রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

ঘুষ কেলেঙ্কারি : সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নির্দোষ ঘোষণা করল রেলওয়ের তদন্ত কমিটি : নির্দোষ সার্টিফিকেট দিতে যাচ্ছে দুদকও



রেলওয়ের ৭০ লাখ টাকা ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় তত্কালীন রেলমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নির্দোষ ঘোষণা করল রেলওয়ের বিতর্কিত তদন্ত কমিটি। সাবেক রেলমন্ত্রীর অধিনস্ত একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করালে যে ফল হবে বলে সবাই আশঙ্কা করেছিলেন বাস্তবেও তাই হয়েছে। টাকার ঘটনা ফাঁস করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালনকারী গাড়িচালক আলী আজমের কোনো বক্তব্য নেয়া হয়নি। তিনিই এ ঘটনার প্রধান সাক্ষী হওয়ার কথা। তবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নির্দোষ ঘোষণা করলেও রেলওয়ের মহাপরিচালক ও তদন্ত কমিটির প্রধান মো. আবু তাহের বলেছেন, ঘটনার রাতে সুরঞ্জিত সেনের এপিএস ওমর ফারুক, রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের জিএম (সাসপেন্ড) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেলের নিরাপত্তা কর্মী কমান্ড্যান্ট এনামুল হক (সাসপেন্ড) বস্তাভরা ৭০ লাখ টাকা গাড়িতে করে মন্ত্রীর ঝিগাতলার বাসায় যাচ্ছিলেন বলে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। মন্ত্রী সম্পৃক্ত এমন কথা তদন্ত কমিটিকে কেউ বলেনি। এতে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র ছিল না, তবে ঘটনাটি ছিল অস্বাভাবিক। তদন্ত কমিটি গতকাল বিকালে রেল সচিব ফজলে কবিরের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনের বিস্তারিত গণমাধ্যম কর্মীদের জানানো হয়নি।
এদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে নির্দোষ ঘোষণা করে সার্টিফিকেট দিতে যাচ্ছে দুদক। এ ঘটনা তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ করে এনেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। শিগগিরই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। প্রসঙ্গত, গত ৯ এপ্রিল গভীর রাতে বিপুল পরিমাণ টাকাসহ বিজিবির হাতে ধরা পড়েন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস ওমর ফারুক এবং রেল কর্মকর্তা ইউসুফ আলী মৃধা ও নিরাপত্তা কর্মী ঢাকার কমান্ড্যান্ট এনামুল হক। এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। অবশেষে গত ১৬ এপ্রিল রেলমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বর্তমানে তিনি দফতরবিহীন মন্ত্রী। ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, চাকরিচ্যুত হন ওমর ফারুক তালুকদার। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করে রেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও পৃথকভাবে তদন্ত করছে দুদক।
সূত্র জানায়, তদন্ত কমিটি ২০ কার্যদিবস শেষে গতকাল বিকালে রেল সচিবের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। রেল সচিব রিপোর্ট মন্ত্রীর কাছে পাঠাবেন। রেলভবনের দ্বিতীয় তলায় রেলসচিব ফজলে কবির ও মহাপরিচালক আবু তাহের পাশাপাশি রুমে বসেন। গত ১১ এপ্রিল আবু তাহেরের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব শশী কুমার সিংহ। ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও পরে আরও ৫ কার্যদিবস মেয়াদ বাড়ানো হয়। গতকাল ২০ কার্যদিবস মেয়াদ শেষ হয়েছে। তদন্ত কমিটি এপিএস ওমর ফারুকের গাড়িচালক আলী আজমের বক্তব্য ছাড়াই তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেনা ও বিজিবির ৮ সদস্যসহ মোট ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রেলওয়ের একটি সূত্র জানায়, ৭৭ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৭ পৃষ্ঠা রিপোর্ট ও ৭০ পৃষ্ঠা জবানবন্দি ও অন্যান্য নথিপত্র।
তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার আগে মো. আবু তাহের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তবে বেশিরভাগ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যান তিনি। তদন্ত প্রতেবেদন কত পৃষ্ঠার জানতে চাইলে তাও এড়িয়ে যান রেলওয়ের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, প্রতিবেদন খুব বেশি পৃষ্ঠার হবে না, তবে এর সঙ্গে কিছু সংযুক্তি আছে। তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, গাড়িচালক আলী আজম ছাড়া অন্য সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। চালককে না পাওয়ায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সম্ভব হয়নি। তিনি জানান, তাকে তদন্ত কমিটির সামনে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও তার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দেয়া হয়েছিল, তবে তিনি আসেননি। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছি। আলী আজমের বক্তব্য ছাড়াও তদন্ত কমিটি সঠিকভাবে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বলে দাবি করেন তিনি। ৭০ লাখ টাকার দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস করার ক্ষেত্রে যিনি প্রধান ভ্থমিকা পালন করেছেন সেই ড্রাইভার তথা প্রধান স্বাক্ষীর সাথে কথা না বলেই তদন্ত রিপোর্ট প্রশ্নের সৃষ্টি করবে কিনা -গতরাতে বিবিসির এমন এক প্রশ্নের জবাবে আবু তাহের বলেন, আমাদের যে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন দেয়া হয়েছে তাতে তার জবানবন্দি ছাড়াই তদন্ত সম্পূর্ণ বলা চলে।
ঘটনার রাতে এত টাকাসহ তারা কোথায় যাচ্ছিলেন- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আবু তাহের বলেন, গাড়িটি মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিল- এটা তারা দাবি করেছেন। সেটি বড় বিষয় নয়। মন্ত্রী গাড়িটির গন্তব্য সম্পর্কে জানতেন না, এটিই বড় কথা। এমনকি তারা মন্ত্রীর বাসায় যাওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগও করেননি। তবে ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকের ওই গাড়িতে থাকাটাকে তদন্ত কমিটির কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।
তবে এত টাকার মালিক কে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওমর ফারুক নিজেই স্বীকার করেছে ওই টাকার মালিক সে। সেই ঘটনার পর নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তিনি ওই টাকা জমা দিয়েছেন। কমিটিকেও ওই টাকা নিজের বলে দাবি করেছেন ফারুক। আর কেউ এ টাকা নিজের বলে দাবিও করেনি। টাকার উত্স সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি রেলের তদন্তের বিষয় নয়। টাকার উত্স তদন্ত রেলওয়ের এখতিয়ার বহির্ভূত। এটা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে। দুদকের কাছে ফারুক তার সম্পদের হিসেবও জমা দিয়েছেন। তা রেলের তদন্ত কমিটির সামনেও উপস্থাপন করেছেন। এপিএসের গাড়িতে থাকা টাকার সঙ্গে ইউসুফ আলী মৃধা বা এনামুল হকেরও কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি বলে জানান আবু তাহের। তিনি বলেন, ওই গাড়িতে তাদের থাকাটা অস্বাভাবিক। রেল কর্মকর্তারা সেই রাতে মন্ত্রীর বাসায় যাচ্ছিলেন কিনা, তদন্তে এ ধরনের কোনো তথ্য এসেছে কিনা জানতে চাইলে আবু তাহের বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর এ ব্যাপারে সরকার চাইলে বিস্তারিত জানানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রেল কর্মকর্তারা কতটুকু সম্পৃক্ত তা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এপিএস’র গাড়িটি কীভাবে বিজিবি সদর দফতরে ঢুকেছে- এমন প্রশ্নর জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক জানান, ওই ঘটনায় তদন্ত কমিটি বিজিবি ও সেনাবাহিনীর ৮ সদস্যসহ মোট ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। বিজিবি সদস্যরা জানিয়েছে গাড়িতে সংসদ সদস্যের স্টিকার থাকায় তল্লাশি ছাড়াই গাড়িটি ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। তবে গাড়িতে কত টাকা ছিল সে বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি বিজিবি সদস্যরা।
এই তদন্ত রিপোর্টের পর বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তারা চাকরি ফিরে পাবেন কিনা- বিবিসির এই প্রশ্নের জবাবে গতরাতে আবু তাহের বলেন, তাদের কিছুটা দায়-দায়িত্ব তো রয়েছেই। তবে তাদের চাকরি থাকবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেবেন কর্তৃপক্ষ।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads