বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৪

কলঙ্কিত উপজেলা নির্বাচন


এরশাদ-উত্তর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় গত ২৩ বছরের দাঁড় করানো নির্বাচন ব্যবস্থা কার্যত তছনছ হয়েছে এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। উৎসবের অনুষঙ্গ হয়ে উঠা নির্বাচনে এবার কেন্দ্র দখল, ব্যালটে গণহারে সিলমারা এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা অনেকটাই বিবর্ণ ছিল। এর সব দায়দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপর পড়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন ব্যবস্থা কলঙ্কিত করে ফেলেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার অধীনে স্থানীয় ও জাতীয় যে নির্বাচন হয়েছে অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠ হয়েছে বলে দাবি করা হতো। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনের পর তাদের গর্ব চুর্ণ হয়ে গেছে। এদিকে বিএনপির সমর্থিত বিজয়ী প্রার্থীদের শপথ নেয়া থেকে বিরত রাখতে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ করা হয়েছে। এভাবে সরকার বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ নির্বাচনে বিপুল ক্ষমতা থাকলেও নির্বাচন কমিশন নিষ্ক্রিয় থাকে। অনিয়ম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা প্রশাসন অনিয়মকে সহযোগিতা দেয়ায় সর্বশেষ তিন পর্বে নির্বাচনী অপকর্ম সীমা অতিক্রম করে। অনেক উপজেলায় ভোট শুরুর আগেই সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয় প্রশাসনের সহায়তায়। আর বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে মামলা দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়। এমনকি সাতক্ষীরার কলারোয়ায় বিরোধীদলীয় ভোটাদেরকে ভোটের আগের দিন বলা হয় ভোটকেন্দ্রে গেলে হাত কেটে নেয়া হবে। এবার পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত ৪৫৯টি উপজেলার মধ্যে পাঁচটির ফলাফল স্থগিত করা হয়। বাকি ৪৫৪টি উপজেলার মধ্যে ২২১টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ও ১৫৩টিতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী ৩৬ জন, জাতীয় পার্টি তিনজন ও অন্যান্য ৪১ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। অভিজ্ঞমহলের অভিমত, অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে হয়তবা আওয়ামী লীগ ৫০টির বেশি উপজেলায় নির্বাচিত হতে পারতো না। প্রথম দুই দফায় ১৯ দলীয় জোট ভাল ফলাফল করলে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম দফা নির্বাচনে পেশীশক্তি ব্যবহার করে প্রশাসনের সহায়তায় বিজয়ের কলঙ্কিত মুকুট পরেছেন আওয়ামী লীগ। পাঁচ ধাপে নির্বাচনে ১০ জন নিহত হয়েছে। আগে যারা বলতো আওয়ামী লীগের অধীনে ৫ হাজার নির্বাচন হয়েছে। আর তা অবাধ নিরপেক্ষ হয়েছে। সে নির্বাচন নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি। এখন তারা মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। জালভোট পড়েছে বিনা বাধায়। ক্ষমতাসীনদের মারমুখী অবস্থান, ভোটকেন্দ্র জবরদখল, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টদের বের করে জাল ভোটদান এবং ভোট কেন্দ্রের ভোটের আগে বাক্স ভর্তি করে রাখা রিরোধী দলের ওপর হামলা করা নজিরবিহীন ঘটনা। পঞ্চম ধাপে উপজেলা নির্বাচনে ব্যালট পেপারে সিল মারার মহোৎসব দেশের ভোটারদের হতাশ করেছে। ভোটকেন্দ্র দখল, ভোট জালিয়াতি, বিরোধীদের ওপর হামলা এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে ৭৩টি উপজেলার মধ্যে ২৩টি উপজেলায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা। বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে এসেছে নির্বাচন কমিশনের এরূপ মন্তব্যে প্রশ্নবিদ্ধ নিরপেক্ষতা সমালোচনার মুখে পড়েছে এ নির্বাচন। দেশে-বিদেশে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। ভারপ্রাপ্ত ইসির প্রতি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছে। এই ইসিকে আর কেউ দেখতে চায় না। এই ইসি যত তাড়াতাড়ি পদত্যাগ করবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল হবে অনেকে মন্তব্য করেছেন। নির্বাচন কমিশন আওয়ামী লীগের দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। আমাদের সোনার বাংলাকে বিশ্বের দরবারে কলঙ্কিত করেছেন। মন্ত্রী, এমপি, ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। পুলিশ নিজেই ভোটারদের ভোটকেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ৫ জানুয়ারি ভোট দেননি এখন কেন ভোট দিতে এসেছেন, একথা বলে গ্রেফতার করা হয়। পঞ্চম পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচনে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কিং গ্রুপ এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করা হয়। তারা বলেছেন, পঞ্চম পর্যায়ে উপজেলা নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির হার ৫৩ শতাংশ। এছাড়া ৫০ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা হয়েছে। ৭৬ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে ভোটারকে ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে। ২০ শতাংশ ভোটারকে ভোট দিতে বাধা প্রদান করা হয়েছে। ৫৯ শতাংশ এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ৩৮ শতাংশ পর্যবেক্ষককে গণনা পর্যবেক্ষণ করতে দেয়া হয়নি। পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে ৪০টি উপজেলা দখল, অনিয়ম, জালভোট প্রদানও সংঘর্ষ ঘটেছে। ৪০টি উপজেলায় অন্তত ২০০০ কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংঘর্ষ ঘটেছে দুই শতাধিক কেন্দ্রে। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর সদরে ১৫টি ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়েছে। ওই উপজেলার ১৫৯ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। রায়পুরে সংঘর্ষ হয়েছে ২৫টি কেন্দ্রে। অনিয়ম হয়েছে সাতক্ষীরা সদরের প্রতিটি কেন্দ্রে। ভোট দিতে গেলে হাতে কালি মাখিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। আর ভোটারদের বলা হয়েছে, তোমাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে। রামগতিতে সংঘর্ষ হয়েছে ১০টি ভোটকেন্দ্রে। অনিয়ম হয়েছে ৫১টি কেন্দ্রে। একই অবস্থা রামগঞ্জে। সেখানে সংঘর্ষ হয়েছে ২৫টি কেন্দ্রে। ফেনীর ছাগলনাইন উপজেলায় সংঘর্ষ হয়েছে ২৮ কেন্দ্রে। অনিয়ম ঘটেছে ৩৯ কেন্দ্রে। রাজবাড়ীর ৩৫ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। এসব কেন্দ্রে সরকারি লোকদের বিরুদ্ধে জালভোট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। নরসিংদীর তিনটি উপজেলায় অনিয়মের অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা। সদর উপজেলায় ১৩টি ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়েছে। সংঘর্ষ হয়েছে আরও ১২ কেন্দ্রে। রায়পুরায় অনিয়ম হয়েছে ১৬ কেন্দ্রে। নারায়ণগঞ্জের তিনটি উপজেলায় অনিয়ম-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সোনারগাঁয়ের ৫টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করা হয়। ওই উপজেলায় পাঁচটি কেন্দ্রে সংঘর্ষ ও ১৯টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। আড়াইহাজারের ১৭টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে ভোটকেন্দ্র দখল নিয়ে পাঁচটি কেন্দ্রে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে ১৬টি কেন্দ্রে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুরে অনিয়ম হয়েছে ৩১টি কেন্দ্রে। ওই জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় ৪০টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের সকল প্রায় কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। ওই উপজেলার ৭৪টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। লৌহজংয়ের ৪৫টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। সিরাজদিখানে ৭৩টি কেন্দ্রের ৬০টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। এর মধ্যে সুবর্ণচরে একটি কেন্দ্রে সংঘর্ষ হয়েছে। অনিয়ম হয়েছে ৩৯টি কেন্দ্রে। একইভাবে হাতিয়ায় ৪১টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে সংঘর্ষ হয়েছে দু’টি কেন্দ্রে। অনিয়ম হয়েছে ৪২টি কেন্দ্রে। চান্দিনায় সংঘর্ষ হয়েছে দু’টি কেন্দ্রে ও অনিয়ম হয়েছে ৩৮টি কেন্দ্রে। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলায় ৫১টি কেন্দ্রের মধ্যে ৪১টি কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও বেলকুচি উপজেলায় সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা জালভোট প্রদান করেছে। মারপিট করে কেন্দ্র থেকে পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। প্রশাসনের নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্ব আচরণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শাহজাদপুর উপজেলায় ৮টি কেন্দ্রে জালভোট ও অপ্রাপ্ত বয়স্কদের ভোট দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাতক্ষীরা জেলার সবকটি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজশাহীর পবা উপজেলার ৫টি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলায় সন্ধানপুর, ধলাপাড়া, রসুলপুর, ও দেয়াড়া ইউনিয়নের ৩৫টি কেন্দ্রে ভোটের আগের রাতে ব্যালট কেটে বাক্স বোঝাই করে দেয়া হয়। এ উপজেলার ৪০টি কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। পাবনা সদরের প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে আইনশৃংখলা সদস্যদের সহযোগিতায় জালভোটের মহাৎসব চলে। এছাড়া বেড়া উপজেলার ৬৬টি কেন্দ্রের সবকটি কেন্দ্রে সরকারি দলের সদস্যরা জাল ভোট দেয়। কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ২৫টি মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় মহড়া দেন। এ সময় সরকার সমর্থিত প্রার্থী শহিদুল কাদের জেমস-এর পক্ষে নেতা-কর্মীরা ৪৩টি কেন্দ্রের ৪৫টি কেন্দ্র দখল করে কাপ-পিরিচ মার্কায় ভোট দিয়ে বাক্স ভর্তি করে দেয়। ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের দ্বারা ব্যালট বাক্স বোঝাই করা হয়। এ অভিযোগে বিএনপি প্রার্থী মুশফিকুর রহমান নির্বাচন বর্জন করেন। সিলেটের বিয়ানীবাজারে ১৩টি কেন্দ্রে ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কসবা উপজেলা দখলের মাধ্যমে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের অবাধে ভোট দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। কসবায় মিনিটে ১১টি ভোট পড়েছে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ১০১টি কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। রূপগঞ্জে সবকটি কেন্দ্রে সরকার সমর্থকরা বিরোধী দলের এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। এমনকি পোলিং এজেন্টদেরকে পর্যন্ত বের করে দেয়া হয়েছে। এরপর অবাধে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স বোঝাই করে দেয়।
এ নির্বাচনের পর বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আরও জোরদার হয়েছে। বিএনপি আবার খুব শীঘ্রই লাগাতর আন্দোলনের ডাক দিতে পারে। আর আন্দোলনের ডাক দিলে লাখ লাখ লোক এ আন্দোলনে শরীক হতে পারে বলে অভিজ্ঞমহল অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এতে সরকারের মসনদ খান খান হয়ে যেতে পারে। এদিকে বিগত ২৩ বছরে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। সিল মেরে বাক্স ভরার সংস্কৃতি ভুলতে বসেছিল। আর এ নির্বাচনে ওইসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, ৫ জানুয়ারির পর সরকারের একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়ার সুযোগ ছিল। সে সুযোগ তারা নষ্ট করেছে। মনে হচ্ছে আমরা আশির দশকে ফিরে এলাম। এরশাদ পতনের পর যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল আমরা তা হেলায় হারালাম। তিনি এজন্য নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে দায়ী করেন।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads