শনিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

এক নতুন নেপাল প্রসংগ


আমেরিকা থেকে ড. আলী রিয়াজ লিখেছেন যে, ভারত কর্তৃক নেপাল অবরোধ নিয়ে পাশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশে যত আলোচনা হওয়ার এবং মিডিয়া কাভারেজ পাওয়ার কথা ছিল ততখানি আলোচনা হয়নি এবং ততখানি মিডিয়া কাভারেজ পায়নি। ড. আলী রিয়াজ সঠিক কথাই বলেছেন। প্রিন্ট মিডিয়াতে তাও কিছুটা আলোচনা হয়েছে এবং কিছুটা কাভারেজ পেয়েছে। কিন্তু ইলেকট্রনিক মিডিয়া বলতে গেলে এ সম্পর্কে মোটামুটি নীরব থেকেছে। ব্যাপারটি একদিকে যেমন দুঃখজনক অন্যদিকে তেমনি রহস্যময়। নেপাল তার নিজস্ব সংবিধান রচনা করেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সেটি অনুমোদন করেছে। ভাল হোক খারাপ হোক, এটি তো তাদের সংবিধান। তারা নিজেরা সংবিধান বানিয়েছেন এবং সেই সংবিধান মোতাবেকই ভবিষ্যতে দেশ চালাবেন। এতে অন্য কারোর কিছু বলার কথা নয়। আমার মুরগি আমি আগায় জবাই করবো নাকি পেছনে জবাই করবো সেটি একান্তই আমার বিষয়। কিন্তু সেখানেও ভারত নাক গলিয়েছে। সংবিধান পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। তার আগেই নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে কয়েক দফা দৌড় ঝাঁপ করেছেন ভারতের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
অথচ গত ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে নেপালে চলছে এক ধরনের অবরোধ। নেপালের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে এই অবরোধ আরোপিত হলেও ২ কোটি ৭৮ লক্ষ অধিবাসী অধ্যুষিত নেপালের সবাই কম বেশি এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে বিক্ষিপ্তভাবে যেসব রিপোর্ট আসছে সেসব রিপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটিতে খাদ্য এবং জ্বালানির সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মানবতাবাদী সেবা সংস্থাগুলো বলছে যে সেই দেশে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। এই বিপর্যয়ের কথা আমরা খুব ভাল করে জানি না। কেন জানি না? কারণ আমাদের মিডিয়া তাদের দুঃখ দুর্দশার পূর্ণ চিত্র তুলো ধরছে না। কেন তুলে ধরছে না? কারণ নেপালী জনগণের দুর্দশার মূলে রয়েছে ভারত। যেভাবে নেপালের সংবিধান পাশ হয়েছে এবং যেভাবে সেটি চালু হয়েছে সেটি ভারতের মোটেই মনঃপূত হয়নি। সংবিধানের অন্তত ৭ টি জায়গা ভারত সংশোধন করতে বলেছিল। কিন্তু নেপালী পার্লামেন্টের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ভারতের আপত্তি বা সুপারিশ আমলে নেয়নি। সুতরাং ভারত ক্ষেপে গিয়েছে। ক্ষেপে উঠে তারা নেপালের ওপর অবরোধ বসিয়েছে, বিশেষ করে জ্বালানি অবরোধ।
নেপালে যে সংবিধান চালু হয়েছে সেটির কাঠামো হলো ফেডারেল। দেশটিকে ৭ টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। এটি ভারত পছন্দ করেনি। দ্বিতীয়ত সংবিধানটি গণতান্ত্রিক। ভারত প্রথম থেকেই নেপালের গণতন্ত্রায়ন চায়নি। কারণ, নিখাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে আধিপত্যবাদী শক্তি সেই গণতান্ত্রিক দেশটির ওপর প্রভুত্বের ছড়ি ঘুরাতে পারে না। সে কারণেই নেপালে একটি লিখিত গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু হোক, সেটি ভারত চায়নি। সেই সংবিধানের ভিত্তিতে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, সেটাও চায়নি। তাই ভারতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নেপালে যখন সংবিধান চালু হলো এবং সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো তখন ভারত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত সেখানে তেল সরবরাহ গত মাসে বন্ধ করে দেয়। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, নেপাল গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের তেল-রাজনীতির হাতে বন্দী হয়ে আছে। ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশনই একমাত্র কোম্পানি যা নেপালের তেলের চাহিদা মেটাতো। জ্বালানি খাতে ভারতীয় কোম্পানিটির একতরফা দখলদারিত্বকে পুঁজি করে নেপালের রাজনীতিতে ভারত বিভিন্ন সময় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে আসছিল। সবশেষে গত মাসে দেশটির নতুন লিখিত সংবিধান ভারতের পছন্দমত না হওয়ায় তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন। এতে নজিরবিহীন সংকটে পড়ে নেপালের অর্থনীতি। এর জের ধরেই তেলের বিকল্প সরবরাহের দিকে ঝুঁকে পড়ে নেপাল।
॥দুই॥
গত মাসে ভারত তেল সরবরাহ বন্ধের পরপরই সংকটে নিপতিত নেপালকে প্রয়োজনীয় তেল সরবরাহের প্রস্তাব দেয় চীন। সেই প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে চীন থেকে তেল আমদানির চুক্তি করেছে নেপাল। এর একটি সুফল এই যে, নেপাল ভারতের আধিপত্যবাদী খপ্পর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসার রাস্তা বের করেছে। এটি তার জন্য বলতে গেলে ছিলো একটি অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, পৃথিবীতে নেপালই একমাত্র দেশ যেটি অফিসিয়ালি হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত। অন্যদিকে পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ যার ১৩০ কোটি অধিবাসীর মধ্যে ১১২ কোটি হিন্দু। দ্বিতীয়ত নেপাল সম্পূর্ণভাবে স্থল পরিবেষ্টিত একটি দেশ যার চার ধারের কোথাও কোনো পানি বা সমুদ্র  নেই। ভারত এতদিন নেপালের ওপর খবরদারি করে এসেছে। এখন সেটিরও অবসান হতে চলেছে। ভারতের দাদাগিরি আচরণের ফলে কোনো প্রতিবেশীর সাথেই তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। ভারতের নিকট থেকে নেপালের শুধুমাত্র তেল আমদানিই বন্ধ হয়নি, নেপালে ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আকাশ সংস্কৃতিও এখন আর নেপালে হামলা করতে পারছে না। কারণ, নেপালে সমস্ত ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করা হয়েছে।
ছোট্ট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপ। আয়তন মাত্র ১১৫ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা মাত্র ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার। সেই দেশটিও ভারতকে তার আধিপত্যবাদী আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। অপর দ্বীপ দেশ সিংহল বা শ্রীলঙ্কা। আয়তন ২৫ হাজার ৩২০ বর্গ মাইল। লোক সংখ্যা ২ কোটি ২৮ লক্ষ। এমন ছোট রাষ্ট্রও ভারতের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পাকিস্তান তো ভারতের চির  বৈরী রাষ্ট্র হিসেবেই বিশ্ব মিডিয়ায় পরিচিত।
॥তিন॥
একটি দেশে যদি স্থায়ী সংবিধান না থাকে এবং সেই সুবাদে যদি সাংবিধানিক সরকার না থাকে তাহলে সেই দেশটির স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দেশটির স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়। এই রকম ঘটনা আমরা দেখেছি পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। সংযুক্ত পাকিস্তান ছিল একটি বড় দেশ। আয়তন বেশি (৩ লক্ষ ৯৭ হাজার ৪৮৫ বর্গ মাইল), জনসংখ্যাও হতো অনেক (৩৬ কোটি ৮০ লক্ষ ৪৩ হাজার ৫৯২)। কিন্তু তেমন একটি বড় দেশ ভেঙ্গে গেল শুধুমাত্র গণতন্ত্রের অভাব, বছরের পর বছর ধরে স্বৈরাচারী শাসন এবং সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের কারণে। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই বিশাল ও বহু বর্ণ ও বহু জাতি বিশিষ্ট ভারতে স্বাধীনতার মাত্র ৩ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সংবিধান চালু হয়। অথচ ভারতের চেয়ে আয়তনে চার ভাগের এক ভাগ পাকিস্তানে সংবিধান চালু হয় স্বাধীনতার ৯ বছর পর, অর্থাৎ ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। ভারতের স্বাধীনতার পর ৬৮ বছর গত হয়েছে। এই ৬৮ বছরে একবারও ভারতের সংবিধান এবং সাংবিধানিক সরকার হোঁচট খায়নি। অথচ পাকিস্তানে সংবিধান টিকেছিল মাত্র ১ বছর ৭ মাস। ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে সেনা প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৬ সালের বহু দলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র ভিত্তিক শাসনতন্ত্র বাতিল করেন। ১০ বছর জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে রাখেন। এসব ইতিহাস এবং পরবর্তী ইতিহাস আপনারা সকলেই জানেন। ক্ষমতা লিপ্সা, পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা এবং সাংবিধানিক সরকারের পরিবর্তে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কারণেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়।
॥চার॥
নেপালেও সংবিধান নিয়ে অনেক কাটা ছেঁড়া এবং এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার দেব মুখার্জী একটি লেখায় বলেছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে নেপালে ছয়টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম চারটি প্রণয়ন করেছে রানা বা রাজদরবার। রানাদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন শেষ হওয়ার পর নেপালের রাজনীতিতে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু রাজা মহেন্দ্র সেই বাতাস চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন, তিনি সরকার ভেঙে দিয়ে ১৯৬২ সালে একটি সংবিধান চাপিয়ে দেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে নিজের একক কর্তৃত্বে ‘পঞ্চায়েত রাজ’ গঠন করেন। তারপর ১৯৯০ সালের সংবিধান পেতে নেপালি কংগ্রেসকে প্রায় ৩০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলন করতে হয়েছে। সেই সংবিধান আসলে রাজ দরবার ও রাজনৈতিক দলের আপস রফার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিল। ওই সংবিধান নেপালকে পঞ্চায়েত-রাজের হাত থেকে মুক্তি দিলেও রাজা জ্ঞানেন্দ্র ২০০৫ সালের প্রাসাদ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেন। ২০০৬ সালের এপ্রিলে যে দ্বিতীয় গণআন্দোলন গড়ে ওঠে, তার মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন হয়। রাজনৈতিক নির্বাসন থেকে সংসদকে ফিরিয়ে আনা হয়, শাসনব্যবস্থার কাঠামো প্রণয়ন করতে তারা ২০০৭ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করেন।
॥পাঁচ॥
অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে হিমালয় কন্যা নেপাল। চলতি বছরেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে নেপালে মারা যান ১০ হাজার মানুষ। তারপর আবার এবছরেই সংবিধান বিরোধী বিক্ষোভে মারা গেছেন ৪৫ জন মানুষ। এ অবস্থাতেই দীর্ঘ ৭ বছরের তীব্র বাদানুবাদ এবং প্রাণহানির মধ্য দিয়ে নেপাল আবির্ভূত হয়েছে ফেডারেল গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নেপাল হিসেবে। ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্র একটি সংবিধানের মাধ্যমে দেশটিকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে রূপান্তরিত করেন। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পর অর্থাৎ প্রায় ৫৩ বছর পর বর্তমান সংবিধান গ্রহণের মাধ্যমে হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ধর্মনিরপেক্ষ নেপালে রূপান্তরিত হলো। আর এই সংবিধানটি চালু হয়েছে গত ২০ সেপ্টেম্বর। এবং তার মাত্র ২ দিন পর অর্থাৎ গত ২৩ সেপ্টেম্বর নেপালের ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করলো ভারত। পূর্বমূখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে নেপাল সেই অবরোধের জগদ্দল পাথর সরাবার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ ভারতকেন্দ্রিক বা ইন্দো সেন্ট্রিক নীতির পরিবর্তে চীনের সাথে চুক্তি তথা পূর্ব মুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে।
এখন এই অঞ্চলের সকলেই পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। এমন কি ভারতও পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করেছে এবং ইতোমধ্যেই মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছে। অথচ পূর্বমুখী নীতি গ্রহণ করে ছিলো সর্বাগ্রে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশই আজ এই ব্যাপারে সবচেয়ে পিছিয়ে। বাংলাদেশ আজ পূর্বমুখী নীতির পরিবর্তে একমুখী নীতি অনুসরণ করছে। যেখানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ প্রভৃতি ছোট ছোট দেশ বহুমুখী নীতি অনুসরণ করছে সেখানে বাংলাদেশ আয়তন ও জনসংখ্যায় তাদের চেয়ে অনেক বড় হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নীতি এককেন্দ্রিক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটাকে বলেন ইন্দোসেন্ট্রিক বা ভারতকেন্দ্রিক নীতি। এসব ক্ষেত্রে ভারত এগিয়ে গেলো, চীন এগিয়ে গেলো, এমনকি নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কাও এগিয়ে গেলো। শুধুমাত্র পেছনে পড়ে রইলো বাংলাদেশ। ভারত যা চেয়েছে বাংলাদেশ দিয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চলতে পারছে না। প্রশ্ন হলো, কতো দিন আর আমরা ভারতের  চাদরের নিচে থাকবো?
আসিফ আরসালান

শুক্রবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

দমন-পীড়ন গণতন্ত্রের পথ নয়


দেশে কিছু ঘটলেই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর দায়ভার চাপানোর মানসিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শাসকদলের এ তৎপরতা দেশবাসীর কাছে প্রায় দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে পড়ছে। এতে ক্ষমতাসীনদের ভাবমর্যাদা যে মোটেও বাড়ছে না, তা নিশ্চয়ই তাদের বোধগম্যের মধ্যে রয়েছে বলে আমরা মনে করতে চাই। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এর লক্ষণ আমাদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে না। সম্প্রতি দু’জন বিদেশী নাগরিক হত্যা ও তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে গ্রেনেড হামলার জন্য জামায়াত-শিবির ও বিএনপিকে জড়িয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকেও একই সুরে কথা বলে বাজিমাতের জন্য ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে। পুলিশ নেমে পড়েছে কর্তার হুকুমে সন্ত্রাসী আটক করতে। একইভাবে পাকড়াও করা হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের ঢালাওভাবে। জড়ানো হচ্ছে জামিনের অযোগ্য মামলায়। এমনই দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে দেশে। বিদেশে চিকিৎসাধীন থাকা নেতাদেরও জড়ানো হচ্ছে এসব মামলায়। এছাড়া ঘরোয়া অনুষ্ঠান থেকে তুলে নিয়েও বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসী হামলার আসামী বানানো হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনীতি যখন নিজেই গৃহবন্দী তখন এদেশে গণতন্ত্রের কী দুর্দিন তার বর্ণনা প্রয়োজনহীন বৈকি।
দিন-রাত সকল পর্যায়ের নেতা-নেত্রীদের মুখে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর দোষ চাপিয়ে এবং  দেশীয় মিডিয়ায় সিন্ডিকেটেড রিপোর্ট করেও যখন পার পাওয়া যাচ্ছে না, তখন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষের আইনজীবীদের গ্রেফতার-রিমান্ডের মতো ঘটনা ঘটছে। শুধু তাই নয়, বিদেশী সাংবাদিকও ভাড়া করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট তৈরি করা হচ্ছে প্রচারণার জন্য। অবশ্য ক্ষমতাসীনদের এসব অরাজনীতিক সুলভ অপতৎপরতা ও প্রচারণার তীব্র প্রতিবাদ করা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত-শিেিবরর তরফ থেকে। কিন্তু উপযুক্ত প্রচার পায় না। ফলে সাধারণ মানুষ অনেকটাই অন্ধকারে থাকছেন। কিন্তু যাদের চোখ-কান খোলা তারা ঠিকই প্রকৃত পরিস্থিতি অনুধাবন করে যাচ্ছেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দমিয়ে রাখবার হীনউদ্দেশ্যে যতই জুলুম-নির্যাতন চালানো হোক না কেন, শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, একদিন না একদিন শাকের ভেতর থেকে মাছ বেরিয়ে পড়বেই। অর্থাৎ কোনও মিথ্যাচার গোপন থাকবে না। সত্যের আগুন দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে চতুর্দিকে। ক্ষমতাসীনরা হয় তো মনে করছেন যে, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ফাঁসিয়ে কিংবা তাদের জেলে পুরে রেখে তারা উদ্দেশ্য হাসিল করতে সক্ষম হবেন। তারা যা করবেন তাই গণতন্ত্র বলে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু এ কথা মনে রাখা জরুরি যে, ‘চিরদিন সবার সমান নাহি যায়।’ সুতরাং বৈরিতা, হিংসা, প্রতিহিংসা কখনই ভালো ফল দেয় না, এটা ক্ষমতাসীনদেরই সবচেয়ে বেশি বুঝা উচিত।
গণতন্ত্র মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে নাগরিকদের বেশিদিন বঞ্চিত করে রাখা যায় না। এর পরিণতিও হয় না সুখকর। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখতে যতই মামলা-হামলা চালানো হোক, জনগণ কিন্তু চোখ-কান খুলে রেখেছেন। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের যতই দোষ দেয়া আর তাদের মামলায় জড়িয়ে জেলে পুরে রাখা হোক না কেন, সচেতন জনগণ কিন্তু সবই দেখছেন। সবকিছু বুঝছেনও। আর সব দোষ কেবল নন্দ ঘোষের ওপর চাপিয়ে যে পার পাওয়া যাবে না- তা নিশ্চয়ই সরকার বুঝেন। এই বুঝটা অবশ্যই বিবেকের একটা সতর্ক বাণী। সরকার এটা উপলব্ধি করুন, হিংসা বৈরিতার পথ থেকে সবাই ফিরে আসুন, জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক এটা দেশের সবাই চায়।

বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরি?


কবি ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪) কাব্যগ্রন্থে সঙ্কলিত ‘পাঞ্জেরি’ একটি কালজয়ী কবিতা। পাঞ্জেরি হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি জাহাজের সামনে বা মাস্তুলের বাতি দিয়ে চারপাশ দেখে মাঝিকে পথনির্দেশ করেন। কার্যত পাঞ্জেরি হলেন পথপ্রদর্শক। ফররুখ আহমদ পাঞ্জেরির প্রতীকে দুর্দশাগ্রস্ত জাতির পথের সন্ধান করেছেন। অন্ধকারে, কুয়াশায়, উত্তাল সাগরে পথের নিশানার জন্য অবিরাম দাঁড় টেনে চলা। সামনে আলোর দিশা মিলবে, এক সময় অন্ধকার কেটে যাবে- এমন আশা নিয়ে অবিরাম দাঁড় টেনে যাচ্ছে অভিযাত্রী দল। কখন রাত পোহাবে, কখন সূর্য উঠবে। কিন্তু এই পথচলায় ভুল আছে। আর সে ভুলের খেসারত শুধু নৌকার মাঝি-মাল্লা বা পাঞ্জেরিই দিচ্ছে, তা নয়। এদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে মুসাফির, সওদাগর, ক্ষুধাতুর মজলুম আর সাধারণ মানুষকেও। আর তাই ফররুখ লিখেছেন, ‘পাঞ্জেরি!/ জাগো বন্দরের কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি,/ জাগো অনশন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রূকুটি হেরি!/ দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!’
এখন বাংলাদেশের মানুষের কেবলই রাত পোহাবার অপেক্ষা। শূন্যতা ঘিরে অসীম কুয়াশার আস্তরণ। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আমরা সত্যি সত্যি এক কালো দিগন্তে এসে পৌঁছেছি। এখানে এখন জীবনের জয়ভেরী অস্ত যাবার পথে। এখন মুসাফির নাগরিকের দল আলোর আশায় পেরেশান হয়ে আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের গন্তব্য কেউ যেন ঠাহর করতে পারছে না। গাফিলতি আর খেয়ালের ভুলে আমরা লক্ষ্যহীন কূলকিনারাহীন কোনো দিগন্তের দিকে ছুটে চলেছি। কিন্তু যে নাগরিকরা আমাদের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষমাণ, তাদের সামনে আরও ঘন অন্ধকার নেমে আসছে।
এ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল অনেকদিন ধরেই। তার পেছনে কাজ করেছে সরকারের অপশাসন-দুঃশাসন আর ফ্যাসিবাদী গণতন্ত্রবিরোধী তৎপরতার ফলে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সারা পৃথিবী অগ্রাহ্য করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই যারা বিনা ভোটে জনপ্রতিনিধি হয়ে বসেছেন, তাদের হাতে কেউ নিরাপদ থাকতে পারে না। নিরাপদ নেইও। প্রথম দিকে ক্ষমতা জবরদখলকারী এই সরকার বলেছিল বটে, ঐ নির্বাচন ছিল কেবলই নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। আশা করা গিয়েছিল, শিগগিরই বোধকরি তারা একটি সকলের অংশগ্রহণমূলক নতুন নির্বাচন দেবে। কিন্তু ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সেরকম ইচ্ছা তাদের নেই। ফ্যাসিবাদের ধর্মও তাই। তারা ক্রমেই মুখোশ খুলে ফেলে এখন আপন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। তারা এখন বলতে শুরু করেছে, তারা উন্নয়নে বিশ্বাস করে, গণতন্ত্রে নয়। আর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়ে এই জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার প্রধান বলেছেন, তারা মৌলিক অধিকারে নয়, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী।
এতে যা হবার তাই হয়েছে। সরকার এখন পরিপূর্ণ ফ্যাসিস্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিরোধী দল দমন, গুম-খুন, হাজারে হাজারে মামলা দিয়ে লাখ লাখ সরকারবিরোধীকে আসামী করা, সভা সমাবেশ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নানা কৌশলে হরণ করা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের ফ্যাসিবাদী অভিলাষ পূরণের সহযোগী হিসেবে লাখ লাখ লুঠেরা তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাজার, ব্যাংক লুট, কুইক রেন্টাল, বেতন বৃদ্ধি, দায়মুক্তির মাধ্যমে সে বাহিনীর আকার কেবলই বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনগণের কাছে জবাবদিহিতাহীন আইনপ্রণেতারা আদমপাচার-ড্রাগের ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে, কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এদের মধ্যে অনেকে আবার বন্দুকবাজ। নিজ নির্বাচনী এলাকার লোকদের শায়েস্তা করার জন্য কিংবা নিতান্তই খেয়ালের বশে যখন তখন বিনা কারণে যাকে তাকে গুলী করে বসছেন। এজন্য এ পর্যন্ত কারও বিচার হয়নি। দেখা যাক, সুন্দরগঞ্জের এমপি শুটার লিটনের কী বিচার হয় ৯ বছরের শিশু সৌরভকে অকারণে গুলী করে হত্যার চেষ্টার জন্য।
এরকম একটি ফ্যাসিবাদী শাসন যেখানে থাকে, সেখানে সহজেই আত্মরক্ষার্থে চরমপন্থার উদ্ভব ঘটা বিচিত্র নয়। সেটাই অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক। মানুষ যখন স্বাভাবিক পথে বিচার পায় না, কিংবা সরকার যখন বিচার পাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে, তখন মানুষের মধ্যে আইন নিজের হাতে তুলে নেবার প্রবণতা বাড়ে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। এ পথ ধরেই সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে অস্ট্রেলিয়া জানায়, বাংলাদেশে অস্ট্রেলীয় খেলোয়াড়দের জন্য নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে। এ বিষয়ে তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। এর আগে বিদেশীদের যারাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, সরকার তাদেরই একহাত নিতে কসুর করেনি। তারও আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে পশ্চিমা অনেক দেশের রাষ্ট্রদূতদের অশালীন ভাষায় গালাগাল দিতেও সরকার দ্বিধা করেনি। সরকারের কথাবার্তায় মনে হয়েছে, তারা বোধকরি পৃথিবীতে নয়, ভিন্ন কোনো গ্রহে অবস্থান করছে।
কিন্তু অস্ট্রেলিয়া যখন নিরাপত্তার প্রশ্ন তুললো, তখন সরকার বিষয়টাকে একেবারে পাত্তাই দিতে চাইলো না। তবে অস্ট্রেলিয়া তাদের গোয়েন্দা রিপোর্টে অনড় থাকলো। আর শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া টিমের বাংলাদেশ সফর স্থগিত করল তারা। এত সরকারের গোস্বার অন্ত থাকলো না। তারা এই গোয়েন্দা রিপোর্টকে ঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া টিম বাংলাদেশ সফর বাতিল করে দেয়ার মাত্র দু’দিন পর গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সোয়া ৬টার সময় কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে বেষ্টিত গুলশান এলাকায় আততায়ীর গুলীতে খুন হন ডাচ এনজিওতে কর্মরত ইটালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার। ঐ হত্যাকাণ্ড সুপরিকল্পিত, সন্দেহ নেই। কারণ যেখানে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়, ঘটনার সময়ে সে সড়কের স্ট্রিট লাইট বন্ধ ছিল। হত্যায় অংশ নিয়েছিল দুজন। তাদের আর এক সহযোগী মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই পাশের সড়কে। সে জায়গায়ও স্ট্রিট লাইট বন্ধ ছিল। সিজারকে চারটি গুলী করে ঘাতকরা মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায়। এরপর সড়কবাতিগুলো আবার জ্বলে ওঠে।
এ নিয়ে কূটনীতিক মহলে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর মাত্র ৫ দিন পর রংপুর শহরের নিকটবর্তী আলুটারি গ্রামে কৃষি গবেষণায়রত এক জাপানী নাগরিক হোসি কুনিও একইভাবে খুন হন। সেখানেও একটি মোটরসইকেলে এসেছিল তিন ঘাতক। একজন বসে ছিল মোটরসাইকেলে, অপর দুজন হোসির রিকশা আটকে তাকে গুলী করে হত্যা করে অপেক্ষমাণ মোটরসাইকলে উঠে পালিয়ে যায়।
প্রথম ঘটনা গুলশান এলাকাজুড়ে স্থাপিত শতাধিক সিসি ক্যামেরার কোনোটাতেই ঘাতকদের স্পষ্ট ছবি ধরা পড়েনি। এটাই আমাদের জানিয়ে আসছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আর হোসির হত্যাকারীদেরও এখন পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়নি। ফলে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা অনেক দেশ বাংলাদেশে তাদের নাগরিকদের জন্য রেড এলার্ট জারি করে। অনেকে ঢাকার বাইরে কর্মরত তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে এনে ছুটিতে দেশে পাঠিয়ে দেয়। 
দুটি ঘটনায়ই হত্যার দায় স্বীকার করে আইএস- এই মর্মে একটি প্রতিষ্ঠান খবর প্রচার করে। এত সরকার আরও রুষ্ট হয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারে আতিপাতি মন্ত্রীরা নানা টিপ্পনি কেটে বিদেশীদের জন্য অসম্মানজনক বক্তব্য দিতে থাকেন। রেড এলার্ট জারির কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন। বিদ্যুৎমন্ত্রী তো বলেই বসেছেন, যেসব দেশ ঢাকার বাইরে কর্মরত তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, সেসব নাগরিক যথাসময়ে কাজে যোগ না দিলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যেভাবে বিএনপি-জামায়াত তথা বিরোধী দলকে তারা শায়েস্তা করছেন, যেন একইভাবে তারা শায়েস্তা করে দেবেন বিদেশীদেরও। দেখা যাক, আগে কোনোদিন যাদের নামও কেউ শোনেনি, রেকম ‘ব্যবসায়ী রাজনীতিক’দের হুমকি-ধামকিতে ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সুড়সুড় করে ঐ বিদশী নাগরিকরা ৫ নবেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে কাজে যোগ দেন কিনা। তবে ঐ নাম না জানা ব্যবসায়ী মন্ত্রীর হুমকির পর জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকায় কর্মরত প্রায় অর্ধশত জাপানি নাগরিককে ঐচ্ছিক ছুটি দিয়ে স্বদেশে ফেরত পাঠিয়েছে জাপান সরকার।
যদিও ইটালীর নাগরিক সিজার হত্যার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলে বসেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে বসে বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করেছেন। ফলে বিষয়টির ওখানেই মীমাংসা হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। প্রধানমন্ত্রীর মতো দেশের প্রশাসনের সর্বোচর ব্যক্তি যেখানে বলেছেন, খালেদা জিয়াই হত্যাকারী, তাহলে তো আর কোনো তদন্তের দরকার করে না। ইন্টারপোলের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে ধরে এনে ফাঁসিতে লটকে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। তা না করে ঘটনার ২৪ দিন পর দেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়ায় প্রকাশের জন্য সূত্রহীন দুটি ছবি সরবরাহ করেছে। তাতে সিজারের হত্যাকারীদের শনাক্ত করার কিউ আছে। অর্থাৎ খালেদা জিয়াই খুনি, এই তত্ত্বে সরকারের পুলিশ বাহিনী কোনো গুরুত্ব দেয়নি। তারা প্রকৃত খুনিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। 
গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহকৃত ঐ দুটি অস্পষ্ট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একজন তরুণ মোবাইল-কানে কথা বলতে বলতে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তার ডান পাশ দিয়ে হেড লাইট জ্বালিয়ে একটি গাড়ি যাচ্ছে আর বাম পাশ দিয়ে একটি গাড়ি আসছে। রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার লাইন হিসেবে যে সাদা দাগ টানা থাকে, সে দাগের মুখ সুচালো হয়ে গেছে, ভোঁতা নয়। কোনো পাগল ছাড়া কারও পক্ষে দুটি চলমান গাড়ি মাঝখান দিয়ে এভাবে ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা দিয়ে চলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটি মোটরসাইকেলে যাচ্ছে দুজন তরুণ। এটি নাকি একটি সড়কের কোনো একটি বাড়ির নিজস্ব সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি। যদিও পুলিশ শুরু থেকে বলছিল, আশপাশের শতাধিক সিসি ক্যামেরার কোনো ফুটেজেই ঘাতকদের ছবি শনাক্ত করা যায়নি। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঘাতকদের সম্ভাব্য গতিপথ নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রথমে ছবি এঁকে একটি ছক তৈরি করে। তারপর অগ্রসর হয়। আর গোয়েন্দাদের সরবরাহকৃত ছবি দুটিকে যত না ভিডিওচিত্র মনে হয়, তার চেয়েও বেশি মনে হয়, শিল্পীর আঁকা ছবি বলে।
সরকার দুই বিদেশী হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে তার দায় যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর চাপানো মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রদূতগণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে দেড় ঘণ্টা ধরে কথা বলেছেন। একইসঙ্গে তারা কথা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন, নিরাপত্তা নিয়ে এখনও বিশ্বাসযোগ্য হুমকি রয়ে গেছে তাই বিদেশীদের সতর্ক থাকতে হবে। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চেয়েছেন, আসলে বিদেশী হত্যা নিয়ে কী হতে যাচ্ছে? তার কারণ সম্ভবত এই যে, সিজার ও হোসি উভয় খুনের ক্ষেত্রে সরকার কেবলই তথ্য-প্রমাণ ছাড়া বিরোধীদের দোষারোপ করে যাচ্ছে। ফলে তারা এও বলেছেন, আসলে তদন্ত নিয়ে কী হতে যাচ্ছে, তা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আর তদন্তের অগ্রগতিই-বা কী? তারা একাধিকবার বলেছেন, তদন্ত হতে হবে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বলেছেন, তদন্ত এগিয়ে চলেছে এবং তা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হবে।
বিদেশীদের নিরাপত্তার জন্য গুলশান এলাকায় এখন যুদ্ধাবস্থা। নিরাপত্তা বাহিনী মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা চলছে হর্ন বাজিয়ে। পুলিশ-র‌্যার-বিজিবির গাড়ি বন্দুক উঁচিয়ে টহল দিচ্ছে। পথের মোড়ে মোড়ে আছে রায়ট কার। নিরাপত্তা চৌকিতে যানবাহনে চলছে ব্যাপক তল্লাশি। ঐ এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ এখন চরমে। তার মধ্যেই গত ১৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সাবেক এক এমপির কিশোর ভাতিজা বিকাল সোয়া ৪টায় মদ পান করতে করতে বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিল একটি এসইউভি জিপ। সে দুটি রিকশাকে দুমড়ে মুচড়ে পিষে দেয় ও দুজন পথচারীকে মারাত্মকভাবে আহত করে। সে পুলিশের হাতে আটকও হয়। 
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এতে ঘটনাস্থলেই এক শিশু নিহত হয়। এ ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য ফোনে কারও সঙ্গে আলাপ শেষে পুলিশ অতিশয় তৎপর হয়ে ওঠে। গাড়িটি আটক করে তারা থানায় নিয়ে যায় বটে, তবে দুজন পুলিশ ঐ ঘাতক কিশোরকে তাদের মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিরাপদ আস্তানায় পৌঁছে দেয়। সাবাশ, পুলিশের নিরাপত্তা! আহা কূটনৈতিক জোনে সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কী আশ্চর্য নমুনা! এর সচিত্র প্রতিবেদন বেশ কয়েকদিন ধরে পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তার ওপর সাধারণ নাগরিকরা মন্তব্য করতে শুরু করেন, একই কায়দায় তাভেলা সিজারের ঘাতকদের পুলিশ নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেয়নি তো? গুলশান এলাকায় ঘাতককে এভাবে নিরাপত্তা দেয়ায় বিদেশীদের সংশয়ের অবসান কীভাবে হবে? অতএব ঘন অন্ধকার থাকছেই। আমাদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘতর হচ্ছে। আমরা কেবলই আকুল কণ্ঠে আলোর দিশারীর কাছে জানতে চাইছি, রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরি?
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সামনে অপেক্ষার প্রহর


পৃথিবীর ইতিহাস আসলে ন্যায় এবং অন্যায়ের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। এ কারণেই হয়তো প্রতারণা ও প্রহসনে পূর্ণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়ও কখনো কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। এবার প্রতিবাদদীপ্ত হয়েছেন যুক্তরাজ্যের শিক্ষাবিদরা। যুক্তরাজ্যের ৩৪৩ জন শিক্ষাবিদ ইসরাইলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরাইলের ‘অসহনীয় মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ প্রতিবাদে তাঁরা ‘ফিলিস্তিনীদের অধিকার সমর্থনে যুক্তরাজ্যের শিক্ষানুরাগী সম্প্রদায়’ নামে গত ২৭ অক্টোবর দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক পাতাজুড়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। শিক্ষাবিদরা বলেন, তাঁরা ইসরাইলের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না। দেশটির অর্থে কোনো সম্মেলনেও অংশ নেবেন না। যতদিন ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইন না মানবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান না দেখাবে, ততদিন এই বর্জন অব্যাহত থাকবে। জানি না, শিক্ষাবিদদের এমন প্রতিবাদে ইসরাইল সরকারের মধ্যে কোনো বোধোদয় ঘটবে  কিনা।
আমরা জানি, মানব জাতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে, অনেক বিষয়ে পার্থক্যও আছে। তারপরও মানুষ তো মানুষই। মানুষ মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও মানুষ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের প্রতি মানবিক ও সভ্য আচরণে সক্ষম হচ্ছে না। মানুষ এখনো সভ্যতার সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। এ কারণেই হয়তো ভারতের হরিয়ানায় দলিত সম্প্রদায়ের দুই শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে পারলো স্থানীয় রাজপুত সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯ অক্টোবর রাত তিনটার দিকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ফরিদাবাদের বল্লভগড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নিহত শিশু দু’টির বাবা-মা আগুনে দগ্ধ হয়। তাদের  নয়াদিল্লীর সফদর জং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ফরিদাবাদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নিহত শিশু দু’টির বাবা জিতেন্দ্র বলেন, কিছুদিন ধরেই রাজপুত পরিবারের লোকজন আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। তারা আমাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বলে। আমরা এলাকা ছেড়ে চলে না যাওয়ায় ঘটনার দিন রাতে তারা ঘরের জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আমাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চালায়।
মানুষকে পুড়িয়ে মারার তৎপরতা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, চমৎকার সব বিশেষণে বিশেষিত রাষ্ট্রগুলোতেও এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা। এমন ঘটনায় মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। ফরিদাবাদের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও। ওই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর খাত্রাকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যার মতো ঘটনা প্রতিরোধে সরকার ও প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তো সমাজ আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উগ্রতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা যেন বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে ভারতের লেখক সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেক লেখক প্রাপ্ত পদক ও সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে ভারতে উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মুক্তমনা লেখকরা নিহত হচ্ছেন, গো-মাংস খাওয়ার কারণে নিহত হচ্ছেন সংখ্যালঘু মুসলমানরাও। লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্মল বিনোদন মাধ্যম অভিজাত ক্রিকেট অঙ্গনেও উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আম্পায়ার আলিম দারের পর ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার পঞ্চম ওয়ানডের আগেই ফিরে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আখতারকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার হুমকিতে ওই দুই ক্রিকেট তারকাকে দেশে ফেরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই)-এর কার্যালয়ে শিবসেনার আকস্মিকভাবে প্রবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনায় নিরাপত্তা ইস্যুতে ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আখতারকে পঞ্চম ওয়ানডের আগেই পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় স্টার স্পোর্টস। এই চ্যানেলটির ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজ বিষয়ক বিশেষ প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে আসেন পাকিস্তানের সাবেক ওই দুই ক্রিকেটার। ভারতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আনলে উপলব্ধি করা যায়, নানা কর্মকাণ্ডে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার তাদের সংবিধান সমুন্নত রাখার ব্যাপারে কতটা সক্ষম হয়।
প্রতারণাপূর্ণ বর্তমান বিশ্ব সভ্যতায় আশার তেমন কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান বিশ্বসভ্যতায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বরং হতাশার মাত্রা বেড়ে যায়। কখনও কখনও তাঁরা সুবচন উচ্চারণ করলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। আবার  কারো কারো বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবারও সাম্প্রদায়িকতার চেতনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা বর্তমান বিশ্ব বাতাবরণে অশান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। আলো ঝলমলে বর্তমান সভ্যতায় এটা বড় ধরনের এক অন্ধকার।
এপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, মার্কিন রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রচার অভিযানকালে এক সংবাদ সংস্থায় এসে বলেছেন, নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সব মসজিদ বন্ধ করে দেবেন তিনি। এই বক্তব্যের ফলে নতুন করে এক বিতর্কের সৃষ্টি হলো। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, নিজের ভোটব্যাংক বাড়াতে যা ইচ্ছে তাই বলছেন ডোনাল্ড। একই সঙ্গে তার এ বক্তব্য আমেরিকার পাশাপাশি বিশ্বের মুসলমানদের আঘাত করেছে। উল্লেখ্য যে, কেবল মসজিদ বন্ধ করাই নয়, গত বৃহস্পতিবার ডোনাল্ড তার নির্বাচনী প্রচারের সময় আরো বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মুসলমানদের আক্রমণ করেন। ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিষয়ে তিনি বলেন, আমেরিকার মুসলিমরা আইএস-এর প্রধান সমর্থক। তাদের আটকালেই আইএসকে আটকানো যাবে। ডোনাল্ড আরো বলেন, কোনো মুসলিম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হতে পারে না।
আমেরিকার মতো একটি দেশের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর বক্তব্য যদি এমন হয়, তাহলে বিশ্বশান্তির ব্যাপারে মানুষ আশাবাদী হবে কেমন করে? তিনি তো শুধু মসজিদ বন্ধ করে দেয়ার কথাই বলেননি, তিনি তো আইএস-এর সাথে মার্কিন মুসলমানদের জড়িয়ে ফেলেছেন। অথচ বিশ্বের সচেতন মানুষ এখন একথা জানে যে, আইএস তৈরির কারিগর কারা? পশ্চিমা বিশ্লেষকরাও এখন এ কথা বলছেন যে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতি স্থায়ীভাবে সমরাস্ত্র উৎপাদনের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। অতএব, সমরাস্ত্র বিক্রির জন্য যুদ্ধ প্রয়োজন। এমন বাস্তবতায় একের পর এক মুসলিম দেশ গৃহযুদ্ধ ও সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় বিপর্যস্তের পর বিশ্বের মানুষ এখন সিরিয়ায় বিপর্যয়ের দৃশ্য লক্ষ্য করছে। বিপর্যয়ের এমন প্রেক্ষাপটে মাঝে মাঝে বর্তমান সভ্যতার নায়করা প্রহসনময় দুঃখও প্রকাশ করছেন। এএফপি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়, সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ২০০৩ সালে মার্কিন বাহিনীর নেতৃত্বে ইরাকে সামরিক অভিযান চালানোর সময় যেসব ভুল হয়েছিল তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওই যুদ্ধের পরিণামেই আইএস-এর উত্থান হয় বলে তিনি স্বীকার করেন। গত ১২ অক্টোবর সিবিএস নিউজের এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, আমরা ১৩ বছর আফগানিস্তানে লড়াই করেছি কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেখানকার পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত কঠিন। এমন ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, তাহলে পরাশক্তিগুলো একের পর এক মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালাচ্ছে কেন? স্বার্থ ছাড়া তো তারা সেখানে  সৈন্য ও গোলাবারুদ পাঠাচ্ছেন না। বিশ্লেষকদের মতে, তাদের স্বার্থ খুবই স্পষ্ট এবং সেই স্বার্থ হলো অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক। ন্যায়নীতি বিবর্জিত ও স্বার্থান্ধ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে, এমন নেতৃত্ব দিয়ে কি বিশ্বের কাক্সিক্ষত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব? বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এক নতুন সভ্যতা ও নতুন নেতৃত্বের অপেক্ষায় আছে। তবে তাদের অপেক্ষার প্রহর কতদিনে শেষ হবে সেটাই দেখার বিষয়।

মঙ্গলবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

২৮ অক্টোবর : আওয়ামী জঙ্গিপনার রক্তাক্ত দলিল


Britannica R.R. ENCYCLOPEDIA-
তে বলা হয়েছে- Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগে কথা। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! তাই ২৮ অক্টোবর অন্য দিনের মত একটি দিন নয়। এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলংকের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তা-ব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
যুগে যুগে ক্ষমতার লিপ্সা, ভূমি দখল, সম্পদ আহরণ, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে  হিটলার, মুসোলিনী, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবসাই খান, খেসারু হত্যা, এরকম অনেক রক্তপিপাসু খুনির নামের সাথে শেখ হাসিনার নামটিও আজ স্থান করে নিয়েছে।
ইতিহাসের কালো অধ্যায় জুড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ক্রসেড (ত্রিপলী), ভারত পাকিস্তান দাঙ্গা, মধ্য আফ্রিকায় (মুসলিম গণহত্যা), আফ্রিকায় উপজাতি দাঙ্গা, ইন্দোনেশিয়া গণহত্যা, সোমালিয়ায় গণহত্যা, চায়না কমিউনিস্ট বিপ্লব, সিরিয়া গণহত্যা, কম্বোডিয়া (খেসারু হত্যা), বোসনিয়া/চেচনিয়া মুসলিম হত্যা, মিয়ানমার মুসলিম গণহত্যা, ইরাক, আফগান হত্যা, লেলিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব), স্ট্যালিন (কমিউনিস্ট বিপ্লব) হিরোশিমা নাগাসাকি, ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রি, এপ্রিল ফুল দিবসের ঘটনাসমূহ আমাদের স্মৃতিতে এক বীভৎস চিত্র ভেসে ওঠে, ঠিক তেমনি শত বছর পরও ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করলে শিউরে উঠবে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হবে তার বিবেক, অমানবিকতার কথা মনে করে কেঁদে উঠবে মানুষের হৃদয়। অভিশপ্তদের ঘৃণা করবে বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার রক্তাক্ত দলিল।
পৃথিবীর ইতিহাসে একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামী লীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। আওয়ামী লীগের শাসন আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে।
রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে তখন শাসন করবার সৎসাহসটুকুও শাসকদের আর থাকে না। ফলে সমাজের সর্বত্র অরাজকতা, অমানবিকতা, হিংস্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। রাষ্ট্র ধীরে ধীরে অপরাধ রোধ করবার শক্তি হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ এখন সেই ভয়ংকর সময়টি অতিক্রম করছে। মুলত বিগত ৫ জানুয়ারির অনির্বাচিত সরকার মানুষকে শাসন করবার নৈতিক ভিত্তি এখন আর অবশিষ্ট নেই। সকল ক্ষেত্রেই “অ” অক্ষর যোগ করিলেই যেন শাসক গোষ্ঠীর আসল পরিচয় মেলে। এই সরকার অ-গণতান্ত্রিক, অনির্বাচিত, অনৈতিক, অবৈধ। তাই তাদের কর্মকা-ের মাঝে ও যেন অপদার্থের নিশানাই বেশি!
আজ মনে হচ্ছে আমরা স্বাধীন একটি ভূ-খণ্ড পেয়েছি। পাইনি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি। নাগরিক পাচ্ছে না স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার। জানমাল, ইজ্জত, আব্রুর নিরাপত্তা এখানে ভূলুণ্ঠিত!!। আমরা পাইনি প্রকৃত গণতন্ত্র। আমরা এখন যেন নিজ দেশেই বন্দী। কাঁটা তাঁরের বেড়ায় ফেলনীদের লাশের করুণ চাহনি আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে, আমরা কি আসলে স্বাধীন? প্রতিবেশী রাষ্ট্র হাঙ্গরের মত এদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংস্কৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মাধ্যমে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এখন হিটলার ও মুসোলিনীর অক্ষশক্তির নৃশংসতা ও বর্বর কর্মকা-কেও যেন হার মানাতে বসেছে। জুলুম-নির্যাতন, লুণ্ঠন, রাহাজানি অক্টোপাসের মতো গোটা জাতিকে ঘিরে ফেলেছে। প্রতিদিন কত মানুষ জীবন দিচ্ছে তার কোন হিসেব এখন কেউই যেন রাখতে পারছে না। সর্বত্র আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ বাংলার আকাশ-বাতাস কে ভারী করে তুলছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন পার্লামেন্টে এখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর ডিবেট হচ্ছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন টক অব ওয়ার্ল্ড। ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠাধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা থাকলেও তা রাজনৈতিক বিবেচনায় বাদ দেয়ার উদ্যোগ সরকারের নব্য বাকশালী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। ২৮ অক্টোবরে সংঘটিত এই নৃশংস ঘটনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি, বুকলেট, প্রতিবাদ, সিডি, ভিসিডি ও ওয়েবসাইট খোলাসহ নানা ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সেদিন ঘটনার শুরু যেভাবে-
আজ থেকে প্রায় নয় বছর আগের কথা। ২৮ আক্টোরর-০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার ৫ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মূলত ২৭ আক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে অনেককে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্থ কেন্দ্র্রীয় কার্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিসহ আমরা কয়েকজন উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিউরে উঠছে!।
অফিস থেকে বেরিয়ে আহত-রক্তাক্তদের দেখতে দেখতে আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জড়িয়ে পড়লাম। পল্টন মসজিদের গলিতে একদিকে আমরা ৪০-৫০ জন ভাই, অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র, লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। এভাবে একদিকে সন্ত্রাসীদের মারণাস্ত্রের হামলা অন্যদিকে আমরা নিরস্ত্র। এভাবে ৭ ঘণ্টা মোকাবেলা করেছি আমরা। ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। এ তো আল্লাহর দ্বীনের পথে এগিয়ে যাওয়ার ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা। এ যেন বাতিলের বিরুদ্ধে এক চরমপত্র। ১৪ দলের গালে একটি চপেটাঘাত। এ যেন শাহাদাতের প্রতিযোগিতা। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। এক সময় আমি নিজেও মনে করতাম অস্ত্রের মোকাবেলায় টিকে থাকা যায় না। কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদ দেখে সে ভুল ধারণা শুধরে নিয়েছি। বাকিটুকুর পরিশুদ্ধতা লাভ করেছি ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী হয়ে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হয়ে বিদায় নিচ্ছে আমাদের কাতার থেকে। নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। কারণ বিজয় তো সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
হঠাৎ সামনের দিক থেকে চিৎকার শুনলাম। আমরা ২০/২৫ জন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম তখন দেখি আওয়ামী লীগের ৪-৫ হাজার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী পেছনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তার সাহায্য অনিবার্য। এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘‘কোনো মু’মিন মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির উচ্চারণ করলে বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।’’ ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।
যাক, সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। শাহাদাতের যে মৃত্যুর জন্য তিনি প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাক্সক্ষা পূর্ণ করেছেন আলহামদুলিল্লাহ। এর থেকে সৌভাগ্যবান আর কি হতে পারে? শহীদরা পৃথিবী থেকে  বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর!। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (আল-বাকারা: ১৫৪)। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন,  ‘তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসুল (সা) বলেছেন: ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।’ (তিরমিযী)
হায়েনারা আমাদের প্রিয়ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর ফেলে রেখেছে গলির মধ্যে। কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুঁড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা মুজাহিদ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। পরে হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলী আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো লুটিয়ে পড়লাম হাঁটুর ওপর ভর করে। জাহেদ হোসেন ভূঞা ভাই ও আব্দুল মান্নান ভাইসহ কয়েকজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে বলে। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলীবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং দল বেঁধে আমার সাথে আসতে লাগল। ভাইদের বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা শহীদ কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’ এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলীবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম এই এক্সরে টি আমার? কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলতে চায়নি। আমি বললাম, এই গুলীটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলীটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না ইনশাল্লাহ।
আজ হয়তো কেউ কেউ বলেন ২৮ অক্টোবরে আমাদের প্রস্তুতির কথা। কিন্তু যদি আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকতো! তাহলে কি হতো? কারণ দীর্ঘ ৭ ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? দলে তারা আওয়ামী লীগ কিন্তু ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই গার্মেন্টসকর্মী ও পতিতালয়ের হিন্দা। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। আমাদের প্রস্তুতি আরো ভাল হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেত আর এ ধরনের সন্ত্রাসী একজন টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। হিসাব হতো কাদের লাশ কয়টি। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেখা হতো সেভাবে। অন্তত আল্লাহতায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহিত। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামী লীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে? আর কত রক্তের  হোলি খেললে তাদের নিষিদ্ধের আওয়াজ উঠবে?
কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা ১৪ দল কিভাবে করছে। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ, মাসুম, শিপন, মুজাহিদ, রফিক, ফয়সলের পরিবার। কিন্তু না। এটি আপনার হিসাব হতে পারে তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতি ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য। শহীদ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের ফরিয়াদ : আল্লাহর দরবারে আমার স্বপ্ন ছিল আমি শহীদের মা হবো, আল্লাহ যেন আমাকে একজন শহীদের মা হিসেবে কবুল করেন। শিপন সবসময় সত্যকে সত্য জানতো, মিথ্যাকে মিথ্যা জানতো।
শহীদ সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ মাসুমের গর্বিত মায়ের আহ্বান : আমার জীবনের আশা ছিল আমার ছেলে খালেদ বিন ওয়ালিদ হবে, নিষ্পাপ হবে। আমার ছেলে হাসান-হুসাইনের মত হবে। আমি আমার সাইফুল্লাহর রক্তের বিনিময়ে এ দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রার্থনা সবসময় করি। শহীদ ফয়সলের গর্বিত মা অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ঠিক এভাবে : তাদের কথা শুনেই মনে হয় তারা সত্যিই হজরত ইব্রাহিম (আ)-এর উত্তরসূরী। হযরত ইসমাইল (আ)কে আল্লাহর পথে কুরবান করে হযরত ইব্রাহিম (আ) যেভাবে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন ঠিক তেমনি তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশা করি ইনশাআল্লাহ আমার এই সুশিক্ষিত বিনয়ী, ভদ্র, শান্ত, অমায়িক ও সুন্দর আচরণবিশিষ্ট সন্তানকে আল্লাহ শাহাদাতের মর্যাদা দান করবেন। আমার সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় সন্তানকে আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। শহীদ রফিকুল ইসলামের পিতার চাওয়া : আমার ছেলে আল্লাহর দরবারে শহীদ হিসেবে কবুল হয়েছে বলে আমি মনে করি। কুড়িগ্রামবাসী সবাই তার জন্য কেঁদেছে। জীবনে সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয়নি। সে সবসময় সৎ সঙ্গে মিশত এবং দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকত।
আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা যাদের পিটিয়ে হত্যা করেছে, লাশের ওপর নৃত্যউল্লাস করেছে, ভেঙে দিয়েছে দাঁত, উপড়ে ফেলেছে চোখ; তারা কি আজ উত্তর দিতে পারবে হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মায়ের জিজ্ঞাসার- ‘কী অপরাধ আমার সন্তানের? কেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সন্তানের দাঁতগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে? এই মুখ দিয়ে তো সে মহাগ্রন্থ আল কুরআন মুখস্থ করেছে। ঐ অসভ্য নরপশুরা কি জানে? যে কপালে লাথি মারা হয়েছে সে কপালে দিনে পাঁচবার করে আল্লাহকে সেজদা করতো! পড়তো তাহাজ্জুদ নামাজ। যে হাত ভেঙে দেয়া হয়েছে সে হাত দিয়ে আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতো, যে পা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সে পা দিয়ে আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান করতো। এ রকম হাজারো জিজ্ঞাসার জবাব আজ তাদের কাছে আছে কি?
পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। যাদের সাহস আমাদের এগিয়ে দেয়। যাদের আল্লাহর নির্ভরতা এ কাফেলার কর্মীদের আশান্বিত করে। যাদের ত্যাগ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমরা দেখেছি তাদেরকে। আমরা দেখেছি শ্রদ্ধেয় আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবকে। মুহুর্মুহু গুলী আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। যা ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। যিনি এখনো জালিমের জুলুমের শিকার হয়ে কারাগারে আবদ্ধ। এমনি এক জনসভায় অবিরাম গুলীবর্ষণ চলাকালে মাওলানা মওদুদীকে বসে পড়ার জন্য অন্যরা অনুরোধ করলে দৃঢ়তার সাথে তিনি বলেছিলেন, আমিই যদি বসে পড়ি তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে? তাই বিশ্বাস শহীদের রক্ত বৃথা যাবে না, একদিন কথা বলবেই।
শহীদ কামারুজ্জমান ভাইয়ের ঐ স্মৃতি আজ আমাকে খুবই নাড়া দেয়। ২০০৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি শহীদ শরীফুজ্জামান নোমানী ভাইয়ের কফিন নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ আমাদের প্রিয় নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি শহীদ কামারুজ্জামান ভাই একসাথে গিয়েছি। কামারুজ্জামান ভাই আমাকে অনেকবার জড়িয়ে ধরে সাহস যুগিয়েছে। কিন্তু কে জানে তিনি নিজেই একদিন শহীদ হয়ে এই মাটিতে আসবেন!
শাহাদতের জন্য শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাইয়ের মন কেমন পাগলপারা ছিল এই ঘটনা থেকে তা উপলব্ধি করা যায়। খুব সম্ভব ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজন করে আলোচনা সভার। সকল অতিথিরবৃন্দ উপস্থিত আলোচনা সভা শুরু হয়ে গেছে। ঠিক মাঝখানে আমাদের প্রিয় মোল্লা ভাই প্রোগ্রামে এসে হাজির। আমি দাঁড়িয়ে রিসিভ করে বললাম স্যরি মোল্লা ভাই, আপনি আসছেন এজন্য মোবারকবাদ। কারণ মোল্লা ভাই আমাদের দাওয়াতি মেহমানের মধ্যে ছিলেন না। তবু তিনি নিজ উদ্যোগে আলোচনা সভায় হাজির হয়েছেন। তিনি বললেন, শুন ২৮ অক্টোবর ২০০৬ আমি ঐ প্রোগ্রামে অনুপস্থিতির বেদনা আমাকে সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় একথা বলে আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলেন। পল্টনে আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি। যেখানে আমাদের ভাইয়েরা শহীদ আর গাজী হয়েছে। ঐ দিন আমি ঢাকায় ছিলাম কিন্তু আমীরে জামায়াত আমাকে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে সব খোঁজ খবর রাখতে বললেন। সেদিনের এই অনুপস্থিতির বেদনা থেকে তোমাদের দাওয়াত না পেয়েও বে-দাওয়াতে এখানে উপস্থিত হয়ে গেলাম। এই কথাগুলো মোল্লা ভাই স্টেইজে বসে বসে বললেন। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজ তার শাহাদাতের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে তিনি কত গভীরভাবে শাহাদাতের চেতনাকে লালন করতেন।
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহূর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তান হারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাই হারা বোনের আর্তনাদ, পিতা হারা সন্তানের করুণ চাহনি, মাহারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণীপেশার মানুষ।  বৃদ্ধ বণিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও রেহাই পায়নি জালেমের বুলেটের আঘাত থেকে। আর এর মধ্যে দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক বেশি জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।
আজ মহান রবের দরবারে সন্তানহারা মায়ের আহাজারি আর প্রতিরাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনই কাজে আসবে না? একদিন তারা আল্লাহর সম্মানিত অতিথি হবেন শহীদের পিতা মাতা হিসেবে। সেদিন জান্নাতের সবুজ পাখি হয়ে উড়তে থাকবেন শহীদেরা। এটাই তো শহীদের চূড়ান্ত সফলতা! ন্যায় ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী আদর্শিক দ্বন্দ্বেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস। তবে আমাদের বিশ্বাস এই দুনিয়ার আদালতে এই সকল হত্যার নায্য বিচার না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না।
আজ জীবিত কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লার চাইতে শহীদ কামারুজ্জামান আর আব্দুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন এবং শহীদ ফয়সাল অনেক বেশি শক্তিশালী। আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট জেল-জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, গুম, খুন চালিয়ে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, বরং দ্বীনের বিজয় অনিবার্য হয়ে উঠে। যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে এদেশকে কলোনিভুক্ত করা স্বপ্ন দেখছে, শহীদদের রক্তের শপথ নিয়ে বাংলার তৌহিদী জনতা তা রুখে দাঁড়াবে ইনশাল্লাহ। ২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও।
ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম 

সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সাম্প্রতিক ধরপাকড় ও সরকারের কিছু অসৎ উদ্দেশ্য


গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী নতুন মাত্রায় গ্রেফতার-নির্যাতন ও দলন-পীড়ন শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। গণমাধ্যমসমূহের রিপোর্ট এবং ভুক্তভোগী পরিবারসমূহের অভিযোগ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গণপরিবহন থেকে নামিয়ে, গভীর রাতে বাড়িঘর ঘেরাও করে এবং এমনকি হাটবাজার কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে বিরোধী দল বিশেষ করে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি-ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বিনা ওয়ারেন্টে ধরে নিয়ে তাদের ওপর নানা রকম নির্যাতন চালাচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের গুম করে দিচ্ছে; আবার কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন গুম করে রাখার পর হঠাৎ করে দূর দূরান্তের কোনও এলাকায় হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে গ্রেফতার-নির্যাতন শেষে থানায় সোপর্দ করছে। দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ও বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত সেপ্টেম্বর থেকে এ যাবত জামায়াত-শিবিরের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় তিন সহস্রাধিক ব্যক্তিকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক মামলা রুজু করা হয়েছে। রুজুকৃত মিথ্যা মামলাসমূহের মধ্যে অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য বহন, নাশকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ও সরকার উৎখাতের পরিকল্পনার অভিযোগও রয়েছে। বলাবাহুল্য এই সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে জামায়াত শিবিরের প্রায় ৫ লক্ষাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩৫ হাজার মামলা রুজু করেছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই জামিনে ছিলেন এবং সরকার এ যাবত তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ প্রমাণ করে একটি মামলাও নিষ্পত্তি করতে পারেনি। জামিনপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কোনও প্রকার কারণ প্রদর্শন ছাড়াই বিভিন্ন জেলায় তাদের অনেকের জামিন বাতিল করে পুনরায় তাদের জেলখানায় পাঠানো শুরু হয়েছে। ফলে নির্দোষ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। একইভাবে ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সাথে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গলাকেটে, পিটিয়ে এবং কণ্ঠরোধ করে মানুষ হত্যা, বোমাবাজি, নারীর সম্ভ্রমহানি, বিদেশী নাগরিক হত্যা, ক্ষমতাসীন দল ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোর্ট কাচারীতে রাজনৈতিক মামলার আধিক্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসী, খুনি ও সাধারণ অপরাধীদের বিচার করার কোনও ফুরসত বিচারকরা পাচ্ছেন না। সরকারের প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার বিভাগের ওপর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপের কারণে রাজনৈতিক মামলাসমূহেরও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আবার অপরাধীরা যদি সরকারি দলের হয় তাহলে তাদের তো সাত খুন মাফ। এই অবস্থায় দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, গ্রামগঞ্জ এবং ওয়ার্ড পাড়ায় বিরোধী দল দমনে সরকারি ও বেসরকারি অপরাধীদের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও সরকার হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাংঘাতিক অবনতি ঘটেছে এবং সরকার তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শহর নগর গ্রামগঞ্জে সাম্প্রতিককালে যৌথ বাহিনী দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে নানা গুঞ্জন শোনা যায়। কেউ কেউ মনে করেন যে, যেহেতু সরকারের কোনও গণভিত্তি নেই, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন এবং দুর্নীতি ও অনিয়মে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেহেতু তারা এখন তাদের ছায়া দেখেও ভয় পান। দু’চারজন লোককে কোথাও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কথাবার্তা বলতে দেখলেও তারা মনে করেন তাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তারা ষড়যন্ত্র করছেন। এতই আতঙ্কে তারা সারা দেশের মানুষকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন এবং তাদের সমস্ত গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশকে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন। আবার কোনও কোন বিশ্লেষকদের ধারণা ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং দুঃশাসনের মাধ্যমে দেশের সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক খাতসমূহকে ধ্বংস করে সরকার বিপদে পড়েছেন, সকল দল ও জনগণের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের উপর দেশ-বিদেশের চাপ রয়েছে। ইমেজ রক্ষার স্বার্থে তারাও হয়তো একটা নির্বাচনের কথা ভাবছেন। কিন্তু তার আগে ময়দানকে তারা বিরোধী দলমুক্ত করতে চান। জামায়াতকে তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পান। কেননা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা শহর-নগর ও গ্রামেগঞ্জে এই দলটির শিকড় কত গভীরে প্রোথিত তারা তা প্রত্যক্ষ করেছেন। এ প্রেক্ষিতে সন্ত্রাস, ভয়ভীতি, হত্যা-গুম এবং হামলা-মামলা ও গ্রেফতার-নির্যাতনের মাধ্যমে দলটিকে দমিয়ে রাখতে চান। দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে জাতীয় নির্বাচনে দলীয় ভিত্তিতে তারা জামায়াতের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছেন। কিন্তু স্থানীয় নির্বাচনে দলটির প্রতি সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন তাদের আতঙ্কিত ও বেপরোয়া করে তুলেছে। এই অবস্থায় জামায়াত ঠেকানোর জন্য তারা দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় নির্বাচনের পাঁয়তারা করছেন। এটা একদিকে তাদের ভয় অন্যদিকে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও লুটপাট অব্যাহত রাখার অপচেষ্টার একটা বেপরোয়া অভিব্যক্তি বলে আমার বিশ্বাস।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরেকটি বিষয়ও উল্লেখ করেছেন এবং সেটা হচ্ছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসি দেয়ার সরকারি অপচেষ্টার প্রাথমিক প্রস্তুতি। আমীরে জামায়াত ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন, ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা এবং বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও সাবেক মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে যুদ্ধাপরাধের ভিত্তিহীন ও মিথ্যা মামলায় ট্রাইব্যুনাল ফাঁসির দণ্ড দিয়েছে। মামলা চলাকালে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় সরকারের মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা তাদের ফাঁসির ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জনাব মুজাহিদের আইনজীবীরা তার পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করেছিলেন। আপিলে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। এই রায়টি আইন বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে ছিল ন্যায়ভ্রষ্ট। কেননা এতে কাকে হত্যার অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায় শাস্তি দেয়া হয়েছিল তার উল্লেখ নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ যেমন সুনির্দিষ্ট ছিল না তেমনি শাস্তির অনুকূলে অপরাধের উল্লেখও সুনির্দিষ্ট ছিল না। খ্যাতনামা বৃটিশ পার্লামেন্টারিয়ান ও যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এবং লর্ড সভার নেতা লর্ড কার্লাইল এই রায়কে জনাব মুজাহিদের প্রতি বিরাট অবিচার বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বাংলাদেশের এই আদালতকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দফতরের সাথে তুলনা করেছেন। অনেকের দৃষ্টিতে এই আদালত বিচারের নয়, ফাঁসির আদালত। এগুলো আমার নয় জনগণের এবং বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে এই ধারণা যে অমূলক নয় তার প্রমাণ মেলে সুুুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার লক্ষ্যে জনাব মুজাহিদের রিভিউ আবেদনের পর পুলিশ কর্তৃক তার আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনিরের বাড়ি তল্লাশি ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী এডভোকেট আসাদ উদ্দিনকে গ্রেফতার ও হয়রানি এটাই প্রমাণ করে যে সরকার চান না যে তারা ন্যায় বিচার পান। অবশ্য শুরু থেকেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ ও ইসলামবিদ্বেষী এই সরকারের আচরণে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে জামায়াত নেতাদের নিশ্চিহ্ন করাই তাদের লক্ষ্য, এই দলটির নেতৃত্ব ধ্বংস করতে পারলে দলটিও ধ্বংস হবে এবং দেশে শক্তিশালী আদর্শ ভিত্তিক কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী দল না থাকলে তাদের ক্ষমতায় যাবার রাস্তা নিষ্কণ্টক থাকবে।
পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন যে ১৯৭১ সালে জামায়াত যুদ্ধের কোনও অংশ ছিল না। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যারা যুদ্ধরত বাহিনী বা তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য এবং যুদ্ধরত অবস্থায় আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে আইনে বর্ণিত তফসিলে উল্লেখিত অপরাধ করে তারাই যুদ্ধাপরাধী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অথবা তার কোনও ছাত্র সংগঠন এ ধরনের কোনও বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। বাংলাদেশ হবার পর ৩৯ বছরের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের জন্য বাংলাদেশের কোনও থানায় বা আদালতে মামলাও হয়নি। তারা এই দেশের সাধারণ ও আইনানুগ নাগরিক হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠান ও পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মন্ত্রী হিসেবে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। পক্ষান্তরে সরকার ও সরকারি দল আইনে বর্ণিত সামরিক বাহিনী আধা সামারিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর সদস্য বাক্যটির সাথে ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গ শব্দ যোগ করে আইন সংশোধন করে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইন করে মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। প্রচলিত সাক্ষ্য আইন ও ফৌজদারী দণ্ডবিধি স্থগিত রেখে তাদের বিচার করা হয়েছে। ১৯৭৩ সালে ত্রিদেশীয় কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত ১৯৫ জন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বাদ দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াত নেতাদের বিচারের উদ্যোগ তখনি প্রমাণ করেছিল যে এটা বিচার নয়, বিচারের নামে প্রহসন ও রাজনৈতিক জিঘাংসার বাস্তবায়ন। এই জিঘাংসা চরিতার্থ করতে গিয়ে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা এবং কামারুজ্জামানকে শহীদ করা হয়েছে। এখন পরবর্তী পরিকল্পনায় তারা জামায়াত মহাসচিব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং আমীরে জামায়াত মাওলানা নিজামীকে অন্তর্ভুক্ত করতে যাচ্ছেন। এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ঠেকানোর জন্যই সাম্প্রতিক দিনগুলোতে পুনরায় গ্রেফতার নির্যাতন শুরু করা হয়েছে বলে মানুষের ধারণা। দেশে বিদেশে সকল ঈমানদার ব্যক্তিদের ও সংগঠনসমূহকে এ ব্যাপারে সজাগ থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি।

রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কেন এই উগ্রতা ?


মানব জাতির মধ্যে বৈচিত্র্য আছে, অনেক বিষয়ে পার্থক্যও আছে, তারপরও মানুষ তো মানুষই। মানুষ মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করবে- এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, বিজ্ঞান প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও মানুষ এখনো অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের প্রতি মানবিক ও সভ্য আচরণে সক্ষম হচ্ছে না। মানুষ এখনো সভ্যতার সংকটের মধ্যে রয়েছে। এ কারণেই হয়তো ভারতের হরিয়ানায় দলিত সম্প্রদায়ের দুই শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে পারলো স্থানীয় রাজপুত সম্প্রদায়ের লোকজন। ১৯ অক্টোবর রাত তিনটার দিকে রাজ্যের সবচেয়ে বড় শহর ফরিদাবাদের বল্লবগড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় নিহত শিশু দু’টির বাবা-মা আগুনে দগ্ধ হয়। তাদের নয়াদিল্লীর সফদর জং হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় ফরিদাবাদে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। নিহত শিশু দু’টির বাবা জিতেন্দ্র বলেন, কিছুদিন ধরেই রাজপুত পরিবারের লোকজন আমার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিল। তারা আমাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বলে। আমরা এলাকা ছেড়ে চলে না যাওয়ায় ঘটনার দিন রাতে তারা ঘরের জানালা দিয়ে পেট্রোল ঢেলে আমাদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা চালায়।
মানুষকে পুড়িয়ে মারার তৎপরতা কোনো সভ্য দেশে চলতে পারে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো চমৎকার সব বিশেষণে বিশেষিত রাষ্ট্রগুলোতেও এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা। এমন ঘটনায় মানুষ উদ্বিগ্ন না হয়ে পারে না। ফরিদাবাদের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও। ওই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর খাত্রাকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যার মত ঘটনা প্রতিরোধে সরকার ও প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে তো সমাজ আর মানুষের বসবাসযোগ্য থাকবে না। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কী ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে উগ্রতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা যেন বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে ভারতের লেখক সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অনেক লেখক প্রাপ্ত পদক ও সম্মাননা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলে ভারতের উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মুক্তমনা লেখকরা নিহত হচ্ছেন, গো-মাংস খাওয়ার কারণে নিহত হচ্ছেন সংখ্যালঘু মুসলমানরাও। লক্ষণীয় বিষয় হলো, নির্মল বিনোদন মাধ্যম অভিজাত ক্রিকেট অঙ্গনেও উগ্রতা এবং সাম্প্রদায়িক চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আম্পায়ার আলিমদারের পর ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার পঞ্চম ওয়ানডের আগেই ফিরে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ও টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আকতারকে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন শিবসেনার হুমকিতে ওই দুই ক্রিকেট তারকাকে দেশে ফেরার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই)-এর কার্যালয়ে শিবসেনার আকস্মিকভাবে প্রবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের ঘটনায় নিরাপত্তা ইস্যুতে ওয়াসিম আকরাম ও শোয়েব আকতারকে পঞ্চম ওয়ানডের আগেই পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় স্টার স্পোর্টস। এই চ্যানেলটির ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিজ বিষয়ক বিশেষ প্রোগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য ভারতে আসেন পাকিস্তানের ওই দুই সাবেক ক্রিকেটার। ভারতের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আনলে উপলব্ধি করা যায়, নানা কর্মকাণ্ডে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হলো, সরকার তাদের সংবিধান সমুন্নত রাখার ব্যাপারে কতটা সক্ষম হয়।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অন্তরায়


দেশের সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে প্রতিদিন মামলার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এর নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও ঘটছে বিলম্ব। হয়রানির শিকার হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা। মামলাজটের সৃষ্টি হয় বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও। আর আদালতে এভাবে মামলাজটের সৃষ্টি ন্যায়বিচারের পথে বাধাস্বরূপ। নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ও মামলাজটের কারণে ভোগান্তির শিকার হয় বিচারপ্রার্থীরা। জন্ম নেয় বিচারে আস্থাহীনতা। ব্যাহত হয় আইনের শাসনের উদ্দেশ্য। এভাবে বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি করে মামলার এমন জট।
২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন থাকলেও ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৮৩৯টিতে। আবার ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ২৬০টি মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকলেও পরবর্তী কয়েক বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮টিতে। এ সময়ে আট হাজার ৭৪৮টি মামলা বেড়েছে আপিল বিভাগে। সুপ্রিমকোর্টে মামলাজট বাড়ছে এভাবেই। ২০০৯ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টি। ওই বছর দায়ের হয় ৫৩ হাজার ১৫৫টি, নিষ্পত্তি হয় ২১ হাজার ৪৮৫টি। ২০১০ সালে মামলা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৫টি। দায়ের হয় ৫৭ হাজার ৪৭০টি, নিষ্পত্তি হয় ৬৯ হাজার ৩০৬টি মামলা। ২০১১ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। ওই বছর দায়ের হয় ৪৫ হাজার ৮৪টি এবং নিষ্পত্তি হয় ৬৮ হাজার ৯১২টি। ২০১২ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩৬টি। দায়ের হয় ৫৬ হাজার ৭৩২টি। নিষ্পত্তি হয় ৩৮ হাজার ৪৪৪টি। ২০১৩ সালে মামলা ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ৭২২টি। দায়ের হয় ৫০ হাজার ১০টি। নিষ্পত্তি হয় ২৪ হাজার ২৮৬টি।
আবার ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ৫ হাজার ২৬০টি। ওই বছর দায়ের হয় চার হাজার ৪০৩টি। নিষ্পত্তি হয় ছয় হাজার ৩৫টি মামলা। ২০১০ সালে মামলা ছিল ৯ হাজার ১৪১টি। ওই বছর দায়ের হয় পাঁচ হাজার ৪৬৪টি মামলা, নিষ্পত্তি হয় এক হাজার ৫৮৩টি। ২০১১ সালে মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। ওই বছর দায়ের হয় ৪ হাজার ৭৪৯টি মামলা। নিষ্পত্তি হয় এক হাজার ৪৪৯টি। ২০১২ সালে মামলা ছিল ১২ হাজার ৪৪১টি। দায়ের হয় ৩ হাজার ৩৬টি। নিষ্পত্তি হয় দুই হাজার ৯২টি মামলা। ২০১৩ সালে ছিল ১৩ হাজার ৩৮৫টি। দায়ের হয় ৫ হাজার ৯৮৯টি, নিষ্পত্তি হয় ৫ হাজার ৩৬টি মামলা। এছাড়া সামগ্রিকভাবে ২০১৪ সালের জুলাই পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন লাখ ৪২ হাজার ৮৩৯টি। ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৮টি। (সূত্র : দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪)
মামলা জট নিরসন ও দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আদালতে উপস্থিত হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ার পরিবর্তে তার বক্তব্য হলফনামা আকারে দাখিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। ৮ নবেম্বর ২০১৪ জুডিশিয়াল স্ট্রেনদেনিং প্রজেক্ট (জাস্ট) আয়োজিত ‘অধস্তন আদালতে মামলা ব্যবস্থাপনা কমিটি : কাজের ধরন, নীতিমালা ও সামনে এগিয়ে চলা’ শীর্ষক এক সেমিনারে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, সাক্ষী আদালতে হাজির হয়ে জবানবন্দী দিতে অনেক সময় অপচয় হয়। তাই সাক্ষীর জবানবন্দী হলফনামা আকারে আদালতে দাখিলের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। শুধু সাক্ষীর বক্তব্য হলফনামা আকারে নয় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় বেঁধে দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের সময় এসেছে। মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়ার ব্যবস্থা বাতিল হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, এসব দেশে হলফনামা আকারে আদালতে জবানবন্দী দাখিল করা হচ্ছে। শুধুমাত্র জেরার সময় সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক ও ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বক্তব্য রাখেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশের বিচার ব্যবস্থাকে বিরাট মামলার জট সামলাতে হচ্ছে। এটা ন্যায়বিচার পেতে বাধার সৃষ্টি করছে। মামলার জট বৃদ্ধির পেছনে সমন্বয়হীনতা, অভিজ্ঞতা বিনিময়, সার্বক্ষণিক তদারকি ও সময় ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। আদালতের বিচারক ও আদালত কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাজের মূল্যায়নেরও অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, দেওয়ানী মামলার জট কমাতে ‘মধ্যস্থতা’ একটি জরুরি নিয়ামক হতে পারে। এছাড়া ইলেক্ট্রনিক বিচার ব্যবস্থা (ই-জুডিশিয়ারি) গড়ে তুলতে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। (সূত্র : দৈনিক ইত্তেফাক ৯ নবেম্বর ২০১৪)
হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বহুল আলোচিত ৩৪টি হত্যা মামলার বিচার কাজ প্রায় ১০ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে। আসামীপক্ষের করা রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাগুলোর বিচার কাজের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু এসব স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে সরকারপক্ষ থেকে অদ্যাবধি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অধিকাংশ মামলাতে বিচার শুরুর ব্যাপারে বিচারিক আদালতের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন আসামীপক্ষ। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট দ্বৈত বেঞ্চগুলো স্থগিতাদেশ দেন। এছাড়া ওইসব মামলায় বিচারিক আদালতের বিভিন্ন সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট মামলা করেছেন আসামীরা। ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৪টি হত্যা মামলা, দুই নম্বর ট্রাইব্যুনালে ১৩টি, তিন নম্বর ট্রাইব্যুনালে ৫টি এবং চতুর্থ ট্রাইব্যুনালে ২টি হত্যা মামলার বিচার কাজ প্রায় দশ বছর যাবত বন্ধ রয়েছে।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন ২০০২-এর ১০ এর ধারার ভাষ্যমতে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলা স্থানান্তরের তারিখ থেকে ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আসামীপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেয়া যে কোনো প্রকারের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করতে পারেন সরকারপক্ষ। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেন সরকারের আইন কর্মকর্তারা।
২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট রাষ্ট্র বনাম হেলেনা পাশা (ড্রাগ কেইস নং ৪/১৯৯৩) মামলাটি নিষ্পত্তিতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণ অনুসন্ধান সংক্রান্ত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের ব্যাপারে আইন কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক রুল ও স্থগিতাদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি অহেতুক রুল জারি করাকে দৃঢ়ভাবে নিরুৎসাহিত করতে পারেন এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে স্থগিতাদেশ সংবলিত রুল দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘রুল জারি করা হলেও সর্বোচ্চ ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হওয়ার বিধান করা যেতে পারে। রুল জারি করার অর্থ একটি নতুন মামলা সৃষ্টি। তাই নতুন মামলা সৃষ্টির পরিবর্তে বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানে বিভিন্ন বেঞ্চ গঠন ও পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।’ (সূত্র : দৈনিক যুগান্তর ১২ জুলাই ২০১৫)
দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অনেক মামলার রায়ের কপি বিলম্বে প্রকাশ হচ্ছে। ঘোষণার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ শেষে করতে দেরি হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে মাস পেরিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। এরপরও রায়ের কপি প্রকাশ হচ্ছে না। এতে বিচারপ্রার্থীরা সময়মতো বিচারের ফল ভোগ করতে পারছেন না। সর্বোচ্চ কতদিনের মধ্যে রায়ের কপি প্রকাশ করতে হবে- হাইকোর্ট রুলস ও আপিল বিভাগের রুলসেও বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই।
এমনিতেই মামলার জটসহ নানা কারণে বিচারপ্রার্থীরা হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন বলে অভিযোগ আছে। রায়ের কপি প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টি যোগ হয়ে সেই ভোগান্তিকে প্রলম্বিত করছে।
বর্তমান প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব নেয়ার পর বিচার প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও মামলাজট কমিয়ে আনাসহ নানা বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। রায়ের কপি বিলম্বে প্রকাশের বিষয়টি সব বেঞ্চের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
কিন্তু অনেক বেঞ্চেই রায় পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এর সমাধান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে সর্বোচ্চ কতদিনের মধ্যে বিচারপ্রার্থীরা রায়ের কপি হাতে পাবেন। এই নির্ধারিত সময়সীমার বিষয়টি হাইকোর্ট রুলস এবং আপিল বিভাগের রুলসেও অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে।
বিচারের সঙ্গে রায়ের কপি পাওয়ার ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতা চলতে থাকলে বিচার বিভাগের প্রতি বিশেষত উচ্চ আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা হারানোর আশঙ্কা থাকে। কারণ নিম্ন আদালতে কিন্তু রায়ের কপি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো দীর্ঘসূত্রতা নেই। কাজেই এই সমস্যা দ্রুত নিরসন করতে হবে।
১৯৮৬ সালে তৈরি করা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিচারকদের অবস্থান অনেক নিচে থাকায় তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। শুনানি শেষে ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট ১৯৮৬ সালের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। এতে বিচারকদের পদমর্যাদাক্রম ঠিক করে নতুনভাবে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স তৈরি করতে বলা হয়। ওই রায়ে ৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়। হাইকোর্টের এ রায় বাস্তবায়ন করলে প্রশাসনের মধ্যে অস্থিতিশীলতা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে- এমন দাবি করে সরকারপক্ষ এর বিরুদ্ধে আপিল করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন। এর প্রায় ৫ বছর পর ৭ জানুয়ারি সরকারপক্ষের আপিলটি নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। রায় ঘোষণার পর কয়েক মাস সময় পার হয়েছে। রায়টি লেখার কাজ চলছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন রায়টি লিখছেন। রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রমে বিচারকদের অবস্থান কোথায় হবে তা ওই রায়ের কপির ওপর নির্ভর করছে।
এদিকে ২০১৪ সালের ১৯ জুন হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণার বিধান সংবলিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) ১৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটি রিট খারিজ করে রায় দেন। দশম সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ সংসদ সদস্যের নির্বাচিত হওয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর এই রিটটি করা হয়েছিল। রিট খারিজের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি আপিল দায়েরের জন্য সংবিধান অনুযায়ী একটি সার্টিফিকেটের আবেদন জানিয়েছিলেন রিটকারীর আইনজীবী। কিন্তু সেই সার্টিফিকেটের আবেদনও খারিজ করে দেয়া হয়। এদিকে এখনও ওই রায়ের কপি প্রকাশিত হয়নি। এরই মধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। সার্টিফিকেট না দেয়ায় হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারেননি রিটকারীপক্ষ।
সিভিল আপিল নম্বর ১২৫/২০০৪ মামলাটির বিষয়ে আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন ২০১২ সালের ১২ জুন তারিখে। এই রায়টি লেখছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। কিন্তু এখনও রায়ের কপিতে স্বাক্ষর শেষ হয়নি। এছাড়া ২০১৫ সালের জুন মাসে ২০১২ সালে দেয়া অপর একটি রায়ের কপিতে তিনি স্বাক্ষর করেছেন। এদিকে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে একজন বিচারপতি ২০১৩ সালের মার্চে আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। বর্তমানে আপিল বিভাগের ওই বিচারপতির হাইকোর্টে থাকাকালে দেয়া কয়েকটি রায় লেখার কাজ এখনও বাকি আছে। এভাবে অনেক মামলার রায়ের কপি প্রকাশ হতে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছরে সময় লাগছে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, ‘আইনজীবী সমিতির সভাপতিসহ আমরা ২৩ জুলাই ২০১৫ প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেছি। সেখানে এই রায়ের কপি প্রকাশে বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছি। প্রধান বিচারপতিকে আমরা বলেছি, রায়ের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে কিন্তু বিচারপ্রার্থীরা তিন-চার বছরেও রায়ের কপি পাচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, রায় কারও পক্ষে যাওয়ার পরও শুধু এর কপি প্রকাশে দেরির কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ওই রায়ের কোনো ফল ভোগ করতে পারছে না। ফলে উচ্চ আদালত সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি ধরে রাখার জন্য পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে বলেছি, আশা করছি তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।’
ব্যারিস্টার হাসান এমএস আজীম বলেছেন, ‘অনেক সময় বিচারপতিরা ইচ্ছাকৃতভাবে রায়ের কপি দিতে বিলম্ব করেন না। কাজের অনেক চাপ থাকে। পাশাপাশি দক্ষ বেঞ্চ অফিসারসহ নানা লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব থাকে। ফলে রায়ের কপি দিতে বিলম্ব হয়।’ (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ২৯ জুলাই ২০১৫)
বিচার বিভাগে দুর্নীতি-অনিয়মের একটি অন্যতম জায়গা হচ্ছে মামলা দায়ের ও তা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় নিয়ে আসা। এক্ষেত্রে বেশ তদবিরের প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে মামলা শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম লক্ষ্য করা যায়। তদবির না করলে মামলার সিরিয়াল পেছনে পড়ে যায়। আর এক্ষেত্রে বিও, এবিওরা প্রায়ই অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বেঞ্চ অফিসারদের দৌরাত্ম্য থেকে বিচারপ্রার্থীদের রক্ষায় ১২ জুলাই ২০১৫ কঠোর নির্দেশনা জারি করেছেন সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। বেঞ্চ অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মামলার সিরিয়াল আগে-পিছে করার জন্য চলে সীমাহীন তদবির। এক্ষেত্রে চলে অবৈধ লেনদেনও। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ বিচারপ্রার্থীরা।
বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি লাঘবে এ বিষয়ে তেমন কোনো দৃষ্টি ছিল না সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বিচার বিভাগের অনিয়ম-দুর্নীতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দিয়েছেন। তারই অংশ হিসেবে বেঞ্চ অফিসারদের প্রতি চার দফা নির্দেশনা জারি করা হয়।
কার্যতালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বেঞ্চ অফিসার (বিও) ও সহকারী বেঞ্চ অফিসারদের (এবিও) প্রতি দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে-
১. রিট মামলার মোশন ও শুনানি তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার নম্বর ও সন অনুযায়ী নিম্নক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে দায়েরকৃত রিট মামলার নম্বর পরে দায়েরকৃত রিট মামলার নম্বরের পরে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
২. সব ধরনের ফৌজদারি মামলার মোশন তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার এফিডেভিটের তারিখ ও ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী নি¤œক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে সম্পাদিত এফিডেভিটযুক্ত মামলার আইটেম নম্বর পরে সম্পাদিত এফিডেভিটযুক্ত মামলার আইটেম নম্বরের পরে নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
৩. সব ধরনের ফৌজদারি মামলার শুনানি তালিকা প্রস্তুতের ক্ষেত্রে প্রাপ্ত মেনশন স্লিপগুলোয় উল্লিখিত মামলাগুলো মামলার নম্বর ও সন অনুযায়ী নিম্নক্রম থেকে ঊর্ধ্বক্রমে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই আগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার নম্বর পরে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার নম্বরের পরে আইটেম নম্বর নির্ধারণ করে কার্যতালিকা প্রস্তুত করা যাবে না।
 ৪. এ নির্দেশাবলী কঠোরভাবে অনুসরণীয়। এ নির্দেশাবলীর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কার্যতালিকা প্রস্তুত করলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বেঞ্চ অফিসারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। এটা বন্ধে প্রধান বিচারপতির এই উদ্যোগ একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মামলা শুনানির আর্জেন্সি (জরুরি) আছে। আর্জেন্ট বিষয়গুলো আদালতকে একটু বিবেচনায় নিতে হবে।
মামলা বৃদ্ধির কারণ উদ্ঘাটন করতে হবে আগে। জট নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে এরপর। মামলাজট নিরসনে দক্ষ ও যোগ্য বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি ডিজিটালাইজড করতে হবে বিচার প্রশাসনকে। দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে আইনজীবীদেরও। প্রত্যেক আদালতকে মোশন ও শুনানির এখতিয়ার প্রদান এবং আইনজীবীর উদাসীনতা ও অনুপস্থিতির কারণে খারিজ হওয়া মামলা আবার কার্যতালিকায় উঠানোর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলেও কমবে জট।
কোনো কোনো আইনজীবীর অহেতুক সময় নেয়াও মামলাজট বাড়ার একটি কারণ। এক্ষেত্রে মক্কেলের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে আইনজীবীকে। তাছাড়া নিয়োগ করতে হবে দক্ষ ও যোগ্য বিচারক। সদিচ্ছা থাকতে হবে বিচারকদেরও। দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে সদিচ্ছা সম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগ করা প্রয়োজন। 
জিবলু রহমান 

বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য জাতীয় ঐক্য


বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়েও ক্ষমতাসীন দল অপরাজনীতি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাজনীতিক ও বিশিষ্টজনদের অভিমতসহ বৃহস্পতিবার দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুই বিদেশী নাগরিকের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডকেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহে দেশের সুনাম ও নিরাপত্তার স্বার্থে দরকার যখন ছিল জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা তেমন এক জটিল সময়েও ক্ষমতাসীনরা জাতিকে বিভক্ত করার কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তারা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে এমনভাবে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন যার ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের এই অপরাজনীতি ও একগুঁয়েমির পরিণতিতে এরই মধ্যে পর্যটন খাত মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, বিদেশী উন্নয়ন সংস্থাগুলো হাত গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে জাতীয় অর্থনীতির ওপরও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাছাড়া প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে নতুন নতুন আরো হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে, দেশ এমনকি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের বিভিন্ন আশংকার কারণেই প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অপরাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, নিছক সংকীর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিশেষ দল বা নেতাদের দিকে আঙুল ওঠানোর পরিবর্তে দেশের স্বার্থে, জননিরাপত্তার স্বার্থে এবং জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সকলের-বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের উচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া।
বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশিষ্টজনদের এই অভিমত, আশংকা ও আহ্বানের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। বস্তুত সরকারের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি করার অভিযোগ অকারণে ওঠেনি। গুরুতর সন্দেহ নেই কিন্তু অভিযোগ অস্বীকারও করা যাবে না। সে পথ ক্ষমতাসীন দলই বন্ধ করেছে।  এর কারণ, দেখা যাচ্ছে, ইতালী ও জাপানের দুই নাগরিকের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনরা আবারও প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অশুভ তৎপরতায় নেমে পড়েছেন। তারা বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নাম ধরে বক্তব্য রাখছেন। বিস্ময়ের বিষয় হলো, কোনো রকম তদন্তের আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রচারণা ও আক্রমণের এই অভিযানে অংশ নিয়েছেন। এখনো সে অভিযানে ক্ষান্ত দেয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটা উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা মাত্র এবং ক্ষমতাসীনরা এ কাজটি অতীতে অনেক উপলক্ষেই করেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থ হলে এবং হত্যাকা-ের মতো কোনো ভয়ংকর অপরাধ ঘটলেই তারা সব দোষ প্রতিপক্ষের ওপর চাপানোর এবং নিজেরা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। দুই বিদেশী নাগরিকের ক্ষেত্রেও একই অবস্থান নিয়েছেন তারা। অথচ বিদেশীদের তো বটেই, কোনো হত্যাকা-েরই দায় এড়াতে পারে না সরকার। প্রসঙ্গক্রমে জঙ্গিবাদের প্রশ্ন এসেছে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে। বিএনপি ও জামায়াতের পাশাপাশি বিশিষ্টজনেরাও বলেছেন, জঙ্গিবাদ নিয়ে মন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য রেখে চলেছেন। ব-দিন ধরে জঙ্গিবাদ নিয়ে শোরগোল করার পর সাম্প্রতিক হত্যাকা-ের পর কেউ বলছেন দেশে জঙ্গিবাদী সংগঠন আছে আবার কেউ বলছেন নেই। গত বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একথা পর্যন্ত ঘোষণা করেছেন যে, দুই বিদেশীর হত্যাকাণ্ডে আইএস-এর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশে আইএস-এর অস্তিত্ব নেই বলেও জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। 
আমরা মনে করি, দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে বিশিষ্টজনদের যে বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে তার প্রতিটি অংশ নিয়েই গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কেউই সামান্য বাড়িয়ে বলেননি বরং প্রত্যেকের বক্তব্যেই রয়েছে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়। যেমন মূলকথায় তারা বলেছেন, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা চালানোর পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের উচিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা এবং বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরা যা করছেন তাকে রাজনীতির পরিভাষায় ব্লেমগেম বলা হয়। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এমনকি তদন্ত সম্পন্ন হওয়ারও আগে তারা প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর অশুভ অভিযানে নেমে পড়েছেন। এটা তাদের কৌশল সন্দেহ নেই কিন্তু বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি আমরাও উদ্বিগ্ন এজন্য যে, এর ফলে সবদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। পর্যটন খাতের কথা বিশিষ্টজনেরাই উল্লেখ করেছেন, ওদিকে রফতানি আয়ের প্রধান খাত গার্মেন্টও এরই মধ্যে নেতিবাচক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তৈরি পোশাকের অর্ডার দেয়ার জন্য বিদেশী ক্রেতারা এখন আর বাংলাদেশে আসছেন না, গার্মেন্ট মালিকদেরই উল্টো বিদেশে দৌড়াতে হচ্ছে। উন্নয়ন সংস্থাগুলোর হাত গুটিয়ে নেয়া এবং জাপানের মতো কোনো কোনো দেশের নাগরিকদের প্রত্যাহার করার কার্যক্রমও আতংকিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি কেমন হবে এবং বাংলাদেশকে কতভাবে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে- সময় থাকতেই সেসব ভেবে দেখা দরকার। আর এ ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। আমরা তাই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপরাজনীতি বন্ধ করার এবং তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এর-ওর দিকে আঙুল না ওঠানোর আহ্বান জানাই। একথা অনুধাবন করা জরুরি যে, ক্ষমতাসীনদের অপরাজনীতি, প্রমাণ ছাড়া উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থানের কারণেই দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে চলেছে। সত্যিই সততার সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চাইলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিতে হবে। বলা দরকার, গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির যেমন উন্নতি ঘটবে তেমনি দ্রুত কমে আসবে সব ধরনের অপরাধও। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা এবং অর্থনীতি ও নিরাপত্তাসহ জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণœ হওয়ারও কোনো কারণ থাকবে না।

বুধবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

সংবিধান সমুন্নত না থাকলে মানুষের দুঃখ বাড়ে


পৃথিবীর সব দেশেই এখনো কিছু বিবেকবান মানুষ আছেন। তাইতো প্রতারণাপূর্ণ বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায়ও আমরা হতাশ নই। পড়শি ভারতে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতা বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে গত কয়েকদিনে ৪১ জন লেখক-সাহিত্যিক সরকারি-বেসরকারি পুরস্কার ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। এ নিয়ে ভারতজুড়ে চলছে তুমুল রাজনৈতিক বিতর্ক। এ ব্যাপারে চুপ থাকা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এবার মুখ খুলেছেন। তিনি বলেছেন, বিজেপি এ ধরনের ঘটনা সমর্থন করে না। বিরোধীরা এসব ঘটনাকে সামনে এনে মেরুকরণের রাজনীতি করছেন। অতীতেও এই বিতর্ক হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে এই বিতর্কের নিরসন সম্ভব।
সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারজয়ী যুক্তিবাদী কন্নড় লেখক এমএম কুলবর্গি কর্ণাটকে নিজের বাড়ির কাছে সম্প্রতি খুন হন। এর আগে খুন হয়েছেন যুক্তিবাদী লেখক গোবিন্দ পানসার ও নরেন্দ্র দাভোলকর। সনাতন সংস্থা নামে এক কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এসব হত্যার পেছনে জড়িত রয়েছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সন্দেহ। সংগঠনটির একাধিক সদস্যকে এজন্য গ্রেফতারও করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, শুধু লেখক হত্যার কারণেই নয়, দেশের সার্বিক অসহিষ্ণু ও উগ্র পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই লেককদের প্রতিবাদ। লেখক-লেখিকারা মনে করছেন- বিজেপি আসলে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে, বহুত্ববাদী চরিত্র নষ্ট হয়ে দেশ হিন্দুত্ববাদী হওয়ার পথে এগুচ্ছে। তারা আরো বলেন, গো-হত্যা নিষিদ্ধকরণ, গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মুহম্মদ ইকলাখকে হত্যা, যুক্তিবাদী লেখকদের হত্যা, পাকিস্তানীদের অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান, সুধীন্দ্র কুলকার্নির মুখে কালি লেপে দেওয়াÑ এগুলো আদৌ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ভারতকে ক্রমশ হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার সার্বিক ছকের অঙ্গ এসব ঘটনা।
ভারতের লেখক-লেখিকারা দেশের সার্বিক অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের এই প্রতিবাদ ভারতের সংবিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরাতো জানি, ভারত একটি ধর্মনিরক্ষে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এমন রাষ্ট্রে যুক্তিবাদী লেখকরা কেন খুন হবেন, গো-মাংস খাওয়ার কারণে কেন মুসলমানদের হত্যা করা হবে? এসব ঘটনায় উপলব্ধি করা যায় যে, ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মুক্তবুদ্ধির লেখকদের জীবন নিরাপদ নয়। অথচ আমরা জানি, নাগরিকদের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধান সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালিত হচ্ছে না বলেই ভারতের লেখকরা প্রতিবাদ হিসেবে পুরস্কার ও সম্মাননা ফেরত দিয়েছেন। এটি ভারতের সরকার ও শাসনব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা জ্ঞাপন। আমরা মনে করি, ভারতের সরকার ও প্রশাসন বিষয়টি উপলব্ধি করবেন এবং সংবিধানের আলোকে দেশে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার ব্যাপারে আন্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। আমরা জানি, এই অঞ্চলে ভারত একটি বড় দেশ। দেশটির আচরণ ও ঘটনাপ্রবাহ প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের কর্মকা-ের প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পড়তে পারে। তাই এই অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে আমরা ভারতে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ চাইবো।
বর্তমান পৃথিবীতে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাও কম নয়। অবশ্য এর পেছনে কাজ করে যাচ্ছেন অনেক কারিগর। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে এক নারী এসেছিলেন সহিংস ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে। তার বিবেচনায় মুসলিমরা হলো খুনি আর শিরñেদকারী। কী করে যেন কী হলো, তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি হয়ে গেলেন মুসলমানদের বন্ধু। মুসলমানদের সাথে তিনি কোলাকুলি করলেন, মসজিদে গিয়ে তাদের সাথে নাস্তা করলেন, সেলফি পর্যন্ত তুলে ফেললেন। ঘটনাটি যেমন নাটকীয়, তেমনি কৌতূহল উদ্দীপকও বটে।
আলোচ্য ঘটনাটি ঘটেছে মিশিগানের নূর মসজিদ এলাকায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ওই নারীর সাথে যোগ দেয়ার কথা ছিল আরো কয়েকজনের। কিন্তু অন্যরা তখনও আসেনি। তাই বলে তৎপর এই মহিলা তো থেমে থাকার মানুষ না। তিনি একাই দুই হাতে দু’টি প্ল্যাকার্ড নিয়ে মসজিদের সামনে অবস্থান নিলেন। এবং খুনিদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকলেন। তার স্লোগান শুনে মসজিদ থেকে কয়েকজন বের হয়ে এলেন। একজন তার কাছে এসে জানতে চাইলেন, তিনি তার সাথে বিক্ষোভের বিষয় নিয়ে কথা বলতে রাজি আছেন কিনা? প্রতিবাদকারী নারী বললেন, শয়তানদের সাথে তিনি কথা বলবেন না। এ সময় উক্ত নারী দেখলেন স্কার্ফ পরা কয়েকজন নারীও তার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজন তাকে বললেন, আপনি এসে আমাদের সাথে নাস্তায় যোগ দিতে পারেন। প্রতিবাদকারী বললেন, এটা তো স্রেফ, আরেকটি প্রতারণা হতে পারে। কথাবার্তার এই পর্যায়ে স্কার্ফ পরা এক নারী বললেন, তিনি মেক্সিকো থেকে এসেছেন। সেখানে ড্রাগ-লর্ডরা প্রতিদিন খুন করে ধর্ষণ করে। তারা আবার ক্যাথলিক খ্রিস্টানও। আরেকজন বললেন, হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তারাও ছিল খ্রিস্টান। মসজিদের মুসল্লিরা তাকে বললেন, নাৎসিরা যেমন খ্রিস্টান নন, তেমনি আইএস সদস্যরাও মুসলিম নন। এসব হচ্ছে সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ফসল। এ পর্যায়ে মুসলিমরা আবারও প্রতিবাদকারী নারীকে মসজিদে এসে তাদের সাথে নাস্তা করতে বললেন। ওই নারী আর অন্য সবাই একমত হলেন যে, তারা সবাই খুন ও হত্যার বিরোধি। তারা সবাই আমেরিকার স্বাধীনতা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করবে। এই পর্যায়ে প্রতিবাদকারী ওই নারী মসজিদে যান। সেখানকার সবাই তাকে স্বাগত জানান। সবার উষ্ণতায় চমৎকার এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মুসলমানদের বিরোধিতা করতে এসে ওই মহিলা মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেলেন।
আলোচ্য ঘটনাটি যেন বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির একখণ্ড চিত্র। মুসলিম নামধারী কিছু ব্যক্তির সন্ত্রাসী তৎপরতায় শুধু অন্যরা নয়, সমগ্র মুসলিম উম্মাহও ক্ষুব্ধ। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, পথভ্রষ্ট কিছু মুসলিমের অপতৎপরতা নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালানো হলেও, ওই অপতৎপরতার পেছনে কারা রয়েছে তা খুঁজে বের করার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখা যায় না। ফলে প্রকৃত সত্য উদঘাটিত হচ্ছে না। এই সুযোগে সন্ত্রাসের পরিকল্পনাকারী গডফাদাররা নিরাপদে থেকে একের পর এক তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। অথচ সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের প্রকৃত হোতাদের চিহ্নিত করার কাজে বিশ্ব সম্প্রদায় আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলে প্রকৃত দোষীদের মুখোশ উন্মোচিত হতো এবং তখন মানুষ সহজেই উপলব্ধি করতো, সন্ত্রাস ও নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের সাথে প্রকৃত মুসলিম ও ইসলামের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। যেমনটি উপলব্ধি করেছেন মিশিগানের নূর মসজিদে এসে সংক্ষুব্ধ এক মহিলা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথা বিশ্ব রাজনীতি প্রকৃত সত্য উদঘাটনে আদৌ উৎসাহ দেখাবে কী?
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার মসনদে যারা বসে আছেন, তাদের নৈতিক মেরুদ- খুবই দুর্বল। ফলে সত্য উদঘাটনে কিংবা সত্য উচ্চারণে তাদের কাছ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক কিছু আশা করা যায় না। আর পরিতাপের বিষয় হলো, এরা যখন ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেন তখন কিন্তু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে থাকার শপথই উচ্চারণ করে থাকেন। কিন্তু মসনদে বসার পরেই তারা শপথের বিপরীত কাজ করে চলেন। কায়েমী স্বার্থ রক্ষা এবং ভাগাভাগির রাজনীতিকে উসকে দিয়ে তারা মানুষের জীবনযাপনকে দুর্বিষহ করে তোলেন। একের পর এক যার শিকার হয়ে চলেছে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলো।
মুসলমানদের ধর্মকর্ম নিয়ে আজকাল অনেক আলোচনা হয়, সমালোচনাও হয়। তবে জেনে সমালোচনার ধরন এক রকম, না জেনে সমালোচনার ধরন আবার অন্যরকম। আর উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনার ধরন হয় সবচাইতে নিকৃষ্ট। এমন সমালোচনা উত্তাপ সৃষ্টিতে সক্ষম হলেও মানুষের, সামজের কল্যাণসাধনে একেবারেই অক্ষম। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ভারতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের জীবনযাপন বিশেষ করে হিজাব ও নিকাব নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক আলোচনা ও কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করেছি। তবে সব দেশ অসহিষ্ণু ও উগ্র মানুষের অসদাচরণ থেকে মুসলমানদের রক্ষায় সঙ্গত ভূমিকা পালনে সমর্থ হয়নি। ফলে তারা নিজেদেরকে উদার, অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবি করলেও বাস্তব কারণে তা সচেতন মানুষের কাছে গ্রহণীয় বলে বিবেচিত হয়নি। এটা বর্তমান পৃথিবীর প্রহসনমূলক এক চেহারা, যা অমানবিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
বর্তমান বিশ্বের এমন বাতাবরণে কানাডার আদালতের প্রশংসা করতে হয়। কানাডার ক্ষমতাসীন কনজারবেটিভ পার্টির সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার মুসলিম মহিলাদের নিকাব পরা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আদালতে আরেক দফা হেরে গেলেন। ৫ অক্টোবর ফেডারেল কোর্ট অব আপিল যে রুলিং দিয়েছেন তার অর্থ হলো, কানাডার ধর্মানুরাগী মুসলিম মহিলারা নাগরিকত্ব শপথ নেয়ার সময় মুখ নিকাবে আবৃত রাখতে পারবেন এবং ১৯ অক্টোবর কানাডার সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, নিকাবের বিষয়টি নিয়ে কানাডার বর্তমান সরকারের সাথে লড়ে যাচ্ছিলেন জুনেরা ইসহাক নামের এক মুসলিম মহিলা। ২৯ বছর বয়সী এই মহিলা ২০০৮ সালে পাকিস্তান থেকে অভিবাসী হয়ে কানাডায় আসেন। তিনি অন্টারিওতে বসবাস শুরু করেন। ২০১১ সালে হারপার সরকার এক নির্দেশ জারি করে যে, যে সব মহিলা মুখ আংশিক কিংবা পুরা আবৃত করে চলে, নাগরিকত্বের শপথ গ্রহণ করার সময় তাদের মুখকে অবশ্যই অনাবৃত করতে হবে। জুনেরা ইসহাক তার মুখকে অনাবৃত করে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এই বিধান কানাডার সংবিধানে ‘চার্টার অব রাইটস’ তাকে যে অধিকার দিয়েছে তার পরিপন্থী। তিনি তার অধিকারের পক্ষে আদালতে আর্জি পেশ করেন এবং আদালত জুনেরা ইসহাকের পক্ষে রায় দেন। আদালতের এই রায় মানুষের অধিকারকে এবং আইনের শাসনকে সমুন্নত রেখে বর্তমান বিশ্বে এক উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করলো।
এই ঘটনায় উপলব্ধি করা গেল, কানাডার আদালত মানবাধিকার রক্ষায় কতটা নিষ্ঠাবান। দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিতে আদালত মোটেও কম্পিত হননি। তবে দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমান পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন উদাহরণ লক্ষ্য করা যায় না। যেসব দেশে প্রশাসন, জাতীয় সংসদ ও আদালত সংবিধানকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে সরকারের কাছে মাথানত করে, সেইসব দেশে জনগণের ভোগান্তি বাড়ে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সংবিধানের আলোকে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে সরকার কিংবা রাজনীতিবিদদের মুখের কথায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না, মানবাধিকার রক্ষিত হবে না, সমাজে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতাও লক্ষ্য করা যাবে না। বর্তমান সময়ে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই এমন সংকটের মধ্যে  রয়েছে। তবে কানাডার উদাহরণ থেকে শিক্ষার নিলে ওইসব দেশেও কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। বিষয়টি আমাদের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

‘তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হবো’


‘আমি তোমার যাত্রীদলে রইব পিছে
স্থান দিও হে আমায় তুমি সবার নিচে,
সবার শেষে যা বাকি রয়, তাহাই লব,
তোমার চরণ ধূলায় ধূলায় ধূসর হবো।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এদেশের অনির্বাচিত জবরদখলকারী সরকারের অবস্থা এখন এমনই দাঁড়িয়েছে। জনগণ, দেশ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়ে বর্তমান সরকার যে ভারত তোষণ নীতি কংগ্রেস সরকারের আমলে গ্রহণ করেছিল, এখন চরম সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। এখনও ভারত সরকারের পদতলে নিজেদের নৈবেদ্য হিসেবে উপস্থাপনে মরিয়া হয়ে আছে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসররা। ফলে আমরা কেবল ভারতকে উজাড় করে সব কিছু দিয়েই যাচ্ছি, বিনিময়ে পাচ্ছিনা বা চাইছি না কিছুই। এই সরকারের এক রাষ্ট্রঘাতী উপদেষ্টা তো বলে বসেছেন যে, ভারতের কাছে ট্রানজিট ফি চাওয়া অসভ্যতা। এমন প্রকাশ্য রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী লোকও এদেশে এবং সরকারের ভেতরে আছে। সুতরাং জনগণ, সামনে আরও দুঃসময় অপেক্ষমাণ।
ভারতকে বিনা মাসুলে সব কিছু দিয়ে দেবার এই প্রক্রিয়ায় গত ১৬ অক্টোবর চালু হয়েছে নতুন এক করিডোর- আগরতলা-ঢাকা-কোলকাতা সড়কপথ। এই পথে এখন ভারতীয় নাগরিক ও পণ্য অবাধে যাতায়াত করতে পারবে। বাস সার্ভিস শুরু করার আগে ভারতীয় ভূমি দিয়ে যাতায়াত কোলকাতা থেকে আগরতলার দূরত্ব ছিল ১,৬৭৫ কিলোমিটার। সময় লাগতো ৩৬ ঘণ্টা। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে এই পথের দূরত্ব মাত্র ৫১৫ কিলোমিটার। ভাড়া মাত্র ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা। এ সাশ্রয় ভারতীয়দের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের বেলায়? এই সড়ক পথে ভারতীয় যান চলাচলে সড়কগুলোর যে বাড়তি ক্ষতি হবে, তা দেবে কে? কিংবা এই পথ ব্যবহারের জন্য ভারত বাংলাদেশকে কী মাসুল দেবে, তার উল্লেখ কোথায়ও নেই।
আবার এই পথ চালু হওয়ায় আমাদের কী সুবিধা হলো সেকথা কেউ উল্লেখ করছেন না। ঢাকা-কোলকাতা, ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস আগে থেকেই ছিল। আগেও একজন ভারতীয় নাগরিক  কোলকাতা থেকে ঢাকা এসে আবার ঢাকা থেকে আগরতলা যেতে পারতেন। এখন আর তাদের বাস বদলানোর দরকার হবে না। কিন্তু একই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল যে, বাংলাদেশের নাগরিক, যারা চিকিৎসা, পর্যটন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভারত যাবেন, তাদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করে তোলা হবে। সরকারের ভেতরকার কোনো ‘সভ্য’ লোক এ প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেননি। পাছে মোদি যদি কিছু মনে করেন? সম্প্রতি দু’ দেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যে, বাংলাদেশ ভারত ভুটান নেপালের নাগরিকরা অবাধে সড়কপথে যাতায়াত করতে পারবে অন্য কোনো দেশে। করতে পারবেন পণ্য পরিবহনও। চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সে সুবিধা ভোগ করতে শুরু করলেও বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য তা অধরাই রয়ে গেছে। ভারতীয় নাগরিকরা ছুটছে এখান থেকে সেখানে। আমরা আছি যেমন ছিলাম তেমনই। দ্বিতীয় কোনো দেশে আমাদের যেতে হবে ভারতের ওপর দিয়েই। কিন্তু বাংলাদেশীদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের নীতি ইতরই রয়ে গেছে। এ বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে কেন আগরতলা-কোলকাতা ট্রানজিট দেওয়া হলো সে প্রশ্ন নাগরিকদের আছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে, দেশ সরকারের বাপ-দাদার তালুক-মুলুক নয়, দেশ জনগণের সম্পত্তি। শুধু নিজেদের ক্ষমতায় থাকার লিপ্সায় দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়ার এই খেলা জনগণ বরদাশত করবে না।
এদিকে আবার চার-দেশীয় উপআঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য তোড়জোর শুরু করেছে ভারত। এই চার দেশ হলো বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপাল। দৃশ্যত মনে হতে পারে, হোক এ ব্যবস্থা। এতে এই চার দেশই উপকৃত হতে পারবে। কিন্তু এর গূঢ় অর্থ তা নয়। এটাও সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় চালাকি ও চাল। বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য যে কোনো দেশের যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করতে হবে ভারতীয় ভূখণ্ড। সেটা কার্যত দুঃস্বপ্নই। তার প্রমাণ পাওয়া গেল ভারতের অঘোষিত নেপাল অবরোধের মধ্য দিয়ে। নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল বাণিজ্য খুব বেশি নয়। কিন্তু ভারতীয় অঘোষিত নেপাল অবরোধে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাকও আটকে দিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ভুটান যেতেও যে একই পরিস্থিতি দাঁড়াবে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থাৎ বাংলাদেশ অবাধে এ সড়ক ব্যবহার করতে পারবে না।
এই কানেকটিভিটি চালের মূল লক্ষ্য, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের অবাধ যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। ভারত ঐ সাত রাজ্যে পণ্য পরিবহন তো করবেই, সেই সঙ্গে সেখানকার দীর্ঘ দিনের স্বাধীনতা আন্দোলন দমনের জন্য ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অবাধে নিয়ে যাবে সৈন্য, সামরিক সাজসরঞ্জাম ও রসদপত্র। ফলে খুব সাভাবিকভাবেই বাংলাদেশ পরিণত হবে ঐ স্বাধীনতাকমীদের সাভাবিক টার্গেটে। আমরা ভারতের যুদ্ধ ডেকে আনবো নিজেদের ঘরে। উপরন্তু ভারতীয় চোরাই অস্ত্র ও মাদকে ছেয়ে যাবে বাংলাদেশ। যাতে ধ্বংস হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর সৃষ্টি হবে ব্যাপক সামাজিক বিশৃঙ্খলা। এছাড়াও এই কানেকটিভিটির ফলে বাংলাদেশের যেটুকু বাণিজ্য আছে ভারতের সঙ্গে, তাও মারাত্মকভাবে হোঁচট খাবে। কাছাকাছি হওয়ায় বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে কিছু পণ্য রফতানির সুযোগ পায়। কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের দুয়ার সম্পূর্ণ খুলে দিলে সে রফতানিও বন্ধ হয়ে যাবে। আবার দেশীয় শিল্পও এতে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য। কারণ এ পথে চলাচলকালে ভারতীয় শত শত টন পণ্য যে ভারত বাংলাদেশে খালাস করে যাবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর সেসব পণ্য প্রতিযোগিতায় দেশীয় পণ্যকে বাজার থেকে হঠিয়ে দেবে। কানেকটিভিটির আগে এসব বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে।
গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীতে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা ধারণা দিয়েছেন যে, উপআঞ্চলিক যে কানেকটিভিটির কথা বলা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো খাতে কমপক্ষে ২৩০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ কোনো লাভের আশা ছাড়াই ভারতের সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে অবকাঠামো নির্মাণ করে দিতে হবে। এধরনের আবদার উপনিবেশগুলোর ওপর সা¤্রাজ্যবাদীরাই কেবল করতে পারত। এর আগে এই অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে চড়া সুদে ঋণ দিচ্ছে। তার শর্তও অসাধারণ। তার কংক্রিট খোয়া সিমেন্ট বালি পাথর শ্রমিক যানবাহন সবই আনতে হবে ভারত থেকে। এ জন্য কোনো আন্তর্জাতিক টেন্ডারও আহ্বান করা যাবে না। ভারত যা দর দাম হাঁকবে সেটাই মূল্য। তা আন্তর্জাতিক বাজার দর থেকে দশ গুণ বিশ গুণ বা এক শ’ গুণও বেশি হতে পারে। বাংলাদেশকে বিনা প্রশ্নে তাই মেনে নিতে হবে।
কিন্তু বাস্তবের নিরিখে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের এই কানেকটিভিটির কোনো প্রয়োজনই নেই। ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য যেটুকু যোগাযোগ অবকাঠামো আমাদের প্রয়োজন, তা আমাদের আছে। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা ধারাবাহিকভাকে এসব সড়ক মেরামত করে সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তা কার্যকর রাখার জন্য আমাদের যথেষ্ট হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় অবাধে ভারতীয় ভারী যানবাহন চলাচলের সুযোগ দিতে চাইলে আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়বে।
এদিকে আবার বৈদেশিক ঋণের জন্য সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার দরবারে হত্যা দিয়ে পড়ে আছে। বাজেট সহায়তার মাত্র ৫০ কোটি ডলার ঋণের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে নানা তদবিরে ব্যস্ত সরকার। সরকারের পর্বত প্রমাণ দুর্নীতির রেকর্ডের কারণে সে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে ভারতের স্বার্থে কানেকটিভিটির জন্য যদি ঋণ পেতে আবার দৌড়াদৌড়ি শুরু করতে হয়, তবে সরকারের অবস্থা হবে ত্রাহি মধুসূদন। এক্ষেত্রেও অসম্মানজনক ভারতীয় লুটেরা চেতনা থেকেই দিল্লি আবার এগিয়ে আসতে পারে। সেটাও হবে ডাচ উপকথার ‘ফ্লাইং ডাচম্যানে’র মতো শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে দেওয়ার শামিল। ক্ষমতায় থাকার জন্য সরকার হয়তো তাতেও কসুর করবে না। দেশবাসীর বিপদ সেখানেই। এক্ষেত্রে বর্তমান নতজান সরকার কোনোদিন নেপাল বা মালদ্বীপের মতো বুক চিতিয়ে বলতে পারবে না, সাবধান, আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবেন না।
এত যেখানে ভারত-পীরিতি, এত কিছু যেখানে ভারতকে দেওয়া, তারপরও ভারত তার আধিপত্যবাদী চিন্তা- চেতনা থেকে এক চুলও সরে আসছে না। বরং অতি সংগোপনে বাংলাদেশের সীমান্তে এখনও যেখানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি, সেসব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সেই সঙ্গে পুরো বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে পাকা সড়ক নির্মাণের আয়োজন করেছে যেন, ঐ ন্যাংটার দেশে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষ একবারে মুখিয়ে আছে। কিন্তু ভারতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, ভাগ্যের অণ্বেষণে তাদের নাগরিকরা বাংলাদেশে পাড়ি জমায়, বাংলাদেশীরা ভারতে যায় না। ভারতীয় নাগরিকরা বিদেশে চাকরি করে তাদের দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠায়, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
 বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও সড়ক নির্মাণের  জন্য কেন্দ্রীয় ভারতের সরকার বরাদ্দ দিয়েছে চার হাজার ৪০০ শ কোটি রূপি। এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলার নামান্তর। ভারত যদি ধারাবাহিকভাবে এরকম শত্রুতামূলক মনোভাব পোষণ করতেই থাকবে, তারপরও আমাদের প্রেম দিয়েই যেতে হবে-এই দাস মনোবৃত্তি  থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ভারতের নিকৃষ্টতম লেজুড় হিসেবে উচ্ছিষ্টভোগী। এরা যাত্রীদলের পেছনে থেকে কেবলই ভারতের চরণ ধূলায় ধূসরিত হতে চায়। আর তাই অধিকার ও মর্যাদা জনগণকেই আদায় করে নিতে হবে, এই মুহূর্তে যেভাবে কষ্ট সহ্য করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন নেপালের জনগণ, সেভাবেই।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৫

0 Comments
Posted in Arrangement, Art, Business

কাকে বলি উন্নয়ন !

এখন চার দিকে চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের ‘নিজের ঢোল নিজে পেটানো’র একধরনের মহোৎসব। সরকার সমর্থক মুদ্রণ গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম সেই মহোৎসবে যোগ দিয়েছে মহাসমারোহে। এর ওপর সরকারি টেলিভিশন তো যথারীতি আছেই। এরপরও প্রচার-প্রচারণার পরিধি ও তীব্রতা বাড়ানোর জন্য সরকারদলীয় চেষ্টাসাধ্যিরও কমতি নেই। প্রতিটি অফিস-আদালতের সীমানা-দেয়ালের পাশ ঘেঁষে স্থায়ীভাবে টানানো আছে উন্নয়নের ফিরিস্তির শত শত বিলবোর্ড। অতিসম্প্রতি রাজধানীজুড়ে উঠেছে শত শত নতুন দর্শনীয় বিলবোর্ড। সর্বশেষ চটকদার এসব বিলবোর্ড রাজধানীর সড়কের দু’পাশে শোভা পাচ্ছে ঢাকার দুই নতুন মেয়রের উদ্যোগসূত্রে। এসব বিলবোর্ডে উন্নয়নের যেসব ফিরিস্তি দেয়া হয়েছে, তা দেখলে মনে হয় বাংলাদেশ উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। অচিরেই বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মসূচি নেয়ার মতো কোনো স্থান-খাত খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সম্ভবত সরকারের এক মন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, আর কয় বছর পর বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু সর্বশেষ আদমশুমারি ২০১১ এবং খানার আয়-ব্যয় নির্ধারণ জরিপ ২০১০ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী দেশের ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। সবচেয়ে বেশি গরিব কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। এ জেলার ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষই গরিব শ্রেণীর। বরিশাল ছাড়া বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গরিব মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। এসব অঞ্চলে প্রাথমিক স্কুল শেষ করা শিশুদের সংখ্যাও কম। আগামী কয় বছরের মধ্যে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের কোন জাদুর কাঠি সরকারের হাতে আছে, তা জানি না। 
এ সরকার বেশ বড়গলায় প্রচার করে, বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয় বছর আগেই দাবি করেছেন, দেশের মানুষ এখন দিনে তিন বেলা নয়, পাঁচ বেলা খায়। সর্বসাম্প্রতিক বিশ্ব খাদ্য দিবসের আলোচনা সভায় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, দেশে এখন ভাত পেতে বেশি কষ্ট করতে হয় না। কৃষিমন্ত্রীর এই বক্তব্য গত শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। একই দিনে ওই দৈনিকটি সাংবাদিক মশিউল আলমের উন্নয়নবিষয়ক একটি লেখা সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশ করে। লেখাটির শিরোনাম : ‘খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা’ ও ভাত খাওয়ার গল্প। এ লেখার শুরুতেই লেখক পঞ্চগড় শহরের একটি খাবার হোটেলের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন এভাবে : ‘পঞ্চগড় শহরের এক খাবার হেটেলে সাতসকালে দেখেছিলাম লোকজন ভাত খাচ্ছে। সাদা ভাত, নুন আর একটুখানি সবজি কিংবা মুগডাল। সবজি ও মুগডালের পরিমাণ এতই কম যে, তা দিয়ে একথালা ভাত খাওয়া যায় না।... এখানে ১০ জন যদি ভাত খেতে আসে, তাদের পাঁচ বা ছয়জন ভাত খায়। অন্যরা রুটি পরোটা।’ তার পুরো লেখায় এখানে ভাত খেতে আসা শ্রমজীবী মানুষের ভাত খাওয়ার করুণ চিত্রটিই ফুটে উঠেছে, যা একই সাথে কৃষিমন্ত্রীর ‘দেশে এখন আর ভাত পেতে বেশি কষ্ট হয় না’ বক্তব্যের অসারতাই প্রমাণ করে। স্থানাভাবে এর বিস্তারিতে যাওয়া সম্ভব নয়। তবে বলা দরকার, এই লেখক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন : ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তির প্রায় ৮০ শতাংশের জোগান আসে ভাত ও আলুজাতীয় খাবার থেকে। এটি দরিদ্র মানুষের খাবার; পুষ্টির অভাবে ভোগে প্রধানত এরাই। তাহলে ধরে নিতে হয়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অপুষ্টি দূর করতে কাজে আসছে না। অপুষ্টি দূর করতে হলে তাদের খাবারের তালিকায় মাছ, গোশত, দুধ, ডিম ইত্যাদি পুষ্টিকর খাবার যোগ করা প্রয়োজন। কিন্তু সেটা কে করবে?’
প্রশ্নটা আমারও। যারা লোক-দেখানো উন্নয়নের জারি গেয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়, তাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, এ ধরনের মৌল প্রশ্নের সমাধান হয় না। কারণ, তাদের উন্নয়ন-ভাবনা সংজ্ঞায়িত হয় ভিন্নভাবে। দলীয় নেতাকর্মীদের উন্নয়নই এদের কাছে অগ্রাধিকার পায়। এ জন্যই এরা সীমিত গণতন্ত্রের আওতায় উন্নয়নের কথা বলে। উন্নয়ন প্রশ্নে জনপুষ্টি নিশ্চিত করার কথা এদের কাছে সেকেন্ডারি প্রশ্ন। মশিউল আলমের লেখায় উল্লেখ আছে, উল্লিখিত খাবার হোটেলে আসা একজন এই লেখককে জানিয়েছেন, তিনি গত বছরের কোরবানির ঈদে গরুর গোশত খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এবার আশায় ছিলেন সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কোরবানির ঈদে আবার গরুর গোশতের স্বাদ নেয়ার। সম্প্রতি জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা জানিয়েছে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা কমেনি। পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০-৯২ সময়ে বাংলাদেশে পুষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৬০ লাখ। ২০০০-০২ সময়ে তা কমে দাঁড়ায় দুই কোটি ৭৭ লাখ, ২০০৫-০৭ তা আরো কমে হয় দুই কোটি ৪৩ লাখ। কিন্তু ২০১০-১২ সময়ে তা আবার বেড়ে হয় দুই কোটি ৬৫ লাখ। এই হচ্ছে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাওয়ার নমুনা।
আসলে আমাদের সরকার যদি সত্যিকারের উন্নয়ন কাকে বলে তা উপলব্ধিতে রাখত, তবে বুঝত একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলাই হচ্ছে প্রকৃত দেশোন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ জন্য প্রয়োজন যাবতীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে দেশে সব মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাবার জোগানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। দেশে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আগামী প্রজন্মের জন্য সুশিক্ষা ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা, ধনী-গরিব সবার জন্য সুলভ ও সিন্ডিকেটমুক্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, মানুষের কর্মসংস্থানের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করে মানুষের ভাতকাপড় নিশ্চিত করা, দেশকে বিদ্যমান অসহিষ্ণু রাজনীতি থেকে বের করে আনা, দুর্নীতির অবসান ঘটানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বহু মত-পথের সম্মিলন ঘটিয়ে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সূচনা করা, যাবতীয় দলীয় গোঁয়ার্তুমির অবসান, দেশকে বিভাজনের রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন, দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুরক্ষা ও মূল্যবোধ প্রশ্নে আপসহীন থাকা, দেশে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের মন পাঠ করে যাবতীয় সরকারি সিদ্ধান্ত নেয়া এবং এমনই ধরনের ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যেই নিহিত রয়েছে একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন, ভিন্ন কোনো পথে নয়। তা না করে আমাদের সরকার হাঁটছে ভিন্ন পথে। 
এরা কোনো রাখঢাক না করেই বলছেন, গণতন্ত্র নাই বা থাকল, উন্নয়ন হলেই হলো। আবার এদেরই কেউ কেউ বলছেন, এখন থেকে দেশে চলবে সীমিত গণতন্ত্র। আর এর মধ্য দিয়েই এরা দেশকে উন্নয়নের চরমে নিয়ে পৌঁছাবেন। তখন দেশবাসী ভুলে যাবে সরকারবিরোধীদের। আর এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হবে এ সরকারের স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি। আসলে এরা মনে করছেন কয়েকটি ফাইওভার, ওভারব্রিজ, কালভার্ট, বড় কয়টি সেতু, সুদৃশ্য ভবন, সরকারি অফিস-আদালতের পুরনো দেয়াল ও ফটক ভেঙে সুদৃশ্য করে তোলা, রঙিন ফুটপাথ করে দেয়া, আর কয়েক শ’ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা, কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টের মাধ্যমে কয়েক শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো কিংবা বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা ইত্যাদি ধরনের কাজের মধ্য দিয়ে এ সরকারের উন্নয়নের চিত্রটা বেশ ভালোভাবেই জনগণের কাছে দৃশ্যমান করে তোলা যাবে। অবশ্য এ জন্য প্রয়োজন হবে পাশাপাশি বিলবোর্ড টানানো কর্মসূচিটাও অব্যাহত রাখা। 
আসলে প্রকৃত উন্নয়ন যাকে বলা হয়, তা এর মাধ্যমে হওয়ার নয়। কারণ উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রথম ও অবিকল্প পথ হচ্ছে, দেশে গণতন্ত্রের পথকে অবাধ করা, দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত বিতর্কহীন একটি সরকার কায়েম এবং যাবাতীয় সরকারি প্রয়াসে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা। এখানে আমাদের ব্যর্থতা ষোলো আনা বলেই আমারা ছুটছি লোক-দেখানো মেকি উন্নয়নের পেছনে। আর এর মাধ্যমে কার্যত আমরা আমাদের পিছিয়ে পড়াটাকেই নিশ্চিত করছি। তথ্য পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে সে সত্যেরই প্রতিফলন মেলে। আর সরকারি বিলবোর্ডগুলোর অসারতাকেই সামনে নিয়ে আসে।
সরকার দাবি করছে, ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।’ ইদানীং সরকারের টানানো বিলবোর্ডে এমনটিই লেখা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে তখন, যখন এর পরনির্ভরশীলতা কমবে, ঋণের বোঝা লাঘব হবে এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা। কিন্তু তথ্য-পরিসংখ্যান তা বলে না। ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ রিপোর্টে সম্প্রতি বলা হয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে মানুষের সম্পদ বেড়েছে তিন গুণ। আর প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। কিন্তু সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আমাদের ঋণের বোঝাও। বর্তমানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ঋণের পরিমাণ ৬৪ ডলার। ১৫ বছর আগে তা ছিল ২৪ ডলার। যখন একটি দেশের ঋণের বোঝা বাড়ে, তখন সে দেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এমনটি কী করে বলা যায়? আরেকটি প্রশ্ন সহজেই তোলা যায় যে সম্পদ বেড়েছে বলে বলা হয়েছে, সে সম্পদ কাদের হাতে পুঞ্জীভূত হয়েছে বা হচ্ছে। জনগণের বদ্ধমূল ধারণা, ক্ষমতাসীনেরাই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি আর দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ছে। সাধারণ মানুষ হচ্ছে সম্পদ-বঞ্চিত। এভাবে দেশে এক ধরনের সম্পদবৈষম্য গড়ে উঠেছে। এর নাম উন্নয়ন নয়। তাই দেশের ঋণের বোঝা বাড়ছে। আর এ ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষকেই বয়ে বেড়াতে হবে। পত্রিকায় দেখলাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, তিন মাসের ব্যবধানে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে দুই হাজার ৬৩৫ জন। খবর নিলে দেখা যাবে, এই নতুন কোটিপতি কারা। এরা কারা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মরহুম হাবিবুর রহমান ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলে গেছেন, দেশটা চলে গেছে বাজিকরদের হাতে। এর বাইরে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতির অভিযোগও গণমাধ্যমসূত্রে দেশবাসী অনেক জেনেছে। এ প্রসঙ্গে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। 
পত্রিকায় দেখলাম, ক্ষমতার অপব্যবহার আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বরগুনার আমতলীর পৌরসভার মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান ৪০ কোটি টাকার সরকারি জমিতে বাড়ি ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন। এ ধরনের মতিয়ার রহমানদের সংখ্যা সরকারি দলে অগুনতি। এরাই আসলে রাতারাতি কোটিপতি হচ্ছেন, এমন ধারণা সাধারণ মানুষের। তিন-চার দিন আগের ঘটনা। সাবেক এক এমপির কিশোর ভাতিজা গাড়ি চাপায় গুলশানে চারজনকে আহত করে। আহতদের হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়েছিল। এখন সেখান থেকে এদের সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঘটনার ছয় দিন পরও কোনো মামলা হয়নি। পুলিশ গাড়িটি আটক করলেও ঘটনার নায়ক এই ভাতিজাকে পুলিশই নিরাপদে পৌঁছে দেয়। পত্রিকার খবরÑ এখন পুলিশের মাধ্যমে আপসরফার প্রক্রিয়া চলছে। কাছাকাছি সময়ের আরেক ঘটনা একজন ধর্ষককে জনতা হাতেনাতে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলেও পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ এই ধর্ষক সরকারি দলের কেউ। দেশে আইনের শাসন থাকলে এমনটি হওয়ার কোনো সুযোগ থাকত না। সরকারকে বুঝতে হবে, উন্নয়নের আরেক অপরিহার্য অনুষঙ্গ হচ্ছে আইনের শাসন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আইনের শাসন বলতে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর কারণে-অকারণে দমন-পীড়ন, মামলা-হামলা আর ঘরবাড়িছাড়া করা। সাথে ক্রসফায়ার, গুম, অপহরণের অভিযোগও কম নয়। আসলে দেশের উন্নয়ন এ পথে নয়। এগুলা দেশকে পিছিয়ে নেয়ারই অনুষঙ্গ।
দেশের উন্নয়ন করতে হলে শিক্ষার উন্নয়নও অপরিহার্য। সে ব্যাপারে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু সে দিকে আমাদের সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন। দেশে বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর দমন-পীড়ন কঠোরভাবে জারি রেখে দেশকে কার্যত পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে হাজার হাজার লোক। কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নে অপরিহার্য শিক্ষক নিয়োগে সরকারের আগ্রহ সে তুলনায় অনেক কম। গত পরশু একটি জাতীয় দৈনিক খবর দিয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখনো অর্ধলাখ পদে শিক্ষক নেই। এ দেশের হাজার হাজার মেধাবী তরুণ তাদের কাক্সিক্ষত বিষয় ও কোর্সে উচ্চশিক্ষা নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা দেশের বড় বড় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে থেকে থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে করে দেয়া হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার ভিত নড়বড়ে করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনের মারামারি ও প্রকাশ্য অস্ত্রমহড়া এবং সরকার সমর্থক শিক্ষকদের দলাদলির জের ধরেই বন্ধ হচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। এসবের সচিত্র প্রতিবেদন জড়িতদের নাম-ঠিকানা ভাঙিয়ে গণমাধ্যমে ছাপা হলেও প্রতিকার নেই। এসব জিইয়ে দেশোন্নয়নের চিন্তা চরম বোকামি বৈ কিছু নয়। 
আমরা আজ বড়গলায় দাবি করছি : ‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল’। রোল মডেল কথাটি ১৯৫৫-১৯৬০ সময় পরিধিতে মূলত ব্যক্তি প্রশ্নেই সূচিত। আর তাই রোল মডেলের সংজ্ঞাটি দেয়া হয় এভাবে : Role model is a person whose behavior, example, or success is or can be emulated by others, especially by younger people- Dictionary.com. এর অর্থ সরল। আমরা সেই ব্যক্তিকেই রোল মডেল বিবেচনা করব যার আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য হবে অন্যদের কাছে, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে অনুসরণীয়, তার সমকক্ষ হয়ে ওঠার প্রয়াসে। এখানে ব্যক্তি বা পারসন শব্দটির জায়গায় একটি দেশের কথা বিবেচনা করলে বলতে হয়, একটি দেশ রোল মডেল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে তখন, যখন এই দেশটির তথা দেশটি সরকারের আচরণ, সৃষ্ট উদাহরণ বা সাফল্য অনুসরণ করে অন্য দেশগুলো এই দেশটির সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করবে। আমাদের বাংলাদেশ কি সেই অনুসরণীয় আচরণ, উদাহরণ ও সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? স্বভাবতই প্রশ্ন আসে অন্যান্য দেশ আমাদের কী উদাহরণ অনুসরণ করবে? এরা কি আমাদের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা পার্লামেন্ট নির্বাচনব্যবস্থা অনুসরণ করবে, যেখানে অর্ধেকরও বেশি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন, নির্বাচনের আগেই নির্ধারিত হয়ে যাবে কোন দল ক্ষমতায় যাবে; এমন ব্যবস্থা কায়েম করবে, যেখানে দেশে দুই-তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন বর্জন করতে হবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো অদ্ভুতুড়ে গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টি করবে, যেটি সরকারেও থাকবে, আবার বিরোধী দলেও থাকবে, সরকারের কথায় উঠবে, বসবে? এরা কি তাদের দেশে আমাদের দেশের মতো দলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজির পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে? তাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও আমাদের দেশের শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য আমদানি করবে? ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে অস্ত্রমহড়া চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দলীয় স্বার্থে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে সংবিধানের কাটাছেঁড়ার সংস্কৃতি চালু করবে। এরা কি তাদের দেশে আমাদের মতো ক্রসফায়ার, গুম অপহরণের উদাহরণ সৃষ্টি করবে? এরা কি বিরোধী দল নিঃশেষ করার নতুন নতুন কর্মসূচি হাতে নেবে? এরা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা আমাদের কাছ থেকে আমদানি করবে? এরা কি জাতীয় বিভাজনের কোনো বাংলাদেশী মডেল অনুসরণ করবে? এরা প্রশাসনকে আমাদের মতো দলীয়করণ করবে? এরা কি দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করবে? এরা কি আমাদের মতো দুর্নীতির মাধ্যমে পুকুরচুরির ব্যবস্থা চালু করবে? বাংলাদেশকে রোল মডেল করে তোলার দাবিদারেরা এসব প্রশ্নের ও এমনই আরো হাজারো প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন? 

Ads