বুধবার, ৯ মে, ২০১২

সাংবাদিক নির্যাতন, হামলা-মামলা চলছেই : সত্যের প্রকাশ ঠেকানো যাবে না



গণতান্ত্রিক সমাজে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা কেউই অস্বীকার করে না। সাংবাদিকরা রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ঘটনা, সমস্যার কথা তুলে ধরে সবার সামনে। সমাজের প্রভাবশালী বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা প্রায় ক্ষেত্রে নিজেদের অপকর্ম প্রকাশ হয়ে পড়ায় সাংবাদিকদের চক্ষুশূল মনে করে। পেশাগত দায়িত্ব পালনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে তারা। সত্য প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের কোনো সরকারই এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না। তবে বরাবরের মতো আওয়ামী লীগ সরকার সাংবাদিক নির্যাতনে অন্যদের চেয়ে একটু এগিয়েই থাকে। বর্তমান সরকারও ব্যতিক্রম নয়।
গত কয়েক বছরে ১৫ জনেরও বেশি সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। আহত হওয়ার সংখ্যা বলে শেষ করা যাবে না। এক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশও হাত পাকিয়েছে ভালোই। তারাও সরকারের মন জোগাতে এবং নিজেদের অপকর্ম ঢেকে রাখতে সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের একহাত দেখাতে ছাড়ে না। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্তে এতদিনেও বিন্দুমাত্র অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। ফলে সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ ও কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পরও পরিস্থিতি উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলা বিএনপি নেতা মারা যাওয়ার প্রতিবাদে ডাকা হরতাল চলাকালে সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের হামলার ছবি তোলা ও খবর সংগ্রহের সময় ৭ সাংবাদিক আক্রান্ত হয়। পুলিশ বেষ্টনীর মধ্যেই সাংবাদিকরা আক্রান্ত হলেও কেউ তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। হামলাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয়ই এর কারণ। অন্যদিকে কক্সবাজার মডেল থানার পাশেই একটি স্থানীয় দৈনিকের অফিসে হামলা করে সম্পাদকসহ দু’জনকে গুরুতরভাবে আহত করেছে সন্ত্রাসীরা। ওসির ঘুষ-দুর্নীতি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতির খবর প্রকাশের জের ধরেই এই হামলা হয়েছে বলে সবার ধারণা। উভয় ঘটনায় হামলা-মামলা হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আবার লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় বিরোধী দলের বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় পুলিশি অ্যাকশনের ছবি তোলা ও খবর প্রকাশের কারণে পুলিশের মামলায় সাংবাদিকদেরও জড়ানো হয়েছে। থানার জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা দম্ভভরে ‘বিএনপি আর সাংবাদিকদের শিক্ষা দিয়েই ছাড়া হবে’ বলে হুমকিও দিয়েছেন। তার এই ক্ষমতার উত্স বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। ওদিকে রাস্তা বন্ধ করে শ্রমমন্ত্রীর জনসভার খবর প্রকাশের জন্য ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতার হাতে স্থানীয় প্রতিনিধি লাঞ্ছিত হওয়ার পর একই কারণে পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছে জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। ওই সংবাদের কারণে শ্রমমন্ত্রীর ৩ কোটি ও শ্রমিক লীগ নেতার ৫ লাখ টাকার মানহানি হয়েছে—এমন অভিযোগের মামলাটি গ্রহণ করতে একটুও দেরি হয়নি। এসব ঘটনা থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, মন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতা-পাতিনেতাদের মতোই পুলিশের মুখচেনা সদস্যরাও কীভাবে সাংবাদিক নির্যাতনে মেতে উঠেছে।
দেশে এখন পত্রিকার সংখ্যা ও পাঠক যেমন বেড়েছে, তেমনি টিভি ও রেডিও চ্যানেলের সংখ্যা ও দর্শক-শ্রোতাও বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যাও। সংবাদ মাধ্যমের গুরুত্ব ও প্রভাবও এখন আর কেউ অস্বীকার করতে পারে না। তারপরও এই পেশার লোকজনের ওপর হামলা-মামলার শেষ নেই। এর কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না। সত্য প্রকাশে যাদের আপত্তি, তারাই সবসময় সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার আর পেশিশক্তির সাহায্যে নিজেদের দুর্নীতি-লুটপাট অব্যাহত রাখতে সব অপকর্ম ঢাকা দিতে চায়। এটা গণতন্ত্র নয়, জঙ্গলের রাজত্ব, ফ্যাসিস্ট রাজত্বের লক্ষণ। এক্ষেত্রে একশ্রেণীর সংবাদ মাধ্যমও অপকর্ম এড়িয়ে যেতে, ধামাচাপা দিতে চায় বা কায়দা কৌশলে সেসবকে ভালো বলে তুলে ধরতে চায়। এমন কদমবুসি ভূমিকার কারণে সরকার ও সরকারি দলের লোকদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কার্যকর কিছু হচ্ছে না। তবে মনে রাখা দরকার, যারা আজ ক্ষমতাসীনদের খারাপ কাজের সমালোচনা করার কারণে নির্যাতিত হচ্ছেন, নির্যাতনের ধারা অব্যাহত থাকলে এক সময় কদমবুসি সাংবাদিকরাও এর শিকার হবেন।
আমরা গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থেই সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাই, নিন্দা জানাই। যারা এই নির্যাতনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন তাদের বোঝা উচিত, আজকের বাস্তবতায় হামলা-মামলা করে সাংবাদিকদের সত্য প্রকাশ থেকে দূরে রাখা যাবে না। সে চেষ্টা ব্যর্থ হবেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads