শুক্রবার, ১১ মে, ২০১২

পিতাকে পুত্র

পিতাকে পুত্র


॥ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ॥



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
২০১২ সালের মে মাসটা বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৫ মে নিকট প্রতিবেশী ভারত ও আমেরিকার নেতা একই দিনে কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তারা হলেনÑ আমেরিকার প্রচণ্ড মতাসম্পন্ন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন ও ভারতের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী শ্রী প্রণব মুখার্জি। মনে হয় তাদের দু’জনের সম্পর্কেই তোমার কোনো ধারণা নেই। কাউকেই তুমি চেন না। শ্রী প্রণব মুখার্জি তোমার সময়েও রাজনীতিতে ছিলেন। কারণ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক হিসেবে এক সেমিনারে বক্তৃতা করার সময় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নজরে পড়ে ’৬৯-এ রাজ্যসভার এমপি হয়ে দিল্লিতে যান। এরপর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী, তারপর প্রতিরা, পররাষ্ট্র, অর্থ নানা েেত্র বিচরণ করে দিল্লিতে মতার বলয়ের কাছাকাছি একমাত্র বাঙালি হিসেবে এখনো টিকে আছেন। যদিও মুক্তিযুদ্ধের সময় তাকে নিয়ে তেমন আলোচনা ছিল না। কিন্তু তুমি নিহত হওয়ার পর থেকে তাকে নিয়ে শুরু হওয়া আলোচনা দিন দিন শুধু বৃদ্ধিই পেয়েছে, কখনো কমেনি। আমার সাথে তার ’৭৭ সালে প্রথম পরিচয়। এরপর তোমার কন্যা মানে আমার ভগ্নি, তার সাথেও খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। একজন সাদাসিধা নির্লোভ খুবই সাত্ত্বিক ধরনের মানুষ তিনি। তোমার কন্যাকে এবং আমাকে মনে হয় একই রকম ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। দিনে দিনে সময় তো আর কম হলো না! 
তুমি চলে যাওয়ার পর তোমার জানাশোনা এখন আর তেমন কেউ নেই। তোমার সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভি ভি গিরি, এখন শ্রীমতী প্রতিভা পাতিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সরদার শরণ সিং, এখন এস এম কৃষ্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাকেও আসলে তোমার চেনার কথা না। শুধু ভারতের কথা বলি কেন, সারা দুনিয়ায়ই তেমন কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। 
তোমার সময় আলজেরিয়ায় বেনবেল্লাকে গৃহবন্দী করে হো আর ই বুমেদিন হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। দণি আফ্রিকার উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইদি আমিন। যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু আর মিসরের আবদেল নাসের তারা তিন বন্ধু জোটনিরপে আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। তুমি থাকতে থাকতেই মিসরের আবদেল নাসেরকে সরিয়ে আনোয়ার সাদাত মতায় এসেছিলেন। ’৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আনোয়ার সাদাত যুদ্ধে ব্যবহৃত পুরনো ৪০টি ট্যাংক দিয়েছিলেন, যে ট্যাংক দেখিয়ে তোমাকে হত্যা করেছে সেই আনোয়ার সাদাতও ঘাতকের হাতে নিহত হয়েছেন। তারপর এসেছিলেন হোসনি মোবারক। ভদ্রলোক অনেক দিন মতায় ছিলেন। দু-এক বছর আগে মতা ছাড়লে হয়তো শেষ জীবনটা সম্মানের সাথে কাটাতেন। আসলে মতার স্বাদ পেলে কেউ ছাড়ে না, হোসনি মোবারকও ছাড়েননি। তাকে জনগণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উৎখাত করেছে। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে ভদ্রলোক এখন কারাগারে। আর ক’দিন বাঁচবেন বলা যায় না। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফিও ৪২ বছর মতায় থেকে জনগণের দাবির মুখে মতা ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে নিহত হন। তোমার সময়ের পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কেরা প্রায় কেউ নেই। আমেরিকার মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখন বারাক ওবামা। তারই পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন। মিসেস হিলারির স্বামী বিল কিনটনও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেটা তোমার পরের কথা। নিক্সন, বুশ, রিগ্যান, জুনিয়র বুশ এদেরও পরের তিনি। ব্রেজনেভ, কোসিগিন নেই; রাশিয়ায় ভøাদিমির পুতিনের রাজত্ব চলছে এখন। চীনে মাও জে দং নেই, চিয়াং কাই শেক নেই, চৌ এন লাই নেই। অন্যদের রাজত্ব সেখানে। হ্যাঁ, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ট্রো এখনো জীবিত। তবে রাষ্ট্রীয় মতা কয়েক বছর আগে ছেড়ে দেন। মতা এখন তার ভাই রাউল কাস্ট্রোর হাতে। হিলারি কিনটনকে তোমার চেনার কথা নয়। তোমার সময় আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ইহুদি কিসিঞ্জার। তিনি পাকিস্তানের সহায়তায় চীনের সাথে সল্ট চুক্তি করে সারা পৃথিবীতে এক ভীষণ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যিনি বাংলাদেশকে বলেছিলেন, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। আর আমাদের বিজয়কে তার পরাজয় বলে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় সেটা তার নিজের পরাজয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এখন হিলারি কিনটন। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে ফার্স্টলেডি হিসেবে স্বামীর সাথে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময়ই গ্রামীণ ব্যাংকের কাজ দেখতে মানিকগঞ্জ ও যশোরের পল্লীতে গিয়েছিলেন। আবার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কথা বলতে গেলে তোমাকে তো এক সুখবর দিতেই হয়। কয়েক বছর আগে আমরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছি। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চট্টগ্রামের ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ুদ্রঋণ সূত্রের কারণে নোবেল পেয়েছেন। ৯৭-৯৮ বছর আগে বাঙালি হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। মানিকগঞ্জের আরেকজন বিশ্বনাগরিক ড. অমর্ত্য সেনও অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। কোনো সন্তান ভালো কাজ করলে পরিবারের সবাই খুশি হয়। বাংলাদেশে এখন তেমন হয় না। কারো কোনো কাজে কেউ খুশি হয় না। কেমন যেন সবাই সবার পিছু লেগে থাকে, কাউকে এগিয়ে দেয়ার জন্য নয়, বরং টেনে ধরার জন্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল পুরস্কার বাতিল করার জন্য বা ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকেই লবিং করা হয়েছে। বেশুমার টাকা খরচ করা হয়েছে। একজন অ্যাটর্নি জেনারেল একেবারে অদ্ভুতভাবে বলেছেন, প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে কাউকে নোবেল পুরস্কার দিলে সেটা দেয়া উচিত ছিল তোমার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি পরিষদের সন্তু লারমাকে। তোমার সময় সন্তু লারমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তাই তাকে তুমি চিনবে না। তোমার সময় ছিল মানবেন্দ্র লারমা। সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র লারমা তোমার মৃত্যুর পর স্বজাতির ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছেন। দুঃখের কথা তোমাকে কী বলি? তোমার সময় নিজের জন্য তদবির করতে তোমরা সবাই লজ্জাবোধ করতে। আমরাও কিছুটা করতাম। কিন্তু এখন পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেকে পৃথিবীজোড়া লবিং করে, ঘুষও দেয়। এ যে কী আজব অবস্থা তুমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। আজ এখানেই থাক। পরে আবার এ প্রসঙ্গ জানাব। এখন চলো আগের কথায় যাই।
তোমাকে ভালোবাসতাম। প্রেমিক যেমন প্রেমিকাকে ভালোবাসে, প্রায় অনেকটা তেমনি করে। তাই তোমার কোনো কিছুই অপছন্দ হয়নি। আর আসলেও তো তখন ছোট ছিলাম। যে যা-ই বলুক তুমি না থাকলে পাকিস্তানি পরাজিত শত্র“ অনেক সরকারি কর্মচারীর জীবন বাঁচত না। সামরিক ও বেসামরিক যেসব ব্যক্তি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরেছিল তাদের ফিরিয়ে আনা হলেও চাকরিতে ডাবল প্রমোশন দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকার সুযোগ কেউ দিত না। আর অমন করার চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর বাঙালিরা তা প্রতিহত করত। কিন্তু স্বাধীনতার পর তুমি যখন যা করতে, তাই দেশের মঙ্গল বলে আমরা পাগলেরা মেনে নিতাম। উন্মাদের মতো তোমার আদেশ পালনের চেষ্টা করতাম। তাই ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মচারীরা পাকিস্তান প্রশাসন জিইয়ে রেখেছিল, ১৬ ডিসেম্বর হানাদারদের আত্মসমর্পণের পর তারা সবাই যখন ভাবছিল কোনো রকমে আল্লাহর দয়ায় জীবনটা বাঁচলেই খুশি, সেই সময় তুমি লাই দিয়ে তাদের সবাইকে চাকরিতে বহাল রেখেছিলে। যুদ্ধ শেষে পঞ্চাশ টাকা হাতে দিয়ে প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককেই যখন বাড়ি পাঠাতে পারোনি। পাকিস্তানে আটকে থাকা বাঙালিরা দেশে পা ফেলতেই বেতনের সাথে দুই মাসের অগ্রিম দিয়ে ছুটিতে পাঠালে। তেমনি একজন ছিলেন পাকিস্তান ফেরত তোমার শাসন আমলের সর্বশেষ ডিজিএফআই প্রধান কর্নেল বা ব্রিগেডিয়ার জামিল। আজ বড় কষ্ট ও ঘৃণা হয়, তোমার পরিবারের নিহতদের সাথে যখন কর্নেল জামিলের ছবি দেখি তখন। কোনো মতেই হিসাব মিলাতে পারি নাÑকোন যোগ্যতার বলে তোমার পরিবারের প্রাণহারাদের পাশে তার ছবি জ্বলজ্বল করে। কী যোগ্যতা ছিল তার? না মুক্তিযুদ্ধে, না তোমাকে রা করতে। ভেবে দেখো ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ বিজয় দিবস, ২৪ জানুয়ারি ’৭২ তুমি আমাদের সব অস্ত্র নিয়ে নিলে। ক’দিন সময় দিয়েছিলে? ডিসেম্বরের ১৫ আর জানুয়ারির ২৪ কত আর হয় ৩৯ দিন। ঠিক আছে সব অস্ত্র নিয়েও যদি তুমি বলতেÑ কাদের, তোর হাতে তিন হাজার অস্ত্র নিরাপত্তার জন্য রাখলাম। এ দিয়ে তুই সরকারের নিরাপত্তা দেখবি, আমার নিরাপত্তা দেখবি। অস্ত্র নিতে টাংগাইল গিয়ে বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে পিতার মতো বলেছিলে, ‘তিন বছর আমি তোমাদের কিছু দিতে পারব না। আরো তিন বছর হানাদারদের সাথে যুদ্ধ হলে তোমরা যুদ্ধ করতা না?’ সবাই বলেছিলাম, করতাম, করতাম। তুমিও তো একটু ভেবে দেখতে পারতে, সব না হোক, নিরাপত্তার খাতিরে কিছু অস্ত্র কিছু দিন তোমার সন্তানদের হাতে থাকুক। নাকি তুমি আমাদের বিশ্বাস করতে পারোনি? তবে কি বিশ্বাস করলে তাদেরÑ যারা আমাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর ৯ মাস যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছে?
আমি কর্নেল জামিলের কথা বলছিলাম। সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। বাড়ি আক্রান্ত হলে তুমি নাকি বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলেছিলে। তার মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি, তেমনি সেনাপ্রধান অপদার্থ সফিউল্লাহ ও ডিজিএফআই প্রধান কর্নেল জামিলও নাকি ছিলেন। শোনা যায়, ফোন পেয়ে সেনাপ্রধান কে এম সফিউল্লাহ তোমাকে পালাতে বলেছিলেন। আর কর্নেল জামিল উদভ্রান্তের মতো পাগলপ্রায় হয়ে ছুটে এসেছিলেন। তোমার ফোন পেয়ে ছুটে আসায় আমি কর্নেল জামিলের প্রতি অবশ্যই গভীর শ্রদ্ধা জানাব। এ জন্য তাকে মরণোত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হলেও মনে করব কম হবে। তার এমন জীবনদান আনুগত্যের বিচারে সেরা নজির হয়ে থাকত। কিন্তু ব্যাপারটা তো সে রকম নয়। কর্নেল জামিল তো একজন সাধারণ ব্যক্তি ছিলেন না। পাকিস্তান-ফেরত হলেও তার প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে তাকে মাত্র কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ ডিজিএফআইয়ের প্রধান করা হয়েছিল। এখনকার পিজিআর এসএসএফের মতো মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য তাকে এক ব্রিগেড মানে তিন হাজার নানা ধরনের সৈন্য দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে যেমন তিন ব্যাটালিয়ন পদাতিক ছিল, তেমনি কমান্ডো বাহিনী ছিল। রাষ্ট্রপতির সার্বণিক নিরাপত্তার জন্য সেই এক ব্রিগেড সৈন্যের এক বা দুই ব্যাটালিয়ন স্থায়ীভাবে তখন গণভবনের আশপাশে ছিল। তুমি তো জানো না, এখন আমার সব কথার সমালোচনা হয়। বিশেষ করে তাও আবার হয় তোমার নাম ভাঙিয়ে যারা রাজনীতি করে, সুযোগ-সুবিধার হালুয়া-রুটি খায়, তারাই বড় বেশি করে। এই যে কর্নেল জামিল সম্পর্কে দু’কথা বলছি, এ জন্য কত গালাগাল শুনতে হবে। কারণ এখন তোমার পরিবার-পরিজন আর তথাকথিত অনুগতরা কর্নেল জামিলকেই একমাত্র তোমার প্রেমিক ভাবে। আমরা সেখানে নাকের পশম। 
আমি জেনারেল সফিউল্লাহকে যে কারণে সম্মান করতে পারি না, ঠিক একই কারণে কর্নেল জামিলকেও খুব বড় বলে স্বীকার করতে পারি না। কর্নেল জামিলকে ডিজিএফআইয়ের দায়িত্ব দিয়ে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করা হয়েছিল। সঠিক বলতে পারব না, তুমি যেদিন মারা যাও তার আগের দিন তাকে র‌্যাংক পরানো হয়েছিল, নাকি যে দিন তোমাকে খুন করেছে সে দিন পরানো হয়েছে। তোমার ও তোমার সরকারের নিরাপত্তার জন্য কর্নেল বলো আর ব্রিগেডিয়ার বলো, তাকে এক ব্রিগেড সৈন্য দেয়া হলো। কত আধুনিক অস্ত্র ও সুযোগ-সুবিধা দেয়া হলো। এমনকি তিনখানা বোমারু হেলিকপ্টার তার অধীনে রাখা হলো, যার একটা গণভবনেই ছিল। তারপরও তোমার ফোন পেয়ে লাল হাফ শার্ট গায়ে নিজের সার্ভিস রিভলবারটি পর্যন্ত না নিয়ে দুই দরজার লাল গাড়িতে এসে সাধারণ সৈনিকের গুলিতে নিহত হয়ে গাড়ির মধ্যে পড়ে থেকে তিনি কী দায়িত্ব পালন করলেন, জাতির তেমন কী কাজে লাগল যে তোমার পরিবারের শহীদ সদস্যদের পাশে তার ছবি টাঙাতে হবে? আর আনুষ্ঠানিক কোনো দায়িত্ব না থাকলেও তোমার হত্যার প্রতিবাদ করে ১৬ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে, ২৮ বছর মাংস না খেয়ে, সময়মতো বিয়ে না করে যৌবন ঝরিয়ে কী এমন অপরাধ করলাম যে, তোমার সাথে আমার যে দু-একটা ছবি ছিল তাও দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলা হলো? অস্ত্র জমা দেয়ার ছবি তোমার বাড়ি থেকে নামানো হয়েছে, জাদুঘর থেকে নামানো হয়েছে, অনেক অনেক সরকারি লাইব্রেরি থেকে খুলে ফেলা হয়েছে। তাহলে আজকাল কী দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে পুরস্কার আর পালন করলে তিরস্কার! আচ্ছা, তাকে যে অত সাজসরঞ্জাম দিয়ে সাজানো হলো, তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, সে জন্য সবাই জেগে রইল, আর যার নিরাপত্তার দায়িত্ব সেই ডিজিএফআই প্রধান ও সেনাপ্রধান প্রস্তুতিহীন নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমিয়ে রইলেন? হ্যাঁ, যদি এমন হতো তোমার টেলিফোন পেয়ে জার্মানি কিংবা ইসরাইলি বাহিনীর মতো সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই ষড়যন্ত্রকারীদের সব ষড়যন্ত্র বরবাদ করে তোমাকে উদ্ধার করতেন তাহলে নিশ্চয়ই আমি তাকে ধন্যবাদ দিতাম। তাকে ফিল্ড মার্শালে উন্নীত করলেও কম করা হতো। ঠিক তেমনি ডিজিএফআইর প্রধান ব্রিগেডিয়ার কিংবা কর্নেল জামিলের একটা ব্যাটালিয়ন কিংবা দুটো কোম্পানি আগে থেকেই প্রস্তুত থাকত। কলাবাগানের আশপাশে আসতেই খুনিদের তছনছ করে দিয়ে তোমাকে নিরাপদ করত, তাহলে সেটা হতো তার জন্য যোগ্যতা ও দতার পরিচয়। ওরকম না হলেও তোমার ফোন পেয়ে তিনি যেমন একা উড়ে এসেছিলেন, যেহেতু তার ওপর দায়িত্ব ছিল, দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্র তাকে সব কিছু দিয়েছিল। তিনি একটা ব্যাটালিয়ন নিয়ে সাথে সাথে বিদ্রোহী বা বিপথগামীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিশ্চিহ্ন করে দিতেন। ব্যাটালিয়ন না হোক, একটা কোম্পানি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন। নেহাত না হলেও একটা প্লাটুন নিয়ে তিনি যদি বিপথগামীদের মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দিতেন অথবা তছনছ করে দিতে না পারলেও মোকাবেলা করে শহীদ হতেন, আমি তাকে শ্রেষ্ঠ বীর বলতাম। তাকে শাশ্বত সাহসী বাঙালি বলতাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও দেশপ্রেমিক বলতাম। ১০ জন সৈন্য নিয়ে অমন করলেও আমি তাকে নতজানু হয়ে সম্মান জানাতাম। কিন্তু যেভাবে অস্ত্রহীন এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এতিমের মতো গুলি খেয়ে একজন সেনাপতির অপমৃত্যুকে আমি কোনোমতেই প্রশংসার চোখে দেখতে পারি না। সেখানে যদি আমি হতাম, আমাকেও না। কর্নেল জামিলকে তো সব সুযোগ-সুবিধাসহ এক ব্রিগেড সৈন্য দেয়া হয়েছিল। ওই দায়িত্ব যদি মাত্র এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য দিয়ে আমাকে দেয়া হতো, আমি যদি ব্রিগেডিয়ার জামিলের মতো নাদানের কাজ করতাম, তাহলে কি আমার ছবি ওভাবে তোলা হতো? এত কিছু করেও যেখানে আওয়ামী ঘরানার গালি ছাড়া কিছু পেলাম না, অমন ব্যর্থ হলে আমার কী দশা হতো? 
আমি তো ভালো করেই জানি, আওয়ামী বীরেরা ঝড়-তুফান-দুর্যোগে লেজ গুটিয়ে ইঁদুরের গর্তে লুকালেও শান্তির সময়, নিরাপদ সময় সিংহের সাথেও পাঞ্জা লড়ার চেষ্টা করে এবং বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকানোর সাহস দেখায়। তাই অমন ব্যর্থ যদি হতাম আমাকে তারা পায়ে পিষে মেরে ফেলত। তোমাকে বলছি, এ রকম অবিচারের মধ্যেই ইদানীং আছি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads