মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০১৪

এ কেমন দাবি ঢাবি শিক্ষকের


আমার জীবনের বহুল অংশজুড়েই আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে ২৩ বছর ধরে ছাত্রের খাতায় আমার নাম ছিলো। শেষদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতেও আমি লজ্জিতবোধ করতাম। মনে হতো যেদিন আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম, সেদিন বা তারও পরে যে শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে সেও এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আর আমিও ‘আদু ভাই’য়ের মতো সেখানে ছাত্রই রয়ে গেছি। এই দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র থাকার পেছনে আমার নিজের কোনো কারণ ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় আমি ছাত্র থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি এসবের প্রতি পদে পদেই সেশন জটের কবলে পড়ে আমি অতো দীর্ঘসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকতে বাধ্য হয়েছি।
এই দীর্ঘ সময় ধরে কালের অনেক কিছু সাক্ষী আমি হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হানাহানি, ছাত্রী নিয়ে টানাটানি, বন্দুকবাজী, অস্ত্রবাজী, মুক্তিপণবাজীÑ এমন বহু ঘটনার ভেতর দিয়ে দিন অতিক্রম করেছি। সেই দীর্ঘসময় ধরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে ছিলাম না। কিন্তু লেখাপড়া ও গবেষণার কাছে প্রায় প্রতিদিনই অন্তত লাইব্রেরীতে গিয়েছি। শিক্ষকদের দলবাজী দেখেছি। তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রত্যক্ষ করেছি, শিকার হয়েছি। কিন্তু তারা খুব বেশি অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেননি আমার কাছে। কারণ আমি দেখতে পেয়েছি কখনও কখনও দলবাজ শিক্ষকরা আমাদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করলেও শেষ পর্যন্ত সন্তানবদ স্নেহ করেছেন। খুব যোগ্য ও দক্ষ লোককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার ক্ষেত্রে আদাজল খেয়ে প্রতিরোধে নামেননি। যোগ্য শিক্ষার্থীরা চাইলে পাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় ঢুকতে পেরেছেন অ-আওয়ামী লীগার হয়েও। তাদের অনেকেই এখনও সে পেশায় নিয়োজিত আছেন।
রাষ্ট্রক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ছিলো। বিএনপি ছিলো। ডাকসুতে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ছিলো। ’৭০ এর দশকে শক্তিশালী ছিলো জাসদ ছাত্রলীগ। এদের মধ্যে কখনও কখনও ত্রিমুখী লড়াই হতো। রীতিমতো বন্দুকযুদ্ধ। আমরা ফাঁক বুঝে কলা ভবন থেকে দৌড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে ঢুকে যেতাম। বাইরের যুদ্ধ আমাদের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা ছিলো। অনেক সময় লাইব্রেরীর জানালার ফাঁক দিয়ে সে যুদ্ধ  থ্রিলার, সিনেমার মতো দেখতাম। অনেক সময় যুদ্ধ শেষে কী ঘটলো সেটি অনুমান করার চেষ্টা করতাম। ক্লাসরুমে বা লাইব্রেরীতে নিজেকে কখনও অনিরাপদ মনে হয়নি। শিক্ষকদেরও দেখেছি এসব দুর্দিনে ব্যক্তিগত রাগ থাকলেও সকল ছাত্র-ছাত্রীকে সমান চোখে দেখেছেন। এই দুর্দান্ত সময়ের ভেতর দিয়ে ১৯৭৩ সাল থেকে ২৩ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি। যে কোনো শিক্ষকের কক্ষ নিরাপদ আশ্রয় ভেবেছি।
আমার শ্রদ্ধাভাজন একজন শিক্ষক অনার্সের তৃতীয় বর্ষে ভুল বোঝাবুঝি থেকে আমাকে এই বলে শাসিয়েছিলেন যে, তুমি কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাও আমি দেখে নেবো। তরুণ আমি তাকে বলেছিলাম যে, ‘স্যার, এর আগেও লেখাপড়ায় আমার লস আছে। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করে সা’দত কলেজে ভর্তি হলেও রাজনৈতিক কারণে সেখানে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারিনি। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি নীলক্ষেত থাকে তাহলে আমি কোনো না কোনোদিন অবশ্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে বেরিয়ে যাবো।’ তারপর সত্যি সত্যি এমএ পাসের পর ১৯৭৮ সালে তার কক্ষে হাজির হয়েছিলাম। বলেছিলাম, ‘স্যার, আমি পাস করেছি। এই আমার রেজাল্ট। তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, পুরো সময় তো দিতে পারোনি। চাকরি করেছো। তাহলে তুমি সবচেয়ে ভালো করতে। কিন্তু আমি কী করে তাকে বলি, আমি কেমন করে পাস করে যাই আপনি দেখবেন বলে যে শাসিয়েছিলেন তার জবাব দিতে এসেছি।
শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, ‘স্যার, ঐ যে, আপনি বলেছিলেন আমি কেমন করে পাস করে যাই দেখবেন। কিন্তু আমি পাস করেছি। তিনি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচাইতে স্নব শিক্ষকদের একজন ঐ শিক্ষক নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে একেবারে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, বোকা ছেলে। পিতা এবং শিক্ষক সন্তানকে যতোই গালি দিকনা কেন সে কথা তারা কখনও মনে পুষে রাখে না। আমিও রাখিনি। এমনকি এই যে তুমি মনে করিয়ে দিলে তারপরও বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এমন কথা আমি বলেছি।’ বাকরুদ্ধ আমিও ২৫ বছর বয়সেও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম।
আমার ছাত্রত্বের অবসান ঘটে ১৯৯৫ সালে। তারপর পদ্মা, মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা কর্ণধার হয়েছেন তাদের রুচি, মেধায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষকতার দলীয়করণ, রাজনীতিকরণ একেবারে নীচতায় পর্যবসিত হয়েছে। দলের লোকদের শিক্ষক বানানোর জন্য মেধার কপালে পদাঘাত করা হয়েছে। একসময় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে দলীয় লোক ছাড়া মেধাবীরা সরকারি চাকরিতে ঢুকতে না পারে। ফলে একটি ইংরেজি চিঠির খসড়া তৈরী করতে ইংরেজি জানা বাইরের লোকদের ভাড়া করে আনা হচ্ছে। শিক্ষা, প্রশাসন সবই রসাতলে যাচ্ছে। কিছুকাল আমি নিজেও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার খাতা দেখেছি। মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছি। আমাকে যে কেউ কারও চাকরির জন্য অনুরোধ করেনি এমন নয়। জবাবে আমি বলেছি, মেধার যোগ্যতায় যদি টেকে তাহলে কেউ তাকে বঞ্চিত করতে পারবে না। আমি যে বোর্ডে থেকেছি, বলতে পারি, সে বোর্ডে মেধাহীন কেউ চাকরি পায়নি। হোক ছাত্রলীগ, ছাত্রদল বা শিবির, মেধাবীরাই চাকরি পেয়েছে।
এর পেছনে কারণ ছিলো। আমি মনে করেছি, একদিন যারা শিক্ষক হবে, প্রশাসনে বড় কর্মকর্তা হবে, তারা যেন দক্ষতার সঙ্গে আমাদের দেশের সেবা করতে পারে, উন্নততর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে। আর আমার সন্তানও যখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে তখন সে যেন মেধাবী শিক্ষকের হাতে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারে। কারণ সাময়িক ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ভবিষ্যৎ বংশধররা এগিয়ে যেতে পারে। বিবেকের এই তাড়নায় যদি কাজ না করে, তাহলে মানুষ আর পশুর মধ্যে কোনো ভেদরেখা থাকে না।
এই প্রসঙ্গ অবতারণ করার একটা ভিন্ন কারণ আছে। সরকার তো যেখানে যেভাবে পারছে দলীয়করণ করেই যাচ্ছে। এর পরণতি ভবিষ্যতে জাতির জন্য কী বিপদ ডেকে আনবে সরকার তা ভেবে দেখার চেষ্টা করছে না। কিন্তু যে সাধারণ মানুষ অপার আকাক্সক্ষা নিয়ে তার ছেলে-মেয়েকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠায় তার চোখে অনেক স্বপ্ন থাকে। সন্তানের শিক্ষার জন্য সে জমিজমা বিক্রি করে। ধরে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারলে তার সন্তান একদিন মানুষের মতো মানুষ হবে। হ্যাঁ, সাধারণ মানুষ সরকারি চাকরির স্বপ্ন দেখে বেশি। তারা ধরে নেয় যে- যদি মেধায়, যোগ্যতায় তার সন্তান ভালো করতে পারে সে একদিন বড় অফিসার হবে, এলাকায় নাম হবে, মানুষ সুনাম করবে। পিতা-মাতা হিসেবে গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠবে। তাদের সে আকাক্সক্ষা একেবারেই যে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে এমন কথা বলবো না। কিন্তু ক্রমেই শাসকগোষ্ঠীর কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। দলীয়করণের ফলে প্রশাসন হয়ে পড়েছে মেধাহীন। এবং ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থাকে আরও পোক্ত ও জোরদার করার জন্য যাবতীয় ষড়যন্ত্র চলছে।
গত মঙ্গলবারের কাগজে একটি সংবাদ পড়ে সে কথায় বারবার মনে হচ্ছিলো। সে সংবাদে দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক প্যানেল নীলদলের আহ্বায়ক ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ আব্দুল আজিজ ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছাত্রলীগ ছাড়া কাউকে চাকরি না দিতে’ সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্রলীগের সব কর্মীকে চাকরি দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেছেন, ছাত্রলীগ নেতাদের রেজাল্টের প্রয়োজন নেই। তাদের গায়ে থাকা পুলিশের অত্যাচারের ক্ষত চিহ্নই তাদের বড় যোগ্যতা। তাদের আর কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, বিভিন্ন কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমন্ত্রিত অতিথির কাছে বিভিন্ন দাবির ফিরিস্তি তুলে ধরেন। আজ তারা কোনো দাবি জানাননি। তাদের পক্ষ থেকে আমিই দাবি জানাচ্ছি যে, ছাত্রলীগের সব নেতাকর্মীকে চাকরি দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক এ রকম নাদান উক্তি করতে পারে একথা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি। টুকটাক দলবাজি হয়ও। হচ্ছেও। কিন্তু ছাত্রলীগের সকলকেই চাকরি দিতে হবে। সেখানে যোগ্যতার প্রশ্ন থাকতে পারবে না এমন কথা বলতে পারলেন একজন শিক্ষক! তিনি যে কোন পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন সে প্রশ্ন এখন উঠতে বাধ্য। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগ দাঙ্গাবাজ, অস্ত্রবাজ, টেন্ডারবাজ, নারীবাজ হিসেবে যে খ্যাতি অর্জন করেছে তাতে চারদিকে শুধু ছি! ছি! রব। সাধারণ মানুষের কাছে ছাত্রলীগ মানেই আতঙ্ক। ছাত্রলীগ মানেই অস্ত্র, খুন, বোমাবাজি, চাঁদাবাজি। তাদের সকলকেই যোগ্যতা না থাকলেও সরকারি চাকরি দিতে হবে এমন দাবি যে শিক্ষক করতে পারেন তাকে শুধু ধিক্কারই দেয়া যায় না, এর চাইতে কম আর কিছু নয়।
ছাত্রলীগ বলে কেউ চাকরি পাবেনা তা আমরা বলছি না। কিন্তু দেশের ও পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে যোগ্য ও মেধাবী লোকরাই এগিয়ে আসতে পারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত সেটায়। দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন কারও কাম্য হতে পারে না।
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads