গো-মাংস অর্থাৎ গুরুর গোশ্ত ভক্ষণ নিয়ে ভারতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী’ বলে একটি বিখ্যাত কবিতা আছে। তারই অনুকরণে হিংসায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের কট্টরপন্থী হিন্দুদের একটি অংশ। বুঝলাম, ভারতে হিন্দুদের মধ্যে উদারপন্থীও আছেন। বিজেপি যেখানে গত ইলেকশনে ল্যান্ড স্লাইড বিজয় অর্জন করেছে সেখানে তাদের দলের মধ্যে কোটি কোটি উদারপন্থী হিন্দু আছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু গো-মাংস ভক্ষণ নিয়ে ভারতের একাধিক অঞ্চলে যখন মুসলমানদের ওপর জুলুম ও নির্যাতন করা হলো, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মুসলমানকে হত্যাও করা হলো, তখন কোথায় ছিলেন ভারতে বিশাল জন গোষ্ঠীর উদারপন্থী হিন্দুরা? নীচের ঘটনাগুলো দেখুন, গরুর গোশত খাওয়াকে কেন্দ্র করে ওরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কতখানি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল।
(১) জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হলেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। তিনি তার বাস ভবনে কয়েকজন মুসলমান মেহমানকে দাওয়াত করেছিলেন। তাদেরকে গরুর গোশ্ত দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এটি ছিল একটি ‘মহা অপরাধ’। এরপর কাশ্মীরের প্রাদেশিক পরিষদের (সংসদ) অধিবেশন চলছিল। অধিবেশন চলাকালেই গরুর মাংস খাওয়ানোর অপরাধে (?) সংসদের বিজেপি সদস্যরা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে মারধর করতে থাকে। সংসদের কংগ্রেস সদস্যরা এসে ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে রক্ষা করেন। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ৪)।
(২) গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে দিল্লীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একদল লোক একজন মুসলমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বেধড়ক পেটায় এবং এই ভয়াবহ প্রহারে মুসলমান লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, তার রেফ্রিজারেটরে কোনো গরুর গোশ্ত ছিল না। ছিল খাসির মাংস। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৩) ব্যাঙ্গালোরে একজন হিন্দু মহিলার সাথে কথা বলার অপরাধে একজন মুসলমানকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং মারের পর তার বস্ত্র হরণ করা হয়। অর্থাৎ তাকে উলঙ্গ করা হয়। যারা এই জঘন্য কাজ করে তারা বিজেপি’র সহযোগী সংগঠন বজরং দলের সদস্য। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৪) গুজরাটের মান্ডি নামক স্থানে হিন্দুদের নৃত্যশালায় মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। নবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে মুসলমানদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নিষেধাজ্ঞা জারির উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু মহিলাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করা। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৫) উত্তর প্রদেশের একটি মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করেন এক নবতিপর (যার বয়স ৯০ বছরের কম নয়) বৃদ্ধ। এটি ছিল কট্টরপন্থীদের কাছে একটি ‘গোস্তাকি’। এই গোস্তাকির জন্য ঐ নবতিপর বৃদ্ধের গায়ে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৬) বিজেপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একটি নতুন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কর্মসূচীটির নাম ঘর ‘ওয়াপসি’ (গৃহ প্রত্যাবর্তন বা ঘরে ফেরা)। এই কর্মসূচীর অধীনে গত সপ্তাহে বেনারশির নিকট অবস্থিত একটি গ্রামে ৩০০ ব্যক্তিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু বানানো হয়েছে। যে সংগঠনটি এই অপকর্মটি করেছে সেই সংগঠনটির নাম ধর্ম জাগরণ সমন্বয় সমিতি। তাদেরকে বল পূর্বক হিন্দু বানিয়ে তাদের হাতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’ এবং ‘হনুমান চালিসা’ ধরিয়ে দেওয়া হয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৭) গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের পর গজলের ঐন্দ্রজালিক সুরে যিনি এই উপমহাদেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তার নাম গোলাম আলী। মুম্বাইয়ের একটি কনসার্টে গজল পরিবেশনের জন্য তাকে ভারতীয়রাই দাওয়াত করেছিলেন। কিন্তু বিজেপির অঙ্গ সংগঠন শিব সেনা ঐ কনসার্ট হতে দেয়নি এবং গোলাম আলীকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৮) এই একই উগ্রপন্থীরা মুম্বাইয়ে এক ব্যক্তির মুখে কালো কালি মেখে দেয়। ঐ ব্যক্তির অপরাধ ছিল এই যে, তিনি একটি পুস্তক প্রকাশনী উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, যে পুস্তকটি লিখেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
॥ দুই ॥
এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের মনের তীব্র মুসলিম বিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া যায়। অতীতে কয়েক হাজার মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ভারতে সংঘটিত হয়েছে। আজ আমরা ঐসব রক্তাক্ত ও দুঃখজনক অতীত ঘাঁটা ঘাঁটি করবো না। আমরা গো-মাংস ভিত্তিক আলোচনার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখব। আমরা অনকেই হয়তো জানি না যে, হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া যেমন নিষেধ তেমনি শূকর বা শুয়োরের মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ। হিন্দু ধর্মে যত অবতার রয়েছেন তার মধ্যে একজন হলেন বরাহ অবতার। এই বরাহ অবতার হলেন শূকর বা শুয়োর। হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব লোক গো-মাতাকে রক্ষা করার জন্য গরু কোরবানি এবং গো-মাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণ করে, তারা কিন্তু শূকরের মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করে না।
ভারতে হিন্দু ছাড়াও আরও তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায় হলো- মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী। এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষই কিন্তু গরুর মাংস খান। ইদানিং গো-কোরবানি বা গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা ঘটে গেল, তার ফলে ওরা কি ভারতের এই তিন সম্প্রদায়ের বৈধ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করলো না? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের পর ভারত কোন মুখে ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়াবে?
এই অরাজকতা, নৈরাজ্য এবং সহিংসতার গোড়া পত্তন করেছেন ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি’র একজন পাওয়ারফুল নেতা রাজ নাথ সিং। সকলেই জানেন যে, প্রতি বছর ভারত থেকে অনেক গরু বাংলাদেশে আসে। কোরবানির ঈদের আগে লাখ লাখ গরু সীমান্ত হয়ে এপারে চালান হয়। কিন্তু গত ঈদে বাংলাদেশে কোটি কোটি মুসলমানকে গুরুর মাংস খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিম বঙ্গ সফরে এসে রাজ নাথ সিং ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে বিজেপির শাসনকাল পর্যন্ত একটি গরুও আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তার এই ঘোষণার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের গো-মাতাকে রক্ষা করা। ভারত গরু রপ্তানী করবে কি করবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে গরুর গোশ্ত খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের ওপর হামলা হবে কেন?
ভারতের নীতি সম্পূর্ণ স্ব-বিরোধী। দেশের অভ্যন্তরে গরু জবাই করলে গো-মাংস ভক্ষণকারীদের মারপিট করা হবে, ক্ষেত্র বিশেষে হত্যাও করা হবে। গো-মাতাকে রক্ষা করাই যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে ভারত হাজার হাজার কোটি টাকার গরুর গোশ্ত বিদেশে রপ্তানী করছে কিভাবে? গরুর গোশ্ত রপ্তানী করে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে গেলে তো ভারতকে লাখ লাখ গরু জবাই করতে হচ্ছে। তার বেলা? খাদ্য হিসাবে গো-মাংস ভক্ষণ করলে দেবতার অবমাননা হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ গরু জবাই করলে দেবতার সম্মান কি আরও বৃদ্ধি পায়? ভারতের এই স্ব-বিরোধীতা দেখে ভারতেই কোনো এক কবি লিখেছেন,
কিবা গাছের গুণ
একই গাছে পান সুপারি
একই গাছে চুন।
॥ তিন ॥
গত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত একটি বিষয়ে বিজেপি বেশ বদ্ধপরিকর ছিল। এই ধরণের সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলো নির্মূল করার জন্য অনেক বড় বড় জন সভায় স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি ওয়াদা করেছেন। কিন্তু সরকার গঠন করার পরবর্তী ১৬ মাসে দেখা যাচ্ছে যে, ঐ সমস্ত ওয়াদা কার্পেটের তলে চলে গেছে। এখন ১৩০ কোটি লোকের বিশাল ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিজেপি এবং তার অঙ্গ সংগঠনের হিন্দুত্ববাদী নেতারা আদা পানি খেয়ে নেমেছেন। তাদের এই সাম্প্রদায়িক তৎপরতার মুখে প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিষ্ক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তিনি কি উগ্রপন্থীদের কাছে অসহায়? নাকি তার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ? ভারতের ৪১ জন অত্যন্ত নাম করা লেখক, যারা ভারতের রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হয়েছেন, তারাও এই গো-মাংসকেন্দ্রিক উগ্রবাদীতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবারের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকায় দেখলাম, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা অনুসন্ধান করবেন, কেন এই লেখকরা পদক ফিরিয়ে দিলেন। আমার তো মনে হয়, এখানে ঘটা করে অনুসন্ধানের কিছু নাই। তারা তো বিবৃতি দিয়েই পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই বিবৃতিতে তারা বলেছেন যে, গো-মাতাকে নিয়ে উগ্রবাদী হিন্দুদের ঐ হিংসাত্মক আচরণ তারা সমর্থন করেন না।
॥ চার ॥
অবশেষে বাংলাদেশ বিশাল ছাড় দিল ভারতকে। শুধু বিশাল ছাড় বলি কেন, রীতিমতো সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্ত ছাড় দিল বাংলাদেশ। এই সুবিধাটিই চাচ্ছিল ভারত। আজ নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার শুরু থেকে। সঠিকভাবে বলতে গেলে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। অতীতের কোন সরকারই ভারতকে এই কনসেশন দেয়নি। কিন্তু এবার দেওয়া হলো। বিনিময়ে কি পেলো বাংলাদেশ? কিছুই পায়নি। একেবারে লবডঙ্গ, ঠন্ ঠনা ঠন্ ঠন্। গত ১৬ অক্টোবর শুক্রবার উদ্বোধন করা হয়েছে কলকাতা আগরতলা ভায়া বাংলাদেশ বাস সার্ভিস। এর অর্থ হলো পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতা এবং ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সরাসরি সংযুক্ত হলো, তবে সেটি বাংলাদেশ হয়ে। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, ওদের বাস ভারতের এক জায়গা থেকে ভারতেরই আরেক জায়গায় যাবে। অর্থাৎ ভারত থেকে ভারত যাবে। এই যাওয়ার পথে তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে।
সরকার এটিকে বলে ট্রানজিট। কিন্তু আলোচ্য বাস সার্ভিস ট্রানজিট নয়, করিডোর। এক দেশ থেকে আরেক দেশ হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়াকে বলে ট্রানজিট। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এক দেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে নয়, এমনকি দ্বিতীয় কোনো দেশেও নয়, একই দেশের এক স্থান থেকে সেই দেশেরই আরেক স্থানে যাওয়া হচ্ছে। মাঝখানে অপর একটি দেশের অর্থাৎ বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এটির নাম করিডোর, ট্রানজিট নয়।
এতদিন ধরে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে বাস সার্ভিস চালু ছিল। এবার ভারতের আরেকটি প্রদেশ অর্থাৎ ত্রিপুরা এই সার্ভিসে যুক্ত হলো। গত জুন মাসে ঢাকায় এসে ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই চুক্তিটির বাস্তবায়ন হলো চার মাস ১২ দিন পর গত শুক্রবার। গত শুক্রবার ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ৪৫ আসন বিশিষ্ট একটি ভলবো বাস কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এই বাসটি ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। অনুরূপভাবে কলকাতা থেকে অপর একটি বাস আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা যাবে।
প্রথমপর্যায়ে এই বাস সার্ভিস সপ্তাহে ২ দিন অপারেট করবে। ভাড়া হবে ভারতীয় রুপিতে ১৮০০ থেকে ২০০০ রুপি। ইতিপূর্বে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে অথবা আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে পাড়ি দিতে হতো ১৬৭৫ কিলোমিটার পথ। কিন্তু এখন বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা বা আগরতলা যেতে পাড়ি দিতে হবে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার পথ। অর্থাৎ বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে পেয়ে ভারতের কমে গেল ১১৬০ কিলোমিটার পথ। অতীতে এই ১৬৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত ৩৬ ঘণ্টা। কিন্তু এখন বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে পেয়ে তাদের সময় লাগবে মাত্র ১৬ ঘন্টা। অর্থাৎ তাদের সময় বেঁচে গেল ২০ ঘণ্টা।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিগত সফরকালে তিনি দু’টি বাস সার্ভিস উদ্বোধন করেন। একটি হলো ঢাকা-শিলং-গৌহাটি, আরেকটি হলো ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা। কিন্তু ঢাকা কলকাতা আগরতলা বাস সার্ভিস শুধু উদ্বোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিয়মিত বাস সার্ভিস চলাচল করছে ঢাকা-কলকাতা এবং ঢাকা আগরতলা বাস সার্ভিস। আর ট্রেন সার্ভিস রয়েছে ঢাকা-কলকাতার মধ্যেই। ১৯৯৯ সালে ঢাকা কলকাতা বাস সার্ভিস চালু হয়। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়। খুলনা-কলকাতা এবং যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার দ্বয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে। রেল যোগাযোগ খাতে আখাউড়া আগরতলা রেল সংযোগ এবং পুরাতন রেল সংযোগ সমূহ চালু করার ব্যাপারেও দুই দেশের সরকার দ্বয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ ভারতকে সম্পূর্ণ এবং বহুমুখী করিডোর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দিলো। এর আগে ভারতকে মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এই দুটি সুবিধাই ভারত চাচ্ছিল বিগত ৬৭ বছর ধরে। ৬৭ বছর পর তারা সেই দুটি সুবিধাই পেয়ে গেল। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি পেলাম?
বাংলাদেশে একটি গান আছে, যার প্রথম দু’টি লাইন হলো,
তোমাকে ভালবেসে আমি অবশেষে
কি পেলাম?
বাংলাদেশ তো উদার। সে মুক্ত হস্তে দান করে। বাংলাদেশ দান ছত্র খুলে বসেছে। তাই আমরা সব সময় গেয়ে চলি,
রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি
দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু ভালবাসা
দিলাম আমি তাই।
(১) জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হলেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদ। তিনি তার বাস ভবনে কয়েকজন মুসলমান মেহমানকে দাওয়াত করেছিলেন। তাদেরকে গরুর গোশ্ত দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এটি ছিল একটি ‘মহা অপরাধ’। এরপর কাশ্মীরের প্রাদেশিক পরিষদের (সংসদ) অধিবেশন চলছিল। অধিবেশন চলাকালেই গরুর মাংস খাওয়ানোর অপরাধে (?) সংসদের বিজেপি সদস্যরা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে মারধর করতে থাকে। সংসদের কংগ্রেস সদস্যরা এসে ইঞ্জিনিয়ার রশিদকে রক্ষা করেন। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৫ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ৪)।
(২) গরুর গোশত খাওয়ার অপরাধে দিল্লীতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একদল লোক একজন মুসলমানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, বেধড়ক পেটায় এবং এই ভয়াবহ প্রহারে মুসলমান লোকটি মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, তার রেফ্রিজারেটরে কোনো গরুর গোশ্ত ছিল না। ছিল খাসির মাংস। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৩) ব্যাঙ্গালোরে একজন হিন্দু মহিলার সাথে কথা বলার অপরাধে একজন মুসলমানকে বেধড়ক পেটানো হয় এবং মারের পর তার বস্ত্র হরণ করা হয়। অর্থাৎ তাকে উলঙ্গ করা হয়। যারা এই জঘন্য কাজ করে তারা বিজেপি’র সহযোগী সংগঠন বজরং দলের সদস্য। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৪) গুজরাটের মান্ডি নামক স্থানে হিন্দুদের নৃত্যশালায় মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। নবরাত্রি উৎসব উপলক্ষে মুসলমানদের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নিষেধাজ্ঞা জারির উদ্দেশ্য হলো, হিন্দু মহিলাদেরকে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা করা। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৫) উত্তর প্রদেশের একটি মন্দিরে প্রবেশের চেষ্টা করেন এক নবতিপর (যার বয়স ৯০ বছরের কম নয়) বৃদ্ধ। এটি ছিল কট্টরপন্থীদের কাছে একটি ‘গোস্তাকি’। এই গোস্তাকির জন্য ঐ নবতিপর বৃদ্ধের গায়ে আগুন লাগিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৬) বিজেপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একটি নতুন কর্মসূচীর বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কর্মসূচীটির নাম ঘর ‘ওয়াপসি’ (গৃহ প্রত্যাবর্তন বা ঘরে ফেরা)। এই কর্মসূচীর অধীনে গত সপ্তাহে বেনারশির নিকট অবস্থিত একটি গ্রামে ৩০০ ব্যক্তিকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে হিন্দু বানানো হয়েছে। যে সংগঠনটি এই অপকর্মটি করেছে সেই সংগঠনটির নাম ধর্ম জাগরণ সমন্বয় সমিতি। তাদেরকে বল পূর্বক হিন্দু বানিয়ে তাদের হাতে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘গীতা’ এবং ‘হনুমান চালিসা’ ধরিয়ে দেওয়া হয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৭) গজল স¤্রাট মেহেদী হাসানের পর গজলের ঐন্দ্রজালিক সুরে যিনি এই উপমহাদেশকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন তার নাম গোলাম আলী। মুম্বাইয়ের একটি কনসার্টে গজল পরিবেশনের জন্য তাকে ভারতীয়রাই দাওয়াত করেছিলেন। কিন্তু বিজেপির অঙ্গ সংগঠন শিব সেনা ঐ কনসার্ট হতে দেয়নি এবং গোলাম আলীকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
(৮) এই একই উগ্রপন্থীরা মুম্বাইয়ে এক ব্যক্তির মুখে কালো কালি মেখে দেয়। ঐ ব্যক্তির অপরাধ ছিল এই যে, তিনি একটি পুস্তক প্রকাশনী উৎসবের আয়োজন করেছিলেন, যে পুস্তকটি লিখেছেন পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। (ডেইলি স্টার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫, পৃষ্ঠা ১৪)।
॥ দুই ॥
এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের মনের তীব্র মুসলিম বিদ্বেষের পরিচয় পাওয়া যায়। অতীতে কয়েক হাজার মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা ভারতে সংঘটিত হয়েছে। আজ আমরা ঐসব রক্তাক্ত ও দুঃখজনক অতীত ঘাঁটা ঘাঁটি করবো না। আমরা গো-মাংস ভিত্তিক আলোচনার মধ্যেই নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখব। আমরা অনকেই হয়তো জানি না যে, হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া যেমন নিষেধ তেমনি শূকর বা শুয়োরের মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ। হিন্দু ধর্মে যত অবতার রয়েছেন তার মধ্যে একজন হলেন বরাহ অবতার। এই বরাহ অবতার হলেন শূকর বা শুয়োর। হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব লোক গো-মাতাকে রক্ষা করার জন্য গরু কোরবানি এবং গো-মাংস ভক্ষণের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক আক্রমণ করে, তারা কিন্তু শূকরের মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য করে না।
ভারতে হিন্দু ছাড়াও আরও তিন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। এই তিন ধর্মীয় সম্প্রদায় হলো- মুসলমান, খ্রিষ্টান এবং ইহুদী। এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষই কিন্তু গরুর মাংস খান। ইদানিং গো-কোরবানি বা গরু জবাইয়ের বিরুদ্ধে যে সহিংসতা ঘটে গেল, তার ফলে ওরা কি ভারতের এই তিন সম্প্রদায়ের বৈধ নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার হরণ করলো না? বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার হরণের পর ভারত কোন মুখে ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি আওড়াবে?
এই অরাজকতা, নৈরাজ্য এবং সহিংসতার গোড়া পত্তন করেছেন ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বিজেপি’র একজন পাওয়ারফুল নেতা রাজ নাথ সিং। সকলেই জানেন যে, প্রতি বছর ভারত থেকে অনেক গরু বাংলাদেশে আসে। কোরবানির ঈদের আগে লাখ লাখ গরু সীমান্ত হয়ে এপারে চালান হয়। কিন্তু গত ঈদে বাংলাদেশে কোটি কোটি মুসলমানকে গুরুর মাংস খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিম বঙ্গ সফরে এসে রাজ নাথ সিং ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে বিজেপির শাসনকাল পর্যন্ত একটি গরুও আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তার এই ঘোষণার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের গো-মাতাকে রক্ষা করা। ভারত গরু রপ্তানী করবে কি করবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে গরুর গোশ্ত খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের ওপর হামলা হবে কেন?
ভারতের নীতি সম্পূর্ণ স্ব-বিরোধী। দেশের অভ্যন্তরে গরু জবাই করলে গো-মাংস ভক্ষণকারীদের মারপিট করা হবে, ক্ষেত্র বিশেষে হত্যাও করা হবে। গো-মাতাকে রক্ষা করাই যদি তাদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে ভারত হাজার হাজার কোটি টাকার গরুর গোশ্ত বিদেশে রপ্তানী করছে কিভাবে? গরুর গোশ্ত রপ্তানী করে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে গেলে তো ভারতকে লাখ লাখ গরু জবাই করতে হচ্ছে। তার বেলা? খাদ্য হিসাবে গো-মাংস ভক্ষণ করলে দেবতার অবমাননা হয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য লক্ষ লক্ষ গরু জবাই করলে দেবতার সম্মান কি আরও বৃদ্ধি পায়? ভারতের এই স্ব-বিরোধীতা দেখে ভারতেই কোনো এক কবি লিখেছেন,
কিবা গাছের গুণ
একই গাছে পান সুপারি
একই গাছে চুন।
॥ তিন ॥
গত নির্বাচনের আগে পর্যন্ত একটি বিষয়ে বিজেপি বেশ বদ্ধপরিকর ছিল। এই ধরণের সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলো নির্মূল করার জন্য অনেক বড় বড় জন সভায় স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি ওয়াদা করেছেন। কিন্তু সরকার গঠন করার পরবর্তী ১৬ মাসে দেখা যাচ্ছে যে, ঐ সমস্ত ওয়াদা কার্পেটের তলে চলে গেছে। এখন ১৩০ কোটি লোকের বিশাল ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য বিজেপি এবং তার অঙ্গ সংগঠনের হিন্দুত্ববাদী নেতারা আদা পানি খেয়ে নেমেছেন। তাদের এই সাম্প্রদায়িক তৎপরতার মুখে প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিষ্ক্রিয় দেখা যাচ্ছে। তিনি কি উগ্রপন্থীদের কাছে অসহায়? নাকি তার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ? ভারতের ৪১ জন অত্যন্ত নাম করা লেখক, যারা ভারতের রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হয়েছেন, তারাও এই গো-মাংসকেন্দ্রিক উগ্রবাদীতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রীয় পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবারের এক শ্রেণীর পত্র পত্রিকায় দেখলাম, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা অনুসন্ধান করবেন, কেন এই লেখকরা পদক ফিরিয়ে দিলেন। আমার তো মনে হয়, এখানে ঘটা করে অনুসন্ধানের কিছু নাই। তারা তো বিবৃতি দিয়েই পদক ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই বিবৃতিতে তারা বলেছেন যে, গো-মাতাকে নিয়ে উগ্রবাদী হিন্দুদের ঐ হিংসাত্মক আচরণ তারা সমর্থন করেন না।
॥ চার ॥
অবশেষে বাংলাদেশ বিশাল ছাড় দিল ভারতকে। শুধু বিশাল ছাড় বলি কেন, রীতিমতো সম্পূর্ণ এবং নিঃশর্ত ছাড় দিল বাংলাদেশ। এই সুবিধাটিই চাচ্ছিল ভারত। আজ নয়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার শুরু থেকে। সঠিকভাবে বলতে গেলে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই। অতীতের কোন সরকারই ভারতকে এই কনসেশন দেয়নি। কিন্তু এবার দেওয়া হলো। বিনিময়ে কি পেলো বাংলাদেশ? কিছুই পায়নি। একেবারে লবডঙ্গ, ঠন্ ঠনা ঠন্ ঠন্। গত ১৬ অক্টোবর শুক্রবার উদ্বোধন করা হয়েছে কলকাতা আগরতলা ভায়া বাংলাদেশ বাস সার্ভিস। এর অর্থ হলো পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতা এবং ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা সরাসরি সংযুক্ত হলো, তবে সেটি বাংলাদেশ হয়ে। বিষয়টি স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, ওদের বাস ভারতের এক জায়গা থেকে ভারতেরই আরেক জায়গায় যাবে। অর্থাৎ ভারত থেকে ভারত যাবে। এই যাওয়ার পথে তারা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যাবে।
সরকার এটিকে বলে ট্রানজিট। কিন্তু আলোচ্য বাস সার্ভিস ট্রানজিট নয়, করিডোর। এক দেশ থেকে আরেক দেশ হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে যাওয়াকে বলে ট্রানজিট। কিন্তু আলোচ্য ক্ষেত্রে এক দেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে নয়, এমনকি দ্বিতীয় কোনো দেশেও নয়, একই দেশের এক স্থান থেকে সেই দেশেরই আরেক স্থানে যাওয়া হচ্ছে। মাঝখানে অপর একটি দেশের অর্থাৎ বাংলাদেশের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এটির নাম করিডোর, ট্রানজিট নয়।
এতদিন ধরে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বঙ্গের মধ্যে বাস সার্ভিস চালু ছিল। এবার ভারতের আরেকটি প্রদেশ অর্থাৎ ত্রিপুরা এই সার্ভিসে যুক্ত হলো। গত জুন মাসে ঢাকায় এসে ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই চুক্তিটির বাস্তবায়ন হলো চার মাস ১২ দিন পর গত শুক্রবার। গত শুক্রবার ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ৪৫ আসন বিশিষ্ট একটি ভলবো বাস কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। এই বাসটি ঢাকা হয়ে কলকাতা যাবে। অনুরূপভাবে কলকাতা থেকে অপর একটি বাস আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে এবং ঢাকা হয়ে আগরতলা যাবে।
প্রথমপর্যায়ে এই বাস সার্ভিস সপ্তাহে ২ দিন অপারেট করবে। ভাড়া হবে ভারতীয় রুপিতে ১৮০০ থেকে ২০০০ রুপি। ইতিপূর্বে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে অথবা আগরতলা থেকে কলকাতা যেতে পাড়ি দিতে হতো ১৬৭৫ কিলোমিটার পথ। কিন্তু এখন বাংলাদেশ হয়ে কলকাতা বা আগরতলা যেতে পাড়ি দিতে হবে মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার পথ। অর্থাৎ বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে পেয়ে ভারতের কমে গেল ১১৬০ কিলোমিটার পথ। অতীতে এই ১৬৭৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত ৩৬ ঘণ্টা। কিন্তু এখন বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে পেয়ে তাদের সময় লাগবে মাত্র ১৬ ঘন্টা। অর্থাৎ তাদের সময় বেঁচে গেল ২০ ঘণ্টা।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিগত সফরকালে তিনি দু’টি বাস সার্ভিস উদ্বোধন করেন। একটি হলো ঢাকা-শিলং-গৌহাটি, আরেকটি হলো ঢাকা-কলকাতা-আগরতলা। কিন্তু ঢাকা কলকাতা আগরতলা বাস সার্ভিস শুধু উদ্বোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিয়মিত বাস সার্ভিস চলাচল করছে ঢাকা-কলকাতা এবং ঢাকা আগরতলা বাস সার্ভিস। আর ট্রেন সার্ভিস রয়েছে ঢাকা-কলকাতার মধ্যেই। ১৯৯৯ সালে ঢাকা কলকাতা বাস সার্ভিস চালু হয়। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়। খুলনা-কলকাতা এবং যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিস চালুর ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার দ্বয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে। রেল যোগাযোগ খাতে আখাউড়া আগরতলা রেল সংযোগ এবং পুরাতন রেল সংযোগ সমূহ চালু করার ব্যাপারেও দুই দেশের সরকার দ্বয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশ ভারতকে সম্পূর্ণ এবং বহুমুখী করিডোর সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দিলো। এর আগে ভারতকে মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে। এই দুটি সুবিধাই ভারত চাচ্ছিল বিগত ৬৭ বছর ধরে। ৬৭ বছর পর তারা সেই দুটি সুবিধাই পেয়ে গেল। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কি পেলাম?
বাংলাদেশে একটি গান আছে, যার প্রথম দু’টি লাইন হলো,
তোমাকে ভালবেসে আমি অবশেষে
কি পেলাম?
বাংলাদেশ তো উদার। সে মুক্ত হস্তে দান করে। বাংলাদেশ দান ছত্র খুলে বসেছে। তাই আমরা সব সময় গেয়ে চলি,
রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি
দেবার কিছু নাই,
আছে শুধু ভালবাসা
দিলাম আমি তাই।
আসিফ আরসালান
0 comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন