বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৪

সীমান্তে হত্যাকান্ডের প্রতিকার হতে হবে


ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর হত্যা এবং নির্যাতন আগের মতোই চলছে। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে সাধারণ ভারতীয়রা। দৈনিক সংগ্রামের এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, গত ৬ এপ্রিলও বিএসএফ-এর সহযোগিতায় চারজন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতীয়রা। এদের মধ্যে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গৌড়নগর এলাকার মজুমদারবাড়ি গ্রামের লোকজন। একইদিন সিলেটের গোয়াইনঘাট সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়াদের গুলীতে প্রাণ হারিয়েছে আরো একজন বাংলাদেশী। তাদের সবাই গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য সীমান্তের কাছাকাছি নিজেদের জমিতে গিয়েছিল। গোয়াইনঘাটের দেলোয়ার হোসেন গিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া গরু খুঁজতে। কিন্তু তাদের সবাইকে ভারতীয়রা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। খবর শুধু এটুকুই নয়। বিএসএফ-এর মাধ্যমে লাশগুলো  ফেরত আনতে গেলে বিজিবিকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে ভারতীয়রা। এজন্য বিজিবিকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি পর্যন্ত যোগাড় করতে এবং বিএসএফ-এর কাছে তা পেশ করতে হয়েছে। তারপরও এখন না তখন করে বিজিবিকে বহুবার ঘুরিয়েছে বিএসএফ। লাশ হস্তান্তরের স্থান পরিবর্তন করেছে কয়েকবার। শেষ পর্যন্ত লাশ ফেরত দিয়েছে এমন একস্থানে যেখানে ফেরত দেয়ার কথা ছিল না। উল্লেখ্য, ভারতীয় নাগরিকদের ওপর দায় চাপানো হলেও বাস্তবে প্রতিটি হত্যাকা-ের অন্তরালে বিএসএফই রয়েছে। অপহরণের কর্মকা-ও প্রায় প্রতিদিনই চালাচ্ছে এর জওয়ানরা। ভারতের এই ঘাতক বাহিনীর হত্যা-নির্যাতন ও অপহরণ অবশ্য মোটেও নতুন খবর নয়। কারণ, বিএসএফ-এর সন্ত্রাসী সৈনিকরা স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের নিয়মিতভাবে হত্যা করে আসছে। দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টটিতে পরিসংখ্যান উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, বিএসএফ-এর গুলীতে ২০১২ সালে ৩৬ জন নিহত এবং ৯৮ জন বাংলাদেশী আহত হয়েছে। ওই বছরে অপহরণ করা হয়েছে ৬৪ জনকে। ২০১৩ সালে ৩৮ জন নিহত এবং ৮৩ জন আহত হয়েছে। অপহরণ করা হয়েছে ২১৫ জন বাংলাদেশীকে। এ সময় পর্যন্ত অপহরণ করা ১২৯ জন বাংলাদেশীর কোনো খোঁজই এখনো পাওয়া যায়নি। এভাবে ২০০০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১১০০ বাংলদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। চাষাবাদ করার বা গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ানোর মতো কোনো জরুরি প্রয়োজনে সীমান্তের কাছাকাছি নিজেদের জমিতে গেলেও বাংলাদেশীরা বিএসএফ-এর গুলীর শিকার হচ্ছে। বিজিবি ও বিএসএফ-এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ২২২০টি পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সব জেনে-শুনেও ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানানো দূরে থাকুক, প্রায় সব হত্যাকা-ের ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ সরকার এমনকি জনগণকেও সঠিক খবর জানতে দিচ্ছে না। এ অবস্থারই সুযোগ নিচ্ছে বিএসএফ। এর সন্ত্রাসী সৈনিকরা শুধু মানুষই হত্যা করছে না, কুড়িগ্রামের কিশোরী ফেলানীর মতো কাউকে কাউকে হত্যার পর কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখার দুঃসাহসও দেখাচ্ছে। পেছনে ভারত সরকারের প্রশ্রয় রয়েছে বলে কখনো কখনো ঘটনাক্রমিক দুঃখ প্রকাশ করা হলেও বিএসএফ-এর গুলী ও হত্যা একেবারে বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকার বরং বিডিআর-এর বিলুপ্তি ঘটানোর মধ্য দিয়ে বিএসএফ-এর হত্যাকা-কে প্রশ্রয় দিয়েছে। এই সুযোগে ভারতের সাধারণ ভারতীয়রা পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ার এবং বাংলাদেশীদের ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযান শুরু করেছে। স্মরণ করা দরকার, বিডিআর থাকাকালে সাধারণ ভারতীয়দের প্রশ্ন ওঠে না, বিএসএফও এত বেশি দুঃসাহস দেখাতো না। কারণ, মাঝে-মধ্যেই সমুচিত জবাব দেয়ায় বিডিআরকে বিএসএফ বাঘের মতো ভয় করতো। একই বিএসএফ বর্তমান বিজিবিকে গণনায়ই আনছে না, সামান্য পাত্তাও দিচ্ছে না।
এদিকে অসংখ্য নিরীহ বাংলাদেশীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলেও আওয়ামী লীগ সরকার কিছুই বলছে না। এই ‘উদারতা’র কারণ নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোর দরকার পড়ে না। ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ সম্মান বাঁচানো এবং স্বার্থ হাসিল করে দেয়াই সরকারের উদ্দেশ্য। না হলে সরকার অবশ্যই প্রতিটি হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হতো। কূটনৈতিক পন্থায় প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি বিষয়টিকে সরকার জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নিয়ে উপস্থাপন করতো। হত্যা বন্ধের ও ন্যায়বিচারের দাবি জানাতো। কারণ, কোনো দেশের নাগরিক অন্য কোনো দেশে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে বিপন্ন বা নিহত হলে সে দেশের সরকার সাধারণত কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে থাকে। ক্ষতিপূরণও আদায় করে। অন্যদিকে ‘বন্ধুরাষ্ট্রের’ স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার জন্য আমাদের সরকার সবকিছু নীরবে হজম করে চলেছে। যেন বাংলাদেশীদের জীবনের কোনো দাম নেই! যেন এদেশের মানুষ নিতান্ত তুচ্ছ কোনো জন্তু বা প্রাণী! আমাদের আপত্তির কারণ হলো, ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দিল্লী সফরে গিয়ে সীমান্ত সমস্যাসহ সকল বিষয়ে ‘১০০ ভাগ সাফল্য’ অর্জন করে আসার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সফলতার সূত্র ধরে সীমান্ত বিষয়ক যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বিভিন্ন বৈঠকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশীদের ওপর বিএসএফ ‘আর একটিও গুলী’ চালাবে না। অন্যদিকে বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আমরা মনে করি, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই সরকারের উচিত সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যা বন্ধ ও প্রতিহত করার ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেয়া। এ উদ্দেশ্যে বিজিবি’র লোকবল ও মনোবল বাড়াতে হবে, বিজিবি’র জওয়ানদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিতে হবে। সীমান্তে একই সঙ্গে সেনাবাহিনীকেও মোতায়েন করা ও তৎপর রাখা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার সরকারি পর্যায়ে প্রতিবাদ জানানো। কারণ, এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে যে, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ভারতকে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ হিসেবে ‘মাথায় রাখার’ মতো লোকজনের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে বলেই বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চিন্তা পর্যন্ত করা হচ্ছে না। এমন নীতি ও মনোভাবের সুযোগই নিচ্ছে বিএসএফ। আমরা আশা করতে চাই, সরকার একটু নড়েচড়ে উঠবে এবং বিজিবি’র ও প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক পর্যায়েও ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে ভারত সম্মত না হলে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করতে হবে। আমরা চাই, আর যেন একজন বাংলাদেশীকেও বিএসএফ-এর গুলীতে প্রাণ হারাতে না হয়।  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads