণ, নেপালে সমস্ত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে।
ছোট্ট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ। আয়তন মাত্র ১১৫ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা মাত্র ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার। সেই দেশটিও ভারতকে তার আধিপত্যবাদী আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। অপর দ্বীপ দেশ সিংহল বা শ্রীলঙ্কা। আয়তন ২৫ হাজার ৩২০ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ২ কোটি ২৮ লক্ষ। এমন ছোট রাষ্ট্রও ভারতের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তান তো ভারতের চির বৈরী রাষ্ট্র হিসেবেই বিশ্ব মিডিয়ায় পরিচিত।
॥তিন॥
একটি দেশে যদি স্থায়ী সংবিধান না থাকে এবং সেই সুবাদে যদি সাংবিধানিক সরকার না থাকে তাহলে সেই দেশটির স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দেশটির স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়। এই রকম ঘটনা আমরা দেখেছি পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। সংযুক্ত পাকিস্তান ছিল একটি বড় দেশ। আয়তন বেশি (৩ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৮৫ বর্গ মাইল), জনসংখ্যাও হতো অনেক (৩৬ কোটি ৮০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫৯২)। কিন্তু তেমন একটি বড় দেশ ভেঙ্গে গেল শুধুমাত্র গণতন্ত্রের অভাব, বছরের পর বছর ধরে স্বৈরাচারী শাসন এবং সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের কারণে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই বিশাল ও বহু বর্ণ ও বহু জাতি বিশিষ্ট ভারতে স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান চালু হয়। অথচ ভারতের চেয়ে আয়তনে চার ভাগের এক ভাগ পাকিস্তানে সংবিধান চালু হয় স্বাধীনতার ৯ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। ভারতের স্বাধীনতার পর ৬৮ বছর গত হয়েছে। এই ৬৮ বছরে একবারও ভারতের সংবিধান এবং সাংবিধানিক সরকার হোঁচট খায়নি। অথচ পাকিস্তানে সংবিধান টিকেছিল মাত্র ১ বছর ৭ মাস। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সেনা প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৬ সালের বহু দলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। ১০ বছর জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে রাখেন। এসব ইতিহাস এবং পরবর্তী ইতিহাস আপনারা সকলেই জানেন। ক্ষমতা লিপ্সা, পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা এবং সাংবিধানিক সরকারের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কারণেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়।
॥চার॥
নেপালেও সংবিধান নিয়ে অনেক কাটা ছেঁড়া এবং এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার দেব মুখার্জী একটি লেখায় বলেছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে নেপালে ছয়টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রণয়ন করেছে রানা বা রাজদরবার। রানাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন শেষ হওয়ার পর নেপালের রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজা মহেন্দ্র সেই বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন, তিনি সরকার ভেঙে দিয়ে ১৯৬২ সালে একটি সংবিধান চাপিয়ে দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নিজের একক কর্তৃত্বে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ গঠন করেন। তারপর ১৯৯০ সালের সংবিধান পেতে নেপালি কংগ্রেসকে প্রায় ৩০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন করতে হয়েছে। সেই সংবিধান আসলে রাজ দরবার ও রাজনৈতিক দলের আপস রফার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল। ওই সংবিধান নেপালকে পঞ্চায়েত-রাজের হাত থেকে মুক্তি দিলেও রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যে দ্বিতীয় গণআন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে সংসদকে ফিরিয়ে আনা হয়, শাসনব্যবস্থার কাঠামো প্রণয়ন করতে তারা ২০০৭ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করেন।
॥পাঁচ॥
অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হিমালয় কন্যা নেপাল। চলতি বছরেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালে মারা যান ১০ হাজার মানুষ। তারপর আবার এবছরেই সংবিধান বিরোধী বিক্ষোভে মারা গেছেন ৪৫ জন মানুষ। এ অবস্থাতেই দীর্ঘ ৭ বছরের তীব্র বাদানুবাদ এবং প্রাণহানির মধ্য দিয়ে নেপাল আবির্ভূত হয়েছে ফেডারেল গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল হিসেবে। ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্র একটি সংবিধানের মাধ্যমে দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করেন। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পর অর্থাৎ প্রায় ৫৩ বছর পর বর্তমান সংবিধান গ্রহণের মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ধর্মনিরপেক্ষ নেপালে রূপান্তরিত হলো। আর এই সংবিধানটি চালু হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। এবং তার মাত্র ২ দিন পর অর্থাৎ গত ২৩ সেপ্টেম্বর নেপালের ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করলো ভারত। পূর্বমূখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নেপাল সেই অবরোধের জগদ্দল পাথর সরাবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ভারতকেন্দ্রিক বা ইন্দো সেন্ট্রিক নীতির পরিবর্তে চীনের সাথে চুক্তি তথা পূর্ব মুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে।
এখন এই অঞ্চলের সকলেই পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। এমন কি ভারতও পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে এবং ইতোমধ্যেই মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। অথচ পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে ছিলো সর্বাগ্রে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশই আজ এই ব্যাপারে সবচেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশ আজ পূর্বমুখী নীতির পরিবর্তে একমুখী নীতি অনুসরণ করছে। যেখানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রভৃতি ছোট ছোট দেশ বহুমুখী নীতি অনুসরণ করছে সেখানে বাংলাদেশ আয়তন ও জনসংখ্যায় তাদের চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতি এককেন্দ্রিক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাকে বলেন ইন্দোসেন্ট্রিক বা ভারতকেন্দ্রিক নীতি। এসব ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে গেলো, চীন এগিয়ে গেলো, এমনকি নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে গেলো। শুধুমাত্র পেছনে পড়ে রইলো বাংলাদেশ। ভারত যা চেয়েছে বাংলাদেশ দিয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, কতো দিন আর আমরা ভারতের চাদরের নিচে থাকবো?
অথচ গত ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে নেপালে চলছে এক ধরনের অবরোধ। নেপালের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে এই অবরোধ আরোপিত হলেও ২ কোটি ৭৮ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত নেপালের সবাই কম বেশি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব রিপোর্ট আসছে সেসব রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটিতে খাদ্য এবং জ্বালানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মানবতাবাদী সেবা সংস্থাগুলো বলছে যে সেই দেশে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। এই বিপর্যয়ের কথা আমরা খুব ভাল করে জানি না। কেন জানি না? কারণ আমাদের মিডিয়া তাদের দুঃখ দুর্দশার পূর্ণ চিত্র তুলো ধরছে না। কেন তুলে ধরছে না? কারণ নেপালী জনগণের দুর্দশার মূলে রয়েছে ভারত। যেভাবে নেপালের সংবিধান পাশ হয়েছে এবং যেভাবে সেটি চালু হয়েছে সেটি ভারতের মোটেই মনঃপূত হয়নি। সংবিধানের অন্তত ৭ টি জায়গা ভারত সংশোধন করতে বলেছিল। কিন্তু নেপালী পার্লামেন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ভারতের আপত্তি বা সুপারিশ আমলে নেয়নি। সুতরাং ভারত ক্ষেপে গিয়েছে। ক্ষেপে উঠে তারা নেপালের ওপর অবরোধ বসিয়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি অবরোধ।
নেপালে যে সংবিধান চালু হয়েছে সেটির কাঠামো হলো ফেডারেল। দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারত পছন্দ করেনি। দ্বিতীয়ত সংবিধানটি গণতান্ত্রিক। ভারত প্রথম থেকেই নেপালের গণতন্ত্রায়ন চায়নি। কারণ, নিখাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আধিপত্যবাদী শক্তি সেই গণতান্ত্রিক দেশটির ওপর প্রভুত্বের ছড়ি ঘুরাতে পারে না। সে কারণেই নেপালে একটি লিখিত গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু হোক, সেটি ভারত চায়নি। সেই সংবিধানের ভিত্তিতে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটাও চায়নি। তাই ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেপালে যখন সংবিধান চালু হলো এবং সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন ভারত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত সেখানে তেল সরবরাহ গত মাসে বন্ধ করে দেয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নেপাল গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের তেল-রাজনীতির হাতে বন্দী হয়ে আছে। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনই একমাত্র কোম্পানি যা নেপালের তেলের চাহিদা মেটাতো। জ্বালানি খাতে ভারতীয় কোম্পানিটির একতরফা দখলদারিত্বকে পুঁজি করে নেপালের রাজনীতিতে ভারত বিভিন্ন সময় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছিল। সবশেষে গত মাসে দেশটির নতুন লিখিত সংবিধান ভারতের পছন্দমত না হওয়ায় তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন। এতে নজিরবিহীন সংকটে পড়ে নেপালের অর্থনীতি। এর জের ধরেই তেলের বিকল্প সরবরাহের দিকে ঝুঁকে পড়ে নেপাল।
॥দুই॥
গত মাসে ভারত তেল সরবরাহ বন্ধের পরপরই সংকটে নিপতিত নেপালকে প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহের প্রস্তাব দেয় চীন। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে চীন থেকে তেল আমদানির চুক্তি করেছে নেপাল। এর একটি সুফল এই যে, নেপাল ভারতের আধিপত্যবাদী খপ্পর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার রাস্তা বের করেছে। এটি তার জন্য বলতে গেলে ছিলো একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, পৃথিবীতে নেপালই একমাত্র দেশ যেটি অফিসিয়ালি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত। অন্যদিকে পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ যার ১৩০ কোটি অধিবাসীর মধ্যে ১১২ কোটি হিন্দু। দ্বিতীয়ত নেপাল সম্পূর্ণভাবে স্থল পরিবেষ্টিত একটি দেশ যার চার ধারের কোথাও কোনো পানি বা সমুদ্র নেই। ভারত এতদিন নেপালের ওপর খবরদারি করে এসেছে। এখন সেটিরও অবসান হতে চলেছে। ভারতের দাদাগিরি আচরণের ফলে কোনো প্রতিবেশীর সাথেই তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারতের নিকট থেকে নেপালের শুধুমাত্র তেল আমদানিই বন্ধ হয়নি, নেপালে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতিও এখন আর নেপালে হামলা করতে পারছে না। কারণ, নেপালে সমস্ত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে।
ছোট্ট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ। আয়তন মাত্র ১১৫ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা মাত্র ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার। সেই দেশটিও ভারতকে তার আধিপত্যবাদী আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। অপর দ্বীপ দেশ সিংহল বা শ্রীলঙ্কা। আয়তন ২৫ হাজার ৩২০ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ২ কোটি ২৮ লক্ষ। এমন ছোট রাষ্ট্রও ভারতের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তান তো ভারতের চির বৈরী রাষ্ট্র হিসেবেই বিশ্ব মিডিয়ায় পরিচিত।
॥তিন॥
একটি দেশে যদি স্থায়ী সংবিধান না থাকে এবং সেই সুবাদে যদি সাংবিধানিক সরকার না থাকে তাহলে সেই দেশটির স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দেশটির স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়। এই রকম ঘটনা আমরা দেখেছি পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। সংযুক্ত পাকিস্তান ছিল একটি বড় দেশ। আয়তন বেশি (৩ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৮৫ বর্গ মাইল), জনসংখ্যাও হতো অনেক (৩৬ কোটি ৮০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫৯২)। কিন্তু তেমন একটি বড় দেশ ভেঙ্গে গেল শুধুমাত্র গণতন্ত্রের অভাব, বছরের পর বছর ধরে স্বৈরাচারী শাসন এবং সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের কারণে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই বিশাল ও বহু বর্ণ ও বহু জাতি বিশিষ্ট ভারতে স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান চালু হয়। অথচ ভারতের চেয়ে আয়তনে চার ভাগের এক ভাগ পাকিস্তানে সংবিধান চালু হয় স্বাধীনতার ৯ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। ভারতের স্বাধীনতার পর ৬৮ বছর গত হয়েছে। এই ৬৮ বছরে একবারও ভারতের সংবিধান এবং সাংবিধানিক সরকার হোঁচট খায়নি। অথচ পাকিস্তানে সংবিধান টিকেছিল মাত্র ১ বছর ৭ মাস। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সেনা প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৬ সালের বহু দলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। ১০ বছর জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে রাখেন। এসব ইতিহাস এবং পরবর্তী ইতিহাস আপনারা সকলেই জানেন। ক্ষমতা লিপ্সা, পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা এবং সাংবিধানিক সরকারের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কারণেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়।
॥চার॥
নেপালেও সংবিধান নিয়ে অনেক কাটা ছেঁড়া এবং এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার দেব মুখার্জী একটি লেখায় বলেছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে নেপালে ছয়টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রণয়ন করেছে রানা বা রাজদরবার। রানাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন শেষ হওয়ার পর নেপালের রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজা মহেন্দ্র সেই বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন, তিনি সরকার ভেঙে দিয়ে ১৯৬২ সালে একটি সংবিধান চাপিয়ে দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নিজের একক কর্তৃত্বে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ গঠন করেন। তারপর ১৯৯০ সালের সংবিধান পেতে নেপালি কংগ্রেসকে প্রায় ৩০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন করতে হয়েছে। সেই সংবিধান আসলে রাজ দরবার ও রাজনৈতিক দলের আপস রফার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল। ওই সংবিধান নেপালকে পঞ্চায়েত-রাজের হাত থেকে মুক্তি দিলেও রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যে দ্বিতীয় গণআন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে সংসদকে ফিরিয়ে আনা হয়, শাসনব্যবস্থার কাঠামো প্রণয়ন করতে তারা ২০০৭ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করেন।
॥পাঁচ॥
অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হিমালয় কন্যা নেপাল। চলতি বছরেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালে মারা যান ১০ হাজার মানুষ। তারপর আবার এবছরেই সংবিধান বিরোধী বিক্ষোভে মারা গেছেন ৪৫ জন মানুষ। এ অবস্থাতেই দীর্ঘ ৭ বছরের তীব্র বাদানুবাদ এবং প্রাণহানির মধ্য দিয়ে নেপাল আবির্ভূত হয়েছে ফেডারেল গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল হিসেবে। ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্র একটি সংবিধানের মাধ্যমে দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করেন। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পর অর্থাৎ প্রায় ৫৩ বছর পর বর্তমান সংবিধান গ্রহণের মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ধর্মনিরপেক্ষ নেপালে রূপান্তরিত হলো। আর এই সংবিধানটি চালু হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। এবং তার মাত্র ২ দিন পর অর্থাৎ গত ২৩ সেপ্টেম্বর নেপালের ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করলো ভারত। পূর্বমূখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নেপাল সেই অবরোধের জগদ্দল পাথর সরাবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ভারতকেন্দ্রিক বা ইন্দো সেন্ট্রিক নীতির পরিবর্তে চীনের সাথে চুক্তি তথা পূর্ব মুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে।
এখন এই অঞ্চলের সকলেই পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। এমন কি ভারতও পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে এবং ইতোমধ্যেই মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। অথচ পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে ছিলো সর্বাগ্রে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশই আজ এই ব্যাপারে সবচেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশ আজ পূর্বমুখী নীতির পরিবর্তে একমুখী নীতি অনুসরণ করছে। যেখানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রভৃতি ছোট ছোট দেশ বহুমুখী নীতি অনুসরণ করছে সেখানে বাংলাদেশ আয়তন ও জনসংখ্যায় তাদের চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতি এককেন্দ্রিক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাকে বলেন ইন্দোসেন্ট্রিক বা ভারতকেন্দ্রিক নীতি। এসব ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে গেলো, চীন এগিয়ে গেলো, এমনকি নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে গেলো। শুধুমাত্র পেছনে পড়ে রইলো বাংলাদেশ। ভারত যা চেয়েছে বাংলাদেশ দিয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, কতো দিন আর আমরা ভারতের চাদরের নিচে থাকবো?
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন