বুধবার, ৫ মার্চ, ২০১৪

হেলাফেলা করে দেখার মতো বিষয় নয় এটি


হত্যাকা- সবসময়ই এক ভয়ানক ব্যাপার। এই পৃথিবীতে কেউ চিরকাল বেঁচে থাকতে পারে না। তবে মৃত্যু মানুষের জন্য এক শোকের ব্যাপার। স্বাভাবিক মৃত্যুকে মানুষ মেনে নেয়। কিন্তু হত্যাকা-ের বিষয়টিকে মানুষ মেনে নিতে পারে না। এ কারণে কোথাও হত্যাকা- ঘটলে সমাজ নড়েচড়ে ওঠে। হত্যাকা-ের পেছনে নানা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। শত্রুতা, আধিপত্য, জিঘাংসা, লোভ-লালসা, অহঙ্কার, সন্ত্রাস, অবদমন ইত্যাদি কারণে আমরা সমাজে হত্যাকা-ের ঘটনা লক্ষ্য করে থাকি। হত্যাকা-ের পেছনে আইনকে হাতে তুলে নেয়ার বিষয়টি বর্তমান সময়ে বেশ গুরুতর হয়ে উঠেছে। সমাজে হত্যাকা- ঘটুক নাগরিকদের কেউ তা চায় না। এমন না চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মানসে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে এবং রাষ্ট্র গঠন করেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন মৌলিক দায়িত্ব রয়েছে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তার একটি। অপরাধের শাস্তি দেবেন আইন-আদালত। কেউ আইনকে হাতে তুলে নিয়ে কাউকে শাস্তি দিতে পারে না হত্যাও করতে পারে না। এমনকি রাষ্ট্রেরও এই ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রও কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে নিয়ম-কানুন মেনে আইনের আওতায় তা করতে হয়। আমরা জানি, সরকারের ক্ষমতা অনেক। সুশাসনের লক্ষ্যে সরকার পুলিশ ও প্রশাসনের সাহায্য নিতে পারে, কাউকে শাস্তিও প্রদান করতে পারে। তবে সরকারকে সব কিছু করতে হয় সংবিধানের আলোকে ও আইন-কানুনের মাধ্যমে। সরকার কিংবা প্রশাসন চাইলেই কাউকে কিংবা কোনো অপরাধীকে বিচার ব্যবস্থার বাইরে হত্যা করতে পারে না। এ কারণেই বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বারবার বলেছেন, আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের নিন্দা করি। আমাদের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- প্রশ্রয় পাবে না। কিন্তু বাস্তবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিপরীত চিত্র। বর্তমান সময়ে বন্দুকযুদ্ধের নামে, ক্রসফায়ারের নামে চলছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-। ৪ মার্চ মানবজমিনের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় : রাজধানীর কদমতলী এলাকায় দিন-দুপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান দুই ব্যক্তি। র‌্যাব দাবি করেছে, নিহতরা অপহরণকারী এবং বন্দুকযুদ্ধে তাদের মৃত্যু হয়। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, র‌্যাব তাদের গুলী করে হত্যা করেছে। গত সোমবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে কদমতলী আলমবাগ মদিনা মসজিদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত মোহাম্মদ ওয়াসিম ও সংগ্রাম চৌধুরী পোস্তগোলা সেতুতে টোল আদায় করত। ওয়াসিম ওই সেতু টোল আদায়ের ঠিকাদার এবং সংগ্রাম চৌধুরী তার সহকারী বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। র‌্যাব-১০’র অধিনায়ক জানান, গোপন সংবাদে সোমবার দুপুরে অপহৃত কয়েকজন ব্যক্তিকে উদ্ধারে কদমতলীর একটি বাসায় অভিযান চালানো হয়। অপহরণকারীরা এক পর্যায়ে র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। আত্মরক্ষায় র‌্যাবও পাল্টা গুলী চালায়। গোলাগুলীতে অপহরণকারীদের দুজন ও র‌্যাবের তিনজন সদস্য আহত হন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে অপহরণ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে পারেনি র‌্যাব।
এদিকে গত সোমবার মদিনা মসজিদ এলাকায় নিহত ওয়াসিমের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সাত তলার ওই বাসার আসবাবপত্র এলোমেলো। মালামাল ভাংচুর করা। বাসার নিচে সিঁড়ির কাছে জমাটবাঁধা রক্ত। নিহতের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার জানান, দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ওয়াসিম বাসার ৭ম তলার চিলে কোঠার অফিসে অবস্থান করছিলেন। তখন সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা বাসা ঘিরে ফেলে। তারা বাসায় প্রবেশের চেষ্টা করলে ষষ্ঠ তলার একটি বাথরুমে আশ্রয় নেন ওয়াসিম। এক পর্যায়ে বাসায় প্রবেশ করে র‌্যাব সদস্যরা তল্লাশি চালান এবং আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। তল্লাশির এক পর্যায়ে বাথরুম থেকে ওয়াসিমকে বের করে আনেন র‌্যাব সদস্যরা। এরপর সিঁড়ির কাছে নিয়ে তারা পরপর তিনটি গুলী করেন। গুলী করার আগে আমি একজন র‌্যাব সদস্যের পা জড়িয়ে ধরে বলেছি, আমাদের যা আছে নিয়ে যান, তবুও আমার স্বামীকে মারবেন না। আমি তার প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা সোনিয়া বলেন, আমি বলেছি, আমার স্বামী অপরাধী হলে আইনের হাতে তুলে দিন, যা শাস্তি হয় মেনে নেব। আমার অনাগত সন্তানের দিকে চেয়ে আপনারা তাকে মারবেন না। কিন্তু আমার কান্না তারা শোনেননি। এ সময় আমাকে লাথি ও চড় মারেন র‌্যাব সদস্যরা। চোখের সামনে তাকে গুলী করে রক্তাক্ত অবস্থায় তুলে নিয়ে যান। সোনিয়া দাবি করেন, নিহত ওয়াসিমের নামে কোনো মামলা নেই। কোনো অপরাধের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন না। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সংগ্রাম চৌধুরী ওই বাসায় র‌্যাব’র অভিযান চালানোর সময় সপ্তমতলা থেকে একটি পাইপ বেয়ে নিচে নামার সময় র‌্যাব সদস্যরা তাকে ধরে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পর পার্শ্ববর্তী একটি স্থানে নিয়ে তাকেও গুলী করা হয়। পরে দু’জনকে রক্তাক্ত অবস্থায় মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
আমরা জানি, র‌্যাব ও পুলিশ আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন তাদের প্রধান কাজ। এ কাজে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদানও রেখে থাকেন। কিন্তু এখানে বলার বিষয় হলো, তারাও আইন-শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে নন। রাষ্ট্রের আইন-কানুন ও বিধি-বিধান মেনেই তাদের কাজ করার কথা। কোনো অপরাধীকে শাস্তি দিতে হলে আইনের আওতায় এনেই তাদের তা করার কথা। বন্দুকযুদ্ধ কিংবা ক্রশফায়ারের নামে তারা কাউকে হত্যা করতে পারে না। কারণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সবার জন্যই অপরাধ, র‌্যাব পুলিশেরও জন্যও। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্তেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত এক ব্যক্তির নাম রজব আলী। অভিযান পরিচালনা করে যশোরের কেশবপুর থানা পুলিশ। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ঘটা এ ঘটনাকে হত্যাকা- বলেছে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। প্রথমবারের মতো কমিশন এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের তদন্ত করে। পুলিশের বর্ণিত ঘটনার নানা অসঙ্গতি চিহ্নিত করে কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে, এই কথিত বন্দুকযুদ্ধের কোনো সত্যতা নেই। কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, এটি একটি হত্যাকা-। যারা আসামীকে গ্রেফতার করেছিল তাদেরকেই এর দায় নিতে হবে। তিনি এদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোরও দাবি করেন।
মানুষ তো সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র গঠন করেছে সুন্দর জীবনের জন্য, জানমাল-ইজ্জতের নিরাপত্তার জন্য। এজন্য মানুষ শুধু সরকারকে ট্যাক্সই দেয় না, সরকারের আইন-কানুন মেনে সরকারকে সমর্থনও করে। মানুষ এটাও চায় যে, রাষ্ট্রের পুলিশ ও প্রশাসন আইন-কানুন মানার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করে নাগরিকদের অনুপ্রাণিত করবে। কিন্তু গণআকাক্সক্ষার বিপরীতে গিয়ে র‌্যাব-পুলিশ যদি নিজেই আইনকে হাতে তুলে নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ কিংবা ক্রশফায়ারের নামে নাগরিকদের হত্যা করে, তখন নাগরিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
বিশ্লেষকদের মতে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের জন্য শুধু সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা র‌্যাব সদস্যদের দায়ী করলেই চলে না। এর মূল দায় বর্তায় সরকারের উপর। কারণ সরকার চাইলে একদিনের মধ্যেই দেশে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের যেসব অভিযোগ ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে, তারমধ্যে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, তেমনি রয়েছে ব্যবসায়ী, অপরাধী ও বিভিন্ন পেশার লোকজন। রাজনীতি ছাড়াও নানা স্বার্থ জড়িয়ে গেছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সাথে। বিষয়টি সমাজকে যেন অরাজকতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর পরিণতি সরকার ও রাষ্ট্রকে উপলব্ধি করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যই যে প- হয়ে যাবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের বিষয়টিকে হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই দেশের কোনো নাগরিকেরই। তাই এ ব্যাপারে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবার সোচ্চার হওয়া এখন সময়ের দাবী।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads