শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি


বিভিন্ন মহলের অনুরোধ ও প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ালো সরকার। জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও অব্যাহত মূল্যস্ফীতির চলমান বাস্তবতায় বিদ্যুতের নতুন বর্ধিত মূল্য সাধারণ মানুষের কাছে বোঝার উপর শাকের আঁটির মত দুর্ভার হয়ে দেখা দেবে। এর ফলে সকল ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয়বৃদ্ধির সাথে সাথে জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়বে। অথচ দেশে শিল্পবিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং সাধারণ মানুষের আয়বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নের কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎখাতে অস্বাভাবিক ভর্তুকি কমিয়ে আনতে এ খাতে মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যে যুক্তি দেখানো হচ্ছে তা’ অগ্রাহ্য করা না গেলেও চলমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলোর উন্নয়নে কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি বোঝা চাপিয়ে দেয়া সমর্থকযোগ্য হতে পারে না। সঙ্গতকারণেই বিদ্যুতের এ মূল্যবৃদ্ধিতে সারাদেশে জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সরকারী দল ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি গতকাল সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে এবং আরো কঠোর কর্মসূচির ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। গত মাসে যখন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির নতুন প্রস্তাব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখনই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজ এই মূল্যবৃদ্ধি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।  
বিদ্যুতখাতে ব্যাপক উন্নয়ন সরকারের একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে বিবেচিত হলেও গত ৫ বছরে বিদ্যুৎখাতে লক্ষণীয় কোন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। দ্রুতগতিতে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবেলা করতে গিয়ে রেন্টাল, কুইকরেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করার পর গত ৫ বছরে অন্তত ৭ দফা বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এরপরও বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে বছরে ১৮-২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। পিডিবি’র সরকারী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যেখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ প্রায় ৩ টাকা এবং গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রি হয় ৪ টাকা, সেখানে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ক্ষেত্রবিশেষে ইউনিট প্রতি ১৮ টাকা পর্যন্ত বিদ্যুৎ কিনছে পিডিবি। রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো জ্বালানি হিসেবে আমদানীকৃত তেল ও ফার্নেসঅয়েল ব্যবহার করছে। বিপুল পরিমাণ জ্বালানি আমদানীর ভর্তুকির বোঝা সরাসরি জনগণের উপরই পড়ছে। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান ও স্থায়ী চাহিদা মোকাবেলায় কোন তাৎক্ষণিক বা এড-হক ভিত্তিক সমাধান নেই। এ কারণেই রেন্টাল ও কুইকরেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের শুরুতেই তা’ ব্যাপক সমালোচনা ও নাগরিক সমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে জনগণ যথাশীঘ্র বিদ্যুৎ সঙ্কটের সমাধানের প্রত্যাশা করলেও কার্যত কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। সেবার মান না বাড়িয়ে ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির এ চাপ অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রত্যাশিত।     
দেশি-বিদেশী শিল্প বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্য অর্জনে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। একই সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সব সময়ই স্পর্শকাতর ইস্যু। বিদ্যুৎ খাতের টেকসই উন্নয়নের রূপরেখা বাস্তবায়নের বদলে বছরের পর বছর ধরে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ঘানি টানার ধারাবাহিক বাস্তবতা আমাদের সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা-কেই ব্যাহত করছে। রেন্টাল-কুইকরেন্টালের জ্বালানি ভর্তুকির যোগান দিতে বছরে একাধিকবার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও বিদ্যুতের ঘাটতি বা লোডশেডিং কমানো সম্ভব হয়নি। এবারের মূল্যবৃদ্ধির আগে সরকারের পক্ষ থেকে একটি গণশুনানির আয়োজন করা হয়েছিল এবং এ শুনানিতে আগত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিপক্ষে তাদের যুক্তি তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত তা’ গ্রাহ্য হয়নি। অংশগ্রহণকারী কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধি ‘গণশুনানি’ কে একটি নাটক বলে অভিহিত করেছেন। তবে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের নিরীখে এনার্জি রেগুলেটরী কমিশন (বিইআরসি)’র মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ শতকরা ৭ ভাগে সীমাবদ্ধ রাখার ঘোষণাকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের চাপের ফল হিসেবেই গণ্য করা যায়। জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া বর্ধিত মূল্যের এই নতুন বোঝা হয়তো অগ্রাহ্য করা যাবে না, তবে তারা বিদ্যুতের লোডশেডিং, অপচয় ও দুর্নীতি কমানোর বাস্তব পদক্ষেপ দেখতে চায়। সেই সাথে যথাশীঘ্র রেন্টাল-কুইকরেন্টালের স্বেতহস্তি পোষা বন্ধ করে গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads