রবিবার, ৬ মে, ২০১২

আসল রূপে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ By ফিরোজ মাহবুব কামাল


শেখ মুজিবের আসল রূপ প্রকাশ পায় ১৯৭১-এর পর। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের ধুম্রজালে তিনি তার আসল চরিত্র বহুলাংশে লুকিয়ে রাখতে পারলেও সেটি বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের ন্যায় প্রকাশ পায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার পর। ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন। সে নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ মুজির ২৮শে অক্টোবর জাতির উদ্দেশ্যে রেডিও ও টিভি ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি বহু অসত্য কথা বলেন। তার একটি নমুনা, “তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) সমগ্র দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সেই হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই আমাদের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ভাবেই আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপোষহীন সংগ্রাম শুরু করি।”-(২৯ অক্টোবর ১৯৭০, দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা)। এ তথ্যটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। সত্য হল, পাকিস্তান মুসলিম লীগ কখনই দেশকে একদলীয় রাষ্ট্র করার চেষ্টা করেনি। তার প্রমাণ, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকে এই নতুন দলটির প্রতিষ্ঠায় কোন রূপ বাধাই সৃষ্টি করা হয়নি।

পাকিস্তান কোন কালেই একদলীয় রাষ্ট্র ছিল না। সে দেশের কোন গণতান্ত্রিক সরকার দূরে থাক, এমন কি কোন সামরিক সরকারও এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি। শুধু আওয়ামী লীগ কেন, আরো বহু দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই পাকিস্তানে কাজ করছিল। এমন কি যে কংগ্রেস পাকিস্তান সৃষ্টির প্রচন্ড বিরোধীতা করেছিল সে দলটিরও স্বাধীন ভাবে কাজ করার পূর্ণ অনুমতি ছিল। সংসদে এ দলটির সদস্যও ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশটির যে গণ-পরিষদ তথা পার্লামেন্ট গঠন করা হয় তার সদস্যরা নির্বাচিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে। সে গণপরিষদ থেকে কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের সদস্যপদও হরণ করা হয়নি। বহু দলীয় রাজনীতি চলেছে আইউব ও ইয়াহিয়া খানের আমলেও। খোদ আওয়ামী লীগও সে বহু দলীয় রাজনীতি থেকে পুরা ফায়দা নিয়েছে। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগের শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটি ছিল অতি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। মুসলিম লীগে সে নির্বাচনে প্রচন্ড ভাবে হেরে গিয়ে প্রমান করেছিল, তারা নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার কোন চেষ্টা করেনি। সে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে কোন কালেই দেয়নি। একদলীয় রাজনীতির শুরু পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর এবং সেটি বাংলাদেশে। সেটিও স্বয়ং শেখ মুজিবের হাতে। এবং সেটি বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ফলে প্রমাণ মেলে, শেখ মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনের শুরুটিই করেছিলেন ঢাহা মিথ্যা কথা রটনার মধ্য দিয়ে।


বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর শেখ মুজিব আবির্ভূত হন একজন স্বৈরাচারি ফ্যাসীবাদী নেতা রূপে। শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়,শুধু সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নেতা যিনি একদলীয় শাসনের ঘোষণা দেন। এমন স্বৈরাচারি পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা পাকিস্তানে যেমন কোন কালে হয়নি; ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালেও হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়া, পূর্ব ই্উরোপী দেশগুলি ও চীনের ন্যায় বাংলাদেশেও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। শেখ মুজিরেব হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে দেওয়ার স্বার্থেই ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুযারিতে শাসনতন্ত্রে আনা হয় সংশোধনী। মাত্র ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪জন পার্লামেন্ট সদস্যের ভোটে “পার্লামেন্টারী কেবিনেট ফরম” রূপান্তরিত হয় প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে । শেখ মুজিব হন ৫ বৎসরের জন্য-অর্থাৎ ১৯৮০ সাল অবধি-নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারি প্রেসিডেন্ট এবং সে সাথে একদলীয় রাজনীতির সর্বেসর্বা। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য শেখ মুজিব জনতার আদালতে তথা ভোটে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। প্রতিষ্ঠা করেন, দেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল। তালা ঝুলিয়ে দেন অন্যান্য দলের দফতরগুলিতে। ফরমান জারি করেন, ১৯৭৫ সালের ২৫শে মে’র মধ্যে সকল সংসদ সদস্যকে বাকশালে যোগ দান করতে হবে নইলে বাতিল ঘোষিত হবে তাদের সংসদ সদস্যপদ। তার দলীয় সদ্স্যরা তাকে আজীবন প্রেসিডেন্ট করার পাকা বন্দোবস্তও করছিল। ১৯৭৫এর ১৫ আগষ্ট মারা না গিলে সে রেকর্ডও যে তিনি প্রতিষ্ঠা করতেন তা নিয়েও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার দলীয় নেতা ও কর্মীরা মাঠে ময়দানে এক নেতা-একদেশেরর ধারণা জোরেশোরে প্রচার করছিল। যে দলের কর্মীরা শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে প্রবল বিশ্বাস রাখে তারা সে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালীকে আজীবনের জন্য যে প্রেসিডেন্ট করতে চাইবে তাতেই বা বিস্ময়ের কি আছে?


দেশে কি গণতন্ত্র চর্চা বাড়াবে, গণতন্ত্র মৃত্যুবরণ করেছিল দলটির নিজের মধ্যেই। আওয়ামী লীগের কোন নেতাই সেদিন শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈরাচারি রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। নেতা ও কর্মীগণ পরিণত হয়েছিল বিবেকহীন চাটুকারে। গণতন্ত্রের নামে একটি দল কি ভাবে একদলীয় ফ্যাসীবাদের দিকে ধাবিত হতে পারে তারই নমুনা পেশ করে আওয়ামী লীগ। মুজিব পরিণত হয় বাংলাদেশের হিটলারে। সেদিন একমাত্র জেনারেল ওসমানী ও ব্যারিষ্টার মঈনুল হোসেন -এ দুই ব্যক্তি তার একদলীয় বাকশালী নীতির বিরোধীতা করে পদত্যাগ করেছিলেন। লক্ষণীয় হল, এ দু’জনের কেউই আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ছিলেন না। অথচ যারা ছিল আওয়ামী লীগের নিজ ঘরানার পুরনো নেতা ও কর্মী, গণতন্ত্র নিয়ে যাদের ছিল প্রচন্ড গলাবাজি -তারা সেদিন কোন রূপ নৈতিক মেরুদন্ডের প্রমাণ রাখতে পারেননি। সংসদের ২৯৪জন সদস্যের মাঝে দুইজন বাদে আর কোন ব্যক্তিই সেদিন প্রতিবাদ করেনি। মনের ক্ষোভে দল থেকে পদত্যাগও করিনি। অথচ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সামান্যতম অঙ্গিকার থাকলে কোন ব্যক্তি কি এমন একদলীয় শাসনকে সমর্থণ করতে পারে? কারণ এটি তো ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবরে পাঠানোর মত অপরাধ। অথচ সেদিন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতা-কর্মীগণ স্বৈর-শাসনের শুধু সমর্থণই করেনি, সেটির পক্ষে প্রচন্ড ওকালতিও করেছে। সেটি নিয়ে সামান্যতম অনুশোচনা দূরে থাক, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের আজও তা নিয়ে প্রচন্ড অহংকার। গণতান্ত্রিক চেতনা-বিবর্জিত মেরুদন্ডহীন কর্মী ও নেতা উৎপাদনে এ দলটি যে কতটা সফল কারখানায় পরিণত হয়েছিল, সেটির প্রমানিত সেদিন হয়েছিল। এমন মেরুদন্ডহীন নেতা-কর্মীরাই সেদিন দলে দলে এবং উৎসব-ভরে আত্মসমর্পণ করেছিল শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈর-শাসনের কাছে। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতায় থাকায় ছাড়া এ দলটির আর যে কোন মহত্তর লক্ষ নেই এবং স্বপ্নও নেই সেটি তারা সেদিন প্রমাণ করেছিল। গণতন্ত্রের বুলি পরিণত হয়েছিল ক্ষমতায় উঠার সিঁড়ি রূপে। নিজেরা ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথে সে সিঁড়িটাই দূঁরে ছুড়ে ফেলেছে। স্মরণযোগ্য, পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাসে কোনদিন এমন ফ্যাসীবাদের প্রবর্তন ঘটেনি। এমনকি জেনারেল আইউব ও জেনারেল ইয়াহিয়ার ন্যায় জেনারেলগণও গণতন্ত্রের এতবড় শত্রুতে পরিণত হয়নি। তাদের আমলেও বহুদলীয় রাজনীতি ছিল, বহু বিরোধী দলীয় পত্রিকাও ছিল। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ৪ বছরের মধ্যেই বহুদলীয় রাজনীতির কবর রচিত হল এবং সেটি আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবের হাতে। দেশ পরিনত হয়েছিল পুলিশী রাষ্ট্রে। সেদিন নিষিদ্ধ হয়েছিল সকল বিরোধী পত্রিকা। প্রকাশনের অধিকার পেয়েছিল একমাত্র সে সব পত্রিকাই যে গুলি মুজিব-বন্দনাকে নিজেদের ব্রত রূপে গ্রহণ করেছিল। পাকিস্তানী শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ ও তার নেতা শেখ মুজিবকে যে গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছিল সেটি শেখ মুজিব ও তার দল অতি নিষ্ঠুর ভাবে কেড়ে নিল বাংলাদেশীদের থেকে । একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বস্তুতঃ তিনি গণতন্ত্রকে সেদিন কবরস্থানে পাঠিয়েছিলেন। দেখা যাক, মুজিব সম্বন্ধে এ নিয়ে তার অতি কাছের লোকেরা কি বলেন।


“১১ই জানুয়ারি (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। রিসিভার তুলিয়া একটি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কন্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। কন্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন হইতে বন্ধূ; ..টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন, “শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি এবং প্রস্তাবও করিয়াছি। কারণ তিনি যে কোন পদেই বহাল থাকুন না কেন, তাঁহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ শাহেবের মানসিক গড়ন তুমিও জান; আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ্। অতএব ক্ষণিকের ভূল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারী কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনে পরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মান্ত্রিক নাম-মাত্র দায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসনে পরিণত করিবেন। এই দিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তোমার মত কি?” তদুত্তরে তাঁহাকে বলি, “তোমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবের শুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা, ক্ষমতার লোভ তাঁহার সহজাত।” তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম, মৌলিক প্রশ্নে তোমার আমার মধ্যে মতভেদ হইবে না।” -(অলি আহাদ)। উল্লেখ্য, জনাব অলি আহাদ ছিলেন পঞ্চাশের দশকে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। সে সময় শেখ মুজিব ছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।


নিরংকুশ ক্ষমতা দখলই ছিল শেখ মুজিবের প্রধান খায়েশ -তা নিয়ে এমন কি তাজউদ্দিন আহমদেরও কোন সন্দেহ ছিল না। ক্ষমতার নেশায় তিনি কখনও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কখনও প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কখনও বা জরুরী আইন জারী করে জনগণের সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়েছেন এবং সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন। শেষের দিকে এসে সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে নিষিদ্ধ করেন। হরণ করেন বাক স্বাধীনতা। একমাত্র সামরিক ক্ষমতা বলে অপসারণ ছাড়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আর কোন পথই তিনি খোলা রাখেননি। অবশেষে সে পথেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এই হল তার রাজনৈতিক জীবন। কথা হল, তাঁর এ ক্ষমতালোভী ও স্বৈরাচারি রাজনৈতিক জীবন কি কোন সভ্য দেশের ও সভ্য মানুষের জন্য মডেল হতে পারে? অথচ বাংলাদেশের আওয়ামী-বাকশালী মহল তার সে রাজনীতি নিয়েই গর্বিত। তাদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিব সর্ব কালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী। তার সে রাজনীতির মডেল তারা পুনরায় বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে যুগে যুগে স্বৈরাচারি শাসকদের সমর্থক চাটুকার মোসাহেবদের আচরণ অবিকল এমনটিই ছিল। এজন্য সেসব স্বৈরাচারি শাসকদের অতি মানব বা মহামানব হওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। যুগে যুগে দস্যু চরিত্রের বহু নৃশংস মানুষও এসব চাটুকরদের থেকে শ্রদ্ধ| পেয়েছে, এমনকি পুজাও পেয়েছে। দুর্বৃত্ত ফিরাউনকে তো তার তাঁবেদার প্রজারা ভগবান মনে করতো। খোদার আসনে বসিয়ে তাকে শুধু আনুগত্য ও রাজস্বই দিত না, প্রাণও দিত। তারাই তার স্মৃতিকে স্মরণীয় করতে বছরের পর বছর ধরে বহু অর্থ ব্যয়ে ও বহু প্রাণের বিণিময়ে পিরামিড নির্মাণ করেছিল। আর এরাই হযরত মূসা (আঃ)কে মনে করতো দুর্বৃত্ত। হযরত মূসা (আঃ)র হত্যায় ফিরাউনের নেতৃত্বে তারা সাগর পর্যন্ত ধেয়ে গিয়েছিল। অবশেষে মহান আল্লাহপাক এ দুর্বৃত্ত ফিরাউন ও তার সাথীদের সমূদ্রে ডুবিয়ে হত্যা করেছিলেন। হিটলারকেও তার ভক্তরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জার্মান মনে করতে। তার হুকুমে তারা লাখে লাখে প্রাণ দিয়েছে। মানুষ যখন আল্লাহতে অজ্ঞ ও ঈমানশূণ্য হয়, তখন তার আচরণ যে কতটা বিস্ময়কর ভাবে নীচে নামতে পারে সে উদাহরণ তো ইতিহাসে প্রচুর। মানুষ কেন, মানবেতর শাপ-শকুন-গরু-বাছুড়কেও এসব জাহেলেরা তখন দেবতার আসনে বসায়। শাপ-শকুন-গরু-বাছুড়ের তুলনায় ফিরাউন, হিটলারেরা তো অনেক শক্তিধর ছিল। তারা বড় বড় যুদ্ধ জয় করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যায় প্রচন্ড সামর্থ দেখিয়েছে এবং বড় বড় রাষ্ট্রও নির্মাণ করেছে। তাই যারা আজ শেখ মুজিবকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বা|ঙালী বলে, তাদের আচরণেও বিস্ময়ের কিছু আছে কি?


