বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণ করা হয়েছে



বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত রাতে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে অতিমাত্রায় রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে বিরোধীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথকে সঙ্কুুচিত করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি একটি মারাত্মক সমস্যা। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সেলফ সেন্সর চলছেই। গুম, নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু, খেয়ালখুশিমত গ্রেফতার ও আটক রাখার জন্য দায়ী নিরাপত্তা বাহিনী। তারা মানবাধিকারের বড় সমস্যা। প্রতিবেদনের মুখবন্ধেই এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চরম সমালোচনা করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের খুবই উল্লেখযোগ্য মানবাধিকার সমস্যা হলো নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন ও হত্যা। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা সাংবাদিকদের হয়রানি করছে।
প্রতিবেদনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে বিস্তারিত প্রতিবেদনের সাতটি বিভাগে এদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।
বিচার বিভাগ : বিচার বিভাগ সম্পর্কে ওই রিপোর্টে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, আইনে আছে বিচারবিভাগ স্বাধীন। কিন্তু সংবিধানের দীর্ঘদিনের একটি অস্থায়ী বিধানের কারণে নির্বাহীরা নিম্ন আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা বিচার বিভাগের নিয়োগ দেন। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ দেন। আইনের মাধ্যমে ২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হয়েছে। বছরজুড়েই তা অব্যাহত ছিল। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ
থেকে আলাদা করা সত্ত্বেও উচ্চ আদালতে নিয়োগ দিয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর অনেক মামলায় তারা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেন। এতে সমস্যা বেড়েছে। বিরোধী দলের সদস্যদের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সঙ্কুচিত করা হয়েছে।
২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ১০ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। তাদের শপথ গ্রহণ হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন ওই সব বিচারককে অভিনন্দন জানানো থেকে বিরত থাকে। তারা বলেন, ওই নিয়োগ রাজনৈতিক। বছরজুড়ে প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের মাধ্যমে আগের সরকারের আমলের করা মামলা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে। সরকার বলছে, ওইসব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যেসব লোককে মামলা থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে তারা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ সম্পৃক্ত। এক্ষেত্রে অনেক অব্যাহতি দেয়ার ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে সুশীল সমাজে। সরকারি বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও বাইরে থেকে প্রভাব বিস্তার করা ছিল একটি সমস্যা।
নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা : নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশিরভাগ সদস্য সাধারণ ক্ষমার অধীনে কাজ করেন। এক্ষেত্রে র্যাবের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে সরকার সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়নি। সরকারি দুর্নীতি ও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সাধারণ ক্ষমা অব্যাহত রয়েছে। ওই রিপোর্টে নিখোঁজ হওয়া সম্পর্কে বলা হয়, পুরো বছরে যেসব নিখোঁজ ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অভিযোগ আছে তা ঘটিয়েছে বেশিরভাগই নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ২০১১ সাল জুড়ে তা বেড়ে যায়। কিন্তু এর সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। কমপক্ষে কতগুলো অপহরণ ঘটেছে রাজনৈতিক উদ্দেশে। কিছু অপহরণ ঘটেছে টাকার জন্য। আবার কিছু অপহরণ ঘটেছে স্থানীয় শত্রুতা থেকে।
মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অধিকার-এর মতে, নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত এমন অভিযোগ আছে ৩০টি নিখোঁজের ঘটনায়। ২০১০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৯। র্যাব বলছে, যেসব নিখোঁজের ঘটনায় তাদের দায়ী করা হচ্ছে, সেসব ঘটনা র্যাব বা পুলিশ সেজে অন্যরা ঘটিয়েছে। অধিকার উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ওই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি র্যাব ঢাকা শহরের উত্তর শাহজাহানপুর থেকে একজন ইমাম ও বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামকে আটক করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রফিকুলের জামাই পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন র্যাব অফিসাররা আটক করেছে রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কাভার্ডভ্যানে তুলে নিয়েছে। এ সময় র্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্ু্ত র্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়।
ওদিকে ২০১০ সালের জুনে র্যাব সদস্যরা ঢাকা সিটি কমিশনার চৌধুরী আলমকে আটক করে বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ২০১১ সাল শেষ হয়ে গেলেও জানা যায়নি চৌধুরী আলম কোথায় আছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রফিকুলের জামাতা পুলিশে গিয়ে অভিযোগ করেছেন র্যাব অফিসাররা আটক করেছে রফিকুলকে। তাকে জোর করে একটি কভার্ডভ্যানে তুলে নিয়েছে। এ সময় র্যাব সদস্যদের কেউ কেউ ছিলেন সাধারণ পোশাকে। কিন্তু র্যাব এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বছর শেষে রফিকুল কোথায় তা অজ্ঞাতই রয়ে যায়।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : ওই রিপোর্টে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বলা হয়, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অনেক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব এ সময়ে অপ্রত্যাশিত শক্তি ব্যবহার করেছে। র্যাবের খেয়ালখুশিমত কার্যক্রমের ঘটনা অনেক। এতে বলা হয়েছে, সংবিধান নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুর শাস্তি সংবিধান রহিত করলেও র্যাব ও পুলিশসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা ঘন ঘন নির্যাতন করত। মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করছে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের সময়। তারা এখন হুমকি দিচ্ছে, প্রহার করছে। এমনকি বৈদ্যুতিক শক দেয়। অধিকারের মতে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কমপক্ষে ৪৬ জনকে নির্যাতন করেছে। এর জন্য যারা দায়ী তাদের অভিযুক্ত বা শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিরল। র্যাব ও পুলিশ এমন ঘটনা ঘটালেও তাদের সাধারণ ক্ষমা দেয়া হয়। ওই রিপোর্টে বলা হয়, সংবিধান খেয়ালখুশিমত গ্রেফতার ও আটক রাখাকে রহিত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক অধিকার : মানবাধিকার রিপোর্টে ২০১১ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশদ বর্ণনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সংবিধানে জনগণের ভোটে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনে অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। গত বছর ৩০ জুন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সংবিধানে একটি সংশোধনী আনে। ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে বর্তমান সরকারের অধীনেই ২০১৩ সালের নির্বাচন হওয়ার কথা। ওই সংশোধনীতে স্বাধীন ইলেকশন কমিশন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে।
তারা বলছে, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা এখনও ভঙ্গুর। যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করার আশঙ্কা রয়েছে। গত বছরজুড়ে সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থানে আগামী নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের শীর্ষ বিতর্কিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। বিরোধী দলের জাতীয় সংসদ বর্জনের বিষয়ে রিপোর্টে বলা হয়, বিরোধীরা স্পিকার নিরপেক্ষ নয় বলে বারবার অভিযোগ করছে। তারা সংসদের স্থায়ী কমিটিগুলোর কার্যক্রমে বিভিন্নভাবে অংশ নিলেও সংসদ অধিবেশন নিয়মিত হচ্ছে না।
সরকারের দুর্নীতি : সরকারি কার্যক্রমের অনিয়ম-দুর্নীতি বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার রিপোর্টে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দুর্নীতিবিরোধী আইন ও বিধিবিধান থাকলেও সরকার তার যথাযথ প্রয়োগ করে না। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে দুর্নীতি করলেও শাস্তি হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ‘দন্তহীন বাঘ’ আখ্যা দিয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেসব মামলা হয়েছিল কোনো আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নির্বাহী আদেশের বলে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে। অথচ খালেদা জিয়া কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা খুব কম মামলাই প্রত্যাহার করা হয়েছে।
গণমাধ্যম : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে সরকার। এক্ষেত্রে সেলফ সেন্সর চলছেই। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হয়রানি করছে সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের আক্রমণ অব্যাহত আছে। সরকারি দলের লোকজন সাংবাদিকদের ওপর হামলা করছে তাদের নামে মামলা দিচ্ছে। যেসব সাংবাদিক সরকারের সমালোচনা করে তাদের সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী হয়রানি করে থাকে। সংবিধানের সমালোচনা করলে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে গণ্য করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও বড় একটি সমস্যা। শ্রমিকদের অধিকার সীমিত করা, শিশু শ্রমসহ কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব রয়েই গেছে।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads