শুক্রবার, ১১ মে, ২০১২

ভোল পাল্টাচ্ছে প্রশাসন



অনেক মন্ত্রী এমপির ফোন 
ধরেন না কর্মকর্তারা 
থমকে যাচ্ছে উন্নয়ন


সরকারের প্রভাবশালী এক প্রতিমন্ত্রী কিছুদিন আগে টেলিফোন করেন ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকার এক সহকারী কমিশনার, ভূমি (এসি ল্যান্ড)-কে। নিজ নির্বাচনী এলাকার এক কর্মীর জমি রেজিস্ট্রি-সংক্রান্ত কাজ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান তিনি ফোনে। জবাবে এসি ল্যান্ড বলেন, 'স্যার, আগেও আপনার অনেক কাজ করেছি। এটা কয়েক মাস পরে করি।' এ ঘটনার ঠিক দুই দিন আগে আরেক প্রভাবশালী এমপি রাজধানীর মাঠপর্যায়ের এক পুলিশ কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে তার পার্টনারের গাড়ি রিকুইজিশন না করার অনুরোধ করেন। জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা এমপিকে বলেন, 'স্যার, আপনি গাড়ি রিকুইজিশন করতে বাধা দিচ্ছেন। এই গাড়ি আপনাদেরই সরকারের কাজে ব্যবহার করতে নিচ্ছি।' গাড়িটি শেষ পর্যন্ত রিকুইজিশন না করলেও পুলিশ কর্মকর্তার গলার টোন ছিল নেতিবাচক।এভাবেই সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-এমপিদের থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। সরকারের মেয়াদ পূরণের আরও দেড় বছর বাকি। কিন্তু এর আগেই সরকারি কর্মকর্তাদের কথাবার্তা বদলে যেতে শুরু করেছে। দলীয় চিন্তায় ঢেলে সাজানো প্রশাসন পদে পদে অসহযোগিতায় পড়ছে। আগামী ছয় মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এ ব্যাপারে এখনই সতর্ক অবস্থানের সুপারিশও পাঠানো হয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে। কারণ সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে এলে বঞ্চিত ও হতাশ কর্মকর্তারা অসহযোগিতা শুরু করে থাকেন। এবারের ধরন অনেকটা ভিন্ন। বঞ্চিতরা এখনো চুপচাপ। তারা পরিস্থিতি দেখছেন। কিন্তু সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে যারা পদোন্নতি (প্রাইজ পোস্টিং) পেয়েছেন, তারাই এখন সুর বদলাতে শুরু করেছেন। তাদের এ তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আগামী ডিসেম্বরের পর সরকার বিপাকে পড়তে পারে।জানা গেছে, এখন সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে উন্নয়ন কাজে। সরকারের বিভিন্ন দফতরে মন্ত্রী-এমপিদের শত শত ডিও লেটার পড়ে আছে, কিন্তু কেউ খুলেও দেখছেন না। এমনকি প্রভাবশালী মন্ত্রীর কর্মকর্তারাও ঠিকমতো মন্ত্রীর নির্দেশ মেনে চলছেন না। নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে মন্ত্রী-এমপিদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। অসহায়ের মতো শুধু মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রণালয়ে ঘুরছেন অনেক এমপি। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত একজন এমপি জানান, উন্নয়নের জন্য এলজিইডিতে শত শত ডিও লেটার দিয়েছেন। কোনো কাজ হয় না। উন্নয়ন খাতের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের চিত্র বেহাল। সড়ক, জনপথ, শিক্ষা বিভাগ উন্নয়নের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের কাজ করে। বাকি সব এলাকাই উন্নয়নবঞ্চিত। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে, এখন অনেক কর্মকর্তা সরকারি দলের এমপিদের ফোন ধরেন না। এ ক্ষেত্রে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন এগিয়ে।সরকারেরই এক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী আক্ষেপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে সরকারের দলীয়করণ আর অধিক দলীয়করণ কোনো কাজে আসে না। দলবাজ কর্মকর্তারা দলবাজি ছাড়া কোনো কাজই ঠিকমতো করেন না। সরকারদলীয় আরেক নেতা বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগেই প্রশাসনের কাছ থেকে এ ধরনের অসহযোগিতা অস্বাভাবিক। এখন তো সড়ক, জনপথ ও স্থানীয় সরকারের মতো বিভাগেও ডিও লেটার পাঠিয়ে ঘুরতে হচ্ছে। তিনি বলেন, এমনটা সাধারণত মেয়াদ শেষের ছয় মাস আগে প্রশাসনে দেখা যায়।সচিবালয় ঘুরে দেখা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে প্রায়ই কয়েকজন করে এমপি গিয়ে বসে থাকেন। তারা অনেক সময়ই সচিব-মর্যাদার কর্মকর্তার দেখাও পান না। জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে গল্প করেই ফিরে আসতে হয়। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা উত্তরাঞ্চলের এক এমপি বলেন, কর্মকর্তারা সরকারের অর্থ সংকটের কথা বলেই চলেছেন। সব সংকট যেন জনগণের জন্য নেওয়া প্রকল্প বাস্তবায়নেই।

সচিবালয় সূত্রগুলো জানায়, মহাজোট সরকারের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার নিয়ন্ত্রণে ছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। তিনি এখনো দায়িত্বে থাকলেও সব কিছু আগের মতো তার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই। অতিমাত্রায় দলবাজির কবলে প্রশাসন গত তিন বছর জিম্মি ছিল। ফলে উচ্চপর্যায় থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত কোথাও যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা-সততার মূল্যায়ন ছিল না। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রচলিত কোনো কাঠামোই মানা হয়নি। আর দলবাজরা নিজেদের প্রয়োজনে বারবার নেতাও বদলাচ্ছেন। একবার পদ অর্জনের পর পুরনো মন্ত্রী-এমপিদের ফোনও ধরেন না অনেক কর্মকর্তা।সূত্রমতে, সরকারের মেয়াদের শেষের দিকে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের লোকজন নিরপেক্ষ হয়ে যান। তারা যেদিকে স্রোত সেদিকে চলতে থাকেন। এবার সাড়ে তিন বছরেই অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সম্প্রতি এ বিষয়ে তার নির্বাচনী এলাকায় এক অনুষ্ঠানে নিজের আক্ষেপ প্রকাশ করেন। ফরিদপুরের শ্রমিক লীগের অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে 'কিছু মনে না করার' অনুরোধ জানিয়ে শ্রমমন্ত্রী বলেন, ধমক না দিলে ডিসি ও এসপিও কাজ করেন না। তাই কাজ আদায় করতে আমাকে ধমক দিতে হয়। এ ধমকে কোনো অন্যায় নেই। এ বিষয়ে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আসলে উপমহাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো অনুসরণ করেই সরকারি কর্মকর্তারা নিজেদের কাজের প্রতি আন্তরিক থাকেন না। সব সময় একটা জটিলতা লেগে থাকে। তবে সব কর্মকর্তাই রাজনৈতিক নেতাদের এড়িয়ে চলেন, এটা মানতে নারাজ শ্রমমন্ত্রী।নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সচিব বলেন, সব ক্ষেত্রেই সরকারি নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে কাজ করতে হয় কর্মকর্তাদের। জনপ্রতিনিধিরা যতটা সহজে তাদের হুকুম জারি করতে পারেন, ততটা সহজে সরকারি কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেন না। এ কারণে মাঝেমধ্যেই রাজনৈতিক নেতাদের রোষানলে পড়তে হয় তাদের। তবে সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হোক এটা কোনো মেধাবী কর্মকর্তা চান না। কিছু দলবাজ কর্মকর্তার জন্য সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনের ওপর এ দায়ভার এসে পড়ছে বলে মনে করেন তিনি। অবশ্য তরুণ এমপি গোলাম মওলা রনি কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার বিষয়টিকে বেশ ইতিবাচকভাবেই দেখেন। রনি মনে করেন, প্রশাসনের এই দূরে সরে যাওয়ার বিষয়টি একদমই স্বাভাবিক। অবশ্য এতে সরকারেরও সুবিধা আছে। প্রথম দুই বছরে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কর্মকর্তা অত্যুৎসাহী হয়ে কাজ করেন। কিন্তু পরে তাদের আসল রূপ বের হয়ে এলে সরকার প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারে। আসলে কোনো গণমুখী সরকার কখনোই দলবাজ কর্মকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে না।তবে রনির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন সরকারি দলের বেশির ভাগ এমপি। তাদের মতে, উন্নয়ন কাজে সরকারকে সহায়তা করাই প্রশাসনের মূল কাজ। কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে নিজেরা জড়িয়ে পড়ায় দলবাজ কর্মকর্তারা এখন সরকারকে অসহযোগিতা করছেন। সরকারের সঙ্গে প্রশাসনের দূরত্ব প্রতিদিনই বাড়ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এগুলো দেখার যেন কেউ নেই।সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের দূরত্ব সৃষ্টি হলে নিশ্চিতভাবেই সুশাসনে সমস্যা সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, সুশাসন হচ্ছে সেই ব্যবস্থা, যেখানে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে তার কাজ সম্পাদন করে থাকেন। কিন্তু প্রশাসনিক কাজে দলবাজি হলে একজন যোগ্য ব্যক্তির পরিবর্তে আরেকজন অদক্ষকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। আবার জনপ্রতিনিধিরা হলেন সরকারের চোখ। তাদের মাধ্যমেই জনগণের চাহিদা মোতাবেক কাজ করে সরকার। তাদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হলে ও চেইন অব কমান্ড না থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় সরকার আর রাষ্ট্রকেই।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads