Britannica R.R. ENCYCLOPEDIA-
তে বলা হয়েছে- Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে কথা। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! তাই ২৮ অক্টোবর অন্য দিনের মত একটি দিন নয়। এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলংকের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তা-ব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
যুগে যুগে ক্ষমতার লিপ্সা, ভূমি দখল, সম্পদ আহরণ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবসাই খান, খেসারু হত্যা, এরকম অনেক রক্তপিপাসু খুনির নামের সাথে শেখ হাসিনার নামটিও আজ স্থান করে নিয়েছে।
ইতিহাসের কালো অধ্যায় জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ক্রসেড (ত্রিপলী), ভারত পাকিস্তান দাঙ্গা, মধ্য আফ্রিকায় (মুসলিম গণহত্যা), আফ্রিকায় উপজাতি দাঙ্গা, ইন্দোনেশিয়া গণহত্যা, সোমালিয়ায় গণহত্যা, চায়না কমিউনিস্ট বিপ্লব, সিরিয়া গণহত্যা, কম্বোডিয়া (খেসারু হত্যা), বোসনিয়া/চেচনিয়া মুসলিম হত্যা, মিয়ানমার মুসলিম গণহত্যা, ইরাক, আফগান হত্যা, লেলিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব), স্ট্যালিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব) হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, এপ্রিল ফুল দিবসের ঘটনাসমূহ আমাদের স্মৃতিতে এক বীভৎস চিত্র ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনি শত বছর পরও ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করলে শিউরে উঠবে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হবে তার বিবেক, অমানবিকতার কথা মনে করে কেঁদে উঠবে মানুষের হৃদয়। অভিশপ্তদের ঘৃণা করবে বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার রক্তাক্ত দলিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামী লীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। আওয়ামী লীগের শাসন আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে।
রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন শাসন করবার সৎসাহসটুকুও শাসকদের আর থাকে না। ফলে সমাজের সর্বত্র অরাজকতা, অমানবিকতা, হিংস্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অপরাধ রোধ করবার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ এখন সেই ভয়ংকর সময়টি অতিক্রম করছে। মুলত বিগত ৫ জানুয়ারির অনির্বাচিত সরকার মানুষকে শাসন করবার নৈতিক ভিত্তি এখন আর অবশিষ্ট নেই। সকল ক্ষেত্রেই “অ” অক্ষর যোগ করিলেই যেন শাসক গোষ্ঠীর আসল পরিচয় মেলে। এই সরকার অ-গণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত, অনৈতিক, অবৈধ। তাই তাদের কর্মকা-ের মাঝে ও যেন অপদার্থের নিশানাই বেশি!
আজ মনে হচ্ছে আমরা স্বাধীন একটি ভূ-খণ্ড পেয়েছি। পাইনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি। নাগরিক পাচ্ছে না স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার। জানমাল, ইজ্জত, আব্রুর নিরাপত্তা এখানে ভূলুণ্ঠিত!!। আমরা পাইনি প্রকৃত গণতন্ত্র। আমরা এখন যেন নিজ দেশেই বন্দী। কাঁটা তাঁরের বেড়ায় ফেলনীদের লাশের করুণ চাহনি আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে, আমরা কি আসলে স্বাধীন? প্রতিবেশী রাষ্ট্র হাঙ্গরের মত এদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যমে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এখন হিটলার ও মুসোলিনীর অক্ষশক্তির নৃশংসতা ও বর্বর কর্মকা-কেও যেন হার মানাতে বসেছে। জুলুম-নির্যাতন, লুণ্ঠন, রাহাজানি অক্টোপাসের মতো গোটা জাতিকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতিদিন কত মানুষ জীবন দিচ্ছে তার কোন হিসেব এখন কেউই যেন রাখতে পারছে না। সর্বত্র আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ বাংলার আকাশ-বাতাস কে ভারী করে তুলছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন পার্লামেন্টে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ডিবেট হচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন টক অব ওয়ার্ল্ড। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলেও তা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেয়ার উদ্যোগ সরকারের নব্য বাকশালী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। ২৮ অক্টোবরে সংঘটিত এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, বুকলেট, প্রতিবাদ, সিডি, ভিসিডি ও ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে-
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগের কথা। ২৮ আক্টোরর-০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মূলত ২৭ আক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্থ কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ আমরা কয়েকজন উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিউরে উঠছে!।
অফিস থেকে বেরিয়ে আহত-রক্তাক্তদের দেখতে দেখতে আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জড়িয়ে পড়লাম। পল্টন মসজিদের গলিতে একদিকে আমরা ৪০-৫০ জন ভাই, অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র, লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। এভাবে একদিকে সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্রের হামলা অন্যদিকে আমরা নিরস্ত্র। এভাবে ৭ ঘণ্টা মোকাবেলা করেছি আমরা। ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এ তো আল্লাহর দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। এ যেন বাতিলের বিরুদ্ধে এক চরমপত্র। ১৪ দলের গালে একটি চপেটাঘাত। এ যেন শাহাদাতের প্রতিযোগিতা। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। এক সময় আমি নিজেও মনে করতাম অস্ত্রের মোকাবেলায় টিকে থাকা যায় না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদ দেখে সে ভুল ধারণা শুধরে নিয়েছি। বাকিটুকুর পরিশুদ্ধতা লাভ করেছি ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী হয়ে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হয়ে বিদায় নিচ্ছে আমাদের কাতার থেকে। নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। কারণ বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
হঠাৎ সামনের দিক থেকে চিৎকার শুনলাম। আমরা ২০/২৫ জন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম তখন দেখি আওয়ামী লীগের ৪-৫ হাজার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী পেছনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তার সাহায্য অনিবার্য। এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘কোনো মু’মিন মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির উচ্চারণ করলে বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।’’ ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।
যাক, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। শাহাদাতের যে মৃত্যুর জন্য তিনি প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাক্সক্ষা পূর্ণ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। এর থেকে সৌভাগ্যবান আর কি হতে পারে? শহীদরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর!। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (আল-বাকারা: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, ‘তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।’ (তিরমিযী)
হায়েনারা আমাদের প্রিয়ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুঁড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলী আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম হাঁটুর ওপর ভর করে। জাহেদ হোসেন ভূঞা ভাই ও আব্দুল মান্নান ভাইসহ কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে বলে। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলীবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং দল বেঁধে আমার সাথে আসতে লাগল। ভাইদের বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা শহীদ কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলীবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম এই এক্সরে টি আমার? কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি বললাম, এই গুলীটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলীটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না ইনশাল্লাহ।
আজ হয়তো কেউ কেউ বলেন ২৮ অক্টোবরে আমাদের প্রস্তুতির কথা। কিন্তু যদি আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকতো! তাহলে কি হতো? কারণ দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? দলে তারা আওয়ামী লীগ কিন্তু ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই গার্মেন্টসকর্মী ও পতিতালয়ের হিন্দা। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভাল হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেত আর এ ধরনের সন্ত্রাসী একজন টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। হিসাব হতো কাদের লাশ কয়টি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হতো সেভাবে। অন্তত আল্লাহতায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামী লীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে? আর কত রক্তের হোলি খেললে তাদের নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠবে?
কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা ১৪ দল কিভাবে করছে। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ, মাসুম, শিপন, মুজাহিদ, রফিক, ফয়সলের পরিবার। কিন্তু না। এটি আপনার হিসাব হতে পারে তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতি ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য। শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের ফরিয়াদ : আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো, মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো।
শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের গর্বিত মায়ের আহ্বান : আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালেদ বিন ওয়ালিদ হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইনের মত হবে। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সবসময় করি। শহীদ ফয়সলের গর্বিত মা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ঠিক এভাবে : তাদের কথা শুনেই মনে হয় তারা সত্যিই হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর উত্তরসূরী। হযরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর পথে কুরবান করে হযরত ইব্রাহিম (আ) যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী, ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। শহীদ রফিকুল ইসলামের পিতার চাওয়া : আমার ছেলে আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কুড়িগ্রামবাসী সবাই তার জন্য কেঁদেছে। জীবনে সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়নি। সে সবসময় সৎ সঙ্গে মিশত এবং দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকত।
আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, লাশের ওপর নৃত্যউল্লাস করেছে, ভেঙে দিয়েছে দাঁত, উপড়ে ফেলেছে চোখ; তারা কি আজ উত্তর দিতে পারবে হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের জিজ্ঞাসার- ‘কী অপরাধ আমার সন্তানের? কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সন্তানের দাঁতগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে? এই মুখ দিয়ে তো সে মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুখস্থ করেছে। ঐ অসভ্য নরপশুরা কি জানে? যে কপালে লাথি মারা হয়েছে সে কপালে দিনে পাঁচবার করে আল্লাহকে সেজদা করতো! পড়তো তাহাজ্জুদ নামাজ। যে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে সে হাত দিয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতো, যে পা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে পা দিয়ে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতো। এ রকম হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব আজ তাদের কাছে আছে কি?
পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। যাদের সাহস আমাদের এগিয়ে দেয়। যাদের আল্লাহর নির্ভরতা এ কাফেলার কর্মীদের আশান্বিত করে। যাদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা দেখেছি তাদেরকে। আমরা দেখেছি শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলী আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। যিনি এখনো জালিমের জুলুমের শিকার হয়ে কারাগারে আবদ্ধ। এমনি এক জনসভায় অবিরাম গুলীবর্ষণ চলাকালে মাওলানা মওদুদীকে বসে পড়ার জন্য অন্যরা অনুরোধ করলে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, আমিই যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাই বিশ্বাস শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, একদিন কথা বলবেই।
শহীদ কামারুজ্জমান ভাইয়ের ঐ স্মৃতি আজ আমাকে খুবই নাড়া দেয়। ২০০৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী ভাইয়ের কফিন নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ আমাদের প্রিয় নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শহীদ কামারুজ্জামান ভাই একসাথে গিয়েছি। কামারুজ্জামান ভাই আমাকে অনেকবার জড়িয়ে ধরে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু কে জানে তিনি নিজেই একদিন শহীদ হয়ে এই মাটিতে আসবেন!
শাহাদতের জন্য শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল এই ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভার। সকল অতিথিরবৃন্দ উপস্থিত আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম স্যরি মোল্লা ভাই, আপনি আসছেন এজন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। তিনি বললেন, শুন ২৮ অক্টোবর ২০০৬ আমি ঐ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় একথা বলে আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলেন। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ আর গাজী হয়েছে। ঐ দিন আমি ঢাকায় ছিলাম কিন্তু আমীরে জামায়াত আমাকে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোঁজ খবর রাখতে বললেন। সেদিনের এই অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বে-দাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এই কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেইজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে তিনি কত গভীরভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন।
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহূর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুণ চাহনি, মাহারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণীপেশার মানুষ। বৃদ্ধ বণিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও রেহাই পায়নি জালেমের বুলেটের আঘাত থেকে। আর এর মধ্যে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক বেশি জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।
আজ মহান রবের দরবারে সন্তানহারা মায়ের আহাজারি আর প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনই কাজে আসবে না? একদিন তারা আল্লাহর সম্মানিত অতিথি হবেন শহীদের পিতা মাতা হিসেবে। সেদিন জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবেন শহীদেরা। এটাই তো শহীদের চূড়ান্ত সফলতা! ন্যায় ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী আদর্শিক দ্বন্দ্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস। তবে আমাদের বিশ্বাস এই দুনিয়ার আদালতে এই সকল হত্যার নায্য বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না।
আজ জীবিত কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লার চাইতে শহীদ কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন এবং শহীদ ফয়সাল অনেক বেশি শক্তিশালী। আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট জেল-জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, বরং দ্বীনের বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠে। যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এদেশকে কলোনিভুক্ত করা স্বপ্ন দেখছে, শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে বাংলার তৌহিদী জনতা তা রুখে দাঁড়াবে ইনশাল্লাহ। ২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও।
তে বলা হয়েছে- Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে কথা। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! তাই ২৮ অক্টোবর অন্য দিনের মত একটি দিন নয়। এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলংকের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তা-ব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
যুগে যুগে ক্ষমতার লিপ্সা, ভূমি দখল, সম্পদ আহরণ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবসাই খান, খেসারু হত্যা, এরকম অনেক রক্তপিপাসু খুনির নামের সাথে শেখ হাসিনার নামটিও আজ স্থান করে নিয়েছে।
ইতিহাসের কালো অধ্যায় জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ক্রসেড (ত্রিপলী), ভারত পাকিস্তান দাঙ্গা, মধ্য আফ্রিকায় (মুসলিম গণহত্যা), আফ্রিকায় উপজাতি দাঙ্গা, ইন্দোনেশিয়া গণহত্যা, সোমালিয়ায় গণহত্যা, চায়না কমিউনিস্ট বিপ্লব, সিরিয়া গণহত্যা, কম্বোডিয়া (খেসারু হত্যা), বোসনিয়া/চেচনিয়া মুসলিম হত্যা, মিয়ানমার মুসলিম গণহত্যা, ইরাক, আফগান হত্যা, লেলিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব), স্ট্যালিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব) হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, এপ্রিল ফুল দিবসের ঘটনাসমূহ আমাদের স্মৃতিতে এক বীভৎস চিত্র ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনি শত বছর পরও ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করলে শিউরে উঠবে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হবে তার বিবেক, অমানবিকতার কথা মনে করে কেঁদে উঠবে মানুষের হৃদয়। অভিশপ্তদের ঘৃণা করবে বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার রক্তাক্ত দলিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামী লীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। আওয়ামী লীগের শাসন আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে।
রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন শাসন করবার সৎসাহসটুকুও শাসকদের আর থাকে না। ফলে সমাজের সর্বত্র অরাজকতা, অমানবিকতা, হিংস্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অপরাধ রোধ করবার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ এখন সেই ভয়ংকর সময়টি অতিক্রম করছে। মুলত বিগত ৫ জানুয়ারির অনির্বাচিত সরকার মানুষকে শাসন করবার নৈতিক ভিত্তি এখন আর অবশিষ্ট নেই। সকল ক্ষেত্রেই “অ” অক্ষর যোগ করিলেই যেন শাসক গোষ্ঠীর আসল পরিচয় মেলে। এই সরকার অ-গণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত, অনৈতিক, অবৈধ। তাই তাদের কর্মকা-ের মাঝে ও যেন অপদার্থের নিশানাই বেশি!
আজ মনে হচ্ছে আমরা স্বাধীন একটি ভূ-খণ্ড পেয়েছি। পাইনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি। নাগরিক পাচ্ছে না স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার। জানমাল, ইজ্জত, আব্রুর নিরাপত্তা এখানে ভূলুণ্ঠিত!!। আমরা পাইনি প্রকৃত গণতন্ত্র। আমরা এখন যেন নিজ দেশেই বন্দী। কাঁটা তাঁরের বেড়ায় ফেলনীদের লাশের করুণ চাহনি আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে, আমরা কি আসলে স্বাধীন? প্রতিবেশী রাষ্ট্র হাঙ্গরের মত এদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যমে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এখন হিটলার ও মুসোলিনীর অক্ষশক্তির নৃশংসতা ও বর্বর কর্মকা-কেও যেন হার মানাতে বসেছে। জুলুম-নির্যাতন, লুণ্ঠন, রাহাজানি অক্টোপাসের মতো গোটা জাতিকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতিদিন কত মানুষ জীবন দিচ্ছে তার কোন হিসেব এখন কেউই যেন রাখতে পারছে না। সর্বত্র আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ বাংলার আকাশ-বাতাস কে ভারী করে তুলছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন পার্লামেন্টে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ডিবেট হচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন টক অব ওয়ার্ল্ড। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলেও তা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেয়ার উদ্যোগ সরকারের নব্য বাকশালী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। ২৮ অক্টোবরে সংঘটিত এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, বুকলেট, প্রতিবাদ, সিডি, ভিসিডি ও ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে-
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগের কথা। ২৮ আক্টোরর-০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মূলত ২৭ আক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্থ কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ আমরা কয়েকজন উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিউরে উঠছে!।
অফিস থেকে বেরিয়ে আহত-রক্তাক্তদের দেখতে দেখতে আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জড়িয়ে পড়লাম। পল্টন মসজিদের গলিতে একদিকে আমরা ৪০-৫০ জন ভাই, অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র, লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। এভাবে একদিকে সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্রের হামলা অন্যদিকে আমরা নিরস্ত্র। এভাবে ৭ ঘণ্টা মোকাবেলা করেছি আমরা। ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এ তো আল্লাহর দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। এ যেন বাতিলের বিরুদ্ধে এক চরমপত্র। ১৪ দলের গালে একটি চপেটাঘাত। এ যেন শাহাদাতের প্রতিযোগিতা। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। এক সময় আমি নিজেও মনে করতাম অস্ত্রের মোকাবেলায় টিকে থাকা যায় না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদ দেখে সে ভুল ধারণা শুধরে নিয়েছি। বাকিটুকুর পরিশুদ্ধতা লাভ করেছি ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী হয়ে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হয়ে বিদায় নিচ্ছে আমাদের কাতার থেকে। নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। কারণ বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
হঠাৎ সামনের দিক থেকে চিৎকার শুনলাম। আমরা ২০/২৫ জন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম তখন দেখি আওয়ামী লীগের ৪-৫ হাজার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী পেছনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তার সাহায্য অনিবার্য। এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘কোনো মু’মিন মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির উচ্চারণ করলে বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।’’ ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।
যাক, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। শাহাদাতের যে মৃত্যুর জন্য তিনি প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাক্সক্ষা পূর্ণ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। এর থেকে সৌভাগ্যবান আর কি হতে পারে? শহীদরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর!। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (আল-বাকারা: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, ‘তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।’ (তিরমিযী)
হায়েনারা আমাদের প্রিয়ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুঁড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলী আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম হাঁটুর ওপর ভর করে। জাহেদ হোসেন ভূঞা ভাই ও আব্দুল মান্নান ভাইসহ কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে বলে। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলীবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং দল বেঁধে আমার সাথে আসতে লাগল। ভাইদের বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা শহীদ কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলীবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম এই এক্সরে টি আমার? কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি বললাম, এই গুলীটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলীটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না ইনশাল্লাহ।
আজ হয়তো কেউ কেউ বলেন ২৮ অক্টোবরে আমাদের প্রস্তুতির কথা। কিন্তু যদি আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকতো! তাহলে কি হতো? কারণ দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? দলে তারা আওয়ামী লীগ কিন্তু ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই গার্মেন্টসকর্মী ও পতিতালয়ের হিন্দা। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভাল হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেত আর এ ধরনের সন্ত্রাসী একজন টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। হিসাব হতো কাদের লাশ কয়টি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হতো সেভাবে। অন্তত আল্লাহতায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামী লীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে? আর কত রক্তের হোলি খেললে তাদের নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠবে?
কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা ১৪ দল কিভাবে করছে। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ, মাসুম, শিপন, মুজাহিদ, রফিক, ফয়সলের পরিবার। কিন্তু না। এটি আপনার হিসাব হতে পারে তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতি ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য। শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের ফরিয়াদ : আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো, মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো।
শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের গর্বিত মায়ের আহ্বান : আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালেদ বিন ওয়ালিদ হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইনের মত হবে। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সবসময় করি। শহীদ ফয়সলের গর্বিত মা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ঠিক এভাবে : তাদের কথা শুনেই মনে হয় তারা সত্যিই হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর উত্তরসূরী। হযরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর পথে কুরবান করে হযরত ইব্রাহিম (আ) যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী, ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। শহীদ রফিকুল ইসলামের পিতার চাওয়া : আমার ছেলে আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কুড়িগ্রামবাসী সবাই তার জন্য কেঁদেছে। জীবনে সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়নি। সে সবসময় সৎ সঙ্গে মিশত এবং দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকত।
আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, লাশের ওপর নৃত্যউল্লাস করেছে, ভেঙে দিয়েছে দাঁত, উপড়ে ফেলেছে চোখ; তারা কি আজ উত্তর দিতে পারবে হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের জিজ্ঞাসার- ‘কী অপরাধ আমার সন্তানের? কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সন্তানের দাঁতগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে? এই মুখ দিয়ে তো সে মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুখস্থ করেছে। ঐ অসভ্য নরপশুরা কি জানে? যে কপালে লাথি মারা হয়েছে সে কপালে দিনে পাঁচবার করে আল্লাহকে সেজদা করতো! পড়তো তাহাজ্জুদ নামাজ। যে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে সে হাত দিয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতো, যে পা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে পা দিয়ে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতো। এ রকম হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব আজ তাদের কাছে আছে কি?
পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। যাদের সাহস আমাদের এগিয়ে দেয়। যাদের আল্লাহর নির্ভরতা এ কাফেলার কর্মীদের আশান্বিত করে। যাদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা দেখেছি তাদেরকে। আমরা দেখেছি শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলী আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। যিনি এখনো জালিমের জুলুমের শিকার হয়ে কারাগারে আবদ্ধ। এমনি এক জনসভায় অবিরাম গুলীবর্ষণ চলাকালে মাওলানা মওদুদীকে বসে পড়ার জন্য অন্যরা অনুরোধ করলে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, আমিই যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাই বিশ্বাস শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, একদিন কথা বলবেই।
শহীদ কামারুজ্জমান ভাইয়ের ঐ স্মৃতি আজ আমাকে খুবই নাড়া দেয়। ২০০৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী ভাইয়ের কফিন নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ আমাদের প্রিয় নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শহীদ কামারুজ্জামান ভাই একসাথে গিয়েছি। কামারুজ্জামান ভাই আমাকে অনেকবার জড়িয়ে ধরে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু কে জানে তিনি নিজেই একদিন শহীদ হয়ে এই মাটিতে আসবেন!
শাহাদতের জন্য শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল এই ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভার। সকল অতিথিরবৃন্দ উপস্থিত আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম স্যরি মোল্লা ভাই, আপনি আসছেন এজন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। তিনি বললেন, শুন ২৮ অক্টোবর ২০০৬ আমি ঐ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় একথা বলে আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলেন। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ আর গাজী হয়েছে। ঐ দিন আমি ঢাকায় ছিলাম কিন্তু আমীরে জামায়াত আমাকে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোঁজ খবর রাখতে বললেন। সেদিনের এই অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বে-দাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এই কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেইজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে তিনি কত গভীরভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন।
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহূর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুণ চাহনি, মাহারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণীপেশার মানুষ। বৃদ্ধ বণিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও রেহাই পায়নি জালেমের বুলেটের আঘাত থেকে। আর এর মধ্যে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক বেশি জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।
আজ মহান রবের দরবারে সন্তানহারা মায়ের আহাজারি আর প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনই কাজে আসবে না? একদিন তারা আল্লাহর সম্মানিত অতিথি হবেন শহীদের পিতা মাতা হিসেবে। সেদিন জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবেন শহীদেরা। এটাই তো শহীদের চূড়ান্ত সফলতা! ন্যায় ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী আদর্শিক দ্বন্দ্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস। তবে আমাদের বিশ্বাস এই দুনিয়ার আদালতে এই সকল হত্যার নায্য বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না।
আজ জীবিত কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লার চাইতে শহীদ কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন এবং শহীদ ফয়সাল অনেক বেশি শক্তিশালী। আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট জেল-জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, বরং দ্বীনের বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠে। যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এদেশকে কলোনিভুক্ত করা স্বপ্ন দেখছে, শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে বাংলার তৌহিদী জনতা তা রুখে দাঁড়াবে ইনশাল্লাহ। ২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও।
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন