শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০১৪

তৃতীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচনে সরকারের সন্ত্রাস ও অবৈধ দখল


ক্ষমতাসীনরা আরো একবার বুঝিয়ে দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ দূরে থাকুক, সন্ত্রাস ও সংঘাতমুক্ত নির্বাচনও সম্ভব নয়। উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্যায় থেকেই কথাটার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত তৃতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা সন্ত্রাস ও সংঘাতের সকল সীমা অতিক্রম করেছেন। গণতন্ত্রসম্মত আচরণ বা কর্মকা-ের ধারে-কাছেই থাকেননি তারা। সেদিন দেশের ৮১টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এমন কোনো উপজেলার নাম বলা যাবে না, যেখানে শুরু থেকেই ব্যাপক অনিয়ম, কেন্দ্রের পর কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই এবং বিএনপি-জামায়াতসহ ১৯ দলীয় জোটের প্রার্থী ও নির্বাচনী এজেন্টদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়ার মতো ভয়ঙ্কর কর্মকা- না ঘটেছে। প্রতিটি কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের লোকজন হাজার হাজার জালভোটও দিয়েছে প্রকাশ্যে। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে জালভোট দেয়ার শুধু নয়, শত শত ব্যালট বইও দেখানো হয়েছেÑ যেগুলোর কোনো একটির মুড়িতেই নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সিল-স্বাক্ষর ছিল না। এসব মুড়িতে ভোটারের স্বাক্ষর বা টিপসইও দেখা যায়নি। আওয়ামী সন্ত্রাসের মুখে অসহায় হয়ে পড়া নির্বাচনী কর্মকর্তারা খোলামেলা ভাষাতেই সবকিছু স্বীকার করেছেন। সাংবাদিকদের বলেছেন, আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন। টিভি ক্যামেরার সামনেও ধরা পড়ে গেছে অনেক আওয়ামী সন্ত্রাসী ও ভোট ডাকাত। কারো হাতে, কারো আবার পকেটে দেখা গেছে ব্যালট বই। ভয় পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, তাদের কাউকে এমনকি সামান্য লজ্জিত হতেও দেখা যায়নি। দিব্যি বুক ফুলিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছে তারা। একজন মন্ত্রীর এপিএস তো পিস্তল হাতে হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, সাংবাদিক মেরে ফেললে কি হয়? এই এপিএসের হুঙ্কার যে নিতান্ত কথার কথা ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া গেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। প্রাণে মারা না গেলেও অসংখ্য সাংবাদিক আহত হয়েছেন। ওদিকে বিএনপি ও জামায়াতের কত শত নেতা-কর্মী ও সমর্থক যে আহত ও পঙ্গু হয়েছেন সে সংখ্যা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনী সহিংসতায় অন্তত তিনজনের মৃত্যুও ঘটেছে। এদের মধ্যে বাগেরহাটে মারা গেছেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতা মানজারুল ইসলাম। তাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করেছে আওয়ামী ঘাতক-সন্ত্রাসীরা। শরীয়তপুরে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ঠেকাতে গিয়ে গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বিএনপির একজন পোলিং এজেন্ট। নেত্রকোনায় পোস্টার ছেঁড়া নিয়ে সংঘটিত সংঘর্ষেও বিএনপির একজনের মৃত্যু ঘটেছে। জালভোট দেয়া ও কেন্দ্র দখল করাসহ সন্ত্রাসী কর্মকা-েও রেকর্ড করেছে আওয়ামী লীগের লোকজন। বহু কেন্দ্রে মিনিটে ছয় থেকে দশটি পর্যন্ত ভোট দিয়েছে তারা। ফেনীতে ৬২টি কেন্দ্র দখল করে নিয়েছে তারা। ওই উপজেলায় এত দ্রুত জালভোট দেয়া হয়েছে যে, সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই ব্যালটের সব বই শেষ হয়ে গেছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ১০৩টি কেন্দ্রের মধ্যে ৭৩টি কেন্দ্র থেকেই ১৯ দলীয় প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ঘাড়ে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়া হয়েছে।
এভাবে সবমিলিয়েই ১৫ মার্চের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের অবৈধ দখল ও রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। ফলাফলও তারা নিজেদের ইচ্ছামতোই বানিয়ে ছেড়েছেন। ৮১টি উপজেলার বেশিরভাগ আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা চেয়ারম্যান পদে ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন! বিএনপিকে দ্বিতীয়স্থানে এবং জামায়াতে ইসলামীকে তৃতীয়স্থানে ঠেলে পাঠনো হয়েছে। এর প্রতিবাদে অন্তত আটটি উপজেলায় নির্বাচন বর্জন করেছে ১৯ দলীয় জোট। বেশকিছু উপজেলায় হরতালও ডেকেছে তারা। জবাবে ক্ষমতাসীনরা বরং বিরোধী দলের বিরুদ্ধেই উল্টো মিথ্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এক সুপার উপদেষ্টা বলেছেন, বিরোধী দল নাকি মিথ্যা বুননের মেশিন খুলে বসেছে! অন্য দু-চারজন মন্ত্রী ও নেতাও বিরোধী দল সম্পর্কে ব্যঙ্গ-তামাশা করে বোঝাতে চেয়েছেন, জনগণ সত্যি অবাধে ভোট দিতে পেরেছে, বিরোধী দল বাধাহীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেয়েছে এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা সত্যি সত্যিই নির্বাচিত হয়েছেন! অন্যদিকে প্রকৃত অবস্থা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল সে কথার প্রমাণ দেয়ার জন্য ভোটার জনগণ তো বটেই, গণমাধ্যমের হাজার হাজার কর্মী ও সাংবাদিক এবং বেসরকারি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার ফুটেজই যথেষ্ট। আপত্তি ও প্রতিবাদের কারণ হলো, নির্বাচনের দিনই কেবল সন্ত্রাস চালানো হয়নি। প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছিল নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই। উপজেলাগুলোর কোনো একটিতেও বিরোধী দলের প্রার্থীরা প্রকাশ্যে প্রচারণা ও তৎপরতা চালাতে পারেননি। তাদের প্রায় সকলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করানো হয়েছিল। বেশকিছু প্রার্থীকে গ্রেফতারও করেছিল পুলিশ। অন্যরা পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এতেও রেহাই মেলেনি তাদের। যৌথবাহিনী তাদের বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে সন্ত্রস্ত রেখেছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী-ক্যাডাররাও হামলা চালিয়েছে। ফলে প্রার্থীরা তো বটেই, তাদের সমর্থক নেতা-কর্মীরাও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি। তার ওপর আবার নির্বাচনের দিন কায়েম করা হয়েছিল ভয়াবহ ত্রাসের রাজত্ব।
আপত্তি ও প্রতিবাদের দ্বিতীয় কারণ প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের অবস্থান ও কার্যক্রম। প্রশাসন একশতে একশভাগই ক্ষমতাসীন দলের হয়ে কাজ করেছে। পাশাপাশি যৌথবাহিনী তো ছিলই। ওদিকে নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বাধাহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মোটেও সততার প্রমাণ দেয়নি। জনগণকে স্তম্ভিত করে নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে ‘অবকাশ’ যাপনের জন্য বিদেশে পাড়ি জামিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তিনি থাকলেই যে আহামরি ধরনের কিছু ঘটতো না তার প্রমাণ অবশ্য সংসদ নির্বাচনের সময়ই পাওয়া গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ঠিক এ সময়ে তার বিদেশে চলে যাওয়া ছিল ক্ষমতাসীনদের জন্য সরাসরি একটি ব্ল্যাংক চেকের মতো ব্যাপার। এ অবস্থার সুযোগে কমিশনের অন্য কর্তারাও সরকারের পক্ষে আদাজল খেয়ে কাজ করেছেন। এর প্রমাণ, নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছেও লিখিত অভিযোগ পেশ করে দেখিয়েছেন বিরোধী দলের প্রার্থীরা। কিন্তু কোনো একটি অভিযোগেরই মীমাংসা করেনি কমিশন। দায়িত্ব যেখানে ছিল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে সরকারকে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা এবং প্রভাব বিস্তার থেকে নিবৃত্ত রাখা, কমিশন সেখানে উল্টো ক্ষমতাসীন দলের জন্য ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীনদের অস্ত্রের প্রকাশ্য মহড়া এবং কেন্দ্র দখল ও জালভোট দেয়ার মতো কর্মকা-ের পরিপ্রেক্ষিতেও সামান্য নড়াচড়া করেনি কমিশন। এসব কারণেই জনগণকে বিশ্বাস করতে হয়েছে, এই কমিশনের অধীনে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। গত ১৯ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম ও দ্বিতীয় দফার নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গেছে। ফলে ধরে নেয়া হচ্ছে যে, আগামী দুটি পর্বের নির্বাচনেও একই ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। জোর করে হারিয়ে দেয়া হবে বিরোধী দলের প্রার্থীদের।
গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, সংবিধানের নির্দেশনার ভিত্তিতেও আমরা মনে করি, নির্বাচনের নামে এ ধরনের ভয়াবহ সন্ত্রাস-সহিংসতা এবং প্রহসন চলতে পারে না। এভাবে চলতে থাকলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই শুধু অকার্যকর হয়ে পড়বে না, গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক শাসন টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। এজন্যই সব নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, বিরোধী দলের প্রার্থীরা যাতে বাধাহীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন এবং ক্ষমতাসীন দলের লোকজন যাতে সন্ত্রাস-সহিংসতা চালাতে ও বিজয় ছিনিয়ে নিতে না পারে এসব বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ উদ্দেশ্যে প্রশাসন ও সব বাহিনীকে অবশ্যই সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে। বড় কথা, নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে সাংবিধানিক কর্তব্য পালন করতে হবে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads