শুক্রবার, ৪ মে, ২০১২

চাপের মুখে সরকার



কূটনৈতিক অংশীদার এবং উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে তীব্র চাপের মুখে সরকার। গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি, মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অস্বচ্ছতা আর গুম, খুন ও শ্বাসরুদ্ধকর আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ তীব্র ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকে দেশ তাদের কূটনৈতিক মিশনের সদস্য ও নাগরিকদের বাংলাদেশ সফরের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। অন্য দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণে এ শঙ্কা আরো বেড়ে গেছে। প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদার কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক অস্থিরতাকে সামনে রেখে প্রক্রিয়াধীন চুক্তি ও সমঝোতা দ্রুত করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এ অবস্থায় পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারছে না সরকার। দ্রুত অকার্যকর সরকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে সুশীলসমাজসহ বিভিন্ন মহলে। 
সুখকর হয়নি জাপানি উপপ্রধানমন্ত্রীর সফর : একদা বাংলাদেশের বৃহত্তম সাহায্যদাতা দেশ জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদার ঢাকা সফর সরকারের জন্য খুব একটা সুখকর হয়নি। বিশ্বব্যাংককে বাদ দিয়ে সরকার নিজে সমন্বয়কারী হিসেবে পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে জাপানের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাওয়ার অঙ্গীকার আশা করেছিল ঢাকা। কিন্তু জাপানের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বলে দেয়া হয় যে, বিশ্বব্যাংকের সাথে ঝামেলা নিষ্পত্তি না হলে জাপানের এ ক্ষেত্রে এগোনোর সুযোগ নেই।
জানা গেছে, আগ্রাসী বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে বিনিয়োগের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেননি; বরং আগে গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কট সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে এক সময় জাপানি নতুন ও রিকন্ডিশন্ড গাড়ির বড় বাজার ছিল। ভারতীয় গাড়ির বাজার সৃষ্টির সুযোগ করে দিতে কয়েক বছর ধরে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানির শর্ত কঠোর থেকে কঠোরতর করা হচ্ছে। বিষয়টি জাপান প্রকাশ্যে না আনলেও সরকারের কাছে অসন্তুষ্টির বার্তা পৌঁছে দিয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষত ও বিশ্বব্যাংকের নেটওয়ার্ক : গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে পররাষ্ট্র সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক ও এর সহযোগী সব প্রতিষ্ঠানের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যাংক থেকে অসম্মানজনকভাবে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ুদ্রঋণের মডেল ও দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখার জন্য আলোচিত গ্রামীণ ব্যাংককে স্বাভাবিকভাবে চলতে না দিয়ে এর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে বিুব্ধ হয় অনেক দেশ ও সংস্থা। উন্নয়ন সহযোগীদের সমন্বয়কারী হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিস আগেই গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে দারিদ্র্য বিমোচনে নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠানকে নিজের মতো করে চলতে দিতে হবে বলে জানায়। এরপরও সরকার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে তৎপরতার ধারা অব্যাহত রাখে। এমনকি গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে কমিশন গঠন করে গ্রামীণফোনে গ্রামীণ টেলিকমের যে শেয়ার রয়েছে, সেটিকে গ্রামীণ ব্যাংকের ইকুইটি শেয়ারে পরিণত করার জন্য কাজ শুরু করে। বিষয়টি ুব্ধ করে বিশ্বব্যাংককে। ব্যাংকের আপত্তির মুখে গ্রামীণ কমিশন গঠনের কাজ প্রকাশ্যে বন্ধ থাকলেও গোপনীয়ভাবে এগিয়ে নেয়া হচ্ছেÑ এমন তথ্যে আরো ুব্ধ বিশ্বব্যাংক। এ ব্যাপারে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেলে বাংলাদেশে যেকোনো অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিতে পারে বিশ্বব্যাংক। এমনকি মিয়ানমারের মতো বাংলাদেশ থেকে বিশ্বব্যাংকের অফিস গুটিয়ে নেয়ার বিষয়ও বিবেচনা করা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। 
বিশ্বব্যাংকের যেকোনো পদক্ষেপের প্রভাব সহযোগী সংস্থা আইএমএফ, আইএফসি ও অন্য সংস্থার ওপর পড়তে পারে। প্রাপ্ত আভাস অনুযায়ী আইএমএফ প্রতিশ্রুত ঋণের প্রথম কিস্তি অবমুক্ত করলেও দ্বিতীয় কিস্তি কড়াকড়িভাবে শর্ত পূরণ ছাড়া অবমুক্ত করবে না। শর্ত নির্ধারণের সময় বিষয়টিকে মাথায় রাখা হয়ে থাকতে পারে বলে মত প্রকাশ করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্যভিত্তিক বাজারমূল্য নির্ধারণ, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি ও কৃষি ভর্তুকি কমানোর শর্ত পূরণ করা সরকারের জন্য বেশ কঠিন।
সবার এক সুর : ইআরডির একটি সূত্র জানিয়েছে, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সবাই প্রায় একই ভাষায় সুশাসন, দুর্নীতি বন্ধ ও আইনশৃঙ্খলার মতো সরকারের জন্য বিব্রতকর বিষয় নিয়ে কথা বলে। নতুন অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক অর্থপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বিদেশী অর্থায়নের বিষয়টি প্রকল্প অর্থায়নে প্রদর্শন করা হলেও বাস্তবে এর কম অংশই অবমুক্ত হবে। বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশী অর্থায়ন না হওয়ায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিকে কাটছাঁট করতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। 
তবু চাপ প্রতিবেশীদের : প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রভাবশালী কূটনৈতিক অংশীদারদের কেউই এখন সরকারের প্রতি আস্থাবান নয়। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয় প্রতিবেশী ভারতের সাথে। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি আজ বাংলাদেশে আসছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শত জন্মবার্ষিকী পালনের যৌথ সমাপনী অনুষ্ঠানে। এ সময় তিনি দুই দেশের মধ্যকার বিভিন্ন ইস্যুর বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করবেন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার ব্যাপারে যৌথ ঘোষণাকে চুক্তিতে রূপান্তর করার জন্য কঠোরভাবে তাগিদ দেবেন বলে জানা গেছে। 
অন্য দিকে ট্রানজিট, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার, টিপাইমুখ বাঁধে অনাপত্তি চাওয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে কী ধরনের সম্পর্ক বাংলাদেশ বজায় রাখবে সে ব্যাপারেও নির্দেশনা দিতে চায় ভারত। এ নিয়ে সরকারকে বেশ কূটনৈতিক সঙ্কটে পড়তে হয় বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
পরিস্থিতির ওপর নজর চীনের : বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আমেরিকার কোম্পানিকে কাজ দেয়া এবং সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণকাজ চীনকে দেয়ার ব্যাপারে তীব্র আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির। একই সাথে প্রতিরক্ষা খাতে চীনের সাথে চলমান বিভিন্ন কন্ট্রাক্ট অব্যাহত না রাখার ব্যাপারেও রয়েছে চাপ। এ নিয়ে ঘোষিত-অঘোষিত নানা চাপের মধ্যে রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপ্রকাশ্য কূটনীতিতে বেশি অভ্যস্ত চীন পুরো পরিস্থিতির ওপর গভীরভাবে নজর রাখছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র উল্লেখ করেছে।
ুব্ধ যুক্তরাষ্ট্রও : ওয়ান-ইলেভেনের সরকার থেকে বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ ভূমিকা থাকলেও কাউন্টার টেরোরিজম ছাড়া অন্য ক্ষেত্রগুলোতে ঢাকার সহযোগিতায় ওয়াশিংটন সন্তুষ্ট নয় বলে জানা গেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনের দুই দিনের সফরে বাংলাদেশে আসার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু ছাড়াও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলবেন। বর্তমান সরকার সুশীলসমাজের তৎপরতা ও ভূমিকা রাখার সুযোগকে সীমিত করে ফেলার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে দেখেনি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য সমঝোতায় আসার তাগিদ দেয়া হয়েছিল বারবার। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো সাড়া না পাওয়ায় তারা হতাশ বলে জানা গেছে।
বিচারের স্বচ্ছতা নিয়েও অসন্তোষ : যুদ্ধাপরাধের বিচারকে সরকার সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় এ বিচার করা হচ্ছে তা নিয়ে অসন্তুষ্ট আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। প্রেসিডেন্ট ওবামার বিশেষ দূত র‌্যাপ বিচারকে স্বচ্ছ করতে অনেক সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছিলেন ঢাকাকে। ওয়াশিংটন আশা করেছিল দেশীয় আইনে যুদ্ধাপরাধের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার স্বচ্ছভাবে বাংলাদেশ করতে পারলে তা যুক্তরাষ্ট্রের আইসিসিতে স্বাক্ষর না করার ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা যাবে। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়া রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অস্বচ্ছ প্রমাণিত হওয়ায় একেবারে হতাশ যুক্তরাষ্ট্র। বিচারটির অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া মুসলিম দেশগুলোতে বাংলাদেশকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এ নিয়ে সৌদি আরবের প্রভাবশালী পত্রিকা সৌদি গেজেটে সম্পাদকীয় প্রকাশ হওয়ার পর রিয়াদ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি ঢাকার কাছে জানতে চেয়েছে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক তুরস্ক ও কাতার সফরকালেও এ নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। 
সঙ্কট মনে করছে না সরকারি পক্ষ : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র সরকারের ওপর চতুর্মুখী চাপের কথা স্বীকার করে। তবে তা নিয়ে সরকার উল্লেখ করার মতো সঙ্কটে পড়েছে বলে মনে করে না। সূত্র মতে, সরকারকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হয়। এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটন ও ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরকে নানাভাবে মূল্যায়ন করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ নয়া দিগন্তকে বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে। তাতে করে তারা ইমার্জিং চায়নাকে আটকে দিতে পারবে। তারা অন্তত পশ্চিম দিকটা ঘিরে ফেলতে চায়। এ ক্ষেত্রে ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল ও পাকিস্তানকে তাদের দরকার। 
তিনি বলেন, এখানে এমন একটা অক্ষশক্তি তৈরি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, যাতে ভারত ও বাংলাদেশ থাকবে। এখানে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বাংলাদেশকে তাদের পাশে রাখতে হবে। এ জন্য চীনও বাংলাদেশকে চায়। কারণ নেপালের সাথে তাদের সম্পর্ক ভালো। ভুটানকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না ঠিকই, তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশকে সাথে চায় চীন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে হিন্দু কম, খ্রিষ্টান বেশি। চীন ওই লাইনটি ধরে ভারতে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ চায়। নেপালকেও কাছে টানতে চায় দেশটি। 
ড. এমাজ বলেন, কৌশলগত রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে হিলারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এসব দেশ সফর করবেন। তাদের চেষ্টা থাকবে তিনটি শক্তিকে এক জায়গায় করা। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একটা অক্ষশক্তি তৈরি করতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে এখানকার কোনো একটা জায়গায় পা ফেলতে। সমুদ্র বিজয়ের যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে রাখা হয়েছে। হয়তো দেখা যাবে অদূর ভবিষ্যতে সেখানে যুক্তরাষ্ট্র পা ফেলছে। এখানে একটা ঘাঁটি বসিয়ে দিতে পারে তারা। 
তিনি বলেন, তারা টিফা চুক্তি থেকে সরে এসে এখন কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তির কথা বলছে। এ চুক্তি হয়তো এখনই হবে না। অদূর ভবিষ্যতে এ চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ সুসম্পর্ক চায়। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের কারণে আমাদের পদ্মা খালে পরিণত হয়েছে। টিপাইমুখ বাঁধ হলে সুরমা ও কুশিয়ারা খালে পরিণত হবে। মেঘনার তখন কী হবে? ভারত আন্তঃনদী সংযোগ করতে চাইছে। তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা কী হবে? বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে যদি পানি এক ফুট বাড়ে তাহলে ১৮ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে। আমরা যাযাবর জাতিতে পরিণত হবো। 
তিনি বলেন, ভারতীয় আমলারা চায় বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে নিতে, তাহলে চীনের সাথে যদি কখনো তাদের যুদ্ধ বাধে তাহলে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে অস্ত্র নিতে পারবে। সে জন্য তারা করিডোর চায়। একই কারণে এ করিডোরের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রও। 
ড. এমাজ বলেন, চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ করার কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে দক্ষিণ ও পূর্ব-এশিয়া হাইফেনে থাকলে (দক্ষিণ-পূর্ব) সবচেয়ে ভালো। এক দিকে ঝুঁকে পড়লে বিপদ। বিশেষ করে ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়লে ভয়ঙ্কর বিপদ। আমরা ভারতকে ভালো বন্ধু হিসেবে চাই, কিন্তু তাদের আজ্ঞাবহ হতে চাই না। এটা যদি হই তাহলে আমাদের সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। আমরা চাই ভারত আমাদের নদীগুলোকে জীবন্ত থাকতে দিক, তারা যেন আমাদের শুকিয়ে না মারে সেটা আমরা চাই। চীন গভীর সমুদ্রবন্দর বানাক, ভারত ট্রানজিট পাক কিন্তু আমাদের বাঁচতে দিতে হবে। আমাদের শুকিয়ে মারা যাবে না। আমরা যাযাবর জাতিতে পরিণত হতে চাই না। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. রমজুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, সরকারকে শক্তি অর্জন করতে হবে। জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। সরকার যদি মনে করে বিদেশীদের কথা না শুনলে, ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হবে, সে জন্য বিদেশীদের তোয়াজ করে চলতে হবে, তাহলে তা সঠিক ভাবনা নয়।
তিনি বলেন, কূটনীতি হলো ‘এক্সটেনশন অব ইন্টারনাল পলিসি’। দেশের ভেতরের নীতিই যদি ঠিক না থাকে, কেবল দলীয় লোকদের জন্য কাজ করেন, তাহলে তো দেশের বাইরে এর প্রভাব পড়বেই। কোনো সরকারই বাংলাদেশে সঠিক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়নি, চালাতে পারেনি। চালানোর মতো সক্ষমতা কিন্তু আমাদের আছে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে যাবেন বিশেষজ্ঞরা, না, তা না করে সরকার সেখানে পাঠান মন্ত্রীদের। তাহলে কি ভালো কোনো ফল আসবে? আসবে না। মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশ সরকার যে সমুদ্র বিজয়ের কথা বলছে! এটা কিসের বিজয়? এখানে কি মিয়ানমার হেরে গেছে? হারেনি। এখানে একটা ডিমারকেশন হয়েছে। ২০০৮ সালে কেয়ারটেকার সরকার ২৮টি ব্লক ঘোষণা করেছিল। কিন্তু আমরা সব ব্লক পাইনি। তাহলে কে জিতল? 
কেয়ারটেকার সরকার সে সময় উদ্যোগ নিয়েছিল বলেই ২০০৯ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারকে আরবিট্রেশনে যেতে হয়েছে। নইলে তারা যেত না। পয়েন্ট অব নো রিটার্ন বলে তারা এটা করেছে। 
তিনি বলেন, ভারত খুব চালাকি করেছে। আমরা তাদের সুযোগও দিচ্ছি। তাদের সাথে আরবিট্রেশন হবে ২০১৪ সালে। এ ফাঁকে ভারত একটা টোপ দেবে, বলবে চলো আলোচনা করে সমাধান করি। এ সমাধান আমাদের পক্ষে আনার মতো লোক কই। নেই তো। কাউকে দেখছি না। 
১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিই বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। গত বছর মনমোহনের সফরের সময় বলা হয় এবার সীমান্ত বিরোধ মিটে যাবে। চুক্তির বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা হয়নি। সামনেও হবে বলে মনে হয় না। তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিরোধিতা করায়, কেন্দ্রীয় সরকার তা করেনি। কেন করবে? তারা তাদের স্বার্থ দেখবে। তারা দেশপ্রেম নিয়ে চলে। আমাদের মতো সব উজাড় করে দেবে না। 
রমজুল হক বলেন, ভারত আমাদের কিছু দিলো না। আমরা তিতাস নদী ভরাট করে তাদের মালামাল নেয়ার ব্যবস্থা করলাম। এটা তো হতে পারে না। এটা যদি হয় আমাদের দেশপ্রেম, তাহলে তো আমাদের সমস্যায় পড়তে হবেই। ভারতকে বলতে হবে, আগে ভারত আমাদের তিস্তার পানি দিক, সীমান্ত সমস্যার সমাধান করুক তারপর দেখা যাবে আমরা তাদের কী দেবো না দেবো। 
তিনি বলেন, দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। সব সরকারই দুর্নীতিগ্রস্ত। পাজেরো গাড়ি ছাড়া সরকারের চলে না। এর তেলের টাকা কোত্থেকে আসে? সরকারের লোকদের এত টাকার উৎস কী। পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে কী হয়নি সরকার এটা তদন্ত করে আজও বলল না। এটা বলতে হবে। দেশে যত অনিময় হবে বিদেশে তত এর প্রভাব পড়বে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads