সোমবার, ১৭ মার্চ, ২০১৪

তৃতীয় পর্যায়ের উপজেলা নির্বাচন : শাসকদলের চেহারা উন্মোচন


তৃতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাত, গোলযোগ, বোমা হামলা, আগ্নেয়াস্ত্রের পাইকারি ব্যবহার, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, অগ্নিসংযোগ, জালভোট প্রদান, বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের ন্যায় ঘটনা-দুর্ঘটনা বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ৪২টি জেলার ৮১টি উপজেলায় গত শনিবার ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচনী সহিংসতায় তিনজন নিহত ও পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। পত্র-পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, শনিবারের সহিংসতা ছিল নজিরবিহীন। এই দিন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডাররা দুই শতাধিক ভোট কেন্দ্র দখল করে নেয় এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের কোথাও প্রভাবিত করে আবার কোথাও জিম্মি করে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোটের আগেরদিন রাত্রেই বাক্স ভর্তি করে ফেলে। তারা দেড় শতাধিক কেন্দ্রে নির্বাচনের দিন বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের প্রবেশ করতে দেয়নি এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সামনেই ব্যাপকভাবে জালভোট দিতে থাকে। ছাত্রলীগের এক নেতা একাই ৪০০ ভোট প্রদান করে। সব জাতীয় দৈনিকে শাসক দলের সশস্ত্র হামলা, জালভোট প্রদান, ব্যালট বাক্স ছিনতাই প্রভৃতির সচিত্র ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় ৪২ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ৮টি জেলার ১৩ উপজেলার অন্তত ২৬টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। শতাধিক ভোট কেন্দ্রে সাময়িক স্থগিত করে পরে আবার ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, ভোট গ্রহণের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সাথে জড়িত শাসক দলের যাদের কারণে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল পরে তাদের হাতেই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছে এবং তারা তাদের ইচ্ছামতো জালভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করেছে। ক্ষমতাসীনদের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি মহলের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি দৈনিক জানিয়েছে যে, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের ব্যাপক প্রভাব এবং ক্যাডার বাহিনীর সীমাহীন সন্ত্রাস সত্ত্বেও নির্বাচনী ফলাফলে তাদের নজিরবিহীন ভরাডুবি, বিরোধী দলের প্রতি সাধারণ ভোটারদের অকুণ্ঠ সমর্থন তাদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, তার নেতৃত্বে গঠিত জোটের সদস্য জেনারেল এরশাদের দলের প্রার্থীদেরও ভোটারদের প্রত্যাখ্যান এবং অন্যান্য শরীক দলের শোচনীয় পরাজয় তাদের উদ্বিগ্ন করে তোলে। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন এবং পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রহরা ও পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে তারা বিশ্বের দরবারে অব্যাহতভাবে নিন্দিত হয়ে আসছিলেন। উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল বিশ্ববাসীর কাছে তাদের দীনতাকে আরো প্রকট করে তুলছিল। এ অবস্থায় তারা ছলে-বলে-কৌশলে নির্বাচনী ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নেবার জন্য তৃতীয় পর্যায় থেকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দলগুলো তাদের আচরণ দেখে পূর্ব থেকে তা আঁচ করতে পেরে নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করেছিল, কিন্তু কমিশন তা আমলেই নেয়নি। ফলে পুনরায় আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গণতন্ত্রের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কের সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততার অভিযোগ তুলে ৪২ জন প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন। সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, ব্যালট পেপার ছিনতাই, জালভোট ও তিন ব্যক্তিকে হত্যার প্রতিবাদে রোববার ছয়টি উপজেলায় হরতাল পালিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, উপজেলা নির্বাচনে ধারাবাহিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে পত্র-পত্রিকাগুলো পূর্ব থেকেই নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ভূমিকা পালন করার জন্য পরামর্শ দিয়ে আসছিল। বিশেষ করে সংঘাত-সংঘর্ষে তৃতীয় ধাপে নির্বাচনের পূর্বেই এক ব্যক্তির প্রাণহানি এবং গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নির্বাচন স্থগিত করায় স্বাভাবিকভাবে বুঝা যাচ্ছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৫ দিনের জন্য সেনা বাহিনী মোতায়েনের খবর জনমনে কিছুটা আশ্বাসের জন্ম দিলেও শ্রীপুর উপজেলায় নির্বাচন কমিশনের চরম ব্যর্থতা এবং সরকারি দলের প্রতি নতজানু নীতি এই আশ্বাসকে আস্থায় রূপান্তরিত করতে পারেনি। জানা যায় যে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নির্বাচনের দিন আরো ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটবে বলে নির্বাচন কমিশনে তাদের আশঙ্কা সম্বলিত একাধিক রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। কিন্তু কমিশন এই রিপোর্টকে হয় গুরুত্ব দেয়নি অথবা একটা গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয়ার নীতিই গ্রহণ করেছিল। একজন নির্বাচন কমিশনের বেপরোয়া উক্তি এরই প্রমাণ বহন করে। ফেনীর দাগনভূঁইয়া সম্পর্কে নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক আগে থেকে ক্ষমতাসীন দলের রণ প্রস্তুতি নিয়ে অভিযোগ করা হচ্ছিল। কিন্তু বিষয়টি নির্বাচন কমিশন আমলে না নেয়ায় উপজেলার অলাতলি, রাজাপুর, দরাপপুর উত্তর আলীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীনদের সন্ত্রাস শুধু ভোট প্রক্রিয়াকেই বিঘিœত করেনি বরং মানবিক বিপর্যয়েরও সৃষ্টি করেছে।
আগেই বলেছি, নির্বাচনের পূর্ব রাত থেকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সংশ্লিষ্ট এলাকার অন্যান্য বাহিনীর সাথে ৫ দিনের জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছিল। নির্বাচনী কেন্দ্রসমূহ যখন আগুনে পুড়ছিল, সংঘাত সংঘর্ষে জর্জরিত হয়ে পড়ছিল এবং জাল ভোট, বাক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল এবং নানা নৈরাজ্য সন্ত্রাসে ভোটারদের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছিল, সরকার বিরোধী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হচ্ছিল তখন, তথা সংকট মুহূর্তে সেনাবাহিনীর কোনও তৎপরতা দেখা যায়নি। ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তারা এগিয়ে আসতে পারেননি। এর কারণ কি? তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে সেনা মোতায়েন ছিল নিছক প্রহসন, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে তাদের যে অথরিটি দেয়ার কথা ছিল নির্বাচন কমিশন তা তাদের দেননি? অবস্থা যাই হোক না কেন এক্ষেত্রে কমিশনের ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।
গত ১৪ মার্চ ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা নেত্রীদের নিয়ে একটি চমকপ্রদ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্বাচন কমিশনারের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন কোনও প্রকার সহযোগিতা পাচ্ছে না। কমিশন অবশ্য এই অসহযোগিতার ব্যাপারে নিজেই নির্লিপ্ততা প্রদর্শন করছে। কেননা নির্বাচনের ব্যাপারে কেউ অসহযোগিতা দেখালে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা তাদের রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কমিশনারের ভাষায়, “অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনী আমাদের নির্দেশনা মেনে চলে না, তারা স্থানীয় এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে তারা ক্ষমতাসীন দলকেই খুশি রাখতে ব্যস্ত, উল্লেখ্য যে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা রিটার্নিং অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে কাজ করেন। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পুলিশ সুপারদের উপর ন্যস্ত রয়েছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তা সরকারি নির্দেশ মানতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন কমিশনের নির্দেশকে উপেক্ষা করে চলেন।
ডেইলি স্টার পত্রিকা নির্বাচন কমিশনের একজন উপ-সচিবের বক্তব্যও তাদের রিপোর্টে উদ্ধৃত করেছে। তিনি বলেছেন যে, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘন করছেন এবং নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছেন। ডেইলি স্টারের এই রিপোর্টটিতে দেশের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে বলে আমি মনে করি, অনেকে আশা করেছিলেন যে ৫ জানুয়ারিতে ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রহসন করে আওয়ামী লীগ সারা দুনিয়ায় যে দুর্নাম কুড়িয়েছে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হত্যা করে যে কলঙ্কের সৃষ্টি করেছে উপজেলা নির্বাচনে অন্তত নিরপেক্ষ ও সুন্দর আচরণ করে সে দুর্নাম ঘুচাবে। কিন্তু হা হতষ্মি মন্দভাগ্য! দুরাচার কখনো চরিত্র বা আচরণ বদলাতে পারে না, আওয়ামী লীগ তাই প্রমাণ করলো। তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করলো যে, গণতান্ত্রিক চর্চা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কোনটিই আওয়ামী লীগের দ্বারা সম্ভবপর নয়, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারই তাদের বৈশিষ্ট্য। ভোটাধিকার রক্ষার নামে ভোটাধিকার হরণই তাদের লক্ষ্য। তারা দেশকে উত্তরাধিকারের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে স্বাধীনভাবে শোষণ নির্যাতনে বিশ্বাসী, জনগণের স্বাধীনতায় নয়। এমতাবস্থায় মানুষের অধিকার আদায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং শোষণ নির্যাতন বন্ধ এবং স্বাধীনতাকে সমুন্নত রাখার জন্য গণ আন্দোলনের বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads