বুধবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৪

তারেক জিয়ার তথ্য ও বাগি তর্কের হারজিত


জেদ, হিংসা-বিদ্বেষ ক্ষমতার রাজনীতির নিত্যসঙ্গী। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চর্চা নিত্যকার ঘটনা। এর ভেতরও পরিমিতিবোধ থাকা বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন পুরনো অভিজ্ঞতা। দুর্নীতি মহোৎসব যেন রাজনীতিরই অংশ। অসহিষ্ণুতা রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। এবার গ্রাস করল সহিষ্ণুতার শেষ মাত্রাটাও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইট-পাটকেল ছোড়ার নজির আছে। তুই তোকারি করে সম্বোধন করার নজির নেই। এবার তারেক জিয়ার দিকে তর্জনী উঁচিয়ে সেই নজিরও স্থাপন করলেন এক জাঁদরেল আওয়ামী লীগ নেতা।

এত দিন ধরে জিয়ার মুণ্ডপাত করে জাত-পাত ও কুষ্টিনামা উদ্ধার করে কিছু পতিত বামপন্থী ও আওয়ামী লীগ নেতা পুলক অনুভব করতেন। খেলতেন আক্রমণভাগে। এবার বেগম জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান আওয়ামী লীগকে রক্ষণভাগে ঠেলে দিলো। এতে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগার মতো আচরণ করছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। খেলছেন রক্ষণভাগে থেকে। অবৈধ বলছেন বিএনপিকেও। বিএনপি এবার হয়তো বলবে বাকশাল এসে আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করেছে। পুনঃপ্রাণ দিয়েছেন জিয়া। এই আরোপিত খেলা না উপভাগ্য, না প্রত্যাশিত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্ক করার মতো অনেক ফাঁকফোকর আছে। কেউ বিনা তর্কে একপক্ষকে মেনে নিলে এক বিষয়, না মেনে নিলে সেই বিতর্ক কোনো দিন শেষ হবে না। ওয়াকথু বলে বাদও দেয়া যাবে না। এর জন্য এ প্রজন্মকে দায়ী করে লাভ নেই। অপরাধ বলি, আর দোষের কথাই ধরি, সবটুকুর জন্য দায়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমরা। তৎকালীন নেতৃবৃন্দ। সংগঠকেরা। বুদ্ধিজীবীরা এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক লেখকসমাজ। নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার ষোলো আনা দায় আমাদের। কারণ সময়মতো বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন নির্মোহ সত্য ইতিহাস আমরা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি।

রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠবার প্রাক্কালে সব বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব ছিল। যুদ্ধোত্তর সরকার এ দিকটায় আদৌ নজর দেয়নি। শহীদদের একটা তালিকা প্রণয়নেও সরকার আগ্রহ দেখায়নি। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় ইতিহাস রচনা ও গ্রন্থনার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। দলীয় মর্জির ইতিহাসে সব বাস্তবতা ও প্রকৃত তথ্য সত্যটাই ঠাঁই পায়নি। এই সত্যটি যারা মানবেন না তারা সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে রচিত ইতিহাসকে এড়িয়ে যাবেন।

নতুন জাতিসত্তা বিনির্মাণ ও জাতি রাষ্ট্রের  জন্মের পর কাক্সিক্ষত গণপ্রত্যাশার ভিত্তিতে সংবিধান রচিত না হওয়াটাও অনেক শূন্যতা ও ভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে। ফলে তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণিত দলিল মনে করে সংরক্ষণ করা হয়নি। এখন অন্ধের হাতি দেখিয়ে লাভ নেই। তারেক রহমানকে দুষেও মুক্তি নেই।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ দিবাগত রাত পর্যন্ত ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা চেয়েছেন। তিনি এক দিনের জন্য হলেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রত্যাশার কথা অনেকের কাছে গোপন করেননি। রাজনৈতিক সমঝোতা, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর সঙ্কট সমাধানের চেষ্টা করা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির জন্য ছিল যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়া ক্ষমতার লালসার বিষয় ছিল না। এটা ছিল সত্তরের নির্বাচনে প্রাপ্ত ম্যান্ডেটের আলোকে তার অধিকার। আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচন করেছে ইয়াহিয়ার বিধি মেনে এবং বঙ্গবন্ধু এই সত্যটি আড়াল করা শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও সঠিক মনে করেননি।

পঁচিশের কালরাতের পর পুরো প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়ে যায়। যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবক দেন তারা অতীতের বৃন্তচ্যুত আসমান থেকে নাজিল হওয়া কল্পকাহিনী শোনান। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকেন, ২৫ মার্চ রাতের গল্প শোনাতে চান কেন! আবার ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস আপনারাই তো নির্ধারণ করলেন। মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, সত্তরের নির্বাচন, সমঝোতার চেষ্টা- কোনো কিছুই মিথ এবং মিথোলোজির বিষয় নয়, ইতিহাস। এই ইতিহাসে পুকুর চুরির কোনো সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগ নেতারা বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রশস্ত জায়গা খুঁজতে গিয়ে জিয়া, ওসমানী, ভাসানীসহ সবাইকে ছোট করে দেখতে চেয়েছেন। নিজেদের দলীয় ভাবনা থেকে একটা অর্ধ সত্য ও মনগড়া ইতিহাস বলতে চেয়েছেন। ভ্রান্তি থেকে বিরোধ, সব সমস্যার শুরু এখান থেকেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, ঘোষক ও সময় বিতর্ক থেকে গেছে। একইভাবে আত্মসমর্পণ, যুদ্ধ পরিচালনা, ভারতের অবস্থান, বিভিন্ন উপবাহিনী, শহীদ সংখ্যা, যুদ্ধাপরাধী ইস্যু, দালাল প্রসঙ্গ, সরকার গঠনপ্রক্রিয়া, যুদ্ধোত্তর সরকার গঠন, সংসদীয় পথে যাত্রা, আবার প্রেসিডেন্সিয়াল ধারায় চলে যাওয়া ও সংবিধান রচনা সব কিছুতেই বিতর্ক ও কুতর্ক করার জায়গা থেকে গেছে। বিয়াল্লিশ বছর পর বিতর্কগুলো যখন ঘুরেফিরে আসছে তখন আমাদের কাছে সুখকর মনে না হলেও এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। কারণ একটি উদ্দেশ্যমূলক পেন্ডোরার বাক্স খুলেছে আওয়ামী লীগ নেতারা। যত অসহ্য লাগুক এখন অপ্রিয় অনেক সত্য এসে সামনে দাঁড়াবে। মামলার ভয় দেখিয়ে, হামলা চালিয়ে, টুঁটি চেপে ধরে এবং তুই তোকারি করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে না। তথ্যকে তথ্য দিয়ে, সত্যকে সত্য দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। রাজনীতিকে মোকাবেলা করতে হবে রাজনীতি দিয়ে।

আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও মুক্তি আন্দোলনের পথপরিক্রমায় সেই তুলনায় বিতর্ক কম। যদিও ভাষা আন্দোলন আর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়েও আমরা উপসংহার টানিনি। সেই ইতিহাসও হাইজ্যাক করার চেষ্টায় অন্ত নেই। এই আন্দোলনের কৃতিত্ব নেয়ার বেলায় এসে দাবিদার সেজেছে অসংখ্য মানুষ। এখনো কত শত ভুয়া ভাষাসৈনিকের দাবিদার রয়েছেন তার কোনো সংখ্যা নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সনদের মতো এক আজগুবি ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ৯ মাস। আন্দোলন হয়েছে ৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রায় বাইশ বছর। যুদ্ধের সময় জন্ম নেয়নি সেও মুক্তিযোদ্ধা। চাকরিতে দুই বছর বাড়তি সুযোগের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সনদ মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হলো। যুদ্ধ দেখেনি সেও যোদ্ধা। তা ছাড়া রাজনৈতিক ঠমক দেখানোর জন্য শুরু হয়েছে সম্মাননা ও ক্রেস্টবাণিজ্য, তাতে আবার তেরো আনাই ফাঁকি। আর এসব অপকর্মের সব ঠিকাদারি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা যা বলতে চায় তাই মেনে নিলে বিপত্তি নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও কমতি হয় না। একটু জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে বললেই স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ, দেশদ্রোহী, রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী অভিযোগ খাড়া করা হয়। খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া যেসব বিষয়-আসয় নিয়ে কথা বলেছেন তা এখন আর রাজনীতির বিষয় নেই। এগুলো এখন ইতিহাস অš¦ষা ও গবেষণার বিষয়। গবেষণার টেবিলে এসব আলোচনা-সমালোচনা সব সিদ্ধ। যুক্তি ও তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সব আলোচনা করা যায়। তারা হয়তো অসহ্য হয়ে এত দিন ধরে আওয়ামী লীগ নেতাদের গালিগালাজ, জিয়াকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, মীরজাফর বলা, পাকিস্তানি এজেন্ট মন্তব্য করা, মুক্তিযুদ্ধ না করার মতো হাস্যকর বক্তব্য দেয়া, অখ্যাত মেজর বলা, বেগম জিয়াকে পাকিস্তান চলে যাওয়ার নসিহত করা, তারেককে নিয়ে নানা ধরনের অশোভন মন্তব্য করার মোকাবেলায় কিছু ঋজু ভাষায় মন্তব্য করে পুরো ইটের মোকাবেলায় পাটকেলটা ছুড়তে চেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সবসময় আশা করে তারা বলবে বাকিরা শুনবে। নয়তো চোখ বুঝে থাকবে। এটা বোধ করি আর সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ষাট থেকে সত্তর ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে দ্বিমত পোষণ করে। আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিমত পোষণ করা আর বঙ্গবন্ধুকে সম্মানের জায়গায় রাখা এক বিষয় নয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনীতি ও বঙ্গবন্ধু এক বিষয়ও নয়। তা ছাড়া  এত মানুষ নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব হয়। সাময়িক মুখ, হাত ও কলম বন্ধ করে রাখা সম্ভব হলেও কিছু সত্য নিজস্ব গুণেই সামনে এসে দাঁড়াবে। সত্যের নিজস্ব শক্তি বলে সত্যকে আগলে রাখবে। তার পরও খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের জায়গায় বসে এসব জবাবি বক্তব্য কতটা মানানসই সে প্রশ্ন করা যায়। আওয়ামী লীগ বললেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস হয়ে যাবে না। বিএনপি বললেও, সেটা অকাট্য হবে না। ইতিহাস বড় নির্মম ও নির্মোহ। যার যা প্রাপ্য তা পাইয়ে দেবে। ক্ষমতার জোরে সাময়িকভাবে দলীয় রাজনীতির ধারায় ইতিহাস রচনা করা যায়, পাঠ্যসূচিতে কত কী ঢুকানো যায়, বিকৃত করা যায়, অন্যকে চাপা দিয়ে নিজের গৌরব প্রচার করা যায়। তাই বলে আসল সত্য স্থায়ীভাবে আড়ালে চলে যায় না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তব্য খণ্ডন করতে হলে টেবিলে বসে ইতিহাস সত্যের দলিল-দস্তাবেজ সামনে রেখে কথা বলতে হবে। তাদের মূর্খ, অর্বাচীন, হানাদার বাহিনীর দোসর দেশদ্রোহী বলে কোনো লাভ হবে না। তুই তোকারি করে একদলীয় সংসদে চিৎকার করে গলা ফাটালে, আর চোখ টাটালে মানুষ আমলে নেবে না। মিডিয়াকে দুষেও লাভ নেই। এই যুগেও বাংলাদেশের সব মিডিয়া মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেও তথ্যপ্রবাহ বন্ধ করা সম্ভব নয়। মিডিয়ার ওপর আরো খবরদারি মানুষ ভিন্নভাবে পুষিয়ে নিতে উৎসাহী হয়ে উঠবে। তখন নিষিদ্ধের প্রতি মানবিক নেশা আরো বেড়ে যাবে।

যেসব তরুণ ডিজুইস জোয়ারে ভাসছে তাদের জন্য দুপক্ষেরই বক্তব্য অপ্রাসঙ্গিক। যারা ভাবছে, নিজেদের শিকড়টা খুঁজতে চাইছে, ইতিহাসের প্রকৃত সত্যটা জানতে চাচ্ছে- তাদের সত্যিটা বলুন। সত্যের শক্তিটা এতটাই অপ্রতিরোধ্য মিথ্যার সব জঞ্জাল ভেসে যায়। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না।

আমাদের সময়কার প্রজন্ম ও সিনিয়ররা মুক্তিযুদ্ধ করে কৃতিত্ব দাবি করেননি। সব কৃতিত্ব হাতিয়ে নিতে চেয়েছে রাজনীতিবিদেরা। ক্ষমতার জন্য তারা এই গৌরব সৌরভকে পদদলিত করেছে। অপব্যবহার করেছে। জাতিকে বিভক্ত করতে ইস্যু খাড়া করেছে। ভারতীয় আধিপত্যকে জায়েজ করতে ঢাল বানিয়েছে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ও ভিন্নমতকে নির্মূল করতে অস্ত্র শাণিয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা, দলকানা বুদ্ধিজীবী, কথিত সুশীল, পরান্নভোজী সাংস্কৃতিক কর্মীরা ইতিহাস শেখাতে গেলে ভুল করবেন। এখনো সময় আছে জাতিকে, নতুন প্রজন্মকে, আগ্রহী বিশ্ববাসীকে আসল সত্যটা জানান। তাতে বঙ্গবন্ধুর কোনো অমর্যাদা হবে না। ভাসানী, ওসমানী, জিয়া কেউ কারো সমান্তরাল দাঁড়াবেন না। যার যার প্রাপ্য ও অবস্থান ইতিহাসই ঠিক করে রেখেছে। আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু ও বিএনপির জিয়ার বাইরেও ইতিহাসের মহানায়ক-নায়ক ও খলনায়কেরা যার যার অবস্থানে যথাযথভাবেই আছেন। থাকবেনও। আইন ও মামলা করে কোনো জাতীয় নেতা হয় না। একই প্রক্রিয়ায় কাউকে জাতীয় নেতা বানানোও যায় না। আইন ও মামলা করে সমালোচনাও ঠেকানো যায় না। এ সত্যটি সবাইকে বুঝতে হবে। যারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন তাদের জন্য ততই মঙ্গল।

মাসুদ মজুমদার


 

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Ads