দেখা যাক, কীরূপ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে শেখ মুজিবের নিজের ধারণা। একাত্তরে ৯ মাস যুদ্ধচলা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিনের মুজিব নগর সরকার ছিল ভারতের আশ্রীত সরকার। এমন সরকারের কোন মেরুদন্ড থাকে না। জনাব তাজউদ্দিন ও তার মন্ত্রীদের প্রতিদিনের থাকা, খাওয়া-দাওয়া ও ভরন-পোষনের সমুদয় ব্যয় বহন করত দিল্লীর ইন্দিরা গান্ধী সরকার। খাঁচার পাখির নিজে শিকার ধরার সামর্থ থাকে না, মনিব যা দেয় তাই খেতে হয়। মনিব মন জোগাতে তখন তার শেখানো বুলিও তখন গাইতে হয়। তাজউদ্দিন সরকারের অবস্থাও তাই ছিল। ফলে তাকে দিয়ে ভারত সরকারও খুশী মত চুক্তিও সই করিয়ে নেয়। কোন স্বাধীন দেশ এমন চুক্তি কখনও স্বাক্ষর করে না। তাজউদ্দিনের স্বাক্ষরিত তাই ৭ দফা চুক্তিনামাটি হল নিম্নরূপঃ

১। ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হইবে। গুরুত্বের দিক হইতে এবং অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় এই বাহিনী বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী হইতে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হইবে। (পরবর্তীকালে এই চুক্তির আলোকে রক্ষী বাহিনী গড়া হয়)।

২। ভারত হইতে সমরোপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করিতে হইবে এবং ভারতীয় সমরবিদদের পরামর্শানুযায়ী তাহা করিতে হইবে।

৩। ভারতীয় পরামর্শেই বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করিতে হইবে।

৪। বাংলাদেশের বাৎসরিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভারতীয় পরিকল্পনার সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইতে হইবে।

৫। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হইতে হইবে।

৬। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলি ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাইবে না।

৭।ডিসেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোন সময় যে কান সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারিবে।


উপরে বর্ণিত চুক্তিগুলিতে মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন স্বাক্ষর করেন। কিন্তু তাজউদ্দিনের বদলে যখন শেখ মুজিব ক্ষমতা হাতে নিন তখনও কি ভারতের প্রতি এ নতজানু নীতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছিল? আসেনি। তাজউদ্দিন যে দাসখতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেগুলো শেখ মুজিবও মেনে নেন। "১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ ঢাকার বুকে বঙ্গভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সাল বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তিতে সেগুলি সন্নিবেশিত করা হয়।" -(অলি আহাদ) পাকিস্তান আমলে শেখ মুজিব বাংলার মানুষের বহু অর্থনৈতিক কল্যানের বড় বড় কথা বলেছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি ও তার দল কি করেছে সেটি দেখা যাক। প্রতিটি দেশের দেশপ্রেমিক সরকার শুধু দেশবাসীকে বিদেশী শক্তির সামরিক আগ্রাসন থেকেই রক্ষা করে না, রক্ষা করে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক হামলা থেকেও। প্রতিদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই এমন একটি অঙ্গিকার নিয়েই সেদেশে কঠোর ভাবে দিবারাত্র সীমান্ত পাহারা দেয়, যাতে বিদেশী পণ্যের সয়লাবে নিজ দেশের পণ্যগুলো বাজার না হারায়। একাজটি যাতে সুচারু ভাবে হয় সে জন্য প্রতিটি দেশপ্রেমিক সরকারই বিপুল অর্থ ভাবে সীমান্ত রক্ষি বাহিনী গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে আপোষ চলে না। সামরিক প্রতিরক্ষার চেয়ে অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষার বিষয়টি কোন দেশের জন্যই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বহীন ছিল না বাংলাদেশের জন্যও। কারণ, নিজদেশের পণ্য বাজার হারালে সে পণ্যের উৎপাদনকারি শ্রমিকগণ তখন বেকার হয়। এজন্যই প্রতিদেশের দেশ-প্রেমিক সরকার শুধু নিজদেশে নয়, বিপুল উদ্যোগে বিদেশেও বাজার খুঁজে। একাজে ব্যর্থ হলে ভিখারি হওয়া ছাড়া আর কোন রাস্তাই থাকে না। মুজিব আমলে বাংলাদেশের ভাগ্যে সেটিই জুটেছিল। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে মুজিবের কোন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গিকার ছিল না। ফলে সেদিন বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেয়েছিল "তলাহীন ভিক্ষার ঝুলি" রূপে। মুজির আমলের এটিই ছিল সবচেয়ে বড় অর্জন। আগামী হাজার হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষকে এ বদনামের বোঝা ও কলংক বইতে হবে। অথচ দেশটির অতীত ইতিহাসে এ পরিচয় কোনকালেই ছিল না। বরং বাংলার মসলিন শিল্প তখন বাজার পেয়েছে নানা দেশের নানা জনপদে।


ভারত শুরু থেকেই চাচ্ছিল, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূগোল বিলুপ্ত করা যদি সম্ভব না হয়, অন্ততঃ অর্থনৈতিক সীমান্ত লোপ পাক। যাতে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে অবাধে প্রবেশাধিকার পায়। এটি ছিল ভারতীয় বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজী। আর এ লক্ষ্যে ভারতকে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিবের ফেরে আসার তিন মাসের মধ্যে ভারত তার থেকে সে অধিকার আদায় করে নেয়। রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণে একটি দেশের দেশপ্রেমিক সরকারের যে প্রবল রাজনৈতিক অঙ্গিকার থাকে, সেটি শেখ মুজিব ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। প্রতিদেশের ভারত ১৯৭২ সালের ২৭ই মার্চ মুজিব সরকারের সাথে সীমান্তের ২০ মাইল অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করে। আর এ চুক্তি মোতাবেক ভারতীয় পণ্যের জন্য সমগ্র সীমান্ত খুলে দেন। ফলে ভারত অনায়াসেই পায় বৃহৎ বাজার। ভারত পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রতিবেশী ছিল। কিন্তু অখন্ড পাকিস্তান তার ২৩ বছরে একটি দিনের জন্যও ভারতীয় পণ্যের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়নি। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা খরচ করে বরং সীমান্ত পাহারা দিয়েছে যাতে নিজ দেশের পণ্য বিদেশী হামলার মুখে না পড়ে। ফলে সে আমলে ভারতের চেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়েছে শিল্পোন্নায়ন। বেড়েছিল কুঠির শিল্প। তখন বিড়ি তৈরী করেই লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করত। ব্যাপক ভাবে বেড়েছিল তাঁতশিল্প। অথচ মুজিব সে নিরাপত্তা দিতে পারেনি দেশের সে ক্ষুদ্র শিল্পকে। ফলে দ্রুত ধ্বস নেমেছে দেশের অর্থনীতি। দেশের কলকারখানা বন্ধ হয়েছে এবং ধ্বংস হয়েছে কুটির শিল্প। শুধু ভারতীয় পণ্যের জন্য বাজার করে দেওয়ার লক্ষ্যে। ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তখন বেকার হয়েছে। নেমে এসেছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আর এতে প্রাণ হারিয়েছে বহু লক্ষ। মুজিব শুধু নিজের গদীর স্বার্থে দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এমন ভয়ানক মৃত্যু ও বিপদ ডেকে আনে।


১৯৭১-এর যুদ্ধে বিজয়ে ভারতের প্রভূত রাজনৈতিক ও সামরিক সুবিধা হয়েছিল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তারা নিজেরা যে শুধু বিপুল আনন্দ পেয়েছে তা নয় গভীর আনন্দ দিয়েছে বিশ্বের তাবত ইসলামের দুশমন কাফেরদের। ভারত তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দীকে দ্বিখন্ডিত করে নিজে দক্ষিণ এশিয়ায় অপ্রতিদ্বন্দি হয়েছে সেটি সত্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় লাভটি হয়েছিল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বাজার লাভটি ছিল তার সবচেয়ে বড় বিজয়। এটি ছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের সম্মিলিত আভ্যন্তরীন বাজারের চেয়েও বিশাল। এক কালে এ বাজার দখলের জন্যই ইংরেজেরা হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এ দেশটিতে ছুটে এসেছিল। তবে ভারত শুধু বাজার দখল করেই ক্ষান্ত দেয়নি। বাংলাদেশের পণ্য যাতে নিজ দেশে এবং বহিঃবিশ্বে ভারতীয় পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা না করতে পারে তারও পাকা ব্যবস্থা করেছিল। ইংরেজেরা তাদের পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা নির্মূল করতে বাংলাদেশের মসলিন শিল্পের তাঁতীদের হাত কেটেছিল। সে অভিন্ন লক্ষে ভারত বাংলাদেশের তাঁতীদেরই শুধু নয়, পুরা শিল্পকেই ধ্বংস করেছিল। আর সে শিল্প ধ্বংসে ভারতকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীবাহিনা। এবং সবচেয়ে বেশী সহযোগিতা দিয়েছিলেন শেখ মুজিব নিজে। শেখ মুজিব দেশের সমস্ত শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন, সেগুলিকে কেড়ে নিয়েছিলেন তাদের আসল মালিকদের থেকে। এবং তুলে দিয়েছিলেন তার অযোগ্য ক্যাডারদের হাতে। আর এ ক্যাডারগণ যে শুধু শিল্প-পরিচালনায় অযোগ্য ছিল তাই নয়,সীমাহীন দুর্নীতি পরায়নও ছিল। অন্যের কোল থেকে কেড়ে আনা সন্তানের প্রতি অপহরনকারি ব্যক্তির দরদ থাকে না। তেমনি বাংলাদেশের শিল্পের প্রতি দরদ ছিল না এসব আওয়ামী ক্যাডারদের। এরা নিজেদের শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে দেশে কোন শিল্পই গড়েনি, পাকিস্তান আমলে গড়া শিল্পকে তারা দখলে নিয়েছিল মাত্র। ফলে তাদের দরদ ছিল না সেসব প্রতিষ্ঠিত শিল্প কলকারখানার উপর। দেশের স্বার্থের চেয়ে তাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছিল।


সে অযোগ্যতা, দুর্নীতি ও শিল্পধ্বংসের কিছু উদাহরণ দেওয়া যাকঃ “আদমজী জুট মিল ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল। পাটজাত দ্রব্যে বিদেশে রফতানি করে এ মিলটি শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মূদ্রা আয় করেছে। ভারতের পাটকলগুলির সামর্থ ছিল না তার সাথে প্রতিযোগিতার। অথচ মুজিব সরকার এত বড় একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানকে লোকশানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। শেখ মুজিব এ মিলের দায়িত্বে বসিয়েছিলেন তারই এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। উৎপাদন বাড়ানোর চেয়ে এ মিলের মূল কাজ হয় আওয়ামী কর্মীদের এ মিলে চাকুরি দিয়ে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করা। ১৯৭৪ সালের ২২ই মার্চ ইত্তেফাক এ মর্মে খবর ছেপেছিল যে পাট শিল্পে ২৫ হাজার বাড়তি ও ভূয়া শ্রমিক এবং ৩ হাজার ৬ শত ভূয়া কর্মকর্তা রয়েছে।” - (মুনির উদ্দীন আহমদ, ১৯৮০)। কথা হল, একটি মাত্র মিলে যদি ২৫ হাজার ভূয়া শ্রমিক দেখিয়ে রাজনৈতিক ক্যাডার পালনের ব্যবস্থা করা হয় তবে সে কারখানা যত লাভজনকই হোক তা কি টিকে থাকতে পারে? এসব কর্মীরা লুটপাট ছাড়া এ মিলের আর কোন খেদমতই করেনি। সে লুটপাটেরই এক করুন চিত্র ছেপেছিল সে সময়ের দৈনিক গণকন্ঠ ১৯৭২ সালের ২৭ অক্টোবর সংখ্যায়। শিরোনামটি ছিল, “আদমজী জুট মিলের ওয়ার্কশপে এলাহী কান্ডঃ প্রায় দেড় লক্ষ টাকার খুচরা যন্ত্র গোপনে বিক্রি।” বিরামহীন লুটের মাধ্যমে এ বিশ্ববিখ্যাত মিলটি তারা অচল করে দিয়েছে। অথচ এ মিলের মুনাফা দিয়ে এক সময় দেশে আরো অনেক কলকারখানা গড়া হয়েছিল। গড়ে উঠেছিল বহু স্কুল-কলেজ ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের দূর্নীতি ও ভারত-তোষণ নীতির অসম্ভব হয় এ মিলটির নিজের পক্ষে বেঁচে থাকাটিই। শুধু আদমজী জুটমিলই নয়, ধ্বংসের মুখোমুখি হয় অন্যান্য কলকারখানাগুলিও। একের পর এক পাটের গুদামে আগুন লাগানো হয়েছে। বাংলাদেশের পাট শিল্প এভাবে ধ্বংস হওয়াতে রম-রমা হয়েছে ভারতীয় পাটকলগুলো। তারা তখন সহজেই দখল করে নেয় পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক বাজার। এমন কি বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৪ সালে ভারতের সাথে চুক্তি করে পাট রপ্তানির অধিকার ভারতের হাতে সঁপে দেয়। আর এর ফলে ৫৯ হাজার জুটবেলিং শ্রমিক বেকার হয়ে যায়।- (গণকন্ঠ জুন ১২, ১৯৭৪) পাকিস্তান আমলে ভারত এমনটি ভাবতেও পারেনি। শুধু বড় বড় কলকারখানাই নয়, একই রূপ দূর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংসা করা হয়েছিল বাংলাদেশের কুটির শিল্প। সূতা আমদানি ও তার বিতরণ আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে দিয়ে প্রকৃত তাঁতীদের হাতে ন্যায্য দামে ও সঠিক মূল্যে সূতা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেনি। ফলে ভারতীয় সস্তা ও নিম্নমানের কাপড়ের সাথে প্রতিযোগীতার সামর্থ হারা বাংলাদেশের তাঁতীরা। ফলে বেকার হয়েছিল এবং দূর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল পাকিস্তান আমলের স্বচ্ছল তাঁতীরা। মুখে যাই বলুক, বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ ছিল আওয়ামী লীগের প্রকৃত অবদান।


শেখ মুজিব বাংলাদেশকে নিয়ে কীরূপ স্বপ্ন দেখতেন সেটি জনগণের জানার উপায় ছিল না। সেটি তার অদৃশ্য মনজগতের বিষয়। তবে বাংলাদেশকে তিনি যেখানে নিয়ে গেছেন সেটি শুধু বাংলাদেশের মানুষই শুধু দেখেনি, বিশ্ববাসীও দেখেছে। দেশটির বহু হাজার বছরের ইতিহাসে এমন দুস্থ্যদশা মূলতঃ নজিরবিহীন। এতটা দুরবস্থায় বাংলাদেশের কোন কালেই পড়েনি। তবে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীগণ নিজেদের এ ব্যর্থতা লুকাতে অন্যদের গায়ে কালীমা লেপনের চেষ্টা করেছে। এজন্যই একাত্তরের মিথ্যা ইতিহাস রচনায় আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের এত উদ্যোগ। একাত্তরের কতজন মারা গেল সে হিসাবটুকু না নিলে কি হবে, বহু হাজার পৃষ্ঠার বহু লিখেছে নিছক বিরোধীদের খুনী ও দালাল রূপে চিত্রিত করতে। ১৯৭০য়ের নির্বাচনের পূর্বে এ আওয়ামী বাকশালী পক্ষটি “পূর্ব বাংলা শ্মশান কেন?” শিরোনামে পোষ্টার ছেপে সারা দেশে প্রচার করেছিল। কিন্তু তাদের কথিত সে শ্মশান আমলে পূর্ব বাংলার মানুষ কি কখনও দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল? কাপড়ের অভাবে কি মহিলা মাছধরা জাল পড়েছিল? এক দিনের জন্যও কি দেশ ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়েছিল? পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তানকে যারা শ্মশান বলল, তারাই একাত্তরের পর দেশটিকে বদ্ধভূমি ও শ্মশান বানিয়ে বিশ্বের সামনে পেশ করেছিল।


শেখ মুজিব যে শুধু গণতন্ত্র হত্যা করেছেন,দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছেন বা জাতিকে ভারতের গোলাম বানিয়েছেন তা নয়, তার চেয়েও বড় ক্ষতি করেছেন জাতির মেরুদন্ড ধ্বসিয়ে দিয়ে। শিক্ষাই হল জাতির মেরুদন্ড। এখানে কোন ফাঁকি-বাজি চলে না। জ্ঞানার্জনের কোন সহজ রাস্তা নেই।একটি দেশের মেরুদন্ড ভাঙতে হলে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়াটাই সে জন্য যথেষ্ট। এ কাজ শত্রুদের। তাই দেশের কল্যাণে কোন নেতার সামান্যতম আগ্রহ থাকলে শিক্ষাব্যবস্থার সামান্যতম ক্ষতি হবে এমন সিদ্ধান্ত তিনি নেন না। কিন্তু শেখ মুজিব নিয়েছিলেন। একাত্তারের যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস হয়নি। কিন্তু লেখাপড়া না হলে কি হবে শেখ মুজিব ছাত্রদের নাম-মাত্র পরীক্ষা নিয়ে বা পরীক্ষা না নিয়েই পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশনের ব্যবস্থা করলেন। ফলে যুদ্ধকালীন নয় মাসে ছাত্রদের যা শেখা উচিত সেটা শেখা ও শেখানোর আর কোন সুযোগই থাকল না। সরকার শেখানোর ব্যবস্থাও করল না। এমনকি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা না নিয়ে পাসের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে প্রচুর সার্টিফিকেট বিতরণ হল, কোন জ্ঞান বিতরণ ছাড়াই। তার আমলে পরীক্ষার হলে ব্যাপক ভাবে নকল শুরু হয়। নকল সরবরাহকারিরা তখন বই নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে হাজির হত। মুজিব সরকার সেটি রুখবার কোন ব্যবস্থাই নিল না। দায়িত্বহীনতা আর কাকে বলে? জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে চুরি বা দূর্নীতি শুরু হলে তার চেয়ে মারাত্মক আর কি হতে পারে। তখন সে চুরিবিদ্যার প্রয়োগ শুরু হয় অফিস-আদালত ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। একটি জাতির জন্য এরচেয়ে বড় আত্মঘাতি আর কি হতে পারে? কিন্তু আত্মঘাতি রাজনীতি যাদের আজীবনের পেশা তাদের কাজে এত বড় অপরাধ কোন অপরাধই মনে হয়নি। ছাত্রদেরকে তিনি ও তার বশংবদেরা সচারচরই ব্যবহার করেছেন সন্ত্রাসী রাজনীতির অবৈতনিক লাঠিয়াল রূপে। তার আমলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার দলীয় ছাত্রনেতাদের দ্বারা ছাত্র খুণ হয়েছে প্রকাশ্যে। কিন্তু এজন্য কারো কোন শাস্তি হয়নি। বরং মুজিবের দ্বারাই সরকারি ভাবে শুরু হয় বিচারবহিঃর্ভূত হত্যার ঘটনা। তার আমলে বিচার ছাড়াই শুধু বন্দী সিরাজ সিকদারকেই হত্যা করা হয়নি, রক্ষী বাহিনী ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে হাজার ছাত্র ও যুবককে। বহু কলেজের প্রিন্সিপাল পদে বসানো হয়েছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ক্যাডারদের।অপর দিকে শিক্ষাক্ষেত্রে যে সীমাহীন অরাজকতা, দূর্নীতি ও শিক্ষাদানে চরম অবব্যবস্থা তিনি সৃষ্টি করেছিলিন সেটি বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সাংঘাতিক খবর ছড়িয়ে পড়িছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। ফল দাঁড়ালো, বাংলাদেশী ডিগ্রি বিদেশে মূল্য হারালো, এবং এভাবে ইজ্জত হারালো শিক্ষিতরা। ইংল্যান্ডসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলোর স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়। এভাবে বহিঃবিশ্বে বেইজ্জতি বাড়ে বাংলাদেশী ডাক্তারদের এবং সে সাথে শিক্ষা ব্যবস্থারও। শেখ মুজিব এভাবে কালিমা লেপন করলেন, বাংলাদেশী শিক্ষিতদের মুখে। মুজিবামলে ট্রান্সপ্যারেনসী ইন্টারন্যাশনাল জন্ম নেয়নি। সেটির জন্ম হলে দূর্নীতি পরিমাপের সে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশ যে সে আমলেও বিশাল ব্যবধানে বিশ্বে প্রথম হত, তা নিয়ে সন্দেহ আছে কি? বাংলাদেশ পরবর্তীতে যে ভাবে দূর্নীতিতে বিশ্বে বার বার প্রথম হয়েছে তার বিশাল চর্চা তো শুরু হয়েছিল মুজিব আমল থেকেই।


কারো সততা তার কথায় ধরা পড়ে না। সমাজের অতি দুর্বৃত্ত ব্যক্তিটিও নিজেকে সৎ ও নির্দোষ বলে দাবী করে। তবে প্রতি সমাজেই সততা পরিমাপের কিছু গ্রহনযোগ্য মাপকাঠি আছে। তা হল, তার আয় এবং গচ্ছিত সম্পদের হিসাব। একজন ভদ্রলোকের পক্ষে তার আয় ও সম্পদ কোনটাই লুকানোর বিষয় নয়। চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাষাবাদ যাই সে করুক না কেন তা থেকে যেমন তার সমুদয় আয়ের একটি হিসাব যে কেউ বের করতে পারে। তেমন তার ঘরবাড়ি ও গচ্ছিত সম্পদের পরিমাণ কত সেটিরও একটি হিসাব বের করা যায়। আযের সাথে সম্পদের সে অসঙ্গতিই বলে দেয় তার আসল সততা। তখন বেড়িয়ে আসে সে কতটা দুর্বৃত্ত। এ বিচারে বিশাল আদালত বসানো লাগে না। তাই মোটা বেতনের চাকুরি নাই, বিশাল ব্যবসা-বাণিজ্য নেই, পিতার জমিদারীও নাই এমন ব্যক্তি যদি ধানমন্ডি, গুলশান বা বনানীতে বিশাল বাড়ীর মালিক হন, তখন কি গবেষণার প্রয়োজন পড়ে এটুকু বুঝতে যে লোকটি আর যাই হোক সৎ হতে পারে না? শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর তার গৃহে প্রাপ্তসম্পদের একটি তালিকা করা হয়। ৩০ শে অক্টোবর (১৯৭৫) দৈনিক ইত্তেফাক মোতাবেক শেখ মুজিবর রহমানের ধানমন্ডিস্থ ৩২ নং সড়কের ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের বিররণ হলঃ

০ হীরা, মুক্তা, প্লাটিনাম ও স্বর্ণালঙ্কর - ৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা

০ নগদ বাংলাদেশী টাকা- ৯৪ হাজার ৪ শত ৬১ টাকা

০ ব্যক্তিগত মোটর গাড়ী - ৩ টি

০ বৈদেশিক মুদ্রা ১৭ হাজার ৫ শত টাকা (সমমূল্যের)

০ বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত ১ লক্ষ টাকার উপহার

০ বাতিলকৃত শতকী নোট - ৬ শত ২১ খানা

০ ১টি ভারী মেশিনগান, ২টি হালকা মেশিনগান, ৩টি এস,এম,জি, ৪টি স্টেনগান, ৯০ টি গ্রেনেডসহ গোলাবারুদ ইত্যাদি।


মুজিবের রাজনৈতিক সততা যাচাইয়ের বহু দলীল রয়েছে, বহু প্রমাণও রয়েছে। কোটি কোটি মানুষ তার রাজনৈতিক কর্ম ও আচরণ স্বচোক্ষে দেখেছে। রাজনৈতিক চরিত্রের পাশাপাশি অকাঠ্য প্রমাণ রয়েছে তার অর্থনৈতিক চরিত্র বিচারেও। মানুষ মারা যায় এবং রেখে যায় সম্পদ। আর সে গচ্ছিত সম্পদের মাধ্যমেই প্রকাশ পায় তার প্রকৃত চরিত্র। বস্তুতঃ ব্যক্তির চরিত্র পরিমাপে এ সম্পদই হল প্রকৃত গজ-ফিতা। তাই চরিত্র লুকানো যায় ন

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads