মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১২

দমননীতি নির্ভরতা গুম আতঙ্ক ও জনবিক্ষোভ


দমননীতি নির্ভরতা

গুম আতঙ্ক ও জনবিক্ষোভ


॥ সাদেক খান ॥

জলাতঙ্কের মতোই প্রাণভয়ের ‘মহামারী’ এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই হরতাল নিয়ে সরকার প যত কথাই বলুক না কেন, অরাজক পরিস্থিতি নাগরিক অব্যবস্থার নিত্যনৈমিত্তিক কষ্টের ওপর আরো কষ্ট স্বীকার করে শহরবাসী দু-চার দিন বিরতি দিয়ে একটানা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে স্বেচ্ছায়ই শামিল হচ্ছে বলতে হবে। পিকেটিং নেই বললে চলে, রাজপথ দখলে রাখছে পুলিশের টহল আর সরকার পরে দলীয় বাহিনীগুলোর হরতালবিরোধী মিছিল। হরতালের পে মিছিল বেরোলেই পুলিশের ব্যারিকেড টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ আর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রলীগের ‘লাঠি-বৈঠা’ হামলা। তবু হরতাল হচ্ছে। বিএনপি হরতাল ডাকছে, ১৮ দলীয় জোটের শরিকরা সমর্থন জোগাচ্ছে। হরতালের সময় নগরে বন্দরে মফস্বল শহরে লোক চলাচলে বিভ্রাট কিংবা দূরপাল্লার যাত্রী দুর্ভোগ অসহনীয় হয়ে উঠছে। দৈনন্দিন কাজগুলো লোকে সন্ধ্যায় মেটাচ্ছে, ছুটির দিনে কাজ করছে। যারা দিন আনে দিন খায় তাদের কাজ জুটছে না, আহারও জুটছে না। সন্ধ্যায় কিছু কাজ করে যা পাওয়া যায় তা নিয়ে চলতে হচ্ছে। তবুও হরতাল হচ্ছে কারণ প্রাণভয় ুধার তাড়নার চেয়েও বেশি অস্থির করে তুলেছে সর্বশ্রেণীর মানুষকে।
জাতিরাষ্ট্রের দায়বদ্ধ সমাজজীবনে প্রশাসন, আদালত, সাংবিধানিক প্রক্রিয়া, বহুদলীয় রাজনীতি, পুঁজিবাজার-ব্যাংক বীমা, মুদ্রাব্যবস্থা, শিল্প-বাণিজ্যব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থা ও সর্বোপরি জননিরাপত্তা ইত্যাকার যেসব শৃঙ্খলা দেশবাসীকে নাগরিক আস্থা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার মেলবন্ধনে আবদ্ধ রেখেছিল, সেই বন্ধন এখন টুটে যাওয়ার উপক্রম ঘটেছে। একই সাথে ঐতিহাসিক বিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূরাজনৈতিক ও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার নানা টানাপড়েনের মধ্যেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে যে স্বাজাত্যাভিমানকে এ দেশবাসী সযতেœ ধরে রেখেছিল, তার মনোবলের তন্ত্রে কিছুর মূলে কুঠারাঘাত ঘটছে অবিরত। রাষ্ট্রঘাতী দেশজ মীরজাফর চক্র আর বহিঃশক্তির সশস্ত্র গুপ্তচর দল মিলে গুম-খুন আর দুর্ধর্ষ অপরাধী তৎপরতার বিভীষিকা সৃষ্টি করেছে। তার রাজনৈতিক উত্তাপের সাথে নিত্যব্যবহৃত পণ্যের অগ্নিমূল্য, বাড়ি-গাড়ির ভাড়া বৃদ্ধির উৎপাত, বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সেচ বন্ধ, পানির কল বন্ধ, পাখা বন্ধের যন্ত্রণা আর গ্রীষ্মের উত্তাপ মিলে জনজীবন দুর্বিষহ।
এসবেরই যোগফল হরতালের নীরব প্রতিবাদ। অপহৃত রাজনৈতিক নেতা ইলিয়াস আলী তার উপল, তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের জন্য রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দুও বটে। অন্য দিকে সরকার পওে দোষারোপ আর বিভ্রম সৃষ্টির নানা চাল সমানে চালা হচ্ছে। তাই সন্ধানী সাংবাদিকতা কিংবা নিছক গুজব থেকে যে রহস্যের ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সরকারেরই চোখের জ্বালা বাড়ছে। প্রথম থেকেই বিরোধী জোট সন্দিগ্ধ যে সরকারের কোনো সংস্থা ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য’ পাকড়াও করে ওই নেতাকে নিয়ে গেছে; এরপর কাগজে জবরদস্তি সই করিয়ে হয় আদালতে মামলা দেবে, না হয় ‘ক্রসফায়ারে’ দেবে, এটাই ছিল প্ল্যান। বিরোধী দলনেতা বেগম খালেদা জিয়া তাৎণিকভাবে ঘোষণা দিয়ে ইলিয়াসকে সরকারি সংস্থা নিয়ে গেছে বলে তাকে ফেরত দিতে হবে দাবি তোলায় এবং ২২ এপ্রিল হরতালের ডাক দেয়ায় মতাসীনদের হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী এখনো আশায় বুক বেঁধে বসে আছেন যে তার স্বামীকে জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে। সংবাদ সম্মেলন করে ৩০ এপ্রিল তাহসিনা রুশদী আলী নিবেদন করেছেন : ‘আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে মিনতি করে বলছি, দয়া করে আপনার সাথে দেখা করার জন্য একটু সময় ও সুযোগ দিন। যেকোনো মূল্যে ইলিয়াস আলীকে উদ্ধার করে দিন। সংবাদপত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের কথা জানছি। যদি কোনো শর্তও থাকে, তা আমাদের জানানো হোক। যেকোনো শর্তে আমরা তাকে জীবিত অবস্থায় ফিরে পেতে চাই। অর্থ, সম্পদ, মতা কোনো কিছুই আমরা চাই না। ইলিয়াস আলীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে। তাতে আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই। যদি কোনো বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আটক করা হয়ে থাকে, তাহলে অন্তত আমাদের জানানো হোক ইলিয়াস আলী জীবিত আছেন, তিনি কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন। একজন নাগরিক হিসেবে অন্তত এটুকু দাবি করা কোনো অন্যায় চাওয়া নয়।’ প্রধানমন্ত্রী তাহসিনা রুশদী আলীকে সাাৎদান করেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন ২ মে সন্ধ্যায়। তাতে গুমট পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি।
আদপে জীবিত বা মৃত ইলিয়াস আলীকে প্রত্যর্পণের দায় ক্রমেই সরাসরি সরকারের ওপর বর্তাচ্ছে, কারণ সন্ধানী সাংবাদিকতা পুলিশের মধ্যেই একজন প্রত্যদর্শীর সন্ধান পেয়েছে। ২৬ এপ্রিল একটি বহুল প্রচারিত সুলভ দৈনিকে সাঈদুর রহমান রিমনের রিপোর্টে প্রকাশ : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অপহরণকালে সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তা ধস্তাধস্তির আওয়াজে ঘটনাস্থলে হাজির হন। তিনি ছিনতাইকারী ভেবে অপহরণকারীদের একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরেন এবং নিয়মমাফিক কৌশলগত হুমকি দিয়ে বলেন, ‘কেউ লড়বে না, গুলি করে দেবো কিন্তু।’ এ সময় ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত একজন মাইক্রোবাসের সাইডে এগিয়ে এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে নিজেদের একটি বিশেষ বাহিনীর লোক বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, আমরা অভিযান চালাচ্ছি; বাধার সৃষ্টি করবেন না, সরে দাঁড়ান। পুলিশ কর্মকর্তা মাইক্রোবাসের ভেতরে ওই বাহিনীর কিছু নমুনা দেখতে পেয়ে কথিত অভিযান পরিচালনাকারীর শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যান। মাইক্রোবাসের লোকটি এবার এসে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘সরে যেতে বললাম, এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।’ এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা জোর কদমে হেঁটে রাস্তাটির দণি পাশের জলখাবার হোটেলের সামনে রাখা মোটরসাইকেলটি নিয়ে তার কর্মস্থল গুলশান থানায় পৌঁছে যান। তার অফিসার ইনচার্জ ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের কাছে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। অফিসার ইনচার্জ বিভিন্ন জায়গায় টেলিফোনে আলাপ করে ওই সাব-ইন্সপেক্টরকে এ বিষয়ে আর মুখ খুলতে নিষেধ করে দেন। তাকে সাবধানে চলাফেরারও পরামর্শ দেন। প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা তার অফিসার ইনচার্জের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় আরো জানান, তাকে যখন ধমক দিয়ে সরানো হচ্ছিল তখন গাড়ির ভেতর থেকে ধস্তাধস্তি ও ধমকাধমকির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এ সময় পাশের একটি ভবনের আড়াল থেকে একজন মোবাইল ফোনে পুরো ঘটনাটি ভিডিও করছিলেন। সেখানে মোবাইল স্ক্রিনের আলো তিনি যেমন দেখতে পেয়েছেন, তেমনি অপহরণকারীদেরও একজন খেয়াল করছিলেন। মোবাইলে ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তিকে ওই পুলিশ প্রত্যদর্শী পরে খোঁজ করে কোনো হদিস পাননি। ঘটনার পর পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদপত্রে ইলিয়াস আলীকে অপহরণ করার বৃত্তান্ত জেনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ আরেক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘ইলিয়াস আলীর অপহরণ ও গুমের ঘটনায়’ কোনো রকম তথ্যসূত্র-প্রমাণাদি রাখতে চাননি অপহরণকারীরা। এ কারণে তার গাড়িচালককেও জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এভিডেন্স (স্যাপ্রমাণ) হিসেবে ছিলেন শুধু ওই পুলিশ কর্মকর্তা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রায় সম্পৃক্ত থাকা প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘অপহরণকারীরা’ অবিশ্বাস করেননি। সহকর্মী পুলিশ কর্মকর্তার ধারণা, ইলিয়াস আলীর অপহরণ বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলার পর দ্বিতীয় এভিডেন্স হিসেবে প্রত্যদর্শী কর্মকর্তা নিজের জীবন নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রত্যদর্শী পুলিশ কর্মকর্তা যে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন, তার সাবুদ পাওয়া গেছে মহাখালী মোড়ের পেট্রলপাম্পসংলগ্ন জলখাবার হোটেল থেকে। ওই হোটেলের একজন কর্মী জানান, ওই রাতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলযোগে মহাখালীর অদূরে ডিউটি দিচ্ছিলেন। থানায় ফেরার আগে তিনি রাস্তায় মোটরসাইকেলটি থামিয়ে নাস্তা খাওয়ার জন্য বসেন। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে দু’জন পথচারী এসে জানায়, রাস্তার মধ্যে ছিনতাই আর মারামারি হচ্ছে। এটুকু শুনেই ওই সাব-ইন্সপেক্টর সে দিকে ছুটে যান। তার পেছনে আরো এক-দু’জন এগিয়ে গেলেও তারা অজ্ঞাত আশঙ্কায় নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। 
অন্য দিকে তদন্তের নামে র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতা এখনো চলছে প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ইশরায় তথা নিখোঁজ ইলিয়াস বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার কিনা কিংবা ‘বিরোধী দলনেতার নির্দেশে (ইলিয়াস আলী নিজেই) লুকিয়ে আছে কিনা’, তার সম্ভাব্য সূত্র আবিষ্কারে, ইলিয়াস উদ্ধারে নয়। সহজ ভাষায় বলা যায়, বানোয়াট একটা ‘কেস’ সাজানোর জন্য নানা ধরনের আলামত সংগ্রহ হচ্ছে, ইলিয়াসকে খোঁজা হচ্ছে না। মূলত ‘দমনমূলক’ মতলবের কারণে তদন্ত বিভ্রাটের চিত্রটি ফুটে উঠেছে ২৭ এপ্রিল সিলেট থেকে প্রদত্ত একটি খবরে : লন্ডন থেকে ইলিয়াস আলীর সন্ধানদাতাকে এক কোটি টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর বিএনপি অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম, যুক্তরাজ্য। অন্য দিকে সরকারবিরোধী কঠোর অবস্থান, টিপাইমুখ বাঁধ ও সীমান্ত ইস্যুতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ইলিয়াস আলী প্রতিপরে দ্বারা ‘গুম’ হয়েছেন বলে একটা প্রচার পুলিশি মহল থেকেই ছড়াচ্ছে। সরকারের তদন্ত দল সিলেট বিএনপিতে সম্ভাব্য ‘অভ্যন্তরীণ কোন্দল’-এর সন্ধান করছে। বিএনপির একাধিক নেতাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, কয়েকজনকে কঠোর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল ইলিয়াসকে পাওয়া গেছে বলে রাতভর বিভাগজুড়ে ‘খবর’ ছড়িয়ে পড়ে। এ কথা রটে যে, ইলিয়াস আলীকে জীবিত অথবা মৃত মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক এমপি এম নাসের রহমানের বাড়িতে নিয়ে এসে তাকে ফাঁসানো হবে। তাতে উত্তেজিত নেতাকর্মীরা নাসের রহমানের বাগানবাড়িতে সারা রাত অবস্থান নিয়ে চার দিকে পাহারা বসায়। এভাবে চলছে তদন্তের দোহাই দিয়ে রটনার ধূম্রজাল রচনা। শ্রীমঙ্গলের ১৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার (সিও) সাংবাদিকদের জেরায় বলেন, ইলিয়াস আলীর ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবির কোনো অভিযান নেই; তবে অন্য কোনো সংস্থা ধলাই সীমান্ত এলাকার চা বাগানে অভিযান চালাতে পারে। মাধবপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য ছাদিক আলী বলেন, অভিযানের খবর পেয়ে শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানে শ্রমিকেরা সারা রাত জেগে পাহারা দিয়েছে। সিলেটে ইলিয়াস আলীর নিজের উপজেলা বিশ্বনাথে বিজিবি মোতায়েন হয়েছে। বিশ্বনাথ থানা ঘেরাও ভাংচুর ও পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর পর স্থানীয় থানায় বিএনপি-জামায়াতের ১৪ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করা হয়। নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িচালক মো: ইসলাম উদ্দিন বাদি হয়ে গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় বিএনপির আরো তিন হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ নিয়ে শুধু বিশ্বনাথ উপজেলায় ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবির আন্দোলনরত ১৭ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হলো। গ্রেফতার আতঙ্কে বিশ্বনাথের ১৫-১৬ গ্রাম এখনো পুরুষশূন্য। সিলেট নগরীসহ বিভাগের আরো কয়েকটি উপজেলায় সংঘর্ষের ঘটনায় বিএনপির আরো কয়েক হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ফলে ওই সব এলাকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিএনপি নেতা এখন ফেরার, তল্লাশিতে তছনছ হচ্ছে তাদের বাড়িঘর। 
এ দিকে ঢাকায় ২২-২৩-২৪ এপ্রিল সকাল-সন্ধ্যা হরতালের পর ২৯-৩০ এপ্রিল দ্বিতীয় দফা সকাল-সন্ধ্যা জোড়-হরতালের প্রথম দিন নয়াপল্টনে সকাল থেকেই বিএনপির কার্যালয় ঘিরে রাখে পুলিশ। ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে দলীয় কার্যালয়ে আসেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিকেল অবধি দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে-বাইরে কিছু কেন্দ্রীয় নেতা অবস্থান নিতে পারলেও কোনো কর্মীকে ভেতরে যেতে দেয়া হয়নি। পুলিশের আচরণে ােভ প্রকাশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, সরকার দেশটাকে কারাগারে পরিণত করেছে। ওই সময় বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে সচিবালয়ের ভেতরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়াল ঘেঁষে ভেতরে-বাইরে দু’টি ককটেলের বিস্ফোরণ হয়েছে। কেউ হতাহত না হলেও একজন আনসার কর্মকর্তার গাড়ি তিগ্রস্ত হয়েছে। সচিবালয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এ ঘটনার জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করেন। আর পুলিশ কর্তৃপ প্রধান হুকুমের আসামি সাব্যস্ত করে ওই ঘটনার জন্য সে সময়ে ঘটনাস্থল থেকে বহু দূরে দলীয় কার্যালয়ে পুলিশের অবরোধেই আটকে থাকা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বিএনপি পরিচালিত জোটের আরো অনেক প্রথম সারির নেতার বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বর্তমান সংসদ সদস্য। দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাসায় বাসায় পুলিশের হানা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল থেকেই বিরোধী জোটের নেতারা ‘আন্দোলনের কৌশলগত প্রয়োজনে’ ফেরার থাকছেন। একজনের আগাম জামিন হয়েছে। অন্যদের কৌঁসুলিরা ছয় দিন ধরে তাদের আগাম জামিনের জন্য চেম্বার জজ থেকে শুরু করে আদালতের বেঞ্চে বেঞ্চে নিষ্ফল ঘুরেছেন। অবশেষে হাইকোর্টের চার দিকে কড়া গোয়েন্দা পুলিশের পাহারা এড়িয়ে যারা আদালতে ঢুকতে পেরেছেন, তাদের নিম্ন আদালতে মামলা না ওঠা পর্যন্ত এক রকম ছাড় দেয়া হয়েছে। হরতালে নিরাপত্তার নামে ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ১০ প্লাটুন সদস্য নামানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও ৩০ এপ্রিল হরতাল-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মে দিবসের পরদিন সারা দেশে বিােভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি ও ১৭ সহযোগী দল। পরবর্তী কর্মসপ্তাহে ৬ মে আবারো কঠোরতর কর্মসূচি ঘোষিত হবে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়। সেই কর্মসূচির ঘোষণাও এসেছে। আবারো তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ইলিয়াস আলীর উদ্ধার আর ১৮ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে নাশকতার সাজানো মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ৯ মে সারা দেশে বিােভ মিছিল ও সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। সরকার সাড়া না দিলে ৯ মে রাজধানীতে সমাবেশ বা সংবাদ সম্মেলন থেকে এক দফা তথা সরকার পতনের ডাক আসতে পারে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে।
সচিবালয়ে বোমা হামলার ঘটনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামি করার তীব্র সমালোচনা করে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেছেন, ‘সচিবালয়ে নিñিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে কিভাবে বোমা হামলা হলো? আমি নির্দ্বিধায় বলতে চাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউ এটি ঘটিয়ে নাটক করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এই নাটক করছেন। ইলিয়াস আলীকে ফিরিয়ে দিন, নাটক করবেন না। নাটক করে মতায় টিকে থাকতে পারবেন না।’ তাকে ব্যঙ্গ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, এক মামলাতেই বিএনপির সব আন্দোলন চুপসে গেছে! 
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, গুম কালচার, ক্রসফায়ার ও গুপ্তহত্যার প্রশ্নে সরকারের জবাব চেয়ে মার্কিন মহলসহ বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার বিভিন্ন মুখপাত্র উদ্বেগ ব্যক্ত করে চলেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্বেগতাড়িত হয়ে বৈদেশিক কংগ্রেসম্যান সিনেটর এমপি মন্ত্রী বা দূতাবাস মুখপাত্র বাংলাদেশে হাল আমলের গুম-লাশের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকেই কঠোর ভাষায় বিরূপ মন্তব্য করেছেন। সম্ভবত তাদের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কূটনৈতিক সংলাপ ও সৌজন্যের বেষ্টনী অতিক্রম করবে না। কিন্তু বিশ্ববিবেকের কাছে আর্জি পেশ করে অনলাইনে এবং মানবাধিকারের প্রহরী বিশ্ব সংস্থাগুলোতে যে ধিক্কারের আওয়াজ উঠেছে, তার বজ্রনিনাদ সহজে নিরস্ত হওয়ার নয়। বাংলাদেশে একের পর এক বিরোধী নেতাকর্মী নিখোঁজ ও গুম হওয়ার ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপে তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। ২৭ এপ্রিল প্রচারিত তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয় (সারসংপে) : ‘বিনা কারণে বাংলাদেশের বিরোধী নেতাকর্মীরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের কোনো হদিস না পাওয়ার মতো ঘটনা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ নিখোঁজ সব নেতাকর্মীকে খুঁজে বের করতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। হাসিনা সরকার বারবার দেশে অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেও দেশটিতে গুম, খুন, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু এবং রহস্যজনক নিখোঁজের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এসব ঘটনার স্বাধীন ও নিরপে তদন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।’
এর আগে গত ৪ এপ্রিল শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার ঘটনায়ও (পরে তার তবিত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়) উদ্বেগ জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বিরোধী দলের হরতালের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘অত্যধিক শক্তিপ্রয়োগের’ ঘটনাতেও উদ্বোগ প্রকাশ করেছে এবং ২১ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে দু’জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওই সংস্থা। সরকার নির্বিকার। সর্বশেষ ৫-৬ মে ঢাকা সফর করে গেছেন একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিলারি কিনটন। হরতালের চক্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ‘হিলারি-বিরতি’ দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট। বাংলাদেশ-মার্কিন বৈঠকি আলোচনার পর সংবাদ সম্মেলনে হিলারি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়া ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে কথা হয়েছে। এ ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্তের জন্য অনুরোধ জানিয়েছি।’ হিলারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলনেতা খালেদা জিয়া উভয়ের সাথে সাাৎ করেছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের মাধ্যমে মতপার্থক্য দূর করার তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সরকার পরে সংলাপ প্রস্তুতির কোনো লণ নেই।
বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মী ধরপাকড় করেই আন্দোলন ঠাণ্ডা করা যাবে ভাবছে মতাসীনরা। কিন্তু মিসরের তাহরির স্কোয়ারের মতো ঢাকার বুকে গরহাজির নেতৃত্বের অস্ফুট কণ্ঠের ডাক শুনতে না পেয়েও যে জনরোষ অত্যাচারী আত্মসেবী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে পারে, এ কথা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছে।
লেখক : বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